রুপালি মেঘের খামে পর্ব-০২

0
770

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

২.
ঝিকঝিক শব্দে রেলগাড়ি ছুটে চলেছে। জানালার সাথে মাথা ঠেঁকিয়ে বসে আছে অরা। তাদের গন্তব্য ঢাকা। অরা চট্টগ্রামের মেয়ে। আর সামির ঢাকার ছেলে। বিয়ের পর সে অরাকে নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। আরিফ সাহেব মাইক্রোর ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামির ট্রেনেই যেতে আগ্রহী। আসল ব্যাপার হলো শ্বশুরের টাকায় সে মাইক্রো ভাড়া নিতে চায়নি।অরার মন পড়ে আছে চট্টগ্রামে। নিজের বাড়িতে।

” অরা, তুমি কি ঘুমাচ্ছো?”

অরা চমকে উঠল। সামির তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভদ্রতা করে সে উত্তর দিল,” না। ঘুম আসছে না।”

সামির জড়তা ভেঙে সহজ হওয়ার চেষ্টায় বলল,” আমারও ঘুম আসছে না। চলো, আমরা তাহলে গল্প করি।”

এই কথা বলে সে অরার পাশে এসে বসল। গায়ের সাথে গা ঘেঁষতেই চমকে উঠল অরা। অস্বস্তি আর ভয়ে ঢোক গিলল। খানিক দূরে সরে বলল,” গল্প করার জন্য এতো কাছে আসার কি প্রয়োজন? দূর থেকেও তো গল্প করা যায়!”

সামির অরার একটা হাত ধরে নিজের বামগালে ছোঁয়ালো। অরা তার শরীরে তীব্র একটা ঝাঁকুনি অনুভব করল। সামির কেমন উষ্ণ কণ্ঠে বলল,” বিয়ে করা বউ তুমি আমার। কাছে আসবো না কেন? বিয়ের পর অনেক গল্প থাকে। যেগুলো কাছে এসে করতে হয়। দূরে বসা করা যায় না।”

অরার কণ্ঠ আরও শুকিয়ে গেল। খরখরে ভীত গলায় বলল,” মানে?কি গল্প?”

” বলছি। তার আগে…”

সামির কাছে এসে অরার গালে চু’মু দিতে নিবে, তখনি চেঁচিয়ে উঠল অরা।

চিৎকার শুনে ধড়মড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠল সামির। দ্রুত হাতে লাইট জ্বাললো। অবাক স্বরে প্রশ্ন করল,” কি হয়েছে অরা? ভয় পেয়েছো?”

অরা মুহূর্তেই বুঝতে পারল এতোক্ষণ যা হচ্ছিল, সেটা তার কল্পনা। সামির উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা প্ল্যাটফর্মে বসেও একইভাবে ভয় পেয়েছিল। তার কি কোথাও সমস্যা হচ্ছে? সামির ফ্রী মাইন্ডে কথাও বলতে পারছে না। অরা খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের। সে বোধহয় নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই পছন্দ করে।

সামির পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল,” পানি খাও।” অরা বোতলটি হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেল। নিজের আচরণে সে নিজেই বিরক্ত। মায়ের কাছে একটা প্রবাদ প্রায়ই শোনা হয়। মানুষকে বনের বাঘে না খেলেও মনের বাঘে খায়। হ্যাঁ, অরাকেও মনের বাঘে খাচ্ছে। সে খুব লজ্জিত গলায় বলল,” স্যরি, আমার জন্য আপনার ঘুমটা ভাঙল।

সামির কোমল গলায় বলল,” সমস্যা নেই। অন্ধকারে ভয় পেয়েছো নাকি? তোমার নিক্টোফোবিয়া নেই তো?”

” নিক্টোফোবিয়া? এটা কি জিনিস?”

” অন্ধকার ভীতি। কিছু মানুষের থাকে।”

অরার মোটেও অন্ধকার ভীতি নেই। বরং অন্ধকারে একাকি থাকতেই তার ভালো লাগে। কিন্তু এই কথা সামনের মানুষটিকে বুঝতে দিল না। পুনরায় লাইট বন্ধ হয়ে যাক এটা সে কোনোভাবেই চায় না। তাই মাথা নেড়ে বলল,” হুম, আমার অন্ধকারে ভয় হয়।”

” এই কথা আগে বলবে না? তাহলেই তো আমি লাইট বন্ধ করতাম না।”

অরা মুচকি হাসল৷ সামির বলল,” আচ্ছা, আর লাইট বন্ধ করছি না। এখন তাহলে ঘুমানোর চেষ্টা করো। বাড়িতে গিয়ে কিন্তু ঘুমানোর সুযোগ নাও পেতে পারো। এজন্যই আমি আলাদা কম্পার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছি। যাতে ঘুমের অসুবিধা না হয়।”

অরা প্রশ্ন করল,” বাড়ি গিয়ে ঘুমানোর সুযোগ পাবো না কেন?”

সামির হেসে জবাব দিল,” আমাদের বাড়িতে মানুষ থাকবে অনেক। গেস্টরাও আসবে নতুন বউ দেখতে। বেশি ভীরের মাঝে যদি তোমার ঘুম না আসে? তাই বললাম।”

” ও আচ্ছা।”

ঘুমাতেও ভয় লাগছে অরার। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়লে লোকটা যদি তার সঙ্গে উনিশ-বিশ ধরণের কিছু করে? অবশ্য করার হলে তো আগেই করতো। ঘুমের জন্য অপেক্ষা করতো না। অরা তার বিয়ে করা বউ। সে যখন খুশি অরার সাথে উনিশ-বিশ করতেই পারে। কিন্তু সে করেনি। একে একটু তো ভরসা করাই যায়। অরা অকারণেই ভয় পাচ্ছে এতো।

সামির আগের মতোই ব্যাগ ফোল্ড করে অরাকে বালিশ বানিয়ে দিল। আরামে ঘুমানোর ব্যবস্থা৷ ক্লান্ত শরীর নিয়ে অরা যেভাবে কাত হলো সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল। তার সেই ঘুম ভাঙল সকাল নয়টায়।

ততক্ষণে তারা ঢাকার রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে গেছে। এখান থেকে সরাসরি যেতে হবে উত্তরা। অরার ঘুম ভাঙল সামিরের ডাকে। এতো সময় ধরে ঘুমানোর জন্য কিছুটা লজ্জাবোধ করল সে। ট্রেন থেকে নেমেই তারা সিএনজিতে উঠল।

সামিরদের বাড়িতে প্রবেশ করার পাঁচমিনিটের মধ্যেই একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। কোথ থেকে আচমকা একটা মেয়ে এসে অরার হাতের বাহু খামচে ধরল। রাগান্বিত গলায় বলল,”এই মেয়ে, আমার বরকে কোন সাহসে বিয়ে করলে তুমি? জানো আমাদের কত সুখের সংসার ছিল? তোমার জন্য সেই সংসার জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। আমি তোমাকে ছাড়ব না।”

অরা স্তব্ধ। মুহূর্তেই তার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। কিছুই বুঝতে না পেরে সামিরের দিকে চাইল। সামির মৃদু হাসছে। আচমকা হেসে উঠল মেয়েটিও। অরার গাল টেনে বলল,” দ্যাখ দোস্ত, ভয়ে তোর বউয়ের মুখটা কেমন চুপসে গেছে! আহারে… বেশি ভয় পেয়েছো?তোমার সাথে মজা করলাম পাগলি! আমি সামিরের বেস্টফেন্ড হই। আমার নাম অন্তি।”

অদ্ভুত মেয়ে অন্তির সাথে বাকিরা সবাই জোরে হেসে উঠল। জোর করে হাসল অরাও। যদিও এমন মজা তার অসহ্য লাগল।

অন্তি অরার হাত বগলদাবা করে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ” সামিরের সাথে আমার পাঁচ বছরের ফ্রেন্ডশীপ। তুমি না থাকলে রিলেশনশীপটাও এতোদিনে হয়ে যেতো। কতবার যে প্রপোজ করেছি! শা’লা পাত্তাই দিল না।”

অরা বিড়বিড় করে বলল,” ভালোই হতো। তাহলে আমাকে আর কষ্ট করে এই ভয়ানক লোকটিকে বিয়ে করতে হতো না।”

নতুন বউ আসায় উৎসব লেগে গেছে বাড়িতে। অরা তো ভাবতেই পারেনি যে তার ‘হঠাৎ বিয়ে করা’ বরের বাড়ির মানুষ তাকে এতো সানন্দে গ্রহণ করবে।

অরার শাশুড়ী নিলিমা তার চিবুক ধরে চু’মু খেলেন। হাসি মুখে বললেন,” মাশআল্লাহ, তুমি তো একদম আগের মতোই মিষ্টি আছো। একটুও বদলাওনি।”

অরা অবাক হলো। একটুও বদলায়নি মানে? তার কি বদলে যাওয়ার কথা ছিল? ভদ্রমহিলা তো অরাকে আজ প্রথমবার দেখলেন৷ অথচ এমনভাবে কথা বলছেন যেন আগেও কতবার দেখেছেন।

সামিরের বিশাল পরিবার। ছোট ভাই, ছোট বোন, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী। সবাই অরাকে ঘিরে আছে। বিভিন্ন ধরণের গল্প করছে। সবার মাঝে বসে অরার আবার ঘুম পেতে লাগল। সে দুইবার হাই তুলল। প্রায় অরার সমবয়সী একটি মেয়ে বলল,”ঘুম পাচ্ছে নাকি ভাবি?”

অরা বুঝতে পারল এই মেয়েটিই তার ননদ। সামিরের আপন বোন সামিয়া। অরা লজ্জায় ঘুমের ব্যাপারে ‘না’ বলল। কিন্তু নীলিমা বললেন,” নিশ্চয়ই ঘুম পাচ্ছে। জার্ণি করে এসেছে না? অরা, তুমি বরং ঘুমিয়েই নাও। তার আগে একটু খেয়ে নাও। সকাল থেকে তো মনে হচ্ছে কিছুই খাওনি। মুখ শুকনো লাগছে।”

অরা হাসল। আসলেই তার খাওয়া হয়নি। সামিয়া তার হাত ধরে বলল,” এসো ভাবি। তোমাকে ভাইয়ার ঘরে নিয়ে যাই।”

নীলিমা বললেন,”এখন অর্ঘ্যের রুমে নেওয়ার দরকার নেই। রাতে একেবারে যাবে। এখন তোর রুমে নিয়ে যা। সেখানে ও একটু বিশ্রাম করুক।”

“ঠিকাছে মা।”

‘অর্ঘ্য’ নামটা অরার মাথায় আটকে গেল। খুব পরিচিত একটি নাম। কোথায় যেন শুনেছিল সে? পেটে আসছে অথচ মুখে আসছে না। উফ, কে যেন ছিল? হাজার চেষ্টা করেও নামটি মনে করতে পারছে না অরা।

খাওয়া-দাওয়ার পর সামিয়ার বিছানায় যখন তাকে শুতে দেওয়া হলো, তখন হঠাৎ অরার মনে পড়ল তার স্যারের নাম অর্ঘ্য ছিল। যেই স্যারকে সে যমের মতো ভয় পেতো। যার সাথে সামিরের চেহারার নব্বই শতাংশ মিল!

অরার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। ঠিক তখনি দেয়ালে ঝুলানো একটি ছবি নজরে পড়ল। ছোট একটা মেয়েকে কোলে নিয়ে চশমা পরিহিত একটা ছেলে বসে আছে। পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ড কালো। মেয়েটির মুখে প্রাণখোলা হাসি। কিন্তু ছেলেটির হাসি গম্ভীর। চোখ দু’টিতে রহস্য। অরার হাত-পা জমে গেল। এই ছবির মানুষটিই তো তার অর্ঘ্য স্যার! অরাকে হা করে দেয়ালে চেয়ে থাকতে দেখে সামিয়া বলল,” কি ব্যাপার ভাবি? ঘুম আসছে না?”

অরা কাঁপা কাঁপা হাতে দেয়ালের দিকে ইশারা করল।শিউরে ওঠা কণ্ঠে বলল,” ছবির ওই মানুষটি কে?”

সামিয়া হেসে বলল, ” ওইটা আমার আর বড় ভাইয়ার ছোটবেলার ছবি। বড় ভাইয়া ছোটবেলায় খুব কিউট ছিল, তাই না?”

অরা কোনো জবাব দিতে পারল না। সে কথা বলার অবস্থায় নেই। বড় ভাইয়া মানে তো সামির! আর সামির মানেই অর্ঘ্য। সাতবছর আগের অর্ঘ্য আর এখনকার অর্ঘ্যের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। অরা তো তার চেহারাও প্রায় ভুলতে বসেছিল। এজন্যই বুঝি সামিরকে চিনতে এতো সময় লেগেছে।

অরা খেয়াল করল, তার শরীর হঠাৎ কেমন অবশ হয়ে আসছে। চারপাশের সবকিছু ক্রমাগত ঝাপসা দেখছে সে। ফ্যানের সাথে পাল্লা দিয়ে মাথাটাও ভনভন করে ঘুরছে। পৃথিবীতে কি মানুষের অভাব ছিল? ৮০০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে বেছে বেছে কেন এই নির্দিষ্ট লোকটির সঙ্গেই তার বিয়ে হতে হবে? কেন? সে কি পাপ করেছিল?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে