রজনীপ্রভাতে পর্ব-০৪

0
547

#রজনীপ্রভাতে (পর্ব-৪)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৭.
তটিনীর মাথাটা সেই সকাল থেকে হালকা ধরে আছে। গতরাতে হাবিজাবি চিন্তা ভাবনা করে ঠিক মতো ঘুমায়নি মেয়েটি। শেষ রাতে যাও চোখ লেগে এসেছিল পাঁচটা বাজতেই আবার ফুফুর ডাকাডাকিতে উঠতে হলো। সবাই মিলে একসাথে নামায আদায় করে আবারও যখন একটু ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে তখন আয়রা আর তাকে ঘুমাতে দেয়নি। ভালো সুযোগ পেয়ে তারা দুজন আনিকা, তানিয়া আর চন্দ্রমল্লিকা সহ বসে চন্দ্রমল্লিকার আনা লাগেজটা খুলল। তারপর যার যার জন্য আনা উপহার সামগ্রী যা যা ছিল সব নিজেদের মধ্যেই ভাগাভাগি করে নিলো। এরপর আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে তো আর ঘুমানো হয়নি। তাই এখন তার মাথাটা ব্যথায় টনটন করছে।

ছোট ফুফু কড়া লিকারের এক কাপ চা দিয়ে গেছেন কিছুক্ষণ আগে। তটিনী একটু একটু করে সেই কাপে চুমুক দিচ্ছে আর বাহিরের লনের দিকে তাকিয়ে আছে। চা শেষ করে উঠবে যখন তখন দেখল মেইন গেইট দিয়ে তাযীম প্রবেশ করছে। তাকে দেখে তটিনী নড়ল না। অপলক তাকিয়ে থাকে তাযীমের দিকে। তাযীমও তখনই চোখ তুলে তার দিকে তাকালো। ওমনি ধরা পড়া চো’রের মতোন তটিনী সেখান থেকে সরে পড়ল। সেখান থেকে সময় মতো সরে এলেও মাথা থেকে তার তাযীম ভূত যাচ্ছিল না। এক সকাল পুরোটা তাযীমের খেয়ালেই কাটালো। আর আশ্চর্যজনক ভাবে এরমধ্যে একটিবারও তার মাথা ব্যথা অনুভব হলো না। বরং একটু ভ’য় তারই সাথে অদ্ভুত অন্যরকম মিষ্টি একটা অনুভূতিময় চিন্তায় মত্ত ছিল। তার মনে মনে এমন এমন ভাবনা আসছিল যা সে কখনোই ভাবতে চায়নি কিংবা সেসব চাওয়ার মতোই ছিল না। অথচ আজ কোন অলক্ষে যে সে এসব ভেবে যাচ্ছে! সে তার এসব চিন্তা-ভাবনা আর অনুভূতির কথা ম’রে গেলেও কাউকে বলতে পারবে না। ভাগ্যিস, কেউ কারো মন পড়তে পারে না! নয়তো তটিনীর কী হতো?

দুপুরের দিকেই আয়োজন জমে উঠল। একে একে অনেক অতিথি আসতে লাগল। এর মধ্যে বেশির ভাগকেই তটিনী চেনে না। খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই সবাই যে যার মতো ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। কে কার আগে তৈরি হবে এমন একটা প্রতিযোগিতা লেগে যায়। সেই সকলের সাথে তটিনী তাল মিলিয়ে চলতে পারল না। সন্ধ্যার একটু পরে যখন সবাই ঝাক জমক পোশাক পরিধান করে, সুন্দর করে সেজে তৈরি, অনুষ্ঠানও শুরু হবে এমন সময়ে সে তৈরি হতে গেল। মেহেন্দি উপলক্ষে মেয়েরা সবাই লেহেঙ্গা পরবে। সবার মতো সেই লাল আর সবুজের মিশ্রণের লেহেঙ্গাটা তটিনী যখন পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো তখন তার নিজেরই কেমন ল’জ্জা লাগছিল। বারবার মাথায় ওই একজনই এসে তাকে ল’জ্জায় ফেলছিল। একসময় ল’জ্জা শ’র’মকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল আর এসব উল্টোপাল্টা ভাববে না। মানুষটার থেকে দশ হাত দূরে থাকতে হবে কম করে হলেও। ভুলে গেলে চলবে না সে শ’ত্রু।

রুম থেকে বের হতেই তটিনীর প্রতিজ্ঞাটা নড়ে গেল। আগের মতো দুরুদুরু বুক কাঁপা, হঠাৎ দেখা হলে কেমন ল’জ্জা বা অ’স্ব’স্তিতে পড়তে হয় এই ভেবেই অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল তার। বোনদের সাথে তাই দল বেঁধে ডালা নিয়ে ছাদে গেল না। সবাই যখন উপরে উঠল নিচে যখন টুকটাক দুই একজন ঘুরছিল তখন সে ধীর পায়ে সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেল। ভারী লেহেঙ্গাটা একটু উপরে তুলে ধরে সিঁড়িতে এক পা ফেলতেই পেছন থেকে সেই ভারী গলার স্বরটা শুনতে পায়।

-‘সাহায্য লাগবে?’

আকস্মিক চিরচেনা গলা স্বরটা শুনতে পেয়ে চমকে উঠল তটিনী। চট করে পেছনে ঘুরতে নিলেই পা পিছলে পড়তে নেয় ওমনি পেছনের মানুষটা তাকে আগলে নেয়। তটিনী ধাতস্থ হয়ে দ্রুত সরে আসে মানুষটার কাছ থেকে। দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,

-‘না লাগবে না।’

তাযীম আর কিছু বলল না। তবে দাঁড়িয়ে রইল আগের মতো। তটিনীও উপরে আর উঠল না। তাযীমকে উপরে ওঠার জায়গা করে দিয়ে কিছুটা সরে দাঁড়ালো। তারপরেও যখন তাযীম গেল না তখন তটিনী তার দিকে সরাসরি তাকালো।

-‘কি হলো? যাচ্ছেন না যে!’

তাযীম যেন কৌতূক করে বলল,

-‘কোথায় যাব?’

কিছুটা বি’র’ক্ত হয়েই তটিনী জবাব দিলো,

-‘কোথায় আবার! ছাদে যাওয়ার কথা বলছি।’

-‘ওহ ছাদে! যাব তো। তুমি আগে যাও আমি পিছনে আসছি। তোমার যা অভ্যাস, বলা তো যায় না দুই সিঁড়ি গেলে আবারও না পা ফঁসকায়! আমি আগে চলে গেলে তখন ধরবে কে?’

তটিনী কথাগুলো শুনে হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল তাযীমের দিকে। না! বিন্দু মাত্র পরিবর্তন হয়নি। লোকটা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। সুযোগ পেলে তাকে কথা শোনাতে ছাড়ে না। এখনিই আবার বুচি না ডেকে বসে এই ভেবেই সে পা বাড়ালো। প্রতি সিঁড়িতে খুব সাবধানে পা ফেলে সে ছাদে উঠল। আর সে এই পুরোটা সময় একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তাযীমের অস্তিত্ব এত কাছ থেকে অনুভব করছিল সে যে তার বাদ বাকি সব সে ভুলেই বসেছিল। কড়া পুরুষালি পারফিউমের ঘ্রাণটাও তাকে আরো বেশি বেসামাল করে দিচ্ছিল। তটিনীর হুট করেই আফসোস হচ্ছিল নিজের জন্য নয়, তাযীমের জন্য। একটা এত সুন্দর, বলতে গেলে অনেক বেশিই সুদর্শন যুবকটা এত বি’শ্রী ভাষার অধিকারী কেন? হ্যাঁ, তটিনীর কাছে তার ভাষা বি’শ্রীই লাগে। খুব খুব খুব!

৮.
মেহেন্দি অনুষ্ঠানটা বেশ জমজমাট ছিল। সবাই বেশ হৈ হুল্লোড় করছিল। বড় ছোট সবাই পুরো অনুষ্ঠানটা উপভোগ করছিল খুব করে। আর তটিনী তাদের এই আনন্দ উল্লাস দেখে দুঃখী মুখ করে বসে থাকল। তার একটা সময় বুক ভাঙা কান্না আসছিল। কিন্তু কাঁদল না। তার নিজের উপর রা’গ হচ্ছিল বারবার। একটা অভদ্র লোককে নিয়ে এত ভাবার কি দরকার তার? কেন সে এত বেশি ভাবছে তাকে নিয়ে! তার চিন্তা-ভাবনা, মন মানসিকা এমন কেন? দুদিন আগেও যার জন্য সে ফুফুর বাড়িতে আসত না, সে তাদের বাড়িতে গেলে লুকিয়ে থাকত, বড় কথা যাকে সে অনেক অনেক বেশি ঘৃ’ণা করত তাকে নিয়েই কেন এতসব ভাবছে সে? হাত পাঁ কেন ঠান্ডা হয় তার কথা ভাবলে? কেন তার কাছাকাছি গেলে বুক কাঁপে? কেন তাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে?

নাঁচ গান এসবের মাঝপথেই তটিনী ছাদ ছাড়ল। তার এসব আনন্দ সইছে না। ভালো লাগছে না কিছু।

নিচে এসে আয়রার রুমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় তটিনীকে ‘টিনী’ বলে ডেকে উঠল একজন। সেই একজনকে চিনতে তটিনীর অসুবিধা হলো না। টিনী তো একজনই ডাকে তাকে। মোর্শেদ ভাই! পেছন ফিরে দেখল মোর্শেদই দাঁড়িয়ে আছে। তবে সাথে আরো একজন মানুষও আছে। যে মানুষটার জন্য বর্তমানে তটিনীর অন্তরে শান্তি নেই। তাকে দেখেই তটিনী আবার ঘুরে দাঁড়ালো। পেছন থেকে মোর্শেদ এবার জোরে ডাকল আগের তুলনায়;

-‘টিনী, আমি ডাকছি তো তোকে!’

তটিনী পুনরায় পেছনে তাকালো। মোর্শেদ ভাই রে’গে যাচ্ছেন বোধ হয়। এই মানুষটা শান্ত থাকলেই ভালো। রা’গানো ঠিক হবে না। তাই সে আর অন্যদিকে না গিয়ে বরং মোর্শেদের কাছেই এগিয়ে এসে বলল,

-‘বলো ভাইয়া।’

-‘তুই ব্যস্ত?’

-‘না।’

-‘বেশ বেশ! তবে এক কাজ কর। যীমের সাথে একটু যা তো।’

তটিনী আকাশ থেকে পড়ল বোধ হয় এই কথা শুনে। ভ্রু কুঁচকে বলল,

-‘কার সাথে? কোথায় যাব?’

-‘আহা! তাযীমের সাথে যা। ছেলেটা একা হাতে কত কাজ করবে বল! আমার একটা কাজ থাকায় যেতে পারছি না। তুই একটু যা না।’

-‘কিন্তু কেন?’

-‘দাদীর পেটে ব্যথা উঠেছে। এখন তার ঔষুধ আনতে বাড়ি যেতে হবে।’

-‘তো! অন্য কাউকে বলো।’

-‘অন্য আর কে যাবে? যাকে বলছি সে বলছে ব্যস্ত আছে। তুই তো ব্যস্ত নেই। তুই যা না! তাযীম যাবে তো সাথে।’

-‘এখানে আশেপাশে পাওয়া যাবে না ঔষুধ টা?’

-‘দাদী বারবার বলছে সে তার ঔষুধ গুলোই খাবে। আশপাশ থেকে কিনে আনতে পারলে তো হতোই। সে আরও বলেছে বাড়িতে তার কি একটা কাপড় আছে সেটাও আনতে। তুই যা জিজ্ঞেস করে নে কোনটা। তারপর গিয়ে নিয়ে আয়।’

-‘কিন্তু আমিই কেন?’

-‘যা না! তাযীমের সাথে যা। তাযীমকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারিস।’

তটিনী মোর্শেদের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারবে কিনা সে জানে না। তবে এখন চোখ বন্ধ করলে সে ওই তাযীমকেই দেখতে পায়। তটিনী তাযীমের দিকে তাকালো। তাযীমও এতক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। আর ওমনি ল’জ্জায় মুখ অবনত হলো তার।

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে