রুপালি মেঘের খামে পর্ব-০৬

0
788

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

৬.

অরার মনে হচ্ছে তার হাত-পা চেয়ারের সাথে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে বিন্দুমাত্র নড়াচড়ার জো পাচ্ছে না। অথচ সে মুক্ত। চাইলেই উঠতে পারে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার আদেশ মানছে না। সামনের মানুষটির চশমার আড়ালের ওই গভীর দৃষ্টিই তার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে প্রবলভাবে। অরার হাঁসফাঁস লাগছে।

সামির বলল,” এই বিয়েতে তোমার মত ছিল না, সত্যি?”

চেয়ারের দুই হাতলের উপর হাত রেখে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সে। অরা ধীরগতিতে মাথা নাড়ল।

” তাহলে এতোদিন বলোনি কেন?”

অরা নিচে তাকিয়ে স্তব্ধমূর্তির মতো থম মেরে গেছে। সামির উঁচ্চগলায় আবার বলল,” এতোদিন বলোনি কেন তুমি?”

অরা কেঁপে উঠে বলল,” বললেই বা কি হতো? কিছু তো বদলাতো না। আপনার উচিৎ ছিল বিয়ের আগেই আমার সাথে অন্তত একবার কথা বলা। আমি বিয়ে করতে চাই কি-না সেটা জিজ্ঞেস করা। কিন্তু আপনি কিছুই করেননি। আমিও বুঝতে পারিনি যে আপনার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে৷ তাহলে কখনও রাজি হতাম না।”

অরা থামল। এই অবস্থায় একসাথে এতোগুলো কথা সে কিভাবে বলে ফেলল তাও এক বিস্ময়।

সামির অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে , ভ্রু কুঁচকে। যেন কথাগুলো মানতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। কয়েক মুহূর্তে নিজেকে একটু সামলে নিয়েই বলল,” এবার কি চাও তুমি? ডিভোর্স? ”

অরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সামির শান্ত স্বরে বলল,” নির্দ্বিধায় বলতে পারো, ডিভোর্স চাও?”

” আমি জানি না। আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটু সময় দরকার।”

সামির বুকের মধ্যে বিদ্ধ নিঃশ্বাসটা ছাড়ল এবার। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,” বেশ, সময় দেওয়া হলো।”

সাবিরা চিন্তিত মুখে মেয়েকে খুঁজছেন। কোথায় চলে গেল মেয়েটা? বাড়ির পেছনের খোলা জায়গায় নীলিমা একটা বড় চেয়ারে বসে কালকের আয়োজনের তদারকি করছেন। সাবিরাও তার পাশে এসে বসলেন।

” আপা, অরাকে দেখেছেন?”

নীলিমা হেসে বললেন,” একটু আগে সামিরের সাথে যেতে দেখলাম। কেন আপা?”

” না.. এমনি।

সাবিরা আরও চিন্তায় পড়ে গেলেন। একটু আগে যে ভয়ংকর কথা তিনি শুনেছেন এরপর আর কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছেন না। সামিরও এসব জেনে গেলে হবেটা কি? সর্বনাশের আশঙ্কায় তার বুক কাঁপছে। হঠাৎ সামির উপস্থিত হলো। সাবিরার দিকে চেয়ে সালাম দিয়ে মলিন মুখে বলল,” ভালো আছেন?”

সাবিরা আদুরে কণ্ঠে বলে উঠলেন,” এইতো বাবা, আলহামদুলিল্লাহ।তুমি কেমন আছো?”

” ভালো। আম্মু, একটু এদিকে আসো। কথা আছে।”

সামিরের ব্যবহারে সামান্য তীক্ষ্ণতা টের পেলেন সাবিরা। কিছু একটা অবশ্যই হয়েছে। নীলিমা সাবিরার থেকে বিদায় নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সামিরের সাথে উঠে গেলেন।

ঘরে এসেই দরজা বন্ধ করল সামির। তার মুখ রক্তবর্ণ। নীলিমা শঙ্কিত কণ্ঠে বললেন,” কি হয়েছে বাবা?”

সামির ক্ষীপ্ত গলায় উচ্চারণ করল,” যত দ্রুত সম্ভব এগুলো বন্ধ করো। এই বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হবে না।”

” অনুষ্ঠান হবে না মানে? কি বলছিস এসব? মাথা ঠিকাছে?”

নীলিমা হতভম্ব। সামির দরাজ গলায় বলল,” আমার মাথা একদম ঠিকাছে আম্মু। সেজন্যই বলছি, সব বন্ধ করো।”

” আশ্চর্য, বললেই সব বন্ধ করা যায় নাকি? আত্মীয়-স্বজন দাওয়াত করা হয়ে গেছে, সবাই জানে কাল অনুষ্ঠান এখন হঠাৎ সব বন্ধ করে দিলে মানুষকে কি বলব?”

সামিরকে হতাশ দেখাচ্ছে।বিছানায় বসে ফুঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। নীলিমা কাছে এসে ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। নরম সুরে বললেন,” আমাকে বল, কি হয়েছে? হঠাৎ কেন এতো রেগে গেলি?”

সামির লালচে দৃষ্টিতে চেয়ে নির্জীব কণ্ঠে বলল,” অরার এই বিয়েতে মত ছিল না। ও বিয়েটা মানতে পারছে না।”

কথাটা বলেই দুইহাত মুখে ঠেকিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল সামির। নীলিমা তাকিয়ে রইলেন ছেলের বিষণ্ণ মুখের দিকে। তিনি এই ব্যাপারটা আগেই ধরতে পেরেছিলেন। ম্লান গলায় বললেন,” অরা বলেছে?”

সামির মাথা নাড়ল। নীলিমা হাসার চেষ্টা করলেন,” তাতে কি হয়েছে? মাত্র এক সপ্তাহ গেল।।আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। এখন মানতে না পারলেও পরে মানতে পারবে।”

” এটা আস্তে আস্তে ঠিক হওয়ার মতো বিষয় না আম্মু। ও ডিভোর্সের কথা ভেবে ফেলেছে। তুমি বুঝতে পারছো? ডিভোর্স! ”

নীলিমা কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। বাইরে থেকে শোরগোল ভেসে আসছে। ফুলবানু বেগমের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সুমন সাহেব মায়ের সাথে কি একটা বিষয় নিয়ে তর্ক বাঁধিয়ে দিয়েছেন। নীলিমা না গেলে ঝামেলা থামবে না। তবুও তিনি যেতে পারছেন না৷ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ছেলের কাছে।

একপর্যায়ে সামিরের কাঁধে হাত রেখে বললেন,” শুধু ডিভোর্সের কথা বললেই কি ডিভোর্স হয়ে যায়? অরা একটু অবুঝ ধরণের মেয়ে। ওর কথা নিয়ে এতো চিন্তার কিছু নেই। আমি বলছি, সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। অরা তোকে মেনেও নিবে৷ ”

নীলিমার উপদেশ সামিরকে খুব একটা আশ্বস্ত করতে পারল না।বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন তার মুখ।

নীলিমা পাশে বসে বললেন,” একবার চিন্তা করে দ্যাখ, তুই এই পর্যন্ত একবারও কি অরার সাথে মন খুলে কথা বলেছিস? তুই যদি ওর সাথে মিশতেই না পারিস তাহলে মেয়েটা বুঝবে কিভাবে যে তুই কেমন? আগে তো ওকে বোঝাতে হবে, কি জিনিস পেয়েছে ও। কত কপাল হলে আমার ছেলের মতো একজনকে পাওয়া যায়। তুই যে ওকে কত ভালোবাসিস, এটা ওকে বোঝানোর চেষ্টা কর। মেয়েরা সব ছাড়তে পারলেও ভালোবাসার মায়া ছাড়তে পারে না। যখন থেকে অরা তোর ভালোবাসাটা রিয়েলাইজ করবে, তখন ডিভোর্সের কথা আর মুখেও আনবে না৷ তাছাড়া নিজের ছেলের উপর আমার বিশ্বাস আছে। মাই সন ইজ আ পারফেক্ট ম্যান।”

সামির মায়ের দিকে তাকাল। নীলিমা পরম স্নেহে ছেলের কপালে চুমু দিলেন।

অরা একটা ঘরে চুপচাপ বসে আছে। সাবিরা সেখানেই ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন,” সামিরকে তুই কি বলেছিস?”

অরা কোনো জবাব দিল না। সাবিরার মেজাজ তখন উর্ধ্বগতিতে। ফোন করে স্বামীকে ডাকলেন। ঘরে আসার জন্য বললেন। ফোনের ওই পাশ থেকে আরিফ জানতে চাইলেন,” কি ব্যাপার?”

সাবিরা বললেন,” তোমার আহ্লাদী মেয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি এসে ওর মাথাটা ঠিক করো। ওর ঘটে একটু বুদ্ধি দান করো।”

অরা কাঁদতে শুরু করল। আরিফ দুশ্চিন্তা বোধ করছেন। তিনি এসে ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেলেন অরা কাঁদছে। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন,” কি হয়েছে আমার মেয়ের?”

সাবিরা পুরো ঘটনা বললেন। তিনি আশা করেছিলেন স্বামীও তার মতো রেগে যাবেন। অরাকে কিছু কড়া কথা শোনাবেন। কিন্তু আরিফ কিছুই করলেন না। বরং তিনি হেসে উঠলেন সশব্দে। স্বামীর হাসি দেখে স্তব্ধ হলেন সাবিরা,” তুমি হাসছো?”

আরিফ প্রথমেই জানতেন অরার সাথে সামিরের বিয়ের পর এমন কিছু সমস্যা হবে। সেজন্য তিনি প্রস্তুতও ছিলেন। কিন্তু মেয়ে যে সরাসরি ডিভোর্সের কথা ভেবে ফেলবে তা কল্পনাও করতে পারেননি।

আরিফ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,” তোর কি সমস্যা? আমার সাথে শেয়ার কর। ডিভোর্স নেওয়ার জন্য একটা যথোপযুক্ত কারণ লাগে। তুই যদি আমাকে সেই কারণ দেখাতে পারিস তাহলে আমিও তোর সাথে একমত হবো।”

অরা চোখ মুছতে মুছতে বলল,” উনাকে বর হিসেবে আমার পছন্দ হচ্ছে না বাবা।”

আরিফ আবার হাসলেন। সাবিরা চোখ রাঙিয়ে বললেন,” হেসে হেসেই মেয়ের মাথা খেয়েছো তুমি। এই জায়গায় হাসির কি হলো আমি বুঝলাম না তো কিছু। পছন্দ হয়নি মানে কি আবার? স্বামী যেমনই হোক। সে তোর স্বামী। তাকে প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। ও একটা অন্যায় আবদার করছে আর তুমি বাবা হয়ে হেসে ওকে আশকারা দিচ্ছো?”

আরিফ স্ত্রীকে কিছু বললেন না। মেয়ের দিকে চেয়ে বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে বললেন,” শুধুমাত্র অপছন্দের জন্য ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম তো নেই মা। ডিভোর্সের এফিডেভিডে সাইন করার সময় কারণ উল্লেখ করতে হয়। অনেকগুলো অপশন থাকে। সেখান থেকে একটায় টিক মার্ক দিতে হয়। তুই যেই কারণের কথা বলছিস এফিডেভিডে সেই অপশনই তো থাকবে না।”

” বাবা তুমি কি আমার সাথে রসিকতা করছো?”অভিমান ঝরে পড়ল অরার কণ্ঠ থেকে। আরিফ সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন,” রসিকতা না। আমি বুঝতে পারছি তোর সমস্যাটা। তুই আমাকে বল, সামীরের থেকে তুই কি চাস? ও কি তোর মনের মতো হতে পারছে না?”

” মনের মতো হতে পারছে নাকি বলতে পারবো না। তবে উনার মুখ দেখলেই আমার আগের কথা মনে পড়ে যায়। যখন উনি আমার স্যার ছিলেন।”

আরিফ স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন,” তাহলে আর কি করার? জামাইকে বলি প্লাস্টিক সার্জারী করিয়ে নিতে!”

অরা রেগে বলল,” বাবা!”

আরিফ চৌধুরী হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন,” আচ্ছা মুখ ছাড়া আর কি নিয়ে প্রবলেম, বল?”

” উনার কথা ভেবে আমার সারাক্ষণ অস্বস্তি হয়।”

” এটা তো ভালো লক্ষণ। এর মানে তুই সারাক্ষণ ওর কথাই ভাবছিস। ওকে মাথা থেকে বের করতে পারছিস না। যে মাথায় বাসা বেঁধে বসে আছে সে মনে বাসা বাঁধতে কতক্ষণ? ”

” মানে?” অরার কণ্ঠে বিস্ময়ের সুর। আরিফ বললেন,” তুইও সামিরকে ভালোবাসিস। এজন্যই সারাক্ষণ ওর কথা মনে করিস।”

অরা দ্বিধান্বিত হলো। দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” না বাবা। এটা কি করে সম্ভব? ভালোবাসলে তো ভালো অনুভূতি হওয়ার কথা। কিন্তু আমার সব মন্দ অনুভূতি হয়। ”

আরিফ গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বললেন,” হুম। তাহলে এটাকে ভালোবাসা নয়, মন্দবাসা বলা উচিৎ।”

অরা চোখ গরম করে তাকাল,” বাবা!”

আরিফ ফিসফিস করে বললেন,” মানুষ যদি মন্দ থেকে ভালো হতে পারে তাহলে অনুভূতি কেন নয়? তোর অনুভূতিও মন্দবাসা থেকে ভালোবাসা হয়ে যাবে। এতো চিন্তার কিছু নেই।”

” কিন্তু কিভাবে হবে? এতোদিনেও যেহেতু কিছু হয়নি, আমার মনে হয় না আর কখনও হবে।”

” মারে, এমনি এমনি তো আর কিছু হয় না। তোকে সবার আগে চেষ্টা করতে হবে। নিজের চেষ্টা ছাড়া কোনোকিছুতেই মানুষ সফল হতে পারে না। বিয়ের পর এই এতোগুলো দিনের মধ্যে তুই কি একবারও সামিরকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিস?”

অরা মাথা নাড়ল। সে চেষ্টা করেনি। চেষ্টা করার প্রয়োজনও বোধ করেনি। আরিফ প্রশ্ন করলেন,” কেন চেষ্টা করিসনি?”

” যে জিনিস আমার ভালোই লাগে না সেই জিনিস ভালো লাগানোর চেষ্টা কেন করবো অযথা? জানি, কোনো লাভ নেই।”

” এইখানেই তো মানুষ ঠকে যায়। ভালো না লাগার কারণটাও কিন্তু বলতে পারছিস না। এমনও তো হতে পারে, তোর অবচেতন মনের ভালো লাগছে। কিন্তু তুই সেটা বুঝতেই পারছিস না। যখন বুঝতে পারবি তখন হয়তো দেরী হয়ে যাবে। আফসোস করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না।”

” আমি আফসোস করবো না বাবা।”

আরিফ অসহায় বোধ করলেন। মেয়ে দেখা যাচ্ছে নাছোড়বান্দী। কোনো কথা দিয়েই তাকে বুঝ দেওয়া যাচ্ছে না। সে বোঝার চেষ্টাও করছে না। আরিফ ঠান্ডা গলায় বললেন,” ঠিকাছে। মাত্র সাত দিন পার হয়েছে। আরও সাত দিন যাক। অন্তত একটা মাস শেষ হতে দে। এরপরেও যদি তোর ভালো না লাগে তখন আমি ব্যবস্থা নিবো।”

” কিন্তু বাবা, আমি চাই তোমাদের সাথে চট্টগ্রাম যেতে। উনি যেন সেখানে না আসে প্লিজ।”

সাবিরা এই পর্যায় ধৈর্য্য হারালেন। রেগে আবার অরাকে টেনে একটা চড় মারতে চাইলেন। আরিফ হাতের ইশারায় স্ত্রীকে থামিয়ে বললেন,” ঠিকাছে। তাই হবে।”

তখন ভোর-সকাল। সামির একাকি লিভিংরুমের ছোট বারান্দায় বসে আছে। তার চেহারা গম্ভীর। হাত দু’টো দিয়ে মুখের অর্ধেক অংশ ঢেকে রেখেছে। বিষণ্ণ দৃষ্টি দেয়ালে। গভীর মনোযোগে কিছু ভাবছে সে।

অন্তি অনেকক্ষণ যাবৎ সামিরকে দেখছিল। এবার এগিয়ে গেল। সহসা গিয়ে সামিরের কাঁধে একটা ধা-ক্কা মা-রতেই চমকে উঠল সে। অন্তি হাসতে লাগল। সামির বিরক্ত স্বরে বলল,” বিরক্ত করিস না।”

” তুই সকাল সকাল এখানে ভূতের মতো বসে আছিস কেন? প্রবলেমটা কি?”

সামির হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,” ভালো লাগছে না।”

” কেন?”

সামির হঠাৎই খুব আনমনা হয়ে গেল। তীব্র অনুভূতিদের নড়াচড়া তাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেকটা মনখারাপের স্বরে বলল,” আমরা সবসময় ভুল করি কেন অন্তি? জীবনের প্রতিটি পদে পদে আমাদের শুধু ভুলই হতে থাকে। কিছু ভুল তো সাংঘাতিক হয়। পুরো জীবনটাই বদলে দেয়।”

” ভুল থেকেই তো মানুষ শিক্ষা নেয় রে বেটা! তুই যদি ভুলই না করিস তাহলে নিজেকে শুধরাবি কি করে?”

” কিন্তু কিছু কিছু ভুল থাকে, যেগুলো কখনও শুধরানো যায় না। মনে হয় জীবনটাই থেমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কি করণীয়?”

” তুই কি এমন ভুল করেছিস শুনি?”

” কাউকে এতো ভালোবেসে ফেলেছি যে তাকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতেই পারছি না৷ এই ভুল আমি কিভাবে শুধরাবো?”

সামিরের কণ্ঠে প্রবল অসহায়ত্ব। চোখ দু’টো টলমল। অন্তি বিস্মিত হয়ে বলল,” তুই কি অরাকে মিন করছিস? এই, তোদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে নাকি রে?”

সামির আবেগতাড়িত হয়ে অনেক কিছু বলে ফেলেছে। সে নিজের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা পছন্দ করে না। অন্তির প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পেল। মাথা ঝাড়া দিয়ে বলল,” তেমন কিছু না।”

” সত্যি কথা বল দোস্ত। কি হয়েছে? যদি আমাকে বন্ধু মনে করিস তাহলে শেয়ার কর প্লিজ।” অন্তি উতলা হয়ে উঠল।

সামির রুদ্ধ স্বরে বলল,”অরা আমাদের বিয়েটা মানতে চাইছে না। ডিভোর্স চায় ও।”

অন্তি স্তব্ধ হয়ে গেল কথাটা শুনে। তার বুকব্যথা শুরু হলো। অরাকে সামির ঠিক কতটা ভালোবাসে তা অন্তি খুব ভালো করে জানে। শুধু তাই নয়, অরার কথা জানার পর থেকে তার প্রতি প্রবল ঈর্ষা জন্ম নিয়েছে। তবে এই মুহূর্তে করুণা হচ্ছে। বেচারী মেয়েটা বুঝলোই না, তার জন্য কত গভীর ভালোবাসা জমা আছে।

সামির হঠাৎ প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, এমন কেন হলো? তুই আবার অভিশাপ দিসনি তো? ”

” ছি,আমি তোকে অভিশাপ দেবো এটা ভাবলি কেমন করে?”

তারপর একটু থেমে আবার বলল,”তুই চাইলেও আমাকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারতি না। কারণ তোর অনুভূতির রাজ্যে শুধু অরাই ছিল। সেজন্য অভিশাপ দেওয়ার কিছু নেই। ”

” স্যরি। মাথা ঠিক নেই রে! কি বলতে কি বলে ফেলছি, মাফ করে দিস।”

সামির উঠে দাঁড়াল। বারান্দা থেকে বের হয়ে গেল। অন্তি একাই দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। তার খুব খারাপ লাগছে। সামিরকে এতোটা দিশেহারা হতে সে আগে কখনও দেখেনি!

বৌভাতের অনুষ্ঠান শুরু হলো সন্ধ্যায়। অরাকে পার্লার থেকে মাত্র সাজিয়ে আনা হয়েছে। তার গায়ে বেবি পিংক রঙের ভারী লেহেঙ্গা। কানে, গলায় হীরার অলংকার। মুখভর্তি গাঢ় মেকাপের প্রলেপ। দেখতে লাগছে রূপকথার কোনো রাজকন্যার মতো। সাবিরা মেয়ের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। নিজের চোখ থেকে কাজল নিয়ে অরার মাথায় ছুঁইয়ে বললেন,”কারো নজর যেন না লাগে।”

অরা খেয়াল করেছে, নজর তো একটা লেগেই আছে। সারাক্ষণ মানুষটা কারণে-অকারণে অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকেই দেখছে। অরা নিজের গায়ে লেহেঙ্গা আর অলংকারের ভার সয়ে নিচ্ছে কিন্তু ওই মানুষটার নজরের ভার সইতে পারছে না। অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে পড়ছে ক্ষণে ক্ষণেই।

সন্ধ্যার আসর জমজমাট করতে সিংগার ভাড়া করা হয়েছে। ইউটিউবে বেশ নাম-ডাক আছে তার। সামিরের বন্ধু হয়। পুরো নাম শিহাব কায়সার। সে একের পর এক গান গেয়ে চলেছে। গিটার হাতে নিয়ে স্টেজে হেঁটে বেড়ানো আর গান করাই তার কাজ। মাঝে মাঝে দর্শকও তার সাথে তাল মেলাচ্ছে। হাত তালি দিয়ে উৎসাহ প্রদান করছে। লোকটার কণ্ঠ ভালো হলেও গানের চয়েজ অসম্ভব বাজে। একটা গানও অরার পছন্দ হচ্ছে না।

সামিরের ভার্সিটির সময়কার অনেক বন্ধুই আজ এসেছে অনুষ্ঠানে। লামিয়া, রাইসা, শীলা সবাই সামিরের সাথে সেলফি তুলছে। ছেলে বন্ধুর চেয়ে মেয়ে বন্ধুদের উপস্থিতিই বেশি৷ অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। তাই জামাই শুদ্ধো এসেছে। লামিয়া সামিরকে অফ হোয়াইট ব্লেজারে দেখে বলল,” দোস্ত, তোকে যে কি হ্যান্ডসাম লাগছে! একশো মাইল দূর থেকেও শুধু তোর উপর নজর আটকে যাচ্ছে আমার। জাস্ট মাইন্ড ব্লোয়িং! ”

যার নজর আটকানোর কথা সে তো ফিরেও তাকাচ্ছে না; ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সামির। রাইসা বলল,” দোস্ত, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভাবির পাশে গিয়ে দাঁড়া না প্লিজ। তোদের দু’জনকে একসাথে দেখি!”

সামির গেল না। অবজ্ঞার স্বরে বলল,” সবসময় তো ওর সাথেই থাকি। আজ একটু তোদের সময় দেই। প্রবলেম কি?”

শিহাব তখন গান শেষ করে বিরতি নিয়েছে। বিরতির পর সে মাইকে সামিরের নাম উচ্চারণ করল। এবার সে যে গানটা গাইতে চলেছে সেটা নাকি সামির তার বউকে ডেডিকেট করবে। এই কথা শুনে দর্শকরা হাত তালি দিল। বন্ধুরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।

অরার চোখমুখ লাল হয়ে গেল মুহুর্তেই। শিহাব গাইতে শুরু করল। গানের প্রত্যেকটা লাইন অরার কানে আঘাত করছিল। লজ্জায় সে মাথা তুলে তাকাতেও পারছিল না। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি!

আঁড়চোখে সামিরের দিকে তাকাতেই দেখল সামিরও তার দিকে চেয়ে আছে। একটা ধাক্কার মতো লাগল অরার বুকে। সে চোখ নামিয়ে নিল।

গানের এক পর্যায় সামিরের বন্ধুরা তাকে টেনে অরার পাশে এনে দাঁড় করালো। অরার দমবন্ধ হয়ে আসার মতো হাঁসফাঁস লাগছে। রাইসা স্টেজের ডেকোরেশন থেকে একটা গোলাপ ছিঁড়ে এনে সামিরের হাতে দিয়ে বলল অরাকে দেওয়ার জন্য।

সামির অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফুলটি অরার দিকে বাড়িয়ে ধরল। অরা জোরপূর্বক হাসার ভাণ করে ফুলটি নিল। সেই মুহূর্তটি ক্যামেরা বন্দী করতে ভুল হলো না ক্যামেরাম্যানের।

অরা অস্বাতিতে গাঁট হয়ে যাচ্ছিল। মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল, এই বিরক্তিকর মুহূর্ত যেন দ্রুত শেষ হয়ে যায়। হঠাৎ বাথরুমে যাওয়ার বাহানায় সেখান থেকে সরে এলো অরা।

কিছুক্ষণ পর সামিরও একটা কাজে অরা যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকে গেল। তখনি খেয়াল করল তার দেওয়া গোলাপটি অরা ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে। সামিরের মনে হলো বিষাক্ত কোনো পোকা তার হৃদয়ে বিষদাঁত গেঁথে দিচ্ছে।

সামির দ্রুত সরে যেতে চাইল। কিন্তু বাঁধ সাধল লোড শেডিং। সহসা পুরো বাড়ি অন্ধকারে ছেঁয়ে গেল। বাথরুমে তখন অরা একা। সে বলেছিল অন্ধকারে নাকি তার ভয় লাগে। এই ভেবে সামির দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। যাতে অরা ভয় না পায়। অরা দ্রুত বাথরুম থেকে বের হয়ে সামিরকে দেখেই চমকে উঠল,” আপনি এখানে কি করছেন?”

সামির নির্বিকার চিত্তে বলল,” কিছু না।”

এই কথা বলে সে চলে যেতে নিচ্ছিল। আচমকা কিছু একটার সাথে হোচট খেল অরা। সে প্রায় পড়েই যেতো। সামির দ্রুত এসে ধরায় বেঁচে গেল। অথচ ন্যূনতম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে সে বিরক্তির স্বরে বলল,” এটা কি হলো? আমাকে ছাড়ুন।”

সামির রাগে ছেড়ে দিল। অরা ধপাশ করে নিচে পড়ে গেল।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে