রুপালি মেঘের খামে পর্ব-০৪

0
716

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

৪.
রাতের ঘটনা বাড়ির সবাই জানলেও ফুলবানু বেগমকে কিছু জানানো হয়নি। সামিরের দাদি ফুলবানু বেগম। অতিরিক্ত মেজাজের জন্যে তাকে সবাই একটু এড়িয়েই চলে। তিনি সামান্য ঘটনা নিয়ে লংকাকান্ড বাঁধাতে দেরি করেন না।

তাঁর একজন ব্যক্তিগত গোয়েন্দাও আছে এই বাড়িতে। ফিরোজা বুয়ার প্রধান কাজ হলো প্রতিদিন সকালে বাড়ি এসেই সবার খোঁজ-খবর নেওয়া। তারপর গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো ফুলবানু বেগমের কানে চালান করা। এই জন্য সে প্রতি সপ্তাহে কিছু বকশিশ পায়। গতরাতের ঘটনা ফিরোজাই সকালে চা দিতে এসে ফুলবানুকে জানিয়েছে।

ফুলবানু সব শুনে চেঁচামেচি করতে লাগলেন,” নিলু, ও নিলু। এখনি আমার ঘরে আসো৷ নিলু।”

নীলিমা তার শ্বাশুড়ীকে বেশ ভয় পান। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে দরজার কাছে এসে বললেন,” ডেকেছেন আম্মা?”

ফুলবানু তেজ নিয়ে বললেন,” কাল রাইতে কি হইছিল? আমারে কেউ কিছু কইল না ক্যান?”

” কি হয়েছে আম্মা?”

” নতুন বউ নাকি বাসর ঘরে ঢুইকাই জ্বরে ফিট হয়া পড়ছে?”

নীলিমা কড়া দৃষ্টিতে ফিরোজা বুয়ার দিকে চাইলেন। মাথা নিচু করে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল ফিরোজা। নীলিমা নরম সুরে শাশুড়ীকে বোঝালেন,” আম্মা, আসলে মেয়েটা কাল অনেক দূর থেকে জার্ণি করে এসেছে। সারাদিন ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করেনি। হঠাৎ একটা অপরিচিত জায়গা, তাই হয়তো এমন অবস্থা।”

” বাসর কি আমাদের হয় নাই? আমরা কি স্বামীর ঘরে যাই নাই? এমন নাটক তো জীবনেও দেখি নাই।বাসর ঘরে ঢোকার আগেই মাইয়া বমি কইরা অস্তির।এইটা কেমন ঢং! আমার কাছে তো মাইয়ার হাব-ভাব সুবিধার লাগতাছে না। ডাকো তারে। আমি কথা বলব।”

” বাদ দিন না মা। এখন ও ঘুমাচ্ছে। ”

” সকাল কয়টা বাজে? এই সময় কিসের ঘুম? ঘরে বউ আনছো নাকি নবাবজাদী? ঘুম থেকা ওরে উঠায়া আমার কাছে পাঠাও। আমি জিগামু, বাপ-মা ওরে শিখাইছে কি? বড়নাতি এই মাইয়ারে কিছু না বুইঝা বিয়া কইরা আনছে। ও একটা ভুল করছে। তোমরাও সেই ভুল মাইনা নিছো। এই মাইয়ার সম্পর্কে কতদূর জানি আমরা? তার আগের বিয়া ক্যান ভাঙছে সেটাও তো জানি না।”

” বিয়ে তো ছেলেপক্ষ ভাঙেনি। মেয়েপক্ষই ভেঙছে। অরার বাবা জানতে পেরেছেন, ছেলের মধ্যে নাকি বিরাট সমস্যা আছে। এজন্যই বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন।”

ফুলবানু মুখ বাঁকা করে বললেন,” এইসব ভং-চং তোমাদের বোঝানো হইছে। আসল কাহিনি অন্য। আমরা তো ওইখানে ছিলাম না। তাই কিছু জানি না। বড়নাতিরে এখনি ডাকো। ওর সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”

নীলিমার আত্মা শুকিয়ে গেল। সামির এসব শুনলে এখন আরেকটা কেলেংকারি বাঁধবে। তিনি ব্যাপারটা পাশ কাটানোর উদ্দেশ্যে বললেন,” অর্ঘ্য তো নেই আম্মা।”

নীলিমা এই কথা বলা মাত্রই সামির ভেতরে ঢুকল। সে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে প্রায়ই দাদীর ঘরে এসে একবার দেখা করে যায়। নীলিমার মুখ চুপসে গেল ছেলেকে দেখে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। সামিরকে কেন এই সময়ই আসতে হবে?

সামির হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,” দাদী, কেমন আছো?”

ফুলবানু দরাজ গলায় বলে উঠলেন,” কেমন আর থাকমু? আশেপাশে যা ঘটতাছে…”

” কি হয়েছে?” সামির ভ্রু কুঞ্চিত করল।

ফুলবানু চোখ বড় বড় করে শুধালেন,”শুনলাম তোর বউ নাকি বাসরের আগেই পোয়াতি হয়া গেছে? বমি কইরা ঘর ভাসাইছে?”

সামির হতভম্ব দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাল। মুহূর্তেই চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল তার। নীলিমা কাছে এসে সামিরের হাত ধরে বললেন,” আম্মার মাথা ঠিক নেই। রাতের ঔষধটা খায়নি মনে হয়। এজন্যই এমন আবোল-তাবোল বকছে। বাইরে চল বাবা।”

নীলিমা টেনেও ছেলেকে বাইরে নিতে পারল না। পাথরের মতো শক্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সামির। ফুলবানু এক নিশ্বাসে আজে-বাজে কথা বলেই চলেছেন। নীলিমার বুক কাঁপছে। সামির শীতল গলায় বলল,”দাদী তোমার কি মাথা ঠিকাছে? যার নামে তুমি বাজে কথা বলছো সে আমার বউ হয় এটা কি তুমি ভুলে গেছো?খবরদার, আর একটাও নোংরা কথা বলবে না।”

ফুলবানু চেঁচিয়ে উঠলেন,” কি করবি? আমারে ঘরতে বাইর কইরা দিবি? আগে তোর বউরে বাইর কর। বিয়ার আগে পেট বাঁধানো নডি কখনও ভালো হইব না।”

সামিরের চেহারার রঙ পাল্টাতে শুরু করেছে। নীলিমা ভয়েই অস্থির। মিনতির স্বরে বললেন,” আল্লাহর দোহাই লাগে মা। আপনি চুপ করুন। কেউ শুনলে কি ভাববে?”

জোর করে ছেলেকে বাইরে নিয়ে এলেন নীলিমা। সামির ক্রোধে উন্মত্ত। থমথমে কণ্ঠে বলল,” দাদীকে চুপ করাও আম্মু। নাহলে কিন্তু আমি চুপ থাকব না। অরা এসব শুনলে কি হবে?”

” শুনবে না। আমি সামলাচ্ছি আম্মাকে।”

” দাদী যেন কোনোভাবেই অরার কাছে না যায় আম্মু।”

” যাবে না।”

সুমন সাহেব লিভিংরুম ঢুকলেন। সামিরকে অত্যন্ত রূঢ় মেজাজ নিয়ে বের হতে দেখা গেল। সুমন সাহেব প্রশ্ন করলেন,” কি হয়েছে? সকাল সকাল এতো চিৎকার কেন?”

নীলিমা স্বামীকে সম্পূর্ণ ঘটনা জানালেন। এসব শুনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন সুমন। এই বাড়িতে এগুলো নতুন কিছু না। বরং গতকাল পর্যন্ত যে পরিবেশ ঠান্ডা ছিল এটা ভেবেই তিনি অবাক হয়েছেন।

অরা বিছানায় বসে আছে চুপচাপ। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। গতরাতের ঘটনার জন্য তার কারো সামনে যেতেও অস্বস্তি লাগছে। সে পারলে সারাদিন এই ঘরেই বসে থাকতো। কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই সম্ভব না।

বিছানা থেকে নেমে আয়নার কাছে এসে দাঁড়াল অরা। তার চোখ ফুলে আছে। এলোমেলো চুল। দেখতে খুব অদ্ভুত লাগছে। আচ্ছা, সে কি আসলেই খুব অদ্ভুত মেয়ে? পৃথিবীতে এর আগে কোনো নব বধূ কি তার মতো বাসর ঘরে ঢুকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে? যদি সামিরের সাথে বিয়ে না হয়ে বাবার ঠিক করা পাত্র আতিফের সাথে তার বিয়েটা হতো, তাহলেও কি এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তো সে? নিশ্চয়ই না!

” ভাবি, গুড মর্ণিং।” সামিয়ার উত্তেজনামিশ্রিত কণ্ঠ ভেসে এলো। অরা পেছনে ঘুরেই দেখল সামিয়া হাসছে। হাতে থালাভর্তি রুটি, মাংস আর মিষ্টি। অন্যহাতে ঠান্ডা শরবতের গ্লাস। খাবারগুলো নিজের পড়ার টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,” এখন শরীর কেমন লাগছে ভাবি?”

অরা মাথা নিচু করে জানাল,” ভালো। ”

” তুমি তো একদম ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আমাদের।”

” স্যরি।”

সামিয়া হাসল৷ জানালার কাছে গিয়ে পর্দাগুলো সরাতে সরাতে বলল,” স্যরি’টা ভাইয়াকে বলা উচিৎ। সারারাত তোমাকে নিয়েই দুশ্চিন্তা করেছে আমার বেচারা ভাইয়াটা। এতোটুকু ঘুমায়নি, জানো?”

অরা অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। সামিয়া বলল,” মা বলেছিল তোমাকে ভাইয়ার ঘরে শিফট করতে। কিন্তু ভাইয়া রাজি হয়নি। ওই ঘরে গিয়েই তো তুমি বমি করেছিল। ভাইয়া ফিরোজা খালাকে দিয়ে সকালেই ঘর পরিষ্কার করিয়েছে। তার ধারণা এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধটা তোমার সহ্য হয়নি।”

অরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ভাগ্যিস রাতে তাকে সামিরের ঘরে শিফট করা হয়নি। সকালে উঠে যদি সে দেখতো সামিরের পাশে শুয়ে আছে, তাহলে কেমন হতো? ভেবেই গা শিরশির করছে। আল্লাহ বাঁচিয়েছে।

সামিয়া বলল,” খেতে এসো ভাবি। মা তোমার জন্য নাস্তা পাঠিয়ে দিয়েছে।”

” একটু পরে খাই?”

সামিয়া শাসনের সুরে বলল,” উহুম। এখনি খেতে হবে। ভাইয়া বলেছে ঘুম থেকে উঠলেই আগে তোমাকে নাস্তা খাওয়াতে। তারপর ভাইয়াকে ইনফর্ম করতে।”

“ও।”

অরা অনিচ্ছায় খেতে বসল। একটু খেতেই তার মনে হলো পেট ভরে গেছে। অথচ সামিয়া জোর করে সব খাওয়াল। অরা এক পর্যায় বলল,” সামিয়া, একটা কথা বলব?”

” বলো।”

” আজরাতে কি আমি তোমার সাথে এই ঘরে থাকতে পারি? যদি তোমার অসুবিধা না হয়!”

” অসুবিধা নেই। মা বলেছে বৌভাতের আগ পর্যন্ত তুমি আমার সাথেই থাকবে।”

” সত্যি?” অরা হেসে উঠল। সামিয়া একটা ঔষধ এগিয়ে দিল।

” এটা কি?”

” ভাইয়া বলেছে ব্রেকফাস্টের পর তোমাকে এই ঔষধটা খাওয়াতে।”

অরা জোরপূর্বক হেসে ঔষধ হাতে নিল। তার বিরক্ত লাগছে। সে কোনো বাচ্চা নাকি? লোকটা এমন ভাব করছে যেন অরা তার বিয়ে করা বউ। উফ, অরা তো আসলেই তার বিয়ে করা বউ! কি অসহ্য ব্যাপার!

অরা তার ফোন হাতে নিল। রূপাকে একটা ফোন করা দরকার। এখানে আসার পর থেকে তো একবারও কথা হয়নি। কয়েকবার রিং হতেই ওইপাশ থেকে রিসিভ হলো ফোন। অরা টু-শব্দটি করার আগেই উপুর্যুপরি গালি-গালাজ শুরু হলো। প্রত্যেকটি বাক্যের শেষে কমপক্ষে একবার হলেও ‘শা-লি’ উচ্চারিত হচ্ছে।অরা চোখ-মুখ কুচকে বলল,” তোর গালা-গালের রেলগাড়ি কি বন্ধ হয়েছে? তাহলে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতাম।”

” দরকারে আমার কথা মনে পড়ল তোর?হারা-ম-জা-দী, বর পেয়ে দিন-দুনিয়া ভুলে গেছিস শা-লি?”

” তুই আর শুধরালি না।

“হুদাই শুধরাবো কেন বা-ল? বল, কাহিনি কি?”

অরা উদাস গলায় বলল,” মনে আছে? তোকে আমি প্রায়ই একজনের বিষয়ে বলতাম? ক্লাস এইটে থাকতে আমার একটা স্যার ছিল। চশমাওয়ালা, রাগী?”

” হ্যাঁ, মনে আছে। কিন্তু হঠাৎ ওই শা-লার কথা কেন? তুই কি এখনও মিস করিস বা-লটাকে?তোর হাসব্যান্ড এই কথা জানে? হা-রা-মি, তোর বরের নাম্বার দে। তার কাছে এক্ষুণি নালিশ জানাতে হবে।”

অরা বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” আহহা! আগে শুনবি তো আমার পুরো কথাটা? উনার নাম ছিল অর্ঘ্য। আর আমার বরের নাম সামির। বিয়ের দিন আমি উনাকে দেখিনি। বিদায়ের সময় একবারে দেখেছিলাম। তখনি আমার মাথা ঘুরে উঠল। একদম অর্ঘ্য স্যারের মতো চেহারা।”

” এটাই স্বাভাবিক। সারাক্ষণ ওই শা-লার কথা চিন্তা করলে তো সব জায়গায় ওই শা-লাকেই দেখবি। যেমন আমার পছন্দ রণভীর কাপুড়। বিয়ের দিন বরের জায়গায় বর না দেখে আমিও বোধ হয় শা-লা রণভীর কাপুড়কেই দেখবো।”

” ধ্যাত, তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস না। শোন আগে, শ্বশুরবাড়িতে আসার পর দেখি শাশুড়ী উনাকে অর্ঘ্য নামে ডাকছে। তারপর আমি ওদের বাড়িতে অর্ঘ্য স্যারের ছবিও দেখলাম। ননদকে ছবিটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, এটা সামিরের ছোটবেলার ছবি।”

” কিই?”

রূপা রীতিমতো আৎকে উঠল। অরা অসহায় কণ্ঠে বলল,” আমিও তোর মতো ঠিক এভাবেই আৎকে উঠেছিলাম। আমার জ্বর চলে এসেছে।”

” বা-ল, এই কথায় জ্বর আসার কি হলো বুঝলাম না।এটা তো খুব আনন্দের ব্যাপার।আমার পাগলু ড্যান্স দিতে ইচ্ছে করছে।

” এখানে তুই আনন্দ কোথায় পেলি? আমার তো ভয় লাগছে। ”

” ভয় লাগবে কেন? শালি, তোকে কি উনি কা-মড়াচ্ছে?”

” ছি,কা-মড়াবে কেন?

” অরা, অর্ঘ্য স্যারকে যে তুই মনে মনে ভালোবাসিস এটা কি এখনও বুঝতে পারিসনি? গাঁধী,কানের নিচে থা-প্পড় খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে তোর।”

” দ্যাখ, ফালতু কথা বলবি না একদম৷ আমি উনাকে কেন ভালোবাসতে যাব? উনি আমার স্যার হয়!”

” কিন্তু এখন সে তোর ছাইয়া। স্যার থেকে ছাইয়া।”

” এটাই তো আমি মানতে পারছি না। আচ্ছা আমি না হয় উনাকে না চিনে বিয়ে করেছি। কিন্তু উনি তো আমাকে চিনেন। তাহলে কেন বিয়ে করলেন? উনি কি আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চান?”

” প্রতিশোধ কেন নিবে? তোর উপর অত্যাচার করছে নাকি? তোকে দিয়ে কি দিন-রাত কামলা খাটাচ্ছে? বাসর রাতে কি তোকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে?”

” না। কিন্তু বাসর রাতে আমিই বমি করে ঘর ভাসিয়ে দিয়েছি। আমার জ্বর এসে গেছে। তারপর ননদের ঘরে ঘুমিয়েছি। তাই এখন পর্যন্ত সেরকম কিছু হয়নি।”

রূপা এ কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল,” মাই গড! এসব একমাত্র তোর দ্বারাই সম্ভব। এমনি এমনি কি তোকে আমি ন্যাকাবতী ডাকি?”

” রূপা, আমি এখন কি করব?”

” কঁচুগাছের তলায় ফাঁসি দিয়ে ম-রে যা, শা-লি।”

সকাল আটটা। সূর্যের তেজ মসৃণ। চারদিকে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। কাল বাড়িতে বড় অনুষ্ঠান। সামির আর অরার বৌভাত। সন্ধ্যার মধ্যেই অরার বাড়ির লোক চলে আসবে। রান্না-বান্নার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। রমরমা আয়োজন চলছে। অরা দ্রুত গোসল সেরে নিয়েছে।

সামীর ছাদে পুশ আপ করছিল। এটা তার পুরনো অভ্যাস। হঠাৎ ঘাম মুছে পেছনে ঘুরতেই একটি বিস্ময়কর দৃশ্য দেখল। ঠিক ছাদের বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে অরা তোয়ালেতে ভেজা চুল মুছছে। সূর্য রশ্মির প্রতিফলনের দরুণ তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তাই স্বভাবতই সামীরের দৃষ্টি চলে গেল অরার ছিপছিপে শরীরের দিকে।

শাড়ির আঁচল পেটের কাছে এসে উধাও হয়ে গেছে। চন্দন রঙা মসৃণ পেট স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। শরীর ঝাঁকিয়ে চুল মোছার কারণে সেই মসৃণতায় একটি আশ্চর্য সুন্দর ঢেউ খেলা করছে। সামীর তার বেহায়া দৃষ্টিকে সংযত করতে পারল না। হয়তো চেষ্টাই করল না। অপলক সে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ তাদের চোখাচোখি হলো। সামীরকে ওইভাবে চেয়ে থাকতে দেখে অরা অস্বস্তিতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তড়িঘড়ি করে শাড়ির আঁচল ঠিক করল। সামির তখন সঙ্গে সঙ্গেই অন্যদিকে ঘুরে গেছে। কিন্তু এতে অরার লজ্জা কাটল না। সে কোনোমতে ছাদ থেকে বেরিয়ে এলো দ্রুত পদে।

তার অবস্থা দেখে সামির অবাক। মনের ভুলেও কি সে এমন কিছু করেছে যে কারণে অরার মনে তার ব্যাপারে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে! কিন্তু সামীরের তো তেমন কিছু মনে পড়ে না।

নিচে নামতেই অরা চমকে গেল। রূপা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। অরা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” রূপা, তুই এতো দ্রুত আসবি বলিসনি কেন?”

” তোর বৌভাতে আমি আসব না শা-লি? কালরাতেই ট্রেনে উঠে গেছিলাম৷ তোকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য বলিনি।”

অরার খুশিতে কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সে রূপাকে আবার জড়িয়ে ধরল। রূপা ফিসফিসিয়ে বলল,” তোর আতঙ্ক কোথায়?”

” আমার আতঙ্ক মানে?”

” মানে তোর বর।”

” আমি জানি না।”

____________
ফুলবানু তার নিজস্ব রুম থেকে হাঁক ছাড়লেন,” নিলু, ও নিলু।”

” জ্বী আম্মা? কিছু বলবেন?” নীলিমা ঘর্মাক্ত দেহে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছেন। ফুলবানু মুখ কুঁচকে বললেন,” নতুন বউরে দেখলাম একটা পোলার সাথে জড়াজড়ি করতাছে। ওই পোলা কেডা?”

” এসব কি ধরণের কথা আম্মা? ছি, যাকে আপনি দেখেছেন সে রূপা। অরার বান্ধবী। চট্টগ্রাম থেকে এসেছে।”

” কি বললা? ওইটা মাইয়া? পোলাদের মতো চুল ছোট ক্যান? প্যান-শাট পরছে ক্যান? তার কি মাথায় আক্কেল নাই? ডাকো তারে। আমি তার সাথে দুইটা কথা বলব।”

” আপনি আবার ওর সাথে কি কথা বলবেন আম্মা?”

” কি বলব সেটা আমি বুঝব। তুমি তারে ডাকো।”

নীলিমা ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। আবার রান্নাঘরে ঢুকলেন। অনেক কাজ পড়ে আছে তার। শাশুড়ীর সাথে তর্ক করার সময় নেই।

সামির তার ঘরে বসে আছে, কম্পিউটারের সামনে৷ তার চুল অল্প ভেজা। কিছুক্ষণ আগেই গোসল সেরেছে। বাইরে থেকে রূপা তাকে দেখে বলল,” ড্যাম হট, এই তোর বরের ছোট ভাই-টাই নেই? তাহলে একটু লাইন মারা যেতো।”

” আছে তো একজন। সায়ান।”

” ওয়াও, তাহলে খুব শীঘ্রই আমি তোর জা হচ্ছি এটা কনফার্ম। ”

” তুই ফাজলামিটা একটু বন্ধ করবি রূপা? আমার ভালো লাগছে না।”

ফিরোজা বুয়া ডিশে চা নিয়ে সামিরের ঘরের দিকে যাচ্ছে। রূপা তাকে থামিয়ে বলল,” দাঁড়ান খালা, দাঁড়ান। এই চা কি আমার জিজাভাইয়ের জন্য?”

” জ্বী? এটা বড় বাবার জন্য।”

” ও আচ্ছা। তাহলে আপনি চলে যান। আপনার বড় বাবাকে চা দিবে তার বউ।”

ফিরোজা একবার অরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,” আচ্ছা।” তারপর চলে গেল। অরা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,” অসম্ভব। আমি ভুলেও ওই ঘরে যাব না।”

” তুই অবশ্যই যাবি৷ শুধু যে যাবি তা না। মিষ্টি করে বলবি, জানগো, তোমার চা নাও।”

” কি? তোর কি মাথাখারাপ?”

” না। এখনও হয়নি। কিন্তু তুই কথা না শুনলে আমার মাথাখারাপ হবে। আমি যেভাবে এসেছিলাম, সেভাবেই ট্রেনে উঠে বাড়ি চলে যাব। সেটাই কি চাস তুই?”

” প্লিজ, রূপা। তুই আমাকে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে বল। সেটাও আমি পারব। কিন্তু এই কাজ আমি পারব না।”

” তোকে পারতেই হবে। নাহলে আমি সত্যিই চলে যাব। আমাকে তুই চিনিস।”

রূপা কঠিন মুখে চেয়ে আছে। অরার দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। রূপা যেটা বলে সেটাই করে। একবার রাগ করে অরার সাথে সতেরো দিন কথা বলেনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চায়ের ডিশ হাতে নিল অরা। রূপা খুশি হয়ে অরার গালে চুমু দিয়ে বলল,” যা সিমরান, যা! জ্বি লে আপনি জিন্দেগী।”

অরা মন্থর পায়ে হেঁটে রুমের সামনে গেল। সামিরের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টায় একটু কাশল। অরাকে ঢুকতে দেখে বিস্মিত হলো সামির।

অরা কাঁপা হাতে চায়ের ডিশ টেবিলের উপর রাখল। কিন্তু রূপা যেটা শিখিয়ে দিয়েছিল সেটা বলতে পারল না। তার কণ্ঠ জড়িয়ে আসছে। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। সামির চা পেয়ে মৃদু হেসে বলল,” থ্যাংকস।”

অরা দাঁড়িয়ে রইল মূর্তির মতো। সামির প্রশ্ন করল,” কিছু বলবে?”

অরা দুই পাশে মাথা নেড়ে’ না’ বলল।

” মনে হচ্ছে তুমি কিছু বলতেই এসেছো। বলো সমস্যা নেই। আমি শুনছি।”

উফ, কি মুশকিল! একবার পেছনে তাকাল অরা। রূপা কোথাও নেই। অসভ্য মেয়ে তাকে বিপদে ফেলে নিজে পালিয়েছে। কত ফাজিল!সে সাত-পাঁচ ভেবে বলল,” চায়ে কি লবণ হয়েছে?”

” মানে? চায়ে লবণ!” সামির ভ্রু উঁচু করে তাকাল।

” স্যরি… চিনি।”

নিজের উদ্ভট আচরণে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলল অরা৷ সামির হেসে উঠল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। অরার ধুকপুকানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কি যে হলো, অরা বুঝল না। সামির ঝুঁকে এসে বলল,”আমি মিষ্টি চা খাই না, মিষ্টি টা খাই।”

এই কথা বলেই অরার ঠোঁটে টুপ করে চুমু দিয়ে দিল। অরার চোখ আতঙ্কে ঠিকরে বের হয়ে আসার উপক্রম। তার শরীর ইলেকট্রিক বিটারের মতো কাঁপছে। সামির বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই রূপা ঢুকল। সিটি বাজিয়ে বলল,” ও মাই গড!এটা কি হলো দোস্ত? হি ইজ দ্যা হিমেন। পুরাই বাম্পার হিট।”

অরা আবছা দৃষ্টিতে রূপার দিকে চাইল। রূপা তাকে ঝাঁকিয়ে বলল,” এটাই কি তোদের ফার্স্ট কিস ছিল? বল না, আ’ম সো এক্সাইটেড!”

অরা শুধু বিড়বিড় করে বলতে পারল,” তুইও দেখেছিস? মানে এটা কল্পনা ছিল না?”

তারপরেই নিজের জমে যাওয়া শরীরের ভর রূপার উপর ছেড়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল সে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে