#রজনী_প্রভাতে (পর্ব-৭)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
১৩.
আজ সকালে তটিনীর একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙতেই সে ভীষণ অবাক হয়। তার বিছানায় একটা রূপবতী মেয়ে বসে আছে। তটিনীকে জাগতে দেখেই হাসল।
-‘কি ব্যাপার? বিয়ে বাড়িতে কেউ এতক্ষণ ঘুমায়?’
অপরিচিতা মেয়েটির এমন কথা তটিনীর হজম হলো না। বলা চলে কিছুটা বি’র’ক্ত হয় সে। মেয়েটি নিজের মতোই বলতে লাগল,
-‘আমি মৈথী। আয়রার ভাবী।’
তটিনী চমকে উঠল। আয়রার ভাবী মানে! রোহান তো সবে টেনে পড়ে। এই বয়সেই এত বড় মেয়েকে সে বিয়ে করল কখন! কি আবোল তাবোল বলছে মেয়েটা?
মৈথী হেসে উঠল তটিনীর ভাবুক মুখ দেখে। বলল,
-‘তুমি পিচ্চি রোহানের কথা ভাবছ? আরে ধুর! ও তো আমার ছোট দেবর। আমি ওর বড় ভাইয়ের কথা বলছি। তাযীমকে চেনো? ওর বউ।’
তটিনী পাথরের মতো জমে গেল। তাযীম বিবাহিত? কই? সে তো জানে না। অবশ্য এত গুলো বছর কোনো যোগাযোগ ছিল না। তাছাড়া বিয়ের বয়স তাযীমের আরো আগেই হয়েছে। তটিনী আর ভাবতে পারছে না। মাথা ধরছে তার। আচ্ছা! মেয়েটা মশকরা করছে না তো?
-‘মৈথী আপু দুষ্টুমি করছে রে। ওদের বিয়েটা এখনও হয়নি। আমার জন্য আটকে আছে। আমারটা শেষ হতেই ওদেরটাও হবে।’
আয়রার কথা শুনে তটিনীর মনে আরো বেশি দুঃখ জাগে। মৈথী মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। তটিনী বুঝতে পারছে না এত খা’রা’প লাগছে কেন তার? এটা কেমন অদ্ভুত না? নিজেকে আড়াল করতেই সে বলে উঠল,
-‘ওহ আচ্ছা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
-‘জলদি যা। তুই এত লেইট সব কিছুতে!’
তটিনী হাসল। ভেতর থেকেও কেউ একজন বলে উঠল,
-‘আসলেই তুই লেইট রে তটিনী! তুই একজনের জীবনে প্রবেশ করতে খুব দেরি করে ফেলেছিস।’
________________________________
আজ আয়রার হলুদ অনুষ্ঠান। বাড়িতে আয়োজন এবং অতিথি দুটোর পরিমাণই বেড়েছে। সবার সকালের নাস্তা খাওয়া হলেও তটিনীর বাকি ছিল। একা টেবিলে বসে খেতে তার ইচ্ছে করছিল না। চন্দ্রমল্লিকা তাই তাকে ডেকে নিয়ে হল রুমের সাথে লাগোয়া খোলা বারান্দায় নিয়ে বসালো। সেখানে সব ভাই বোন মিলে আড্ডা দিচ্ছিল। তটিনীকে খাবার প্লেট হাতে দেখে মোর্শেদ চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল।
-‘এই টিনী! বাড়িতে যেমন অনিয়ম করতি এখানেও তেমন শুরু করেছিস! আক্কেল জ্ঞান নেই তোর? এই সময় কেউ সকালের খাবার খায়?’
তটিনী ধ’ম’ক খেয়ে চুপচাপ বসে থাকল। পরোটা ছিড়ে মুখে দেওয়া হলো না আর তার।
-‘আশ্চর্য! বসে আছিস কেন? জলদি খাওয়া শেষ কর। এটা আবার কেমন অভ্যাস খাবার প্লেট নিয়ে বসে থাকা!’
তটিনী খাওয়া শুরু করল। ধুর! কোথাও যেন তাল কে’টে গেছে। সুর হারিয়ে গেছে। কিছুই ভালো লাগে না তার। ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে কাঁদতে। উফ! এত দুঃখ হচ্ছে কেন তার? সে আড়চোখে পাশে তাকালো। তাযীম আর মৈথী পাশাপাশি বসে আছে আর কি নিয়ে খুব হাসছে। একটু দূরে থাকায় হাসির কারণটা জানতে পারল না সে। অবশ্য জানতে চায়ও না। একটা পরোটা কোনো মতে গি’লে সে উঠে পড়ল। চলে আসতে নিলেই শুনতে পায়,
-‘এই বুচি? কোথায় যাও?’
বুচি! আবার বুচি! ভরা মজলিসে হাসির রোল পড়ে গেল। সবাই তটিনীকে নিয়ে হাসতে লাগল। কতদিন পর তাকে তাযীম বুচি বলে ডাকল! হাসবে না সবাই? তটিনীর এত ক’ষ্ট হলো! ছিঃ ছিঃ! যে মানুষ তাকে ভরা মজলিসে অ’প’মা’ন করে সে কিনা তাকে এভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে? তটিনী নিজেকে ধি’ক্কা’র জানায়। অভাব পড়েছিল? পুরুষ মানুষের অভাব পড়েছিল? এই অ’স’ভ্যটাকেই কেন মন টানলো? হায়, কি ল’জ্জা! কি ল’জ্জা!
মৈথী উঠে এলো। তটিনীকে বলল,
-‘বাহ! তোমার সব নামই তো ভারি সুন্দর। তটিনী আর বুচি।’
রা’গ সামলাতে পারল না তটিনী। শক্ত গলায় জবাব দিলো,
-‘আমার নাম তটিনী। ওসব বি’শ্রী লোকের দেওয়া বি’শ্রী নাম আমার হতে যাবে কেন?’
থমথমে একটা পরিবেশ তৈরি করে সেখান থেকে চলে আসার পর তটিনীর মনে হলো বেশ ভালো কাজ করেছে সে। হালকা লাগছে। নেই! তার মানে কোনো অনুভূতি নেই তার তাযীমের প্রতি। আহ্! শান্তি!
১৪.
রাতের আটটা বাজে তখন। এলোমেলো ভাবে শাড়ি পরে তটিনী আয়রার রুমের বিছানায় বসে আছে। রুমটা খালি। তটিনী সবার উপরে রা’গ করে পার্লারে সাজতে যায়নি। সবাই গিয়েছে শুধু সে বাকি রয়ে গেছে। শাড়ি তটিনী ভালোই পরতে পারে। কিন্তু আজ কেন যেন পারছে না। বারবার সব তালগোল পেঁচিয়ে যাচ্ছে। রা’গে তাই কোনো মতে শাড়ি পেঁচিয়ে বসে আছে। হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে বসে আছে। মেজো আপাকে কল দিবে ভাবছে। কিন্তু সংকোচ হচ্ছে। তখন তো সাথে গেল না। এখন সমস্যার কথা বলা ঠিক হবে?
তটিনীর ভাবনার মাঝেই খট করে রুমের দরজা খুলে কেউ একজন প্রবেশ করল। বাহিরের আলোর প্রতিফলনে একটু পুরুষের ছাঁয়া পড়তেই কেঁ’পে উঠল তটিনী। তাযীমকে দেখে যেন সেই কাঁ’পা’কাঁ’পি আরো বাড়ল। তাযীম অবশ্য ফিরেও তাকায় না তটিনীর দিকে। তার চোখ মুখ গম্ভীর। আয়রার বিছানার উপর কিছু প্যাকেট পড়ে ছিল সেসব নিয়েই চলে যাচ্ছিল। তার এমন ব্যবহার তটিনীর একটুও পছন্দ হলো না। বিড়বিড় করে বলল,
-‘অ’স’ভ্য একটা।’
বিড়বিড় করে বললেও বোধ হয় একটু জোরেই বলে ফেলে সে কথাটা। কেননা তাযীম শুনতে পায়। আর তাতেই দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফিরে তটিনীর দিকে তাকালো। তটিনীর মনে ভ’য় ঢুকে গেল তাতে। পেটে চিনচিনে একটা ব্যথা হতে লাগল। তাযীমকে এগিয়ে আসতে দেখে তড়িগড়ি করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এলোমেলো শাড়ি তার খসে পড়ে যাচ্ছিল সেটা দুই হাতে আগলে ধরে। তাযীম একদম কাছাকাছি এসে বলে,
-‘কি বলেছিলে? অ’স’ভ্য?’
তটিনী কি বলবে বুঝতে পারছিল না। আসলে এত কিছু ভেবে কথাটা বলেনি। তাযীমকে রে’গে যেতে দেখে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে পড়ছে। তাযীম হাতের প্যাকেট গুলো বিছানায় রাখল। তটিনীর হাত ধরে হেঁচকা টানে তাকে নিজের বুকে এনে ফেলল। তারপরের ঘটনাটা আকস্মিক ঘটে যায়।
যাওয়ার আগে তাযীম তটিনীকে বলে যায়,
-‘এবার যত খুশি অ’স’ভ্য বলো। আই ওন্ট মাইন্ড।’
তাযীম চলে যেতেই তটিনী কেঁদে ফেলল। যেন তেন ভাবে নয়, একেবারে বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদল।
#চলবে।