রহস্য পর্ব_৫
#Sabiha_Rahman_Susmita
খাট থেকে ড্রেসিং টেবিল টা একটু দূরে,খাটের মাথায় বসে লাল রঙের শাড়ি পরে লাল লিপস্টিক দিচ্ছিল মেয়েটা।এমন সময় তার স্বামী এসে লিপস্টিক টা মুছে দিলো গভীর আলিঙ্গনে।
রিজভির আর দেখতে ভালো লাগে না এসব,বারবার পাশের শোহিনী-মোহিনীদের অন্ধকার ফ্ল্যাটের দিকে চোখ চলে যায়।কেমন যেন অশান্তি লাগে।
একয়দিনে এই দুই বোনের নাম জানে না এমন কোনো মানুষ এই এলাকায় আছে বলে মনে হয় না।মোহিনী মেয়েটার কথা তার বারবার মনে পরে।শোহিনী মারা যাবার পর এই মেয়েটার চোখে কেমন যেন এক ঔদাসীন্য ছিল!
বিকির হাতে শোহিনীর মোবাইলের গত এক মাসের কল ও ম্যাসেজ লিস্টের কাগজ। গত এক মাসে ৯০% কল আর ম্যাসেজ ই একটা নাম্বারের সাথে।ম্যাসেজগুলো পড়ে খুব ভালোভাবেও বুঝা যায় ছেলেটা তার বয়ফ্রেন্ড ছিল। বয়ফ্রেন্ড এর নাম্বার এর NID রেজিস্ট্রেশন বের করতে বলা হলো রফিক কে, এই ফাঁকে বিকি শোহিনীর বড় বোন কুহু কে কল দিল-
-হ্যালো,কুহু আপা,আমি বিকি বলছিলাম।
-জি,বলুন।
-আপা,আপনাদের পরিবারের, মানে আপনার বাবার পরিবারের তো একটা ব্রাহ্মণ আছ,তাই না? যাকে দিয়ে পরিবারের সব ধর্মীয় কাজ করানো হয়।
-জি।
-আপনি কি আমাকে তাঁর সন্ধান দিতে পারেন?মানে তার নাম আর মন্দির বা বাসা?
-উনার নাম হচ্ছে,অমল না, অতল না, উফফ ভুলে গেছি মিঃ বিকি।কিন্তু আমি উনার মন্দির চিনি।
-ঠিক আছে,তবে আপনি কি কাল একটু সময় দিতে পারবেন?আমাকে একটু সেই ব্রাহ্মণ এর কাছে নিয়ে যেতে হবে।
-আচ্ছা,কিন্তু কেন?
-আসলে একটু দরকার আছে।রাখছি তাহলে।
-আচ্ছা,একটু দ্রুত বের করুন আমার পরিবারের সবাই কি খুন হয়েছে নাকি সত্যি ই আত্মহত্যা?
ফোন টা রাখতেই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে এলো বিকির।অজিত বাবু এবং রমা সেন প্রকৃতপক্ষেই গলায় ফাঁসি আত্মহত্যা করেছেন এবং সম্ভবত সেটা ভোরের দিকে।
কিন্তু কেন!?কেন উনারা এভাবে আত্মহত্যা করতে যাবেন!? তবে কি শোহিনীর মৃত্যু ও আত্মহত্যা ছিল?নাকি অন্যকিছু?
রফিক ল্যাপটপ হাতে নিয়ে রুমে ঢুকলো,
-স্যার,যে মোবাইল নাম্বার টা দিয়েছিলেন সেটা একটা মহিলার নামে রেজিস্ট্রেশন করা নাম মালিহা হাসনাত।
-আচ্ছা,তবে হতে পারে এটা শোহিনীর বয়ফ্রেন্ডের মা এর এন আইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা।
আচ্ছা,বেশ কয়েকটা ম্যাসেজে দেখলাম শোহিনী তাওহীদ নাম মেনশন করে ম্যাসেজ লিখেছে।তার মানে তার বয়ফ্রেন্ডের নাম তাওহীদ।
আচ্ছা তবে তাওহীদ এর নাম্বার টা ট্র্যাক করো এখনি,আমার মনে হয় ওর এই নাম্বার টা অন আছে।দেখো কোথায় আছে।আজ রাতেই তাওহীদ এর সাথে দেখা করতে হবে।
তাওহীদ এর নাম্বার ট্র্যাক করে দেখা গেলো সুগন্ধার ৩নং রোডের ১২১ নং বিল্ডিং এ আছে তাওহীদ নামের ছেলেটি।
যেহেতু এই শহরে নতুন তাই বিকি অফিসের গাড়ি নিয়ে সাথে সাথে বের হয়ে চলে গেলো কম্পিউটারে দেখানো লোকেশনে।১২১ নং বিল্ডিং টা একটা ৪তলা পুরানো ডিজাইনের বিল্ডিং,নিচে একটা বুড়া দাড়োয়ান আছে, উনাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো তাওহীদ রা ৩তলায় ডান পাশে থাকে।সন্ধ্যা বাজে সাড়ে ৭টা,এই সময়ে তাওহীদ ঘরে থাকবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না,তবে একটু আগেই ট্র্যাক করে তো মনে হলো এতক্ষণ বাসায় ই ছিল।বিকি তাওহীদের মোবাইলে কল দিলো,রিসিভ করলো না কেউ।
এমন সময় গেইট দিয়ে একটা টুপি পরা ছেলে বের হলো,কি মনে করে বিকি আবার তাওহীদের নাম্বারে কল দিতেই ছেলেটার পকেটে বেজে উঠলো।ছেলেটা মোবাইল সাইলেন্ট করে পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটা শুরু করলো।
বিকি পিছু নিলো তাওহীদের।একটু পর পিছন থেকে তাওহীদ বলে ডাক দিতেই ছেলেটা পিছনে ফিরে তাকিয়ে দাঁড়ালো।
ল্যাম্পোস্টের আলোতেও দেখা যাচ্ছে ছেলেটার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি,চেহারায় এক রাশ বিষন্নতা।
-আমাকে ডাকছেন?আপনাকে কি আমি চিনি?
-না,চিনেন না মিস্টার তাওহীদ।
হাত বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বিকি “হ্যালো” বললো।
আমি সারজিল আলম বিকি,পিবিআই এর ইনভেস্টিগেটর।
সাথে সাথেই তাওহীদ এর মুখ টা কেমন যেন আরো ম্লান হয়ে গেলো।
তাওহীদ বললো-আপনাকে আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি?আমি একজন সাধারণ মানুষ।
-যদি ভুল করে না থাকি আপনি তো শোহিনীর বয়ফ্রেন্ড ছিলেন,রাইট?
-হ্যাঁ,ছিলাম।তো?
-আসলে শোহিনীর বাবা মা ও আজ সকালে আত্মহত্যা করেছে,জানেন নিশ্চয়ই?তাই এই কেইস টা নিয়ে একটু ভাবার সময় হয়েছে।
-দেখুন,শোহিনীর মৃত্যু নিয়ে আমি কিছুই জানি না,আমি ওর বয়ফ্রেন্ড ছিলাম,তবে এখন নেই।মৃত্যুর আগের দিন ও ছিলাম না।
-তার মানে!?
-আমরা বিয়ে করেছিলাম,আমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ ছিলাম।আমার জব টা হলেই ও কে উঠিয়ে আনতাম,কেন যে শোহিনী এমন করলো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
কথাটা বলেই চোখ মুছতে লাগলো তাওহীদ।
-আচ্ছা,শান্ত হোন।
আপনার সাহায্য আমার দরকার।তাহলে আমরা শোহিনীর মৃত্যু রহস্য বের করতে পারবো।
-বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
-শোহিনীর বোন মোহিনী কে পাওয়া যাচ্ছে না,তাকে কি কেউ কিডন্যাপ করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
-এমন কিছু তো কখনো আমাকে শোহিনী বলেনি।
কথা বলতে বলতে মসজিদের কাছে আসতেই তাওহীদ বিদায় নিয়ে মসজিদে চলে গেলো।
বিকির কাছে কেন যেন তাওহীদ ছেলেটাকে ভালোই মনে হলো।সে ভেবেছিল তাওহীদ এর কোনো হাত থাকতে পারে।তবে কাউকেই একদম বাতিলের তালিকায় ফালানো যাবে না।
রাতে অফিসের ডরমেটরি তে ডিনার করে শুয়ে সম্পূর্ণ কেইস টা গুছাতে লাগল মনে মনে।কখন যে ঘুমিয়ে গেলো টের পায়নি।
সকাল ৮টা
কুহু ও বিকি দাঁড়িয়ে আছে সোমনাথ মন্দিরে।ব্রাহ্মণ অতলেন্দ্র এর জন্য অপেক্ষা করছে তারা।
উনি পুজা দিয়ে এসে বসলেন তাদের সামনে,কুহু কে দেখে তিনি মুখ গম্ভীর করে রেখে বললেন,কি চাও তুমি আর এই মন্দিরে?
-না,গুরুজী,এভাবে বলবেন না।জানেন ই তো আমাদের কি বিপদ।
এমন সময় বিকি বললেন,আচ্ছা,আপনি তো উনাদের পরিবারের সাথে অনেক আগে থেকে জড়িত,তাই না?শোহিনী কে কোন যখন চিতায় পোড়ানো হয়েছে,আপনি তো ছিলেন।তাই না?
গুরুজী কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে বিকির দিকে তাকিয়ে বলল,আপনি কে?
সাথে সাথে কুহু বলল,গুরুজী ও আমার দেবর।
-ও আচ্ছা,তাই বলো।।শুনো বাবা,কোনো মুসলিম মেয়ে আমরা আমাদের চিতায় পুড়িয়ে অমঙ্গল করতে চাই না।এই মেয়েকে আমাদের চিতায় পোড়ানো হয়নি।ও কে এক জায়গায় মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছি।
কুহু অবাক হয়ে বলল,কি বললেন?শোহিনী মুসলমান হয়েছিল!?
-কেন?তুমি জানো না কিছু?
অবাক হয়ে বললো ব্রাহ্মণ।
এমন সময় আরেকজন পুরুহিত এসে গুরুজী কে ডাক দিলেন,এই ফাঁকে বিকি কুহু কে বলে দিলো যেন কুহু শোহিনীর কবর এর জায়গার কথা জানতে চায়।
গুরুজী অতলেন্দ্র ঠাকুর ফিরে আসলেই কুহু কান্না করে বলতে থাকে,গুরুজী আমাকে একটু জায়গা টা বলুন কোন কবরস্থান?
-না,একদম গোপন কথা,এগুলো কাউকে বলা যাবে না।
সাথে সাথেই কুহু উনার পায়ে ধরে বসে পরলো-গুরুজী,আমার খুব আদরের বোন ছিল,আমি শুধু এক পলক ওর কবর টা দেখতে চাই।আর কাউকে বলব না।
গুরুজী যেন বিপাকে পরলেন,অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন জায়গাটির নাম।কিন্তু সেটা কোনো কবরস্থান নয়,এক জঙ্গলের পাশে দেয় হয়েছে সেই কবর।
মন্দির থেকে বের হয়ে বিকির মনে হলো যেন সে একটা আশার আলো দেখলো,শোহিনী কে পোড়ানো হয়নি।তাকে কবর দেয়া হয়েছে,আর সে মারা গেছে মাত্র ৩দিন।এখনো লাশ পঁচেনি।দ্রুত যেতে হবে কবরের কাছে।জায়গাটার বেশ দূর।
তবুও কুহু ও নাকি যাবে বিকির সাথে।
বিকি ফোন করে কিছু ফোর্স চাইল অফিস থেকে,তারপর ই রওনা হলো তারা শোহিনীর কবরের উদ্দেশ্যে।
স্পটে পৌঁছানোর পর জঙ্গল এর এক কোনায় পেলো শোহিনীর কবর।গুরুজী ভুল বলেনি,একদম যেখানে বলেছে,সেখানেই আছে।এবং কবরস্থান না হলেও সেখানে শোহিনীর নাম লিখা একটা নামের ছোটো ফলক ও আছে,সম্ভবত তার বাবা এটা করে দিয়েছেন।
ফোর্স এসে কবর খোঁড়া শুরু করলো,কিছুক্ষণের মাঝেই বেরিয়ে এলো সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশ।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে লাশ টা থেকে কোনো গন্ধ আসছে না,কেমন যেন ফ্রেশ লাগছে।মুখ থেকে মাটি সরাতেই আতকে উঠলো বিকি ও কুহু!
এটা শোহিনীর লাশ নয়……
এটা একটা পুরুষ লাশ!
চলবে….