#রজনীপ্রভাতে (পর্ব-৫)
লেখনিতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৯.
বাহিরে বের হতেই তটিনীর মনটা ভালো হয়ে গেল। আশেপাশে তেমন কেউ নেই, কি নিরিবিলি সবটা! এই এত সুন্দর আলোকসজ্জা, রঙিন কাপড়, বাহারি রঙের ফুলে সাজানো গার্ডেনে হাঁটতে অসম্ভব ভালো লাগছে তার। ভাবে দুটো ছবি তুললে মন্দ হয়না। কিন্তু ছবিটা তুলে দিবে কে? পাশে হাঁটতে থাকা তাযীমের দিকে এক পলক তাকিয়ে সে চোখ সরিয়ে নেয়। উহু! তাযীমকে বলা যাবে না। মোটেও না! তাযীমকে না বললেও তাযীম বোধহয় বুঝতে পারে। তটিনীর সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
-‘ছবি তুলবে তটিনী?’
আহা! এমন মিষ্টি মধুর করে আগে কি কেউ তার নামটি ডেকেছিল? তটিনীর মনে হলো এই ডেকে ডেকে হলেও মানুষটা তার মন জয় করে নিতে পারবে। তটিনীর এটাও মনে হলো, আগে তাকে বুচি ডেকে তাযীম ভালোই করেছে। নয়তো সেই অল্প বয়সেই আরো কঠিন অসুখ হতো তার। আচ্ছা? তখনকার অসুখটা এখন হচ্ছে না তো? না না! চাই না তার এই অসুখ। সে সুখ কাতরে। তার শুধু সুখই লাগবে। তাই হয়তো এত মধুর আহ্বান উপেক্ষা করতে পারল সে। তাযীমকে পরোয়া না করেই গটগট পায়ে হেঁটে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। তাযীম তাতে একটুও দুৃঃখ পেল না। যেন সে জানতো এমনি হবে। আর তটিনী না বললেও চুপচাপ পকেট থেকে ফোনটা বের করে পেছন থেকেই হেঁটে চলা তটিনীর দুই তিনটা ছবি তুলে নিতে কিন্তু সে ভুলল না।
গাড়ির কাছে এসে তটিনী দেখল ভেতরে ড্রাইভার বসা আছে। উপরে উপরে তা নিয়ে খুশি হলেও ভেতরে ভেতরে তার বারবার মনে হচ্ছিল যদি সে আর তাযীম একা থাকত তবেই ভালো হতো। নিজের এই ভেতরের এই দু’ষ্ট চাওয়াকে সে তাই শা’সি’য়ে উঠল। আস্ত এক বে’হা’য়া মন বলে ভর্ৎসনা করল।
তাযীম এগিয়ে এসে পেছনের দরজাটা খুলে দিলো যখন তখন তার এই ভালো মানুষ সেজে থাকা আর হলো না। মনটা গলতে থাকে তার অবিরত। ল’জ্জায় তার মাথা নত হয়। ছিঃ ছিঃ শেষমেশ কিনা শ’ত্রুকে মন দিতে হলো? এর থেকে আর ল’জ্জাজনক কিছু আছে! তটিনী মনে মনে ঠিক করে ফেলল বাড়ি গিয়ে সে আর ফিরবে না। তমাদের বাড়ি গিয়ে থাকবে দরকার পড়লে তবুও আসবে না। সে এই পুরুষটির ধারে কাছেও আর আসবে না। অপ্রিয় মানুষটাকে ভালোবেসে মোটেও নিজেকে ক’ল’ঙ্কি’ত করবে না।
সিটে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে ফেলতেই সে অনুভব করল পাশে আরেকজন এসে বসেছে। চমকে উঠে চোখ মেলে পাশে তাযীমকে দেখে আরেক দফা চমকায় সে। হড়বড়িয়ে বলে ওঠে,
-‘আপনি এখানে কেন! সামনে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসুন।’
তাযীম সে কথার ধার ধারে না বরং হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে। তটিনী রা’গ হয়। গম্ভীর মুখে বলে,
-‘আপনাকে কিছু বলেছি।’
-‘শুনেছি।’
-‘তাহলে এখনও এখানে বসে আছেন কেন?’
তাযীম একটু নড়চড়ে বসল। খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
-‘লিসেন! আজ সারাদিন আমার অনেক ধকল গেছে। আই আম টায়ার্ড নাও। পেছনে হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসব এখন। বিকজ আই রিয়েলি নিড রেস্ট।’
-‘বেশ, তবে আমি সামনে বসছি।’
-‘ইয়াহ শিওর ইউ ক্যান বাট আতিক মানবে না। কিরে আতিক! পাশে মেয়ে মানুষ বসলে তোর সমস্যা নেই তো?’
আতিক দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,
-‘আছে ভাই। সমস্যা আছে।’
তাযীম মুখ দিয়ে একটা আফসোসের সুর বের করে বলল,
-‘ইশ! বেচারাটা পাশে মেয়ে মানুষ নিয়ে বসতে পারে না। তটিনী? তোমাকে বোধহয় আমারই রাখতে হবে।’
তটিনী উত্তর করল না। আগের মতো চোখ বন্ধ করে একদম চুপ করে গেল। এই এতটা পথে একবারও চোখ মেলে পাশে থাকা তাযীমকে তাকিয়ে দেখলো না, কোনো কথাও বলল না। শুধু সবটা অনুভব করে গেল। পাশে থাকা অপছন্দের মানুষটাকে প্রাণ ভরে অনুভব করল।
১০.
বাড়ি এসে প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে তাযীমের হাতে তুলে দিয়ে সে বিনয়ের সাথে বলল,
-‘সব দেওয়া আছে এই ব্যাগে। নিয়ে যেতে পারেন।’
তাযীম ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘অর্থাৎ?’
-‘আমি আর যাচ্ছি না। তাই।’
-‘কেন?’
-‘সেটা বলার প্রয়োজন বোধ করছি না।’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
তাযীম কোনো কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেল। তটিনী অবাক হয়ে চৌকাঠৈই দাঁড়িয়ে রইল। আশ্চর্য মানুষটার কাছে তার যাওয়া না যাওয়া নিয়ে কোনো ভাবান্তর হলো না। অথচ সে কিনা তাকে নিয়ে আনমনে কত কিছু ভেবে চলেছে।
ভাঙ্গা মন নিয়ে দরজাটা যখন বন্ধ করল তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই তাযীমের হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখা গেল। তটিনী কিছু বলবে তার আগেই সে বলে উঠলো,
-‘ব্যাগে সব তো দেওয়া নেই।’
তটিনী অবাক হয়ে বলল,
-‘সব দেওয়া নেই মানে? সবই দেওয়া হয়েছে। ভালো করে দেখেছেন তো!’
-‘দেখেছি কিন্তু কিছু মিসিং। আরো কিছু আমার সাথে করে নিয়ে যাওয়ার কথা।’
-‘আর কী?’
তাযীম চমৎকার হেসে বলল,
-‘তুমি ছাড়া আর কী!’
#চলবে।