রজনী প্রভাতে পর্ব-০৮

0
504

#রজনী_প্রভাতে (পর্ব-৮)
লেখনিতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

১৫.
গায়ে হলুদ জমকালো আয়োজনে পালিত হচ্ছে। এত সুন্দর সুসজ্জিত অনুষ্ঠানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ করছেন এলাকাবাসী, আত্মীয় স্বজন সকলেই। আয়রার বাবা চাচারা তাতে তৃপ্ত এবং একই সাথে সন্তুষ্ট তাযীমের উপর। ছেলেটাই তো দায়িত্ব নিয়ে সবটা করেছে।

হলুদ পর্ব শেষ হতে চলেছে অথচ তটিনী তখনও আয়রাকে হলুদ ছোঁয়াতে আসেনি দেখে চন্দ্রমল্লিকা গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। হলুদ ছুঁইয়ে তটিনী বাধ্য হয়ে একপাশে একটা টেবিলে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে। তখন গান বাজনা শুরু হয়ে গেছে। কেউ নাচছে না। এমনিতেই গান বাজছে। আপাতত তেমন কেউ ছাদে নেই। অধিকাংশ মানুষ খাবার খাওয়ার জন্য নিচে গার্ডেনের দিকে চলে গেছে। আয়রা স্টেজে আছে তার ফটোসেশন চলছে। সাথে তার ফুফাতো বোনগুলো আছে। এক পাশে মৈথীকেও দেখা যাচ্ছে। আয়রা রা’গ করবে দেখেই সে বসে আছে নয়তো চলে যেতো। ভালো লাগছে না তার।

খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবুক হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর তার সামনে কেউ একজন কোকের বোতল ধরতেই সে চমকে উঠল। তাযীম! সে উঠতে চাইলে পারে না। বরং তাযীম তার সামনে চেয়ার টেনে বসে। আর বাম পা দিয়ে তটিনীর বের হওয়ার পথও বন্ধ করে দেয়। ক্ষি’প্ত তটিনী অ’গ্নি দৃষ্টি নি’ক্ষে’প করলেও টলে না যুবক। ঠোঁটে তার দু’ষ্টু হাসি। উপায় না পেয়ে তটিনী আর নড়ল না এমনকি কোনো কথাই বলল না। মুখ ফিরিয়ে নিলো। কিছু সময় কেটে যাওয়ার পরও তাযীম সরে যাচ্ছে না দেখে সে পুনরায় তাকালো তাযীমের দিকে। তাযীম তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তটিনী চোখের ইশারায় তাকে বোঝালো যে সে যেন সরে যায়। তাযীম যেন সেটা বুঝেও বুঝল না। নিজে আবার ইশারা করল তটিনীর ডান গালে। যেখানটা লাল হয়ে আছে। দেখেই মনে হচ্ছে বেশ ঘষা মাজা করা হয়েছে এই জায়গাটায়।

তটিনী হাত দিয়ে দুই গাল ঢেকে বসে রইল। আবার অ’স’ভ্যটা তাকে চু’মু খাবে এই নিয়েই ভ’য় পায় সে। এক চু’মুতেই তার যাই যাই অবস্থা হয়েছে আবার কিছু হলে সে তো চলেই যাবে। এত বার গাল ঘষে ধুঁয়েছে যে এখন চামড়া জ্ব ল ছে তার।

-‘এই তোমরা দুজন কি করছ এখানে?’

মৈথী আসতেই তাযীম সরে বসল। সুযোগ পেয়ে তটিনী উঠে দাঁড়ায় এবং আয়রার কাছে এগিয়ে যায়। মৈথীর এই হুট করে চলে আসাটা তাযীমের পছন্দ হলো না। সেই সাথে তটিনী চলে যাওয়াতে তার রা’গ ও হলো।

মৈথী তাযীমের পাশে চেয়ার টেনে অবাক সুরে বলল,

-‘আশ্চর্য! মেয়েটা এভাবে চলে গেল কেন? কি কথা হচ্ছিল আপনাদের!’

তাযীমও কোনো জবাব না দিয়েই উঠে পড়ল। মৈথী পেছন থেকে ডাকলেও শুনল না যেন এমন ভান করেই নিচে নেমে গেল সোজা। আনমনেই কত কিছু ভেবে বসল মৈথী। দূরে আয়রার সাথে হাসি মুখ করে ছবি তুলতে থাকা তটিনীর দিকে সরু দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ব্যাপারটা তার মোটেও ভালো লাগল না।

________________________
পরদিন তাযীমের সাথে তটিনীর আর দেখা হলো না। সে যথা সম্ভব নিজেকে আড়াল রেখেছে। আয়রার বিদায়ের পর পরই তটিনীরাও সপরিবারে নিজ বাড়ির দিকে রওনা হয়। তটিনী, চন্দ্রমল্লিকা আর মোর্শেদ তাদের বড় ফুফুকে নিয়ে এক গাড়িতে ছিল। কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তার এক পাশে গাড়িটা থামানো হয়। তটিনী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ গাড়ি থামানোর কারণটা তার বোধগম্য হলো না। একটু পরেই আরেকটা গাড়ি সামনের থেকে আসতেই দেখা গেল মোর্শেদ গাড়ি থেকে নেমে সেই গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তটিনী কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করে দেখল ওই গাড়ি থেকে তাযীমকে বের হতে। তটিনীকে দেখে তাযীম হাসল। তটিনী দ্রুত মাথা ভেতরে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। একটু পর তাযীম তার জানলার পাশেই এসে দাঁড়ালো। চন্দ্রমল্লিকা আর বড় ফুফুর সাথে কথা বলল তাদের বিদায় জানালো। তটিনীর সাথে কথা হলো না কোনো। মোর্শেদ তটিনীকে ধ’ম’কে উঠল,

-‘এই টিনী! বে’য়া’দ’বি করছিস কেন? সালাম দে যীমকে।’

তাযীম কথাটা শুনে তাকিয়ে রইল তটিনীর দিকে। তার চোখটাই যেন কথা বলছে, ‘দাও, সালাম দাও।’

তটিনী সালাম দিলো। সুর করে সেই সালামের জবাব দিতে তাযীমও ভুলল না। তাযীমকে বিদায় দেওয়ার পর মোর্শেদ বলতে থাকে,

-‘কি ভালো একটা ছেলে দেখলি! ওদের বাড়ি থেকে আসার সময় আমাদের সাথে দেখা হলো না, ও বাহিরে ছিল বন্ধুদের সাথে, আমরা চলে যাচ্ছি শুনে বিদায় দেওয়ার জন্য কত দূর ছুটে এলো। টিনী! তুই যে ওকে সম্মান দিস না অথচ ও সবার আগে তোর খবর নেয়। ছোট বোনের মতো ভালোবাসে ও তোকে। আর তুই কিনা এত বা’জে ব্যবহার করিস।’

তটিনী চুপ করে সবটা হজম করল। ছোট বোনের মতো ভালোবাসে! এই ছেলে তার সাথে যা করেছে তা যদি সে একটু বলতে পারত কাউকে! বললেও কি? কেউ বিশ্বাস করবে? তাযীমকে কেউ অবিশ্বাস করে না। যা করার তটিনীকেই করবে।

১৬.
তটিনীর নানু হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়াতে আয়রার বৌ ভাতে তটিনীদের কারো যাওয়া হলো না। তারা সেদিন রাতেই রাজশাহী তার নানুর বাড়িতে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে নানুর অবস্থা কিছুটা ভালো আগের থেকে। কিন্তু তারপরও তটিনীর মায়ের মন মানছিল না দেখে তারা আর ফেরেনি। এক সপ্তাহের মতো সেখানে থাকে। চন্দ্রমল্লিকাও নানুর বাড়ির সকলের সাথে ভালো একটা সময় কাটায় অনেক বছর পরে। এর আগে এতদিন তার তেমন একটা থাকা হয়নি কোথাও।

নানু বাড়ি থেকে ফেরার পর দিনগুলো তটিনীর খুব ব্যস্ততায় কাটে। পড়ালেখার চাপে তাযীমকে নিয়ে ভাবার সময়ও সে পায় না। দেড় মাস তার পরীক্ষা থাকে। দেড় মাস পর ছুটি পেতেই এক বিকেলে চন্দ্রমল্লিকা এসে জানালো বিবিকিউ পার্টি দিবে। চেনা পরিচিত সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। হুট করে এই আয়োজনটা হবে শুনে তটিনী চমকালেও অখুশি হয় না। তার কাছে ভালোই লাগে।

সন্ধ্যার দিকে ছোট ফুফুরা যখন এলো তখনই তার বুক ধড়ফড় করতে থাকে। ছোট ফুফুদের সাথে সবার আদরের তাযীমও এসেছে। মৈথীকে সাথে করে এনেছে। তটিনীর সব আনন্দ এক নিমিষে গায়েব হয়ে গেল। এই অ’স’ভ্য যে আসতে পারে তা তো সে ভুলেই বসেছিল।

আয়রা এসেছে দেখে তটিনী রুমে দরজা দিয়ে থাকতে পারল না। তার সাথে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছিল, গল্প করছিল। বাগানের এক পাশে চন্দ্রমল্লিকা রান্না বান্নার তদারকি করছে। বিবিকিউ পার্টিটা এখন শুধু আর বিবিকিউ পার্টি নেই। বাবা চাচারা কাচ্চি বিরিয়ানির ব্যবস্থা করে তাদের সবার পরিকল্পনা কিছুটা ন’ষ্ট করে দিচ্ছিল। কিন্তু এদিকে বিবিকিউ এর সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলায় সেটাও বাদ দিতে পারল না। তাই একপাশে সেটাও করা হচ্ছে। তটিনী বরাবরই এসব থেকে গা বাঁচিয়ে চললেও আজ পারল না। চন্দ্রমল্লিকা তাকে সেখানে দাঁড় করিয়ে ভেতরে একটা কাজে গেল। আয়রার স্বামীর কল আসায় সেও এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তটিনী একাই তখন দাঁড়িয়েছিল।

-‘তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ!’

তটিনী কেঁপে উঠল। পেছন ফিরতেই দেখল তার চিরচেনা সেই অ’স’ভ্যকে।

-‘কি করছিলে?’

কথা না বলতে চাইলেও তটিনী বলে ফেলল,

-‘আপনার মাথা।’

-‘আমার মাথা? আমার মাথা দিয়ে কি করবে তুমি?’

-‘উফ! আপনি এখানে কেন এসেছেন?’

-‘এসেছি। রান্না কেমন হচ্ছে দেখছি।’

-‘দেখা লাগবে না। খেতে পারলেই হলো তো! যান এখান থেকে।’

-‘আশ্চর্য! কি খাবো তা আগে পরখ করে দেখব না?’

তটিনী ভীষণ রে’গে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-‘আপনার কি মনে হয় আমরা আপনাকে উলটো পালটা কিছু খাইয়ে দিব?’

-‘তোমাকে তো বিশ্বাস নেই। বলা যায় না কোন শ’ত্রুতা থেকে কি করে ফেলো!’

-‘আচ্ছা বেশ। থাকুন আপনি এখানে। আমার কাজ কমেছে। আপনি থাকুন আমি যাই।’

তটিনী চলে যেতে নিলেই তাযীম তার হাত ধরে তাকে আটকায়।

-‘এসব কোন ধরনের অ’স’ভ্যতা? বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু। আমার এসব একদমই ভালো লাগে না। হাত ছাড়ুন।’

তাযীম হাত ছেড়ে দিলো। তটিনী চলে গেল। তাযীমের মনে হলো হাতটা আবারও ধরতে। কিন্তু সেটা অনধিকার চর্চা হয়। আচ্ছা? অধিকার তৈরি করে নিলেই তো হয় তাহলে! এটুকু কি সে পারবে না?

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে