রিভেঞ্জ পর্বঃ ০৭

0
2805

রিভেঞ্জ পর্বঃ ০৭
– আবির খান

নেহাল শুধু অপেক্ষায় আছে কালকের সকালের। আজ রাতে আর ঘুম হবে না নেহালের।

পরদিন সকালে,

নেহাল আজ মায়ের ডাকাডাকির আগেই ঘুম থেকে উঠে গেলো। রাতে বন্ধুদের নেহাল বলে দিয়েছে ভার্সিটিটা যেন সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। নেহাল তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে এসে রেডি হয়ে সোজা নিজে চলে যায়।

নেহালের মা নেহালকে এত্তো সকালে দেখে অবাক হয়ে যায়।

মাঃ নেহাল, বাবা তুই ঠিক আছিস?? কি হয়েছে বাবা তোর?? শরীর খারাপ?? তুই এত্তো সকালে উঠলি কি করে?? আশ্চর্য হয়ে।

নেহালঃ আরে মা এমন কিছু না। ঘুম ভেঙে গেছে তাই উঠে রেডি হয়ে গেলাম। এখন নাস্তাটা তাড়াতাড়ি দেও খেয়ে ভার্সিটিতে যাবো।

মাঃ এতো তাড়াতাড়ি??

নেহালঃ আজ একটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে মা। কাজ হলে তোমার ছেলে আজ অনেক খুশি হবে। তুমি দোয়া করো মা।

মাঃ আমার দোয়াতো তোর সাথেই আছে। কিন্তু তোরতো ভার্সিটি শেষ তাহলে আবার কীসের কাজ সেখানে??

নেহালঃ আছে মা আছে।

মাঃ আমাকে বলবি না??

নেহালঃ মা কাজটা হলেই সবার আগে তোমাকে বলবো। কারণ এরপরের কাজটা তোমার। হাহা।

মাঃ হায়রে কি এমন কাজ আল্লাহ জানে। নে নাস্তা খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর।

নেহাল তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে বাইক নিয়ে সোজা ভার্সিটিতে চলে আসে।

শামিমঃ মামা আসছিস?? দেখতো কেমন সাজালাম??

নেহালঃ আররে সেই হইছে। বাকিরা কই??

শামিমঃ ওরা ওদিকটা গোছাচ্ছে।

নেহালঃ আচ্ছা চল তাহলে।

নেহাল আর শামিম বাকিদের কাছে চলে যায়।

সালমানঃ ভাই এসেছিস?? দেখতো কেমন সাজালাম??

নেহালঃ আসলেই তোরা আমার ভাই। সেই হয়েছে। খুশি হয়ে।

নিলয়ঃ তনুকে এখানেই প্রপোজ করবি।

রাফিঃ তুই গাছের পিছনে লুকিয়ে থাকবি। আমরা তনুকে এখানে নিয়ে আসবো। তারপর তুই ওকে প্রপোজ করবি।

নেহালঃ অাচ্ছা। কিন্তু দোস্ত আমার অনেক লজ্জা করছে। স্যাররা কি বলবে??

শামিমঃ আরে স্যাররা পার্মিশন দিছে। কাউকে খুশি করতে চাওয়া কোনো অপরাধ না। আর আমরাতো এখন ভার্সিটি থেকে বেরই হয়ে গিয়েছি। সো নো টেনশন ডু প্রপোজ। হাহা।

বাকিরা সবাই হেসে দেয়।

সালমানঃ মামা নে এটা পরে আয়। তোকে হেব্বি মানাবে।

নেহাল দেখে ব্লাক সুট আর ব্লাক প্যান্ট সাথে হোয়াইট শার্ট।

নেহালঃ ভাই তুইও পারিস।

সালমানঃ যা তাড়াতাড়ি।

নেহাল ওয়াশরুমে চলে গেলো রেডি হতে। রেডি হয়ে সবাই অপেক্ষা করছে তনুর জন্য। অন্য স্টুডেন্টরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে নেহালের ঐতিহাসিক প্রপোজের সাক্ষী হতে৷ সবার মধ্যেই একটা উত্তেজনা ফিল হচ্ছে। সবাই শুধু অপেক্ষায় এখন তনুর। হঠাৎই একজন এসে বলল, ভাইয়া তনু আপু আসছে।

নেহাল গাছের পিছনে লুকিয়ে গেলো। বাকি স্টুডেন্টরা লাইন দিয়ে দুপাশে দাঁড়িয়ে তনুর জন্য নেহাল অব্দি রাস্তা করে দিলো।

তনুর আজ মনটা অনেক বেশি খারাপ। নেহালের সাথে আজ যেভাবে হোক কথা বলতেই হবে। তনু চিন্তিত বিষন্ন মন নিয়ে ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢুকে ভিতরে হেঁটে আসছে। তনু দেখছে আজ ভার্সিটিটা খুব সুন্দর করে সাজানো। ওর মনে হচ্ছে, হয়তো আজ কোনো অনুষ্ঠান তাই সাজিয়েছে। তনু সামনে আসতেই দেখে স্টুডেন্টের বিশাল বড় দুটো লাইন দুপাশে। মাঝখানে হাঁটার রাস্তা। সবাই ওকে এগিয়ে যেতে বলছে। তনু অনেক অবাক হচ্ছে এরকম দেখে। তনু সেই স্টুডেন্টের দুই লাইনের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তনু যত সামনে এগোচ্ছে তত ওর হৃদস্পন্দন বেড়েই চলেছে। হঠাৎ তনু দেখতে পায়, একটা গাছের নিচটা খুব সুন্দর করে সাজানো। তনু হাঁটতে হাঁটতে সেদিকটায় যেয়ে থামতেই নেহাল গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে তনুর সামনে হাটু গিরে বসে পরে। আর সেই সাথে উপর থেকে প্রথম গোলাপের পাপড়ির বর্ষন হয়। আর নেহাল একগুচ্ছ গোলাপ ফুল নিয়ে বলতে শুরু করে ওর মনে কথা তনুকে,

নেহাল-

তনু মনে আছে সেই সিনেপ্লেক্সের কথা?? সেদিন প্রথম তোমাকে দেখি। তুমি আমাকে বানর বলে আমার ভিতরে তোমায় নিয়ে দুষ্ট বুদ্ধি ভাবার পোকাটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলে। রিভেঞ্জ, এই রিভেঞ্জ নিতে গিয়ে তোমার এই বাচ্চাদের মতো কথা বলা, বাচ্চাপনা দেখে আমাকে তোমার প্রতি অনেক দূর্বল করে দিয়েছে। তোমার সব কিছু আমার অনেক ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তোমার এই বাচ্চাপনা। খুব কিউট লাগে তোমাকে তখন। জানি আমাদের পরিবারের মাঝের দূরত্ব অনেক কিন্তু আমি তা সব ঠিক করে নিবো। আজ আমি নেহাল, এই পুরো পৃথিবীর সামনে বলছি,

তনু আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। তোমার এই বাচ্চাপনাকে ভালোবাসি। দিবে আমাকে সেই সুযোগ তোমাকে সারাটাজীবন ভালোবাসার?? তোমাকে নিয়ে জ্যোৎস্নাবিলাস করার সুযোগটুকু আমাকে দিবে তনু??

তনুর চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। হাত-পা কেমন অবস হয়ে আসছে। তনু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে নেহালের প্রপোজ দেখে। ও কল্পনাতেও ভাবে নি আজ এমন কিছু হবে৷ ও কি ভেবে এসেছিলো আর কি হলো।

সব স্টুডেন্টরা তনুকে বলছে, সে ইয়েস…সে ইয়েস…সে ইয়েস। নেহাল আবার তনুকে বলল,

নেহালঃ তনু দিবে আমাকে সেই সুযোগ??

তনু এবার আর পারলো না। জোরে চিৎকার করে বলতে নিলেই সালমান উপর থেকে আবার ফুলের বর্ষন করে। কিন্তু সে ফুল বিষের মতো এসে লাগে নেহালের গায়ে। কারণ তনু চিৎকার করে বলেছিলো,

তনুঃ নাহহহহ।

বলেই তনু দৌড়ে চলে যায় ভার্সিটির বাইরে। উপস্থিত সবাই থ হয়ে যায়। কেউ ভাবেনি এমনটা হবে। গোলাপ ফুল গুলো এখনো উপর থেকে ঘুরে ঘুরে মাটিতে পরছে। নেহাল পাথরের মতো হয়ে গেলো। চোখগুলো তনুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। নেহাল ফুল হাতে এখনো সেভাবে বসে আছে। হঠাৎই নেহালের নয়নজোড়া থেকে এক-দু ফোঁটা করে অশ্রু ঝরতে শুরু করে। নেহালের হাত থেকে গুচ্ছ গোলাপগুলো সব পরে যায়। নেহালের বন্ধুরা নেহালের কাছেও যেতে পারছে না ভয়ে। কারণ ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা কিংবা কোনো কিছুই ওদের কাছে নাই। নেহাল ঠাস করে দু হাটু মাটিতে ছেড়ে দিয়ে বসে পরে। নেহালের মনে হচ্ছে, ওর বুকের বাম পাশে কেউ গুলি করেছে একটু আগে। এতোটা ব্যাথা করছে। নেহাল সে অবস্থায় বসে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।

নেহালের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হলো সালমান। তাই বাকিরা সালমানকে বুঝিয়ে নেহালের কাছে পাঠালো। সালমান ভয়ে ভয়ে নেহালের কাছে এগিয়ে গেলো। আর বললো,

সালমানঃ ভাই এভাবে বসে থাকিস না। আমাদের কষ্ট হচ্ছে। যা হওয়ার হয়েছে এখ….

নেহাল সালমানের দিকে মাথা তুলে তাকায়। সালমান নেহালের মুখ দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়। কারণ নেহালের চোখদুটো হিংস্র সিংহের মতো জ্বলছিল। লাল হয়ে ছিলো। কপালের রগ দুটো স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো। নেহালকে দেখলে এখন যে কেউই ভয় পেয়ে যাবে।

নেহাল আস্তে করে উঠে চুপচাপ ভার্সিটির মেইন গেইটের দিকে চলে যায়। সবাই নেহালে অগ্নিচক্ষু দেখেছে। কতটা কষ্ট আর রাগ সে চোখে যে দেখেছে সেই জানে। এতো বড় ধাক্কা খেয়ে সাথে লজ্জায় আর আপমানে নেহালের শরীর রীতিমতো কাঁপছে। নেহাল বাইকটা কোনোরকম স্টাট দিয়ে বাইকে জোরে পিকআপ দিয়ে ভো করে একটা বিকট শব্দ করে এই স্তব্ধতা ভেঙে চলে যায়। সবাই পুরো বোকা হয়ে যায়। কি হলো একটু আগে কেউই বুঝতে পারছে না।

নেহাল সোজা সেই ওর পছন্দের জায়গাটা চলে যায়। বাইকটা রেখেই দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় খালের পাড়ে এসে মাটিতে বসে পরে। আর শুরু করে কান্না। বুক ফাটিয়ে কাঁদে নেহাল। তনুকে কত্তো ভালোবাসতো ও। নিজের থেকেও বেশি। তনুকে ওর বুকের সাথে কতবার জড়িয়ে ধরেছে। কই একবারওতো তনু কিচ্ছু বলে নি। আজ সবার সামনে তনু এভাবে ওকে না বলল। নেহাল কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। পাড়ের ছোট ছোট ঘাসগুলো নেহাল রাগে আর কষ্টে টেনে ছিড়ে ফেলছে আর অঝোরে কান্না করছে। চিৎকার করে কান্না করছে। কিন্তু কেউ শুনছে না।

এভাবে নেহাল অনেকটা সময় সেখানে নিজের উপর নির্যাতন চালিয়ে অনেক রাত করে বাসায় চলে যায়। নেহাল সেদিন থেকে নিজেকে অন্ধকার রুমে বন্দী করে ফেলে। বাবা-মা বন্ধু-বান্ধব কারো সাথে কথা বলে না। নেহালের মা শত চেষ্টা করেও জানতে পারে নি নেহালের কাছ থেকে ওর কি হয়েছে। নেহালের বন্ধু-বান্ধবও এড়িয়ে গেছে নেহালের মায়ের কাছ থেকে ওরাও বলেনি।

নেহাল নিজেকে সম্পূর্ণ একা করে ফেলে। সারাটাদিন অন্ধকার রুমে একা বসে থাকে। খাবার সময় হলে নেহালের মা জোর করে এসে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে যায়। নেহালের মা বাবা নেহালের অবস্থা দেখে বেশ চিন্তিত। কিন্তু তারা কিছুই করতে পারছেন না। কারণ নেহাল এখন বেশ বড়। ওর ভালো মন্দ ও বুঝে। সারাদিন অন্ধকার রুমে পরে পরে ঘুমায়। কিন্তু একদিন হঠাৎ নেহালের ফোনটা অনেকক্ষন যাবত একনাগাড়ে বাজতে থাকায় নেহাল ফোনটা রিসিভ করে।

সালমানঃ দোস্ত নেহাল প্রেমা আমাকে বলল, তনুকে নাকি বরিশাল নিয়ে গেছে। ওকে নাকি কাল বিয়ে দিয়ে দিবে৷ তনু নাকি যেতে চায়নি। কিন্তু ওকে জোর করে নিয়ে গেছে বরিশাল।

নেহাল ফোনটা কেঁটে দেয়। ফোনটা বন্ধ করে পাশে ফেলে দিয়ে একটা ঘুম দেয়। ঘুম থেকে উঠে নেহাল ওর প্রয়োজনীয় কিছু জামা কাপড় আরো অনেক কিছু নিয়ে রেডি হয়। আজ দীর্ঘ ১০ দিন পর নেহাল ওর রুম থেকে বের হলো। সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে মায়ের কাছে এগিয়ে যায়।

মাঃ নেহাল?? বাবা কই যাচ্ছিস??

নেহালঃ মা আমাদের বাগানবাড়িতে ঘুরতে যাচ্ছি। আর বাবাকে বইলো আমার কার্ডের টাকা যেন শেষ না হয়।

মাঃ আচ্ছা সব হবে। তার আগে বাবা বল তুই ঠিক আছিস?? কাঁদো কণ্ঠে।

নেহালঃ মা আমি একদম ঠিক আছি। শান্ত গলায়।

মাঃ কিন্তু এত্তো দূর ঘুরতে যাবি একা??

নেহালঃ হ্যাঁ। এখানে ভালো লাগছে না। তুমিতো জানোই বাগানবাড়িটা আমার কত পছন্দের। আর বাবাকে বলো না আমি বাগানবাড়িতে যাচ্ছি। বলো বন্ধুদের সাথে সিলেট গিয়েছি।

মাঃ নেহাল, তুই আমার একমাত্র ছেলে তাই তোর সব আবদার, কথা আমি শুনি। কিন্তু তাই বলে তুইকি কোনো খারাপ কিছু করতে যাচ্ছিস??

নেহালঃ মা আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না?? আমি কি তোমাদের কোনো কষ্ট হোক এমন কোনো কাজ আজ পর্যন্ত করেছি?? তাই বলছি আমাকে বিশ্বাস করো। আমি ঘুরতে যাচ্ছি শুধু। এখানে ঢাকায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

মাঃ আচ্ছা। কিন্তু এতো দূরে একা থাকতে পারবি??

নেহালঃ রামু কাকা আছে না। সমস্যা নেই।

মাঃ আচ্ছা তাকে আমি বলে দিবো নে তোর সাথে থাকতে।

নেহালঃ আচ্ছা মা। তাহলে আমি আসি। পৌঁছে তোমাকে ফোন দিবো নে।

মাঃ আচ্ছা বাবা সাবধানে যাস।

এরপর নেহাল ওর বাইক নিয়ে ওদের বাগানবাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়। নেহাল আজ ঢাকা ছেড়ে আর সাথে সব খারাপ স্মৃতিগুলো ছেড়ে চলে যাচ্ছে ওদের বাগানবাড়িতে। হয়তো সেখানেই ওর একটু শান্তি মিলবে।

চলবে…?

কোনো ভুল হলে জানাবেন।

সবার অনেক বেশি সাড়া চাই। আর কেমন লেগেছে জানিয়েন কিন্তু।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে