গল্পঃ #রাঙা_বউ ( তৃতীয় পর্ব )
দাদীকে দেখে তিথিকে বুকের ওপর থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিলয় উঠে দাড়ালো। তিথিও তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়িয়ে দাদীকে বললো,– দাদী ইয়ে মানে স্লিপ কেটে আমরা একজন আর একজনের ওপর পড়েছিলাম।
দাদী ভ্রু কুঁচকে বললো,– পড়ে যাবার পর উঠে সরে যেতে এতক্ষণ লাগে! সিনেমার নায়ক নায়িকাও তো এত সময় নেয়না স্লিপ কেটে একজন আরেকজনের ওপর পড়ার পরে উঠে দাড়াতে! নাকি তোরা পড়ে গিয়ে একজন আর একজনের উপরে ঘুমিয়ে পড়েছিলি দুষ্ট দুইটা!
তিথি লজ্জা পেয়ে বললো,– কি জে বলো বুড়ী, ভাব দেখে মনে হয় এখনও বয়স কুড়ি।
তিথির কথা শুনে দাদী মুচকি হেসে ভাব নিয়ে বললো,– তো কি, শরীর বুড়ো হলেও মন কখনও বুড়ো হয়না বুঝলি।
দাদীর কথা শুনে নিলয় এবং তিথি দুজনেই হেসে ফেললো।
তিথি আবার দাদীকে বললো,– তো বুড়ী, তোমার জন্য কচি মনের বুড়ো খুঁজবো নাকি? বুড়ো তো তোমাকে ছ্যাঁকা দিয়ে স্বর্গে চলে গেল।
দাদী বললো,– তোর খুঁজতে হবেনা, ক্রাশ খাবার মতো কাউকে পেলে আমি নিজেই ক্রাশ খেয়ে নেবো।
তিথি হেসে বললো,– বুড়ী, এমনিতেই তোমার দাঁত নড়বড়ে, এই বয়সে ক্রাশ খেয়ে দাত ফেলে বিপদে পড়বা কিন্তু।
দাদী চেয়ার টেনে বসে বললো,– তোদের এমন রোমান্টিক দৃশ্য দেখে তাহার কথা মনে পড়ে গেলো রে, মনের পালঙ্কে নাক টেনে ঘুমানো প্রেম সজাগ হয়ে লাফিয়ে উঠে বসলো আবার।
চেয়ার টেনে নিলয় এবং তিথি বসলো দাদীর মুখোমুখি। তারপর বেশ আগ্রহ ভরে তিথি দাদীকে জিজ্ঞেস করলো,– কাহার কথা মনে পড়ছে দাদী?
দাদী ভেঙচি কেটে বললো,– কাহার আবার, তাহার কথা, আমার যৌবনের ক্রাশ, হ্যান্ডসাম হাঙ্ক।
: কে সেই হ্যান্ডসাম দাদী?
: কেডা আবার! তোর দাদা, আমার জীবনের ব্যক্তিগত সালমান খান।
তিথি হেসে ফেলে বললো,– বুড়ীর ঢং কতো, দেখে গা জ্বলে যায়।
দাদী হেসে বললো,– গা তো জ্বলবেই, তখন আমার সৌন্দর্যের কাছে তোদের মতো সুন্দরী ছিল তালের কাছে তিল পরিমাণ।
তিথি বললো,– হইছে! আচ্ছা দাদী তোমার আর দাদার তো প্রেম করে বিয়ে হইছিল, কাহিনীটা একটু বলবা প্লিজ।
: প্রেম কি আর এত সহজে হইছিল, তোর দাদা চোদ্দটা ইনজেকশন নেবার পরে ইমোশনাল হইয়া তাহার প্রেমে পড়ছিলাম।
: মানে কী দাদী! তখন কি প্রেমে পড়ার আগে চোদ্দটা ইনজেকশন নিতে হতো? এখন তো কুকুরে কামড়াইলে চোদ্দটা ইনজেকশন নিতে হয়।
: হা হা হা, ইনজেকশন তো নিতেই হতো, কারণ আমার মন পাওয়া আর বাঘের দুধ দিয়ে সেমাই রান্না করে খাওয়া সমান কথা ছিল। সেই অসাধ্য সাধন করার রিস্ক নিতে গিয়ে তোর দাদার চোদ্দটা ইনজেকশন নিতে হয়েছিল।
দাদীর কথা শুনে তিথির আগ্রহ চড়চড় করে বাড়ছে, বেশ কৌতূহলী হয়ে তিথি বললো,– ও সোনা বুড়ী, একটু বলোনা তোমার প্রেম কাহিনি প্লিজ।
তিথির আগ্রহ দেখে দাদী বলতে শুরু করলো–
তখন আমি নব যৌবনা, এলাকার রোমিও, মজনু, ফরহাদেরা আমার উপর ক্রাশ খেয়ে পেট খারাপ হয়ে একপ্রকার শয্যাশায়ী। আমার মন পাওয়া কি অত সোজা কথা। তারপর হঠাৎ একদিন তোর দাদা আমাকে দেখে ক্রাশ খেয়ে কেমনে যেন হজম করে ফেললো, মনে হয় লোকটার হজম শক্তি চরম লেভেলের ছিল। কলেজে যাবার পথে প্রতিদিন আমাকে ফুল দিতে দিতে ফতুর হয়ে গিয়েছিল লোকটা। একদিন রাতে আমাকে চিঠি দেবার উদ্দেশ্যে আমাদের বাড়িতে আসে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাদের কুকুর টাইগার তোর দাদাকে দেখে ফ্যালে। তারপর তোর দাদার পেছনে কামড়। এক হৃদয়বিদারক আর্ত চিৎকারে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। সবাই বাইরে বের হয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে কিছুই পেলাম না, আমরা ভেবেছিলাম চোর হবে হয়তো। কিন্তু পরদিন আসল ঘটনা জানতে পারি। তারপর ইমোশনাল হয়ে তোর দাদার প্রেমে পড়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিং করে তোদের পৃথিবীতে আনার মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করি। প্রথমে তোর বাপ চাচারা আসে, তারপর তারা তোদের ডাউনলোড করে, বুঝলি।
দাদীর কথা শুনে তিথি ও নিলয় হেসে অস্থির।
‘অনেক রাত হয়েছে, যে যার রুমে গিয়ে ঘুমা, আমিও যাই।’ বলে দাদী উঠে চলে গেল।
তিথি উঠে দু’পা এগিয়ে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালো।
নিলয় বললো,– কিছু বলবি?
‘না কিছু না’ বলে তিথি চলে গেল।
পরদিন তিথি সহ সবাই তিথির খালার বাড়িতে বেড়াতে গেল।
সারাদিন খালা বাড়িতে হাসি আনন্দে সময় কাটছে তিথির। কিন্তু নিলয়ের কেমন যেন লাগছে। সারাবিকেল বাইরে থেকে সন্ধায় ফিরতেই তিথি ধরলো– কি এতসময় বাইরে কি হুম, খুব আড্ডাবাজী শুরু হইছে তাইনা?
নিলয় আমতা আমতা করে বললো– আসলে এখানে তো তেমন কেউ পরিচিত নেই, তাই কেমন কেমন যেন লাগছে তিথি।
ঠাস করে নিলয়ের শার্টের কলার ধরে নিলয়ের চোখে চোখ রেখে তিথি বললো– পুরো পৃথিবী তোর অচেনা হোক, আমি চেনা হইলে হলো।
নিলয় শুকনো হাসি হেসে বললো– শোন বাইরে খুব মেঘ করেছে আকাশে, হয়তো বৃষ্টি হবে। কিছু খেতে দে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
বৃষ্টির কথা শুনে তিথির চোখেমুখে কেমন আনন্দের ঝিলিক দিয়ে উঠলো। কি যেন বলতে গিয়ে আবার বললো না তিথি।
খাওয়াদাওয়া শেষে সামনের একটা রুমে নিলয়ের পিছু পিছু এসে তিথি মশারী টানিয়ে দিয়ে বললো– ভাইয়া এই বৃষ্টির রাতে একটা কবিতা শুনাবি আমাকে।
নিলয় বললো– এখন এসব ভালো লাগছে না তিথি, পরে একদিন।
– আচ্ছা আমি কেয়া আপুর রুমে ঘুমাচ্ছি, কোনকিছু দরকার হলে আমাকে ডাকিস ভাইয়া– বলে তিথি চলে গেল।
অনেক রাতে হঠাৎ নিলয়ের ঘুম ভেঙে যায়, বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর মেঘের গর্জন। ক্ষানিক বাদে বাদে মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বিদ্যুৎ চমকে জাগিয়ে দিচ্ছে রাতের প্রকৃতি। জানালা দিয়ে বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা হাওয়া ঢোকার জন্যই নিলয়ের ঠান্ডা লেগে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।
হঠাৎ করে তিথির ঘুম ভেঙে যায়, চোখ মেলে নিজেকে ছাদে আবিষ্কার করে ভীষণ অবাক। এরপর তিথি বুঝতে পারলো সে নিলয়ের কোলে।
অতিথি কোল থেকে নামিয়ে নিলয় বললো– শুধু ঘুমালে তো হবেনা আমার ভবিষ্যৎ রাঙা বউ, মাঝেমধ্যে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। বৃষ্টিভেজা স্মৃতি মধুর হয় বুঝলি।
তিথি বললো– আমার ঠান্ডা লাগছে তো।
নিলয় মুচকি হেসে বললো– তুই কবিতা শুনতে চেয়েছিলিনা, আয় আমার বুকে, শক্ত করে জড়িয়ে ধর। আমার শরীরের উষ্ণতায় তোর ঠান্ডা দূর হয়ে যাক। আর আমি কবিতা শোনাই।
তিথি চুপচাপ এগিয়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিলয়কে।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে বিরতিহীন।
নিলয় কবিতা বলতে শুরু করলো–
বুকে আয় রাঙা বউ তুই,
বৃষ্টির এই রাতে,
ভালোবেসে ছুঁই।
চোখে রাখ চোখ,
সারারাত জেগে আজ,
শত কথা হোক।
ঠোঁটে ঠোঁট রাখ,
এভাবেই জড়িয়ে,
রাতভর থাক।
নিলয়ের বুকে মাথা রেখে তিথি যেন হারিয়ে গেছে দূর অজানার কোনো কল্পনার রাজ্যে, যেখানে একটা পৃথিবী জুড়ে শুধু দুজনের বিচরণ। ভালোবাসা ছাড়া কিছু নেই যেখানে।
হঠাৎ নিলয় বললো– চল এবার নয়তো বেশি ভিজলে ঠান্ডা লেগে জ্বর আসতে পারে। আবার।
তিথি সেভাবেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বললো– হোক জ্বর, থাকিনা আমরা এভাবেই রাতভর।
– পাগলামি করিসনা– বলে নিলয় তিথিকে আবারও পাজাকোলা করে কোলে তুলে নিচে নেমে এসে রুমের সামনে নামিয়ে বললো– ড্রেস চেঞ্জ করে শুয়ে পড় এবার।
তারপর নিলয়ও এসে শুয়ে পড়লো।
পরদিন বিকেল বেলা হঠাৎ তিথি নিলয়ের হাত ধরে টেনে বললো,– ভাইয়া এদিকে আয়, একটা ছেলের ব্যাপারে তোকে কিছু বলার আছে।
নিলয় ভীষণ অবাক হয়ে বললো,– একটা ছেলের ব্যপারে মানে, কোন ছেলে? আর এখানে বললেই বা সমস্যা কি?
তিথি বললো,– এখানে বলা যাবেনা, আয় আমার সাথে।
নিলয়কে টেনে তিথি তার খালাতো বোন কেয়ার রুমে এনে দরজা বন্ধ করে দিয়ে তিথি খাটের ওপর বসে বললো,– একটা ছেলেকে আমি ভীষণ পছন্দ করি ভাইয়া, কি করবো বুঝতে পারছি না, তাই ভাবলাম তোর সাথে শেয়ার করি।
নিলয় বললো,– আচ্ছা কে সে? নাম কি তার?
তিথি ফিসফিস করে বললো,– এভাবে বলা যাবেনা, কানে মুখে বলতে হবে। তোর কান আমার মুখের কাছে আন।
‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে নিলয় নুয়ে তার কান তিথির মুখের সামনে পেতে বললো,– এবার বল।
তিথি চোখের পলকে…
চলবে…
নিলয় আহমেদ।