#রজনীপ্রভাতে (পর্ব-৬)
লেখনিতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
১১.
ভালোবাসা আর ভালোলাগা এ দুটো আসলে কী? আচ্ছা কোনটা বেশি সুন্দর এবং বেশি অর্থ বহন করে! ভালোবাসা? এই ভালোবাসা কাকে বলে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে বহু জনের কাছে বহু উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু তটিনী চাইছে নিজের কাছ থেকেই এই ভালোবাসার সংজ্ঞা বের করতে। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সে ভালোবাসা চিনতে চায়। অথচ কোনো ভাবেই বুঝে উঠতে পারছে না। আদৌ কি সে ভালোবাসে কাউকে? যদি ভালোবেসে থাকে তবে তো তার জানার কথা। যেহেতু জানে না তাই সে ভালোবাসে না তাযীমকে। আর তার তাযীমকে ভালোবাসতে হবে কেন? তাযীম কখনোই তটিনীর স্বপ্নপুরুষ হতে পারে না। দুদিন একটু বড় ভালো কথা বলেছে বলে তো আর সে সত্যিই ভালো হয়ে যায় নি।
ছাদ থেকে গান বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। তটিনীর ইচ্ছে করছে ছাদে গিয়ে সাউন্ড বক্সটা ভেঙে আসতে। কিন্তু সব ইচ্ছে তো পূরণ হয় না। গা থেকে ভারী সাজ পোশাক ছেড়ে তটিনী সুতির সেলোয়ার কামিজ পরে নিলো। মাথা আবার ধরে আসছে। উফ! কোথায় গেলে যে একটু শান্তি পাওয়া যায়?
দরজায় নক হচ্ছে, চন্দ্রমল্লিকার গলা শোনা যাচ্ছে। তটিনী উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই চন্দ্রমল্লিকা তাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল,
-‘একি! তোর এই অবস্থা কেন? সাজ তুললি কেন? ড্রেস ও চেঞ্জ করে ফেলেছিস। এই তোকে না বললাম সবাই এক সাথে ছবি তুলব। এখনও একটাও ছবি তুলতে পারলাম না তুই সব সাজ গোজ ন’ষ্ট করে বসে আছিস। এমন বেরসিক কেন তুই?’
তটিনী বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘মাথা ব্যথা করছে খুব।’
-‘সেকি! মাইগ্রেনের ব্যথাটা?’
-‘তেমনই মনে হয়।’
-‘ঔষুধ খেয়েছিস!’
-‘না।’
-‘আশ্চর্য! মাথা ব্যথা করছে আর তুই ঔষুধ না খেয়ে বসে আছিস? খাবার খাসনি বোধহয়। দাঁড়া আমি খাবার নিয়ে আসি, খালি পেটে ঔষুধ খাওয়া ঠিক নয়।’
চন্দ্রমল্লিকা চলে যেতেই তটিনী চোখ বুজল। তখন কি নাছোড়বান্দা হয়েই না ছিল তাযীম! এক প্রকার জো’র করে এনেছে তাকে। এক মুহুর্তের জন্য কত বড় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল সে! থাক, তটিনী আর সেসব ভাবতে চায় না। তার ভীষণ ক’ষ্ট হচ্ছে। এত বা’জে অনুভূতি হচ্ছে কেন তার? তাযীম তার অপছন্দের মানুষ। হুট করে পছন্দের হয়ে গেল কেন? এক অন্যরকম অ’প’রা’ধ বোধ থেকে তটিনীর চোখ ভিজে আসে। নিজেকে নিজেই তিরস্কার করে। তার মনে হতে থাকে সে এই ভুবনের সবচেয়ে বা’জে মেয়েটা। তাযীমকে ভালোবাসতে চায় সে। এর থেকে বড় অ’প’রা’ধ আর কি আছে?
———————–
পুরোনো বন্ধুদের সাথে ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল তাযীম। তখনই সেখানে উপস্থিত হয় তার ফুফাতো বোনের ননদ মৈথী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে যুক্ত আছে। হত দরিদ্রদের জন্য কাজ করে। সমাজ সেবা তার পেশা হয়ে উঠেছে বলে তাকে সমাজসেবক বললে ভুল হবে না। মেয়েটি গত দুই বছর থেকে তাযীমকে পছন্দ করে। পারিবারিকভাবে তাদের দুজনের বিয়ের আলোচনা চলছে। আয়রার বিয়ের পর হয়তো তাযীমের বিয়েও হবে। তাযীমের মা পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন আরো আগেই। মৈথীকে তাঁর খুব পছন্দ। তাই হয়তো ছেলের মত নেওয়ার কথাও ভাবছেন না। তাছাড়া এত সুন্দর, শিক্ষিতা, কর্মঠ মেয়েকে তাযীমও নিশ্চয় অপছন্দ করবে না। তাই তিনি নিশ্চিন্তে আছেন। এদিকে তাযীম তার মায়ের হাবভাব বুঝতে পেরে বেশ কয়েকবার তাকে নিজের কর্ম ব্যস্ততা দেখিয়ে এসব আলোচনা বন্ধ করতে বলেছে। তার মা তাই ছেলের সামনে এসব নিয়ে কথা না তুললেও পেছনে ঠিকই মৈথীকে ছেলের বউ করে ঘরে তোলার ব্যবস্থা করছে।
-‘আপনাকে তো দেখা যায় না আজকাল। খুব বেশি ব্যস্ত!’
তাযীম মৈথীর কথা শুনে হাসল। সেই হাসি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখলো মৈথী। ছেলেটা এত সুন্দর! এই এত সুন্দর ছেলেটা কবে তার হবে? একান্তই তার!
-‘কখন এসেছ?’ মৈথীর উদ্দেশ্যে তাযীম বলল।
-‘আরো আগেই। আপনি তখন ছিলেন না। বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন নাকি।’
তাযীমের হঠাৎই তটিনীর কথা মনে পড়ে। মেয়েটা কি রা’গ করে ফেলল খুব? এই মেয়েটাও না! এত রা’গ, জে’দ সব তার তাযীমের সাথেই করতে হয়? আশেপাশে তো কোথাও নেই। আসেনি ছাদে?
-‘কোথায় হারালেন?’
তাযীম সৌজন্যের হাসি হেসে বলল,
-‘কোথাও না। তুমি খেয়েছ! ডাকছে বোধহয় খাবার খাওয়ার জন্য। না খেলে চলো।’
-‘একসাথে খেতে বসলে যাব।’
-‘আচ্ছা চলো!’
১২.
ভোর রাতে তটিনীর ঘুম ভাঙলে ওয়াশরুম হয়ে আসে সে। পুনরায় বিছানায় শুয়ে পড়তেই দরজার বাইরে ফিসফিস করে কারো কথা বলার শব্দ শুনতে পেল। কান খাঁড়া করতেই বুঝতে পারে একজন পুরুষ আর একজন নারী কথা বলছে। নারী কন্ঠটা না চিনলেও সে পুরুষ গলাটা চিনতে পারে। তাযীম! এত রাতে কার সাথে কথা বলছে? কৌতূহল জাগে তটিনীর মনে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা চন্দ্রমল্লিকাকে এক পলক পরখ করে নিয়ে সে বিছানা ছাড়ে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় দরজার কাছে। শুনতে পায় মেয়েটা বলছে,
-‘বিয়েটা এই ডিসেম্বরেই হচ্ছে তবে!’
-‘নট শিওর। তবে মা তো পারে না এখনই তোমাকে ছেলের বউ করে আনে।’
নারী কন্ঠের প্রাণোচ্ছল হাসির শব্দ হলো। মন ভরে হাসছে মেয়েটা। তটিনীর হুট করেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বি’শ্রী এক অনুভূতি হতে লাগল তার। মেয়েটি কে তা জানার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করতে লাগলো তার। হিল জুতোর ঠকঠক শব্দ শুনে সে বুঝতে পারল তারা প্রস্থান করছে। কি মনে করে আলতো ভাবে দরজাটা খুলে সে সামনে তাকালো। একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তবে তাযীম নেই পাশে। সে কোথায় গেল?
-‘কি ব্যাপার? ঘুমাও নি?’
তটিনী কেঁ’পে উঠল। পেছন ফিরে দেখল দেয়ালে হেলান দিয়ে তাযীম দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটাও তার অসম্ভব সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। এখনও পাঞ্জাবি ছাড়ে নি গা থেকে। শুধু হাতাটা গুটিয়ে রেখেছে। তাতে নিঃসন্দেহে তাকে সুদর্শনই লাগছে। তটিনী যে তাকে এত গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তা তাযীম বুঝতে পারে। বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসে। চোখের ইশারায় কিছু বলে তটিনীকে। তটিনী ল’জ্জা পায় তাতে। আর একবারও তাযীমের দিকে না তাকিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।
ভেতরে এলে রুমে থাকা আয়নায় চোখ পড়ে তার। সেদিকে তাকিয়েই কিছু সময় সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর বিছানায় বালিশের দিকে তাকায়। দোপাট্টা নামক বস্তুটা অ’ব’হে’লা’য় তার নিচে পড়ে আছে।
#চলবে।