রুপালি মেঘের খামে পর্ব-০৩

0
767

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

৩.
অরার ছোটবেলার স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে। একবার প্রি-টেস্ট এক্সামে রেজাল্ট খুব খারাপ করায় মা অর্ঘ্য স্যারকে চিকন বাঁশের কঞ্চি এনে দিয়েছিলেন। মা’রার জন্য নয়, শুধু অরাকে ভয় দেখানোর জন্য। এমনিতেও অর্ঘ্যকে অরা বেশ ভয় পেতো। সেদিন স্যারের হাতে কঞ্চি দেখে তার হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল।

মনে মনে সে ভেবেছিল, এই মা কি আদৌ তার আসল মা? কোনো মা বুঝি সন্তানকে এইভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়!

অরা পড়ার টেবিলে বসার সাথে সাথেই অর্ঘ্য লাঠি বের করল। অরার নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম। এই বুঝি রেজাল্টের বাহানায় কয়েক ঘা লাগিয়ে দিবে পিঠ বরাবর। কিন্তু না, অরাকে চূড়ান্ত অবাক করে দিয়ে অর্ঘ্য মটমট করে বাঁশের কঞ্চি ভেঙে কয়েক টুকরো করে ফেলল। অরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিষ্পলক।

অর্ঘ্য লাঠি ভাঙা শেষে টুকরোগুলো জড়ো করে অরার হাতে দিয়ে বলল,” ডাস্টবিনে ফেলে আসো। আমি বাচ্চাদের মা’রি না। যে ভয় পায়, সে চোখের ইশারাতেই ভয় পাবে। মে’রে-ধরে কাউকে ভয় দেখানো যায় না।”

অরা ফিসফিস করে বলল,” ঠিক বলেছেন, আপনার চোখের ইশারাতেই মানুষ খু’ন হয়ে যাবে। ওইরকম ভয়ংকর দু’টি চোখ থাকলে লাঠির আর দরকার কি?”

অরা কখনও মনের কথা প্রকাশ করে না। যা তার মনে আসে, তা সে মনে মনেই উচ্চারণ করে। এতে মন তৃপ্তি পায়। অর্ঘ্যের সামনে বসেই সে মনে মনে অনেক ধরণের কথা বলে। যা মুখ দিয়ে কখনও বলার সাহস হবে না।

একদিন অরা পড়া শেখেনি। সেদিন ভয়ে তার জ্বর চলে এসেছে। কিছুতেই আজ অর্ঘ্যের কাছে পড়তে বসবে না। কিন্তু অর্ঘ্য এতো বেশি নিয়মতান্ত্রিক ছিল যে রেগুলার পড়াতে আসে। একটা দিনও মিস করে না।

অরা সকাল থেকেই কাঁদছিল খুব। তারপর অরার মা সাবিরা বললেন,” ঠিকাছে, আজ পড়তে হবে না। কিন্তু একটা শর্ত। তুই সব পড়া আজকেই মুখস্ত করে আমার কাছে দিবি। যদি এটা করতে পারিস তাহলে আমি অর্ঘ্যকে আসতে নিষেধ করবো।”

অরা খুশিমনে রাজি হলো। মায়ের কাছে পড়া দেওয়া কোনো ব্যাপারই না। অর্ঘ্য স্যারের সামনে গেলেই সে ভয়ে পড়া ভুলে যায়। সকাল থেকে বসে সব পড়া মুখস্ত করল অরা। সাবিরা সন্তুষ্ট হলেন। অর্ঘ্যকে বলা হলো অরা অসুস্থ। তাই বিকেলে পড়াতে আসার দরকার নেই।

কিন্তু অর্ঘ্য হলো নাছোড়বান্দা। সে রাত দশটা বাজে এসে উপস্থিত হলো এক কেজি করে বেদানা, আপেল আর কমলা নিয়ে। অসুস্থ ছাত্রীকে দেখতে আসা।স্যারের এমন সিরিয়াসনেস দেখে সাবিরা ভীষণ খুশি হলেন। অর্ঘ্যকে ডিনার করে যেতে বললেন। কিন্তু অরা মোটেও খুশি হতে পারেনি। সাবিরা তাকে তখনি পড়তে পাঠিয়েছেন। কারণ সে সুস্থই ছিল।

সাবিরা বললেন,” ছেলেটা যখন এতো কষ্ট করে এসেছে, তুই বরং পড়তে বসে যা।”

কাঁদো কাঁদো মুখে রাত দশটা বাজেই অরাকে পড়তে বসতে হলো৷ সে পড়ছিল আর কাঁদছিল। অর্ঘ্যের সামনে কাঁদার সাহস নেই বলে একহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। সেদিন যেন কান্না বাঁধ মানছিল না তার। খুব রাগ হচ্ছিল। অরার লেখার খাতা পর্যন্ত ভিজে যেতে লাগল কান্নায়।

অর্ঘ্য হঠাৎ বিষয়টি লক্ষ্য করল। অরার দিকে গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,” অরা, এদিকে তাকাও।”

অরার হাত কাঁপা-কাঁপি শুরু হলো। কান্না থামার বদলে আরও বৃদ্ধি পেল। অর্ঘ্য অধৈর্য্য হয়ে অরার হাত থেকে কলম আর খাতা ছিনিয়ে নিল। অরা ভয়ে গুটিয়ে গেল। কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে। অর্ঘ্য অরার মুখ ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,” কি সমস্যা তোমার?”

অরা মাথা নিচু করে রাখল। কান্নার দমকে তার শরীর কাঁপছিল।নাক টেনে বলল,”কিছু না।”

এই বলে আবার কান্না শুরু। অর্ঘ্য বিস্ময় নিয়ে বলল,” কিছু না হলে কাঁদছো কেন? আমি কি তোমাকে মেরেছি?”

” না।”

” বকেছি?”

” না।”

” তাহলে তুমি কাঁদছো কেন?”

” আপনি আমাকে পড়াতে এসেছেন। তাই কাঁদছি। কারণ আপনাকে আমি একদম পছন্দ করি না।”

মুখ থেকে ছিটকে কথাগুলো বেরিয়ে যাওয়ার পর অরার সম্বিৎ ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের মুখ চেপে ধরল। এই কথাগুলো সে মনে মনে না বলে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেছে। কি সর্বনাশ!

অর্ঘ্য কয়েক পল বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। অরা ঢোক গিলে অনেক কষ্টে উচ্চারণ করল,” আ’ম স্যরি,স্যার।”

হঠাৎ ফুঁস করে একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল অর্ঘ্য। সে বলল,” স্যরি বলার প্রয়োজন নেই। কাল থেকে আমি আর আসব না। আজকের পড়াটা শেষ করো।”

অরা স্তব্ধ হয়ে গেল অর্ঘ্যের উত্তর শুনে। ব্যাপারটা তার বোধগম্য হচ্ছিল না। অর্ঘ্য গণিত বই হাতে নিল। কিছুই যেন হয়নি এমন ভাব নিয়ে অরাকে অ্যালজেবরা বোঝাতে লাগল। একটু পর অরা খুব অপরাধী কণ্ঠে বলল,” এই ঘটনার কিছু মা’কে বলবেন না প্লিজ। তাহলে মা খুব রাগ করবে।”

“ঠিকাছে, বলবো না।”

অর্ঘ্য সামান্য হাসল। অরা ওই প্রথম তার স্যারকে হাসতে দেখেছিল। সে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে সত্যি সত্যি অর্ঘ্য অরাকে আর কখনও পড়াতে আসেনি।

সাবিরা অর্ঘ্যের হঠাৎ পড়ানো বন্ধ করার বিষয়টি নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। এমন না বলে-কয়ে চলে যাওয়ার ছেলে তো অর্ঘ্য নয়! চলতি মাসের বেতনটা পর্যন্ত নেয়নি সে। হুট করেই নিরুদ্দেশ। ফোনটাও বন্ধ।

সাবিরা বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করলেন। এমন ভালো টিচার সচরাচর পাওয়া যায় না বলে ছেলেটার জন্য তাঁর ভীষণ আফসোস হলো। তারপর তিনি অরাকে স্কুলের কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন। যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। অর্ঘ্য অরার সিলেবাসের সব টপিক খুব যত্নের সাথেই শেষ করে দিয়ে গেছিল। সে বছর অরা জেএসসি’তে খুবই ভালো রেজাল্ট করে। আস্তে আস্তে কে’টে যায় সাতবছর।

অরা কখনও ভাবেনি এতোবছর পর সেই একই মানুষটির সাথে তার আবারও দেখা হবে। নতুন করে মন আবারও উদাস হবে। মানুষটি এখন আর তার শিক্ষক নয়। বরং তার জীবনসঙ্গী! এই মানুষটির সঙ্গে বাকি জীবন কাটানোর কথা চিন্তা করেই শিউরে উঠল অরা।

বাড়িতে সাজ সাজ রব। সামিরের ফুপু, খালা, মামীরা এসেছে অরাকে দেখতে। নীলিমা অরাকে বললেন গোসল করে তৈরী হয়ে যেতে। একটি গোলাপী জামদানি বের করে দিলেন। অরা গোসলের পর সেই শাড়িটা পরল। অন্তি তাকে মেকাপ করে দিয়েছে। মেয়েটার সাজ-গোজের হাত ভালো। মেকাপ করার পর অরা নিজেকে চিনতেই পারছিল না।

সামিয়া মুখে হাত দিয়ে বলল,” তোমাকে দেখতে এত্তো সুন্দর লাগছে ভাবি! ভাইয়া আজ দেখলে তো একদম ফিট হয়ে যাবে।”

অরার মুখ শুকিয়ে গেল। অস্বস্তিতে শরীর কুটকুট করতে লাগল। সামিরের পরিচয় জানার পর থেকে তাকে নিয়ে উল্টা-পাল্টা কল্পনাও আর আসছে না মনে। যাকে একসময় স্যার বলে ডাকতো, তাকে নিয়ে এসব কিভাবে চিন্তা করা যায়? ছি! অরা কোনোভাবেই মানতে পারছে না যে মানুষটি তার স্বামী!

সামিরই যে অর্ঘ্য এই ব্যাপারটি না জানলে বোধ হয় এতো অস্বস্তি লাগতো না। এখন জানার পর সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। এরকম কঠিন পরিস্থিতি কারো জীবনে না আসুক। রাত বারোটার আগ পর্যন্ত একবারও সামিরের সাথে অরার দেখা হয়নি।

বারোটার পর সামিয়া, অন্তি আর রিমা অরাকে বাসর ঘরে নিয়ে এলো। রিমা সামিরের কাজিন হয়। তিনজন তিনদিক থেকে অরাকে ঘিরে আছে। অরার একবার মন চাইল ছুটে কোথাও পালিয়ে যায়। কিন্তু সে সুযোগ নেই। তাকে বাসর ঘর নামক মরণ কূপে ঢুকতেই হবে।

বিছানার চাদরটি লাল আর সাদার মিশেলে তৈরী। ঘর সাজানো হয়েছে গোলাপ আর রজনীগন্ধা দিয়ে। এতোকিছু কখন হলো? রিমা ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে বলল,” ওয়াও, কি সুন্দর তাই না? ভাবি তোমার পছন্দ হয়েছে?”

অরা খুব জোরে শ্বাস নিল। ফুলের সৌরভটাও বিষাক্ত লাগছে। অস্বস্তি মিশে আছে বাতাসে। দমবন্ধ লাগছে।অন্তি অরার ডানহাতটা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। সে লক্ষ্য করল অরার হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে। সে হাঁপানির রোগীর মতো বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। অন্তি সামিয়ার দিকে চেয়ে বলল,” দ্যাখ অবস্থা, মেয়ে তো কাঁপছে।”

সামিয়া ফিসফিস করে বলল,” ভয় পাচ্ছো নাকি ভাবি?”

অরা হাসার চেষ্টা করল। একটুও সহজ হতে পারছে না। অন্তি ফিচেল হেসে বলল,” ভয় তো পাবেই। প্রথমরাত না? আমি অবশ্য ভেবেছিলাম সামির ট্রেনেই অর্ধেক কাজ সেড়ে ফেলেছে। কিন্তু অরার রিয়েকশন দেখে তো মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। সে একদম আনাড়ি।”

এই কথা শুনে কান গরম হয়ে গেল অরার। অন্তি তখন থেকে তাকে জ্বালানোর জন্য আজে-বাজে বলে যাচ্ছে। মেয়েটার মুখে কোনো লাগাম নেই। এসব শুনে অরার লজ্জা তো হলোই না বরং রাগে অস্থির লাগল। এই মেয়েটির সাথে রুপার বেশ মিল। সে এইখানে থাকলে অন্তির সাথে ভালো জমতো৷

রুপা অরার বেস্টফ্রেন্ড। প্রতিটি ইন্ট্রোভার্ট মেয়ের একটা এক্সট্রোভার্ট বেস্টফ্রেন্ড থাকতে হয়। যে পকপক করে সারাদিন কথা বলে মাথা ধরিয়ে দেয়। রুপা ঠিক সেই ধরণের মেয়ে। এই মুহূর্তে অরার রুপার সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে।

রিমা বলল,” উফ অন্তি আপু, তুমি এতো ঠোঁটকাটা! ভাবি এমনিই লজ্জা পাচ্ছে আর তুমি তাকে আরও লজ্জা দিচ্ছো।”

ঠিক এই সময় একটা অপ্রত্যাশিত কান্ড হলো। অরা হড়হড় করে বমি ছেড়ে দিল। অতিরিক্ত নর্ভাসনেসের কারণে সারাদিন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেনি সে। তাই গ্যাস্ট্রিকে এই অবস্থা। সামিয়া আর অন্তি তাকে দ্রুত বাথরুমে নিয়ে গেল।

সামিয়া বলল,” নতুন শাড়ি তো নোংরা হয়ে গেছে। এবার কি হবে আপু?”

অন্তি বলল,” কি আর হবে? শাড়ি বদলাতে হবে!”

রিমা প্রশ্ন করল,” আমি কি বড় চাচীর থেকে আরেকটা শাড়ি নিয়ে আসব?”

অন্তি নিষেধ করে দিল,” দরকার নেই। এখন আর শাড়ি পরিয়ে ওকে অস্থির বানাতে হবে না। মেয়েটার এমনিও শরীর খারাপ। একটা সুতির সেলোয়ার-কামিজ নিয়ে আয়।”

অন্তির কথা শুনে অরা কিছুটা স্বস্তি পেল। তার শাড়ি বদলানো হলো। সামিয়া অরার বেগতিক অবস্থা দেখে মায়ের কাছে ছুটে গেল। বিচলিত হয়ে মাকে জানাল,” ভাবির শরীর ভালো নেই মা। বমি করে সব ভাসিয়েছে।”

” বলিস কি?”

নীলিমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন অরাকে দেখতে। সামিয়ার ঘরে শুয়ে আছে অরা। অন্তি বলল,” আন্টি, ওর তো গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে।”

নীলিমা তাড়াহুড়ো করে বললেন,” রিমা, সামিয়া, দ্রুত অর্ঘ্যকে ডেকে আন।”

অরা সাথে সাথেই বাঁধা দিল,” না। যেও না। কাউকে ডাকতে হবে না।”

নীলিমা অরার গা স্পর্শ করে অস্থির কণ্ঠে বললেন,” কিন্তু তোমার শরীর তো খুব খারাপ মা।”

” আমি ঠিক হয়ে যাবো। প্যারাসিটামল আছে?”

সামিয়া বলল,” আছে, দাদীর ঔষধের বাক্সে পাওয়া যাবে।”

নীলিমা বললেন,” তাহলে দ্রুত নিয়ে আয়।”

প্যারাসিটামল খেয়ে অরা ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘুম ভাঙল সকাল দশটায়। ঘুমের মাঝে একবার সে অনুভব করল, কেউ বুঝি পাশে বসে আছে। তার হাতটা ধরেছে। কপালে কারো ঠোঁটের স্পর্শও সে পেল। চোখের পাতা ভারী লাগার কারণে অরা তাকাতে পারছে না। খুব কষ্টে একবার তাকাল। তখন দেখল সম্পূর্ণ ঘর ফাঁকা। কিন্তু দরজার কাছের পর্দাটা নড়ছে। অরা বিভ্রান্তবোধ করল। সত্যিই কি কেউ এসেছে? নাকি স্বপ্ন?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে