#রজনী_প্রভাতে (পর্ব-৯)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
১৭.
তটিনীর আজ সিটি ছিল। আগের দিন সারা রাত জেগে ধুমধাম পড়েছে সে। এতদিনের পড়া একরাতে পড়তে গিয়ে মাথা গ’র’মও করে ফেলেছিল। সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে এসে দেখল সিটি আজ হচ্ছে না। স্যার আসেননি। নিজের এক রাতের ভো’গান্তির কথা ভেবে তার ক’ষ্টে বুকটা ফেঁ’টে যাচ্ছে। ক্যাম্পাস থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়েছে সে বাড়ি গিয়ে আগে একটা ঘুম দেবে এই ভেবেই। কিন্তু পথে তার দেখা হয়ে গেল তাযীমের সাথে। সেই আয়রার বিয়ের সময় প্রথম সাক্ষাৎে যেমন ফর্মাল গেট আপে দেখেছিল এখনও তেমনিই ফর্মাল গেট আপেই সে দাঁড়িয়ে আছে জারুল গাছের নিচে। সে একা নয় অবশ্য। সাথে তার বয়সী আরো দুজন যুবক আছে। মনে হচ্ছে বন্ধু। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে বেশ হাসি ঠাট্টা করছে তারা। তটিনী নিজের দিকে খেয়াল করল। আজ এত বি’শ্রী ভাবে তৈরি হয়েছে সে! মুখে একটু ক্রিম পর্যন্ত দেয়নি, জামাটাও আয়রন করা ছিল না। চুলটা কোনো রকম বাধা। তার ভীষণ অ’স্ব’স্তি লাগল এই ভেবে যে তাযীম তাকে এভাবে দেখে ফেললে কি ভাববে। তৎক্ষণাত তার মস্তিষ্কে এই চিন্তারও উদয় হলো, তাযীমের ভাবাভাবি দিয়ে তার কী কাজ? আশ্চর্য! তার মাথায় এমন একটা চিন্তা এলো-ই বা কেন?
তটিনী আপনমনে হাঁটতে লাগল। কোথায় কে আছে না আছে এতকিছু ভাবনায় আর মন দিল না। একটু হাঁটার পরেই পেছন থেকে ডাক এলো। তটিনী শুনেও না শোনার ভান করে হাঁটতে লাগল। তার হাঁটার গতি মোটামুটি কমই ছিল তাযীম একটু দ্রুত হেঁটেই তাকে ধরতে পারল।
-‘এই মেয়ে ডাকছি শুনছ না?’
তটিনী পাশ ফিরে তাকালো তাযীমের মুখের দিকে। বাহ্! লোকটার মুখ বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। খোশ মেজাজেও আছে বোধ হয়। এত খুশির কারণ কী?
-‘কি? এতক্ষণ ডাকছিলাম শোনোনি আর এখন দেখছি হা করে তাকিয়েই আছো। এভাবে তাকানোর দরকার নেই। আমি জানি আমি সুন্দর। তুমি রাস্তায় খেয়াল করো, এ’ক্সি’ডে’ন্ট হতে পারে।’
তটিনী ভীষণ ল’জ্জা পেল। সে তাযীমকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে নিজের মতো চলতে লাগল। তাযীমও পাশাপাশি হাঁটছে। তটিনী বি’র’ক্ত হয়ে বলল,
-‘কি সমস্যা? আপনি আমার পেছন পেছন কেন আসছেন?’
-‘আমি তো হাঁটছি। রাস্তায় হাঁটছি। তোমার সামনে আর পেছনে কি? আমি আমার মতো হাঁটছি।’
তটিনী দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা রিকশা যাচ্ছে। সে ডাক দিলো, তাযীম তাড়াতাড়ি করে তটিনীকে টেনে নিয়ে একটু সামনে গিয়ে একটা গাড়ির দরজা খুলে তটিনীকে বলল,
-‘চলো, আমি পৌঁছে দিচ্ছি তোমায়।’
তটিনী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ক্ষি’প্ত গলায় বলল,
-‘আগেও একবার বারণ করেছি এসব আমার পছন্দ না। আপনার সমস্যা কী? আমি আপনার সাথে সত্যিই তর্কে যেতে চাই না।’
-‘যেও না। গাড়িতে ওঠো।’
-‘উঠব না। হুকুম করছেন?’
-‘না। চাইলে করতেও পারি।’
-‘আপনার হুকুম আমি মানলেই তো?’
-‘এত রা’গ করছ কেন? আমরা নরমালি কথা বলতে পারি!’
তটিনী খেয়াল করল সে শুধু শুধুই এত রা’গ দেখাচ্ছে। একটু বেশিই হয়ে গেছে কি ব্যাপারটা?
-‘আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।’
তটিনী চমকে উঠল। কি বলতে চায় তাযীম তাকে? তাযীম আরেকবার মৃদু গলায় বলল,
-‘গাড়িতে ওঠো।’
কেন যেন তটিনী গাড়িতে উঠে বসল। তাযীমও দেরি না করে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। প্রথমে কিছুক্ষণ সবটা নিরব ছিল। নিরবতা ভেঙে তটিনীই বলল,
-‘কি বলতে চান?’
তাযীম তটিনীর দিকে এক বার তাকালো। খুবই শান্ত দৃষ্টি। তটিনীর গা ছমছম করে উঠল। তাযীম কিছুই বলল না। তটিনী তবুও কিছু শোনার আশায় বসে ছিল। অবাক করা ব্যাপার তাযীম একটা কথাও বলেনি গাড়িতে। তটিনীও কেন যেন আবার জিজ্ঞেস করতে পারল না কেন যেন মনের মধ্যে কোথাও তাযীমের বলতে চাওয়া কোথাটা কেউ বলে দিয়েছে তাকে। তটিনীর বাড়ির সামনে গাড়ি থামানোর পরই তাযীম বলল,
-‘তুমি আমাকে নিয়ে কী ভাবো?’
তটিনী এমন প্রশ্নের আশা করেনি। কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
-‘কি ভাবব?’
-‘জানি না। ভালো খা’রা’প কিছু তো একটা ভাবো।’
-‘আপনার জানার কথা তো।’
-‘না, যেটা সচরাচর দেখা যায় বা জানা হয় আসলে সেটা হয় না। আমার মনে হচ্ছে আমি যা জানি যা দেখি তাতে ভুল আছে। তুমি আমাকে ম’ন্দ বাসো না।’
তটিনী বুঝতে পারল না ম’ন্দ বাসাটা। সে আনমনেই বলল,
-‘হ্যাঁ ভালোবাসার মধ্যে আবার ম’ন্দ বাসা কী?’
তাযীম তটিনীর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই তটিনী বুঝল ভুলভাল বলে ফেলেছে। সে এটা বলতে চায়নি কিন্তু বলে ফেলেছে।
-‘আমি বলছিলাম আসলে ম’ন্দ বাসা বলতে তো কিছু নেই। যা আছে সব তো ভালোবাসা।’
তাযীম হেসে ফেলল। তটিনী আসলেই বুঝে উঠতে পারছে না। অতিরিক্ত স্ট্রেস নিয়ে ফেলছে সে। গাড়ি থেকে নেমে সে ভাবল তাযীমকে বলবে ভেতরে যেতে কিন্তু তাযীম খুব দ্রুতই চলে গেল। কোনো কথা শুনল না আর।
তটিনীর অবচেতন মন কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে উ’ত্ত’জি’ত হয়ে পড়ে তাতে। তাযীম কি কোনো ভুল বার্তা নিয়ে যাচ্ছে? না! তেমনটা যেন একদমই না হয়। একদমই না।
১৮.
পরদিন সকালে তটিনী ঘুম থেকে উঠে দেখল ছোট ফুফু এসেছেন। আয়রাও নাকি আসবে। হঠাৎ উপলক্ষটা কি সে বুঝতে পারল না। চন্দ্রমল্লিকা বারান্দায় বসে যোগ ব্যায়াম করছিল। তটিনী গিয়ে বলল,
-‘কি হয়েছে আপা? বাড়িতে আজ কিছু আছে? ছোট ফুফু এলো এত সকালে এখন আবার বড় মামারা এলেন। ব্যাপার কী? তুমি কি চলে যাচ্ছো?’
চন্দ্রমল্লিকা অন্য সবার মতো বি’র’ক্ত হলো না একসাথে এত প্রশ্ন শুনে। সে ধীরে সুস্থে বসা থেকে উঠে দুই হাত উপরে তুলে এক পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘তোর বিয়ে।’
তটিনী হেসে ফেলল। বলল,
-‘ধুর! তুমি মজা করছ কেন? কি হয়েছে বলো না? এই এই! তুমি চলে যাচ্ছো আপা?’
চন্দ্রমল্লিকা এবার স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে তটিনীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘মজা করব কেন? সত্যিই বলছি।’
-‘আচ্ছা বলো তো কে সে? আমার হবু স্বামীটা কে? কোন দেশের রাজপুত্র!’
তটিনীও ভাবল বোনের সাথে মজার সুর মেলানো যাক। কিন্তু চন্দ্রমল্লিকা তাকে আসলে মজা নয় সত্যিই বলছে এমন ভাবে বলল,
-‘রাজপুত্র তো বটেই। সে দেখতে ভারী চমৎকার।’
তটিনীর মনে হলো চন্দ্রমল্লিকা মজা করছে না। সে জোর করে বোনের হাত চেপে ধরে বলল,
-‘এই আপা মজা করছ তাই না?’
-‘ধুর! মজা করব কেন? সত্যিই তোর বিয়ে। আজকে জাস্ট বিয়েটা পড়ানো হবে। অনুষ্ঠান হবে পড়ে।’
-‘কি! কি বলছ? কার সাথে?’
-‘তাযীম ভাইয়ার সাথে। ওই যে কাল যার গাড়ি করে এলি।’
চন্দ্রমল্লিকা চোখ টিপ দিল ইশারা করে। তটিনীর মনে হলো পায়ের তলার মাটি কাঁপছে। সে ধপ করে বেতের সোফায় বসে পড়ল। আসলেই সত্যি বলেছিল চন্দ্রমল্লিকা। দুপুর গড়াতেই তাযীমরা ঠিকই এসেছিল। বিয়েটাও সময় মতোই পড়ানো হলো। মাঝে যা ঘটেছে তা ঘটার ছিল। পরিবার থেকে একটু চাপ মনের মধ্যে থাকা কিছু অনুভূতি সব মিলিয়ে তটিনীকে রাজি হতেই হলো। সত্যি বলতে অন্য উপায় ছিল না। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ গুলো বোধহয় এমনই। চায় না তবুও হুট করেই হয়ে যায়।
#চলবে।