#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz
৭.
মেঝেতে কার্পেট ছিল বলে খুব একটা ব্যথা লাগেনি৷ এদিকে সামির হাত ঝেড়ে চলে যাচ্ছে। অরা ওঠার চেষ্টা করেও উঠতে পারল না। পেটের বামপাশটায় ভীষণ জ্বলুনি হচ্ছে। সেফটিপিন গেঁথে কে-টে গেছে নিশ্চয়ই!
ব্যথায় অরার চোখে পানি এসে গেছে। অন্ধকারে সে তেমন কিছু দেখছে না। বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গেছে। আইপিএস এ ঝামেলা হচ্ছে তাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো লাইট চলে আসবে। কিন্তু অরার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। সেফটিপিন খুলে যাওয়ার দরুণ তার লেহেঙ্গা কোমরের কাছ থেকে ঢিলে হয়ে গেছে। যদি উঠে দাঁড়ায় তাহলে পুরো লেহেঙ্গা খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হবে তখন। অরা মনে মনে দোয়া করতে লাগল যাতে লাইট এতো দ্রুত না আসে। ভারী লেহেঙ্গা নিয়ে উঠতেও পারছে না। পায়ে ব্যথা লাগছে। পা ভাঁজ করেও ওঠা যাচ্ছে না। শিরায় টান লাগছে!
সামির অরার অবস্থা দেখে আবার ফিরে এলো। হাঁটু গেঁড়ে তার সামনে বসল। ডান হাতটা বাড়িয়ে বলল,” আ’ম স্যরি, বেশি ব্যথা পেয়েছো? ওঠো।”
অরা উঠল না। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। সামির বলল,”বিপদে পড়লে অপমান গায়ে মাখতে হয় না।”
অরা জবাব দিল না, ফিরেও তাকাল না। সামিরের উপস্থিতি তার বিরক্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। লোকটা এখনও যায়নি কেন? সে গেলেও তো অরা কোনোভাবে উঠে বসার চেষ্টা করতে পারতো। এখন সামিরের সামনে উঠতে গেলে যদি লেহেঙ্গা সত্যি নিচে নেমে যায় তাহলে একটা কেলেংকারী হবে।
অরা উঠছিল না দেখে সামির অধৈর্য্য হয়ে তাকে একদম পাজাকোলায় তুলে নিল। অরা ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হওয়ারও সুযোগ পেল না। চোখমুখ খিঁচে আর্তনাদ করল।
যে জায়গায় সেফটিপিন গেঁথে গেছে সামিরের হাত ঠিক সেই জায়গাতেই। ব্যথায় অরার চোখমুখ কাঁপছে। চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু পড়ছে। তরল অনুভব হওয়ায় সামির একবার নিজের হাতটা দেখল। র-ক্তে আঙুল ভরে গেছে। সামিরের মাথা ঘুরে উঠল। র-ক্ত এলো কি করে? সে দিশেহারার মতো হয়ে গেল।এদিকে অরা কাঁদছেই। সামির চিন্তা করল কাউকে ডাকবে। তারপর কিছু একটা ভেবে অরাকে ফাঁকা রুমে নিয়ে এলো।
দরজা আটকে তাকে বিছানায় বসালো। বার কয়েক একনাগাড়ে বলল,” আম স্যরি, বুঝতে পারিনি বিশ্বাস করো। দেখি..”
সামির পেটের কাছে হাত নিতে গেলেই অরা আৎকে উঠল। দ্রুত সরে গেল। সামির বলল,” র-ক্ত বের হচ্ছে অরা। না দেখলে বুঝবো কি করে কি হয়েছে?”
অরা চোখমুখ বন্ধ করে কান্নার ঢোক গিলল। ভারী গলায় উচ্চারণ করল,” সেফটিপিন গেঁথে গেছে।”
” ওহহো! দেখতে দাও প্লিজ। কতটা কে-টেছে?”
সামির দেখতে গেলেই পুনরায় বাঁধা দিল অরা। লজ্জায় রীতিমতো নুইয়ে পড়ছে সে। সামির তার নিষেধের তোয়াক্কা করল না। পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে ফ্লাশলাইট জ্বেলে জোর করেই দেখল। ব্রঞ্জের ধারালো সুই গেঁথে একদম থেতলে গেছে শুভ্র,কোমল ত্বক।সামিরের বুক মোচড় দিয়ে উঠল। এইভাবে অরাকে ফেলে দেওয়া উচিৎ হয়নি।
সে অন্ধকারেই ড্রয়ার খুঁজে ফার্স্ট এইড বক্স বের করল। ভাগ্যিস বক্সটা এই ঘরেই ছিল। অন্যঘরে থাকলে অরাকে ফেলে যাওয়াও যেতো না। সামির দ্রুত স্যাভলন আর তুলা হাতে নিল। অনেকটাই কে-টে গেছে। ব্যান্ডেজ ছাড়া র-ক্ত বন্ধ হতে সময় লাগবে। সামির যখন তুলায় স্যাভলন লাগিয়ে কাছে এলো তখন অরা বাঁধ সেধে বলল,” আমাকে দিন। আমি করছি।”
” এতো লজ্জার কিছু নেই। অন্ধকারে আমি কিছু দেখবো না। তুমি শুধু ব্যথার জায়গাটা দেখিয়ে দাও।”
অরা অস্বস্তিতে মাথা নিচু করল। সামির তার মনের কথা বুঝে ফেলেছে। মাইন্ড রিডার নাকি? সামির কাছে এসে অরার ক্ষ-তস্থানে স্যাভলন মাখা তুলো ছোঁয়ালো। তীক্ষ্ণ জ্বলুনিতে শিউরে উঠল অরা। খাম-চে ধরল সামিরের কাঁধ। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিল।
সামির মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল। অরার খুব লজ্জা লাগছিল। কিন্তু কিছু করার নেই। ব্যথাও সহ্য হচ্ছে না। অরার লজ্জাকে পরিপূর্ণ করতেই এই অসময়ে জ্বলে উঠল লাইট। পুরো ঘর আলোকিত হয়ে গেল। অরা এমনভাবে কেঁপে উঠল যেন তার শরীরে কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সামির বলল,” রিল্যাক্স। এইতো আরেকটু। এখনি শেষ হয়ে যাবে।”
অরা লজ্জায় চোখই খুলল না। একরকম গাঁট হয়ে বসে রইল। শরীর শক্ত করে ফেলল। চিন্তা করতে লাগল অন্যকিছু। যাতে মন ডাইভার্ট করা যায়। নয়তো অস্বস্তিতে দম আটকে ম-রেই যাবে সে।
ফার্স্ট এইড ট্রিটমেন্ট শেষ করে অরার দিকে চাইতেই মুগ্ধ হলো সামির। কান্নার কারণে চোখমুখ লাল দেখাচ্ছে অরার। কাজল লেপ্টে আছে। চেহারায় লাজুক আভা। দেখতে ভীষণ আদুরে লাগছে। সামির হালকা স্বরে বলল,” শেষ। ”
অরা চোখ খুলে তাকালো। দ্রুত উঠতে নিয়েও বসে পড়ল। মনে পড়ে গেল লেহেঙ্গা ঢিলে হওয়ার কথা। সামির প্রশ্ন করল,” কি হয়েছে? আর কোনো প্রবলেম?”
অরা নিচু স্বরে বলল,” আপনি যান। আমি আসছি।”
এই বলে বিছানা থেকে সেফটিপিনের ব্রঞ্জটা নিল। সামির বলল,” এইটা দিয়ে কি করবে আবার?”
“লেহেঙ্গায় লাগাতে হবে।”
” আবার এটা লাগাবে? এইটার জন্যই তো কেটে গেছে। দাও আমার হাতে।”
অরা দিল না। এমনভাবে পেছনে নিয়ে লুকালো যেন এই জিনিস তার অমূল্য সম্পদ। সামির ভ্রু কুঁচকে বলল,” আমি তোমাকে কিছুতেই এটা লেহেঙ্গায় লাগাতে দিবো না।”
অরা পড়ে গেল মহা বিপদে। অথচ এইটা নিয়ে গেলে সে অসহায়। সামির সত্যি সত্যি ব্রঞ্জটা ছিনিয়ে নিল তার হাত থেকে। অরা অসহায় গলায় বলল,” এটা দিন প্লিজ। লেহেঙ্গায় লাগাতেই হবে। নয়তো…”
” নয়তো কি?”
অরা মাথা নিচু করে খুব দ্বিধায় আওড়াল,” লেহেঙ্গা ঢিলে হয়ে যাবে।”
” বেশি ঢিলে হবে? খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে নাকি?”
অরা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। সামীর দৃঢ়চিত্তে বলল,” তাও এটা দেওয়া যাবে না।”
অরা করুণ দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলল,” আচ্ছা দিতে পারি। কিন্তু শর্ত আছে।”
অরা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে চাইল৷ সামির কাছে এসে বলল,” চোখ বন্ধ করো।”
অরা চোখ বড় করে দুইপাশে মাথা নাড়ল।সামীর দায়সারা গলায় বলল,” ঠিকাছে। তাহলে এটাও পাচ্ছো না। এখন এই ঘর থেকে তুমি কিভাবে বের হবে সেটা তোমার ব্যাপার!”
অভিমানে চোখ লাল হয়ে গেল অরার। কিছুক্ষণ শান্ত থেকে রা-গ সামলে নিল। তারপর দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল,” ঠিকাছে।”
সে চোখ বন্ধ করল।সামির কড়া গলায় বলল,” খবরদার, আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।”
সে অনুভব করল সামির ড্রয়ারে কিছু একটা খুঁজছে। একটু পরেই তার কোমরের কা-টা অংশে হাত রাখল। এবার আগের চেয়েও শক্ত হয়ে বসল অরা। হঠাৎ সেখানে ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই তার সম্পূর্ণ শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। অজানা অনুভূতিতে চিনচিন করতে লাগল বুক। দুইহাতে সামিরকে ধা-ক্কা মে-রে সরিয়ে ক্ষীপ্ত গলায় বলল,” এটা কি করলেন আপনি?”
সামির মুচকি হেসে বলল,” বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে দ্রুত এসো।”
অরার চোখ দু’টো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে রাগে। সামির তার হাতে ব্রঞ্জ ধরিয়ে বের হয়ে গেল। সে চলে যেতেই রূপা ঢুকল ভেতরে। কপট রাগ নিয়ে বলল,” সমস্যা কি তোদের? দরজা আটকে ভেতরে কি করিস? সারা অনুষ্ঠান পড়ে আছে আর তোরা কি রাতের কাজ সন্ধ্যাতেই শুরু করে দিছিস নাকি?”
অরা কোনো জবাব দিল না। শরীর ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে সে এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। রূপা কাছে এসে তাকে ধরল। বিচলিত গলায় বলল,” অরা, কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
” না, শুধু একটু মাথা ঘুরছে।”
অরা খুব কষ্টে উঠল। তার কোমরের কাছটা এখনও অবশ হয়ে আছে।সে ব্রঞ্জ লাগানোর জন্য আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখল কোমরে লালরঙা জেলপেন দিয়ে ইংরেজিতে লেখা,” I luv u”
অরা লেখাটা দেখেই বিস্ময়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। রূপা চমকে উঠে বলল,” আবার কি হয়েছে?”
অরা দ্রুত জায়গাটা হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল। কাঁপা গলায় বলল,” কিছু না।”
চলবে