#রজনীপ্রভাতে (পর্ব-৩)
লেখনীতে— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৬.
আয়রার চাচাতো আর ফুফাতো বোন গুলোর আচার-আচরণ একটু অদ্ভুত। তটিনীকে কেমন বিরক্তির নজরে দেখছে। আয়রা চাইলেও তটিনীর দিকে নজর রাখতে পারছে না। এই এত এত অবজ্ঞা, অবহেলা আর একাকীত্বটা তটিনী ঠিক সইতে পারছে না। সে আয়রার বারান্দায় দোলনায় বসে আছে আর একা একা বসেই নানান চিন্তা ভাবনা করছে ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই এত চিন্তা ভাবনার মাঝে হুট করেই তার দুষ্টু মনে তাযীমকে নিয়েও চিন্তা এলো। অ’সভ্য লোকটা কী করছে জানতে ইচ্ছে করল। নিজের কৌতূহলী মনের এই স্পর্ধা দেখে তটিনী নিজেই অবাক না হয়ে পারল না। আশ্চর্য! তাযীমকে নিয়ে সে কি করে ভাবতে পারে? ধুর! ভাবনার মাঝেই তটিনীর দৃষ্টি পড়ল বাড়ির গেটের দিকে। একটা গাড়ি ঢুকছে। গাড়িটা এক পলক দেখেই সে চিনে ফেলল। বারান্দার রেলিং ধরে ঝুলে নিচে তাকালো। গাড়ি থেকে মোর্শেদ আর আফজাল নামার পর চন্দ্রমল্লিকা নামে। তাকে দেখে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল সে।
-‘আপা!’
চন্দ্রমল্লিকা ডাক শুনে উপরে তাকায়। বোনকে দেখে হেসে হাত নাড়ায়। তটিনী আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায় না। দৌঁড়ে রুমে ঢুকতেই আয়রা প্রশ্ন করল,
-‘কীরে! দৌঁড়ে কোথায় যাচ্ছিস?’
তটিনী সময় নেই যেন এমন ভাবে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল,
-‘মেজো আপা এসেছে!’
-‘কি বলছিস!’
আয়রা যেন হুট করেই চাচাতো, ফুফাতো বোন গুলোকে ভুলে গেল। সেও তটিনীর পিছু পিছু রওনা হলো চন্দ্রমল্লিকাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।
নিচে এসে তটিনী দেখল চন্দ্রমল্লিকাকে জড়িয়ে ধরে আছে তার মা। তা নিয়ে তাদের দাদী বেশ রে’গে আছেন। তিনি আগে নাতনিকে জড়িয়ে ধরে খোঁজ খবর নিবেন ভেবেছিলেন। ছেলের বউয়ের এই এত বড় কাজটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না। অগত্যা অসহায় চন্দ্রমল্লিকাকে আর সবাইকে ভুলে দাদীকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হলো। ইশারায় তটিনী আর আয়রাকে নিজের লাগেজ দেখিয়ে দিতেই দুজনে খুশি হয়ে গেল। বুঝতে পেরে যায় তারা যে রাতটা বেশ ভালো কাটবে।
লাগেজটা নিয়ে আয়রা নিজের রুমে এলো না। তটিনীকে অবাক করে সে তাযীমের রুমের দরজায় কড়া নাড়ে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তাযীম দরজা খোলে। ছেলেটা বোধ হয় সবে মাত্রই গোসল সেড়ে বেরিয়েছে। কেন যেন তখন তাকে দেখতে তটিনীর খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু এই এত ভালো লাগার হঠাৎ উদয় হওয়ার কারণ কী সে বুঝে পায় না। নিজের উপর খুবই বিরক্ত হয় সে। কী অদ্ভুত ব্যাপার। যে ছেলের জন্য সে এই বাড়িতে আসা বন্ধ করেছে, যার থেকে নিজেকে বছরের পর বছর লুকিয়ে রেখেছে হঠাৎ আজ তার আশেপাশে থাকতেই কত ভালো লাগছে! তাকে একবার দেখলে আবারও দেখতে ইচ্ছে করছে। এত বছরের জমিয়ে রাখা রা’গ, ক্ষো’ভ গুলো কোথাও যেন কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেছে। মোট কথা সব মিলিয়ে তটিনী নিজের কাজে খুবই ল’জ্জিত। তাই আয়রাকে ব্যস্ততা দেখিয়ে জলদি সেখান থেকে চলে এলো। পেছনে দুই ভাই বোন কি নিয়ে আলাপ চালিয়ে গেল তা আর সে জানতে পারল না।
দাদীর থেকে বিশ মিনিট সময় পর মুক্তি মেলে চন্দ্রমল্লিকার। মা, ফুফু, বাবা, চাচা সহ বাকি সব ভাই-বোনের সাথে কথা বলে উপরে আসতে আসতে তার আরো কিছুক্ষণ সময় লেগে যায়।
আয়রার সেই চাচাতো, ফুফাতো বোন গুলো চন্দ্রমল্লিকাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। আয়রার কাছে আর প্রথমের মতো ভাও না পেয়ে তার রুম ছাড়ে। তবে যাওয়ার সময় আয়রার চাচাতো বোন নুহা নিজেদের মধ্যেই বলছিল,
-‘বাহ্! এতো সুন্দর একটা মানুষ!’
তাদের ফুফাতো বোন রুশা সেটা শুনে ঠোঁট বাঁকা করে ব্যঙ্গ করে বলল,
-‘আরে ফুট! সব প্লাস্টিক!’
ইচ্ছে করেই কথাটা যেন শুনিয়ে বলল। আয়রা ভীষণ রে’গে যায়। কিছু বলবে তার আগেই চন্দ্রমল্লিকা তার হাত ধরে ফেলে। ইশারায় বোঝায় সবার সব কথা ধরতে নেই। এত এত ভালো মানুষের মধ্যে দুই তিনটা ম’ন্দ মানুষের কথা নিয়ে ভাবার এত দরকার কী?
ছোট ফুফু এসে সবাইকে চা সাথে আরো কিছু খাবার দিয়ে গেল। তটিনীর চা দেখে মনে পড়ল সন্ধ্যা থেকে এত খারাপ লাগার আরেকটা কারণ হলো চা না খাওয়া। সে ঝটফট চা হাতে নিলো। এরপর তারা তিন বোন গল্পে মেতে উঠল। একটু পরেই তানিয়া আর আনিকাও এসে পড়ল। এরপরই কাজিনদের আড্ডাটা জমে উঠল। বহু দিন পর সবাই একসাথে খুব সুন্দর একটা মুহূর্ত কাটালো।
৭.
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমানোর পালা এলো যখন, তখন দেখা গেল আয়রার ফুফাতো বোনরা আয়রার সাথে ঘুমাতে চলে আসে। আয়রা তাদের মুখের উপর মানা করতেও পারে না। এদিকে এখন তটিনী কোথায় ঘুমাবে সেই নিয়ে যত সমস্যা দেখা দিলো।
তটিনীর ঘুমানোর সমস্যাটা শেষ পর্যন্ত তাযীমের কানে গেল। তটিনী আর আয়রা তখন হল রুমে বসে আছে। তাযীম কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে কেউই খেয়াল করেনি।
-‘ঘুমাতে যাচ্ছিস না কেন আয়রা?’
আয়রা আর তটিনী দুজনেই চমকে উঠল। তাযীমকে দেখে তটিনী সোজা বসে থেকেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। ব্যাপারটায় তাযীমের একটু হাসি পায়। তটিনী স্পষ্ট দেখল তার ঠোঁটের কোণে আড়াল করতে চাওয়া হাসিটা।
-‘এই তো ভাইয়া যাচ্ছি।’
-‘শুনলাম রুম নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে!’
-‘হ্যাঁ, আসলে রুশারা বলছিল আমার রুমে ঘুমাবে। আর আমি আর তটিনী তো একসাথে ঘুমাবো বলে ঠিক করেছিলাম।’
-‘সাফাদের রুম খালি নেই?’
-‘ওরা সেখানে শোবে না।’
-‘ওহ্! বাড়িতেও কি আর রুম খালি নেই?’
আয়রা মাথা দোলায়। না, খালি নেই আর। তাযীম এক পলক তটিনীর দিকে তাকালো।মেয়েটা যে খুবই বিরক্ত আর অস্বস্তি বোধ করছে তা সে ভালোই বুঝতে পারছে।
-‘আচ্ছা, ওরা যেহেতু তোর রুমে ঘুমাবে তবে ওরা সেখানেই ঘুমাক। তুই ও’কে নিয়ে আমার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়।’
-‘ওমা! তবে তুমি কোথায় শুবে?’
তাযীম নিজের ফোনের স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,
-‘আমি চন্দ্রদের বাসায় যাচ্ছি।’
আয়রা যেন কথাটা শুনে বেশ অবাক হলো। উৎকন্ঠা নিয়েই বলল,
-‘চন্দ্র ভাইয়াদের বাসায় যাবে মানে কী! তুমি তো ভাইয়া না থাকলে সেই বাসায় যাও না।’
-‘চন্দ্র দুপুরে এসেছে। বাড়িতেই আছে। আচ্ছা, আমি যাচ্ছি, তোরা আমার রুমে চলে যা। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়। মাকে বলে রেখেছি। কেউ ডিস্টার্ব করবে না।’
তাযীম চলে যেতেই তটিনীর হুট করে কেমন খালি খালি অনুভব করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল কি যেন একটা নেই! আবার একটা নতুন ভালো লাগায়ও কেন যেন মন ছেয়ে গেল।
তাযীমের রুমটা বেশ বড়, গোছানো আর পরিপাটি। ছেলেদের রুম এত সুন্দর হয় তটিনী বোধ হয় জানত না। আফজাল আর মোর্শেদ খুব অগোছালো ধরনের। আফজাল যদিও কম মোর্শেদ যেন একটু বেশিই অগোছালো। ভাইদের অগোছালো স্বভাব দেখে তটিনী ভেবেই বসেছিল সব ছেলেই এমন। আসলে তা নয়। কিছু ছেলেও বোধ হয় ঘর গুছিয়ে রাখতে জানে।
বিছানায় যখন গা এলিয়ে দিলো তখন একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল তার। এই বালিশ আর বিছানা সব কিছুতেই তো তাযীমের ছোঁয়া আছে। উলটো পালটা চিন্তা মাথা থেকে দূর করার জন্য চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। সেখানেও তাযীমের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। তড়িৎ গতিতে চোখ মেলে সে মনে মনে আওড়ায়,
-‘ধুর! ধুর! ধুর!’
#চলবে।