রজনীপ্রভাতে পর্ব-০১

0
672

রজনীপ্রভাতে (১ম পর্ব)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

ছোট ফুপির বাড়িতে বিগত কয়েকবছরেও তটিনী যায়নি। তার একটা বড় কারণ ফুপির ভাসুরের ছেলেটা। আস্ত ব’দ’মা’য়ে’শ! সবকিছুতেই তার বাড়াবাড়ি। কী কারণে যেন তটিনীকে সে ভীষণ অপছন্দ করে। অবশ্য সেটা কেবল তটিনীর মনে হয়। ওহ! ছেলেটার নামই তো বলা হলো না। ছেলেটার নাম হলো আব্দুল্লাহ আল আইমান তাযীম। খুব বড় নাম না? তবে নামটি খুবই সুন্দর, তাযীম! অর্থ শ্রদ্ধা ভক্তি করা। আশ্চর্যজনকভাবে ছেলেটি খুবই ভালো আচরণ করে সকলের সাথে। সবাইকেই শ্রদ্ধা ভক্তি করে খুব। এটা তটিনীকে মানতেই হয়। তবে তার সাথে নয়। তটিনীর মনে আছে সে যখন ক্লাশ সিক্সে তখন একদিন সে ফতুয়া আর একটা ধুতি পাজামা পড়ে সারা বাড়ি ঘুরঘুর করছিল। তাযীমের সাথে বাগানে গিয়েই দেখা হলো। তাকে দেখতেই তাযীম চোখ বড় করে ফেলল। বলল,
-‘আরে বুচি কোন ম’ন্দি’রের পু’রো’হিত তুমি? এই অনিন্দ তোদের বাসার পাশের সেই পু’রো’হিত কাকার মতো লাগছেনারে ওকে? তা খুকি পু’রো’হিত কাকা না হয় পু’রো’হিত মানুষ। তার পোশাকই হলো ধুতি। তুমি কেন পড়লে? নাকি এখন কোথাও ধিতাং ধিতাং বলে গানে নাঁচতে যাচ্ছ! কোনটা? বলো দেখি!’

অনিন্দ ছেলেটা এত হাসল! একটা অচেনা ছেলের সামনে প্রথমে বুচি বলে অ’প’মা’ন করল। তারপর বলল পুরোহিতের ড্রেস ক’পি করেছে। এই এত অপমান তার সইছিল না। অনিন্দ হাসাতে সেই অ’প’মা’নের ফলাফল চোখ থেকে মুক্তোর দানার মতো পানি পড়তে লাগল। সেই কী দৃশ্য! একটা ধুতি পরিহিতা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ভার্সিটির দুইটা ছেলে হু হা করে হাসছে। সেই কী বিকট হাসি। মনে পড়লেই গায়ে জ্বলন ধরে। এখন তটিনীর একুশ হলো। আর সেই অ’স’ভ্যে’র হয়েছে আঠাশ। বে’য়া’দ’ব’টা তার থেকে সাত বছরের বড়। এই বড় নিয়েও তার কত ভাব! তটিনী যখন নাইনে তখন একদিন এই ছোঁকড়া আবার এসেছিল। তটিনী উঠোনে দাঁড়িয়ে মুরগী ল’ড়া’ই খেলছিল। ছেলেটা এসে তটিনীকে এক ঠ্যাং তুলে দুই হাত ভাজ করে লাফাতে দেখে বলল,
-‘আরে বুচি! তুমি দেখি হাতির মত বড় হয়েছ তবুও জ্ঞান বুদ্ধিতে একদমই ছোট। এত বড় মেয়ে ধেই ধেই করে লাফাচ্ছে। খেলা রাখো আর এদিকে আসো।’

রাগে থমথমে মুখ নিয়ে তটিনী গেল। তাযীম বলল,
-‘লেবুর শরবত করে আনো তো। যা গরম পড়েছে! একেবারে মাথা খা’রা’প করা গরম।’

তটিনী শরবত করে নিয়ে আসে। কেননা যতই সে তাযীমকে অপছন্দ করুক সে তো মেহমান। মেহমানকে যত্ন না করলে তো আর হয় না। তটিনী শরবত এনে দেখল বসার ঘরে তাযীম নেই। তটিনী ভাবল চলে গেছে। সে গ্লাস নিয়ে পুনরায় রান্নাঘরে ফেরত যাচ্ছিল দোতলা থেকে তাযীম চিৎকার করে বলল,
-‘এই বুচি! শরবতটা উপরে এসে দিয়ে যাও।’

আবারও বুচি! রাগ সামলে তটিনী দোতলায় গেল। মোর্শেদ ভাই বসে আছে তাযীমের সাথে। তার হাতে কাগজ পত্র। সবসময় থাকে। মোর্শেদ ভাই সারাক্ষণ প্রোজেক্টের কাজে ব্যস্ত থাকে। এই দুনিয়াতে তার কাছে প্রোজেক্ট ছাড়া আর কিছুই প্রাধান্য পায় না। তটিনীকে দেখে বলল,
-‘টিনী! যা তো মা’কে বল এক কাপ চা দিতে।’

মোর্শেদ টিনী বলে ডাকলে খুবই সুন্দর শোনায়। ভরাট গলায় টিনী ডাকটা কী ভালো মানায়! মোর্শেদ সকলের একটা ছোট নাম দেয়। যেমন তার বড় বোন তানিয়াকে তানি বলে ডাকে, মেজো বোন মুনিরাহ’কে মুনি বলে ডাকে। তাযীমকেও ছোট করে ডাকে যীম।

তটিনী চা নিয়ে আসার পর দেখে মোর্শেদ নেই। তাযীম বসে আছে চুপচাপ। হাতে অবশ্য মোবাইল ফোন। তাযীম বলল,
-‘বুচি চা টা নিয়ে তুমি ফেরত যাও। মোর্শেদ ভাই ঘুমাতে গেছেন।’
-‘আমাকে যে চা আনতে বলল!’
-‘তিনি বলছিল যে দুইরাত ঘুম হচ্ছে না। এখন শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। তো খবর নিয়ে জানলাম চা, কফি বেশি খাচ্ছেন। তাই আমি বারণ করলাম। বললাম এখন শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করলে চা না খাওয়াই ভালো। বিছানায় গা এলিয়ে দিলে খুবই ভালো ঘুম হবে। চা খাওয়া মানে তো বি’ষ খাওয়া। কী পরিমাণ ক্যাফেইন! তুমি এক কাজ করো, যেহেতু তুমি চা টা এনেছ তুমি খেয়ে নাও। আমার সামনে বসে খাও। দেখি চা তুমি কীভাবে খাও। চা খাওয়ার সময় তোমায় কেমন লাগে।’
-‘না এখন চা খাওয়ার সময় না।’
-‘কে বলেছে সময় না? এসবের আবার আলাদা সময় আছে নাকি! যাকে তাকে যখন তখন খেতে দেখা যায়।’
-‘আপনার মাথা। আপনি বেশি বোঝেন।’
-‘হ্যাঁ বুঝি। কারণ তোমার থেকে বয়সে আমি অনেক বড়।’
-‘বয়সে বড় হয়েছেন দেখে মাথা কিনে নেন নি।’
-‘তুমি আমার সাথে ভালো ব্যবহার করছ না।’
-‘আপনি আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেন কখন?’
-‘কি! তুমি বলতে চাইছ আমি তোমার সাথে খা’রা’প ব্যবহার করি?’
-‘তা নয় তো কী! আপনি বাড়ি বয়ে এসে সবসময় আমার সাথে এমন করেন। মজা উড়ান।’
-‘তুমি আমাকে বাড়িতে আসার খো’টা দিচ্ছ?’
-‘হুম দিচ্ছি। আবার ও দিব। মেহমান মেহমানের মতো থাকতে পারেন না!’

রাগের মাথায় তো কথাটা বলে দিল। তবে এর খেসারত তাকে দিতে হয়েছে চরম। তাযীম তার চাচির কাছে অর্থাৎ তটিনীর ফুপির কাছে বি’চা’র দিল তটিনী নাকি খুব বা’জে ব্যবহার করেছে তার সাথে। ফুপি তখন তার মায়ের কাছে বলল। মা রাতে চুল টেনে ধুমধাম মা’ই’র দিল। সেই থেকে! সেই দিন থেকে রা’গে অভিমানে ফুপির বাড়ি যাওয়া বন্ধ করল। এবং সেই বাড়ি থেকে এই বাড়িতে কেউ আসলে তাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করল। ফুপি এসে খুব করে বোঝালো অভিমানি তটিনী বুঝল না। তাযীমকে সে অপছন্দ করত না আগে তবে তাকে দেখলে বিরক্ত হতো কিন্তু এরপর থেকে ভীষণ অপছন্দ করতে লাগল। একদিন খবর এলো তাযীমরা তাদের নতুন বাড়িতে অর্থাৎ গুলশানে চলে গেছে। মোহাম্মদপুরে তারা এখন আর নেই। তটিনী শুনেও কোনো ভাবাবেগ দেখালো না। বলা রাখা ভালো! তাযীমরা গুলশান শিফ্ট হওয়ার পরেও কিন্তু তটিনী কখনো যায়নি সেই বাড়িতে। আর না কখনো তাযীমকে চোখের দেখা দেখেছে। তার কথা হলো একটা ঝামেলার সাথে দেখা করার মানে হয় না। তার ভাষ্যমতে তাযীমের অহংকারও দিনকে দিন বেড়ে চলছিল। বুয়েট থেকে পাশ করে বের হবার পর একদিন তাদের বাড়িতে এসেছিল মিষ্টি নিয়ে। তটিনী যখন খবর পেল তখন পেছনের দরজা দিয়ে চয়নিকাদের বাড়ি চলে গেল। তটিনীদের বাড়িটি শহরের থেকে একটু দূরে। গ্রাম এলাকা বলা চলে। সে সেদিকে ধেই ধেই করে চয়নিকার সাথে সারা বিকেল পার করে সন্ধ্যার পরে বাড়িতে ফেরে। ততক্ষণে তাযীমরাও চলে গেছে। তটিনী স্ব’স্তি’র শ্বাস ফেলে!

আজ এতদিন পর ফুপির বাড়িতে যাওয়ার কারণ তার ফুপাতো বোনটার বিয়ে। তার থেকে দুই বছরের বড় হলো তার ফুপাতো বোন আয়রা। আয়রা খুব অনুরোধ করল যাওয়ার জন্য। ফুপি ফুপা সবাই বলল। এই এত অনুরোধ তটিনী ফেলে দিতে পারল না। তাই বলল সে যাবে। এবং সকলের সাথে খুব আনন্দ করবে। নিজের মনকেও বোঝালো! সে এখন বড় হয়েছে, যদি আবারও সেই তাযীমের সামনে পড়ে তো তাকে কা’টি’য়ে যাবার উপায়ও তার জানা আছে। সে এখন আর পনেরো বছরের অভিমানি তটিনী নেই।

২.
তটিনী আর তার বড় ফুপু আলেয়া বেগমকে একসাথে যেতে বলা হলো। তারা একটু আগে চলে যাবে। কারণ বড় ফুপু বাকি সবার তুলনায় বেশ বৃদ্ধ মানুষ। দেরিতে সবার সাথে গাদাগাদি করে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার বয়স সত্তরের কাছাকাছি। তিনি আট ভাই বোনের সবার বড়। তটিনীর দাদুর বয়স নব্বই এর ঘরে। আল্লাহর রহমতে এখনও জী’বি’ত আছেন, সুস্থ আছেন। তাকে আরো এক সপ্তাহ আগেই যখন আয়রাকে দেখতে এসেছিল তখনই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে বিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক করাতে তাকে আর আসতে দেওয়া হলো না। তো তটিনীদের একটু আগে যাওয়ার কারণ হলো তাদের বাড়ির বাকিদের যেতে যেতে বিকেল হবে। আর বড় ফুপুদের বাড়ির সবাইও সন্ধ্যায় যাবে। এখন ছোট ফুপু বারবার চাপ দিচ্ছে তাকে যেন আগেই নিয়ে যাওয়া হয়। তাই সবাই তাকে আর যেহেতু তটিনীর কোনো আহামরি কাজ নেই তাই তটিনীকে এক সাথে পাঠিয়ে দেয় এক গাড়ি করে। গাড়ির কথায় আসাতে এবার গাড়ি নিয়ে যে কাহিনি হলো সেটা কিছুটা বলি। আলেয়া বেগম কার, মাইক্রো এসবে চড়তে পারেনা। তো ঠিক করা হলো সিএনজিতে যাবে। তটিনীর কোনো সমস্যা নেই। কারণ সেও ফুপুর মতো বদ্ধ গাড়িতে থাকতে পারেনা। বমি করে দেয়। তাদের বাড়ির গাড়িতে অতি প্রয়োজন ছাড়া সে চড়ে না। এদিক দিয়েও দুইজন মিলেছে ভালো। এতে সবাই আরো খুশি। খামোখা গাড়িরও দুইবার আসা যাওয়া করাও লাগবেনা। তো সিএনজি ডেকে আনে মোর্শেদ। সে ঠিকানা বলে দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল। ভাতিজি আর ফুপু একসাথে রওনা হলো। মূল কান্ড ঘটে শেষে গিয়ে। ড্রাইভার তাদের মোড়ের মাথায় নামিয়ে দিল। বলল এই রাস্তা পর্যন্তই কথা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলেনি। তটিনী পড়ল বি’প’দে। সে তো চেনেনা এখানের কোন দিকের বাড়িটা, সব ভুলে গেছে। সেই ছোট বেলায় এসেছিল। এখন কত কত বাড়ি হয়েছে নতুন। এর মধ্যে আরো বেশি সমস্যা হয়ে গেল। এদিকে ফুপুও জানেনা বাড়ি কোনটা। তিনি তো এমনিতেও চোখ থাকিতে অ’ন্ধ। তার উপর কালার ব্লা’ই’ন্ড। ড্রাইভার বলল তাকে এতটুকু পর্যন্তই যেতে বলা হয়েছে তবে তারা টাকা বাড়িয়ে যদি ঠিকানাটা বলে তবে সে পৌঁছে দিবে। এদিকে ঠিকানা কেউই জানেনা। অগত্যা ফুপু ড্রাইভারকে বেশ কয়েকটা গা’লি গা’লো’জ করে ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। এই ভর দুপুরে খাড়া রোদের মধ্যে ব্যাগপত্র নিয়ে দুইজন এদিক সেদিক ঘুরছে। একবার একটা বাড়ির সামনে গিয়ে ফুপি বলল,
-‘এই তো এটা, এই বাড়িটা। আয় আয়।’
তটিনী ব্যাগ পত্র টেনে বাড়িতে ঢুকতে নিলে গেইটের দাঁড়োয়ান পথ আটকায়। বলল,
-‘এই আপনেরা কে!’
ফুপু বেশ ভাব নিয়ে বললেন,
-‘আমরা কে! তুই তোর মালিকরে জিগা যা। আমরা কে! তুই জানোস না! যাই বাড়ির ছোট বউরে কইবি যে আপনের বড় বইন আছে।’

ফুপুর এতো বেশি আত্মবিশ্বাস দেখে আর ধ’ম’কা’নি শুনে দাঁড়োয়ান গেল ভেতরে, তাছাড়া আরেকটা কারণও আছে। এই বাড়িতে দুই বউ থাকে। বড় বউ আর ছোট বউ। দুই মিনিটের মাথায় ফেরত এসে বলে,
-‘এই বাইর হোন।। বাইর হোন। ছোট ভাবির তো কোনো বইন এ নাই। মি’থ্যু’ক মহিলা।’

ফুপু ঝ’গ’ড়া লেগে যাচ্ছিল রীতিমত। তটিনী বুঝল যে আসলেই ফুপুর ভুল। সে টেনে তাকে বাহিরে নিয়ে এলো। এভাবে অনেকক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে তাদের না’স্তা’না’বু’দ অবস্থা। এতক্ষণ তাদের এক মুদি দোকানদার লক্ষ্য করছিল। তিনি এসে বললেন,
-‘আপা আপনারা কি কাউরে খুঁজতেছেন?’
ফুপু ত্যক্ত হয়ে বলল,
-‘না বাসা খুঁজতেছি।’
-‘ওই একই হইল। তা কোন বাসা? আগে আসেননাই! গ্রাম থাইকা আসছেন!’
ফুপুর উঠে গেল রাগ। ফুপু ধানমন্ডিতে বিলাশ বহুল বাড়িতে আধুনিক জীবন যাপন করেন। পোশাকে আর কথাতে তিনি সাধারণই চলে। তাই বলে গ্রাম থেকে আসছেন এই কথা শুনতে পারলেন না। তেঁতে উঠলেন। বললেন,
-‘কী কইলি! গ্রাম! আমি গ্রাম থাইকা আসছি? তুই আমারে চিনস?’
-‘জ্বি না। চিনি না।’
ফুপু আবারও ঝ’গ’ড়া করতে গেলেন তবে তটিনী থামিয়ে দিল। লোকটাকে অনুরোধের স্বরে বলল,
-‘আঙ্কেল একটু সাহায্য করুন। বেশ কিছুক্ষণ একটা বাড়ি খুঁজছি পাচ্ছিনা। বেশ কয়েকবছর আগে এসেছিলাম। এখন অনেক কিছু নতুন হওয়াতে গুলিয়ে ফেলছি। কাউকে যে কল করব সেই উপায় নেই। আমার ফোনের টাকা শেষ। ফুপুর ফোনের চার্জ শেষ। কি একটা অবস্থা!’
-‘ওহ। আচ্ছা মা সমস্যা নাই। ঠিকানা জানো কিছু?’
-‘না সেটাই জানিনা। বাড়ির চেহারাও সঠিক মনে নেই। তবে জানি যে এদিকে বড় ব্যবসা আছে তিন ভাইয়ের ইট সিমেন্টের। এখানকার নামকরা নাকি। তাদের বাড়িতে বিয়ে। আমার ফুপাতো বোনের বিয়ে আর কী! ফুপার নাম হাসান শুধু এটা জানি। পুরো নাম জানিনা।’
-‘ওহ হো। আহারে, আগে বলবা না! তাদের তো সবাই চেনে। হাসান মিয়ার বড় ভাই হারুন মিয়া এবার মেয়র পদে দাঁড়াইছে। আমি চিনি তাদের সবাইরে। তবে তাদের বাড়ি তো এদিকে না। সামনের মোড়ে।’
-‘সিএনজি ড্রাইভারকে তো আমার ভাই এই মোড়ের কথাই বলছিল। গণি সাহেব রোড।’
-‘আরে না। এটা কোনো গণি সাহেব রোড না। ড্রাইভার ব’দ’মা’ই’শি করছে। দিন দুনিয়া এসব ভু’য়া মানুষে ভইরা গেছে। দাঁড়াও একটা রিকশা ডাইকা দেই। হাঁইটা যাইতে সময় লাগে দশ মিনিট। বুড়া মানুষ নিয়ে আর কত হাঁটবা!’
ফুপু এবারও বুড়া বলায় রে’গে গেলেন। তটিনী বহু ক’ষ্টে চুপ করালেন। রিকশাওয়ালাকে বলতেই সে ঠিকানা চিনে গেল। তটিনী রিকশায় উঠে সাহায্য করা সেই লোকটার প্রতি বেশ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।

৩.
রিকশা থেকে নেমে সুন্দর সাজানো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তটিনী। তাদের আসলে নিজেদের ও ভুল হয়েছিল। ঐ বাড়িতে ঢোকার কোনো প্রয়োজন ছিল না। একটা বিয়ে বাড়িতে তো বিয়ে উপলক্ষে সাজসজ্জা করা হয়। আর আয়রাদের তো নাকি সেই দেখতে আসার দিন থেকে উৎসব মূখর পরিবেশ। এত বড় ভুলটা সে কেন করল! শুধু শুধু ঐ বাড়িতে যেচে পড়ে ফুপু ভাতিজি অপমানিত হয়ে এলো। যাই হোক! ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে যেতেই ছোট ফুপুকে রীতিমত দৌঁড়ে আসতে দেখা গেল। কুশলাদি করে বড় ফুপুকে নিয়ে সোফায় বসালো। তটিনীও বসে। তবে ফুপুর আজকের সেইসব ঘটনার রসনাই শুনতে তার ইচ্ছা করছিল না। তাই ছোট ফুপুকে বলল ফ্রেশ হবে। ততক্ষণে আয়রাও চলে এসেছে। দুই বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। আয়রা তটিনীকে নিজের রুমে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় তটিনী দেখে কাজের লোকরা ছোটাছুটি করে একটা রুম পরিষ্কার করছেন। তটিনী বলল,
-‘কী ব্যাপার! এই রুম নিয়ে যে ওরা এত দৌঁড়াদৌড়ি করছে? স্পেশাল কিছু!’
-‘আরে তাযীম ভাইয়া আসবে। জেঠা মশাইরা পরশু এলেও ভাইয়া আসেনি। তো ভাইয়া বারণ করেছিল যে এত সাফ সাফাই করা লাগবেনা। সে তখন আসবেনা বলেছিল। বলেছে একদম বিয়ের দিন আসবে, আসলেও থাকবেনা বলেছে। আর ভাইয়ার রুমে কারো যাওয়া মানা। তাই অতিথি আসলেও নিঃসন্দেহে সেই রুমে তো আর তাদের থাকতে দিতে পারবেনা তাই সেটা পরিষ্কার করেনি। এখন ভাইয়া একটু আগেই কল করে বলেছে সে আসবে। সন্ধ্যার দিকেই আসবে। তাই এমন হুলোস্থল কান্ড।’
-‘তোমার ভাইয়ের দেখছি সেই কদর!’
-‘বাড়ির বড় ছেলে। কদর হবে না! তাছাড়া তুইও তো তার বেশ কদর করিস।’
-‘কিহ! আমি?’
-‘তা নয়তো কী! তার কদর বেশি দেখেই তো তার উপর করেছিস রা’গ আর সেটা প্রয়োগ করেছিস আমার উপর। একবারও আসলি না এই কয় বছরে! আপার বিয়েতেও না!’
-‘কই বিয়েতে এসেছি তো!’
-‘সেটা তো কমিউনিটি সেন্টারে বাড়িতে তো আর না! আর কখন এলি কখন গেলি টেরও পাইনি।’

তটিনী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এটা সত্য। সে কিছুটা অ’ন্যা’য় করে ফেলেছে। সে হেসে আয়রাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘এবার সব ঠিকঠাক করে করব। সত্যি।’
আয়রা হেসে দিল। তটিনীও মনে মনে ঠিক করল আর কোনো কিছুতে সে টলবে না। সত্যিই তাকে এই বিয়েটা ইঞ্জয় করতে হবে।’

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে