#রঙ বেরঙের খেলা
#আলিশা
#পর্ব_১৪
সভ্য চলে যাওয়ার সাত দিন হতে চলল। এর মাঝে আর না নিলো সে খোঁজ আর না করলো একটা ফোন। সাবিহার দিন কাটে বিষন্ন হয়ে। বেলকনিতে সভ্য সেদিন রাতে যেখানে বসে ছিল ঠিক সে জায়গায় বসে বসে অনাগত অতিথির সাথে কথা কথা বলে। এর মাঝে অবশ্য ফারজানা বেগম এসেছেন। সভ্য যাওয়ার একদিন পরই। সাবিহা প্রথম প্রথম কিছু অন্তঃকরণ করতে না পারলেও পরে বুঝলো হয়তো এপার ওপারের সবাই জেনে গেছে তার বাচ্চার কথা। সভ্য হয়তো বলেছে। ফারজানা বেগম গত ছয়দিন হলো শশুড় বাড়ি থেকেই কলেজ যাতায়াত করছেন। পরোক্ষ প্রত্যক্ষ সাবিহার খেয়াল রাখছেন। সাবিহার এখন অস্বস্তি হয়। সে শাশুড়ি কে দেখে পালিয়ে বেড়ানোর প্রয়াসে মত্ত প্রতিনিয়ত। লজ্জায় মাথা কাটা যায়। বিয়ের প্রথম রাতের ব্যাবহারের জন্য বুকে অনুশোচনার আগুন জ্বলে। সভ্যর মা সহজ, স্বাভাবিক। তার মুখের কোনো এক অভিব্যাক্তিতে ঈষৎ বিতৃষ্ণা, অভিযোগ, তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে না সাবিহার নামে। আর এটাই হয়েছে সাবিহার কাল। অন্তর জ্বলে পুড়ে খাক করে দেয় বড় মার এমন ব্যাবহার। সাবিহা চায় বড় মা তাকে অপমান করুক, অবজ্ঞা করুক, যত্নের ছিটেফোঁটা তাকে দান না করুক। এর নিমিত্তে সাবিহার পাপ সাবিহার কাছে মহাকাশসম ভারি না হয়ে শুধু হয়তো পৃথিবীর মতো ভারি হতো।
— সাবিহা ঘরে খাবার দিয়ে যাবো?
ভাবনার মাঝে ডাক। সাবিহা দরজার দিকে ফিরে চাইলো। সভ্যর মা দাড়িয়ে আছে। নাকে মুখে চোখের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যায়। হাতে দুইটা চিকন চুড়ি, নাকে নাকফুল। আস্ত এক মমতার সাগর। সাবিহা চোখ ফিরিয়ে নিলো। আজ তো অনেক সুন্দর মনে হচ্ছে সভ্যর মাকে? আগুনে পোড়া চেহারার মাঝেও মুগ্ধতার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সত্যিই সবাই সুন্দর। তাদের সৌন্দর্য দেখার জন্য দুইটা সুন্দর চোখের দরকার হয়। যা সাবিহার এতো দিন ছিল না।
— বড় মা আমি এখন খাবো না। ক্ষুধা নেই।
— এটা কেমন কথা? এই সময় এমন হেয়ালিপনা সাজে না। বেশি বেশি খেতে হবে সাবিহা। শুকিয়ে যাচ্ছো দিনদিন।
— কিছু খেতে না খেতেই বমি আসে।
— সভ্যকে বলবে এসে যেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ওর এই সময় ঢাকায় এতো কি কাজ বুঝি না আমি। ইদানীং ফোনটাও ধরে না। এতো ব্যাস্ত।
ঈষৎ বিরক্ততে বলে উঠলেন ফারজানা বেগম। সাবিহা নিরুত্তর রইলো। সভ্য সত্যিই ব্যাস্ত। সাবিহা নেট থেকে বার্তা পায় সভ্য ফ্যাশন তাড়কা হিসে বড্ড ব্যাস্ত। বড় বড় কোম্পানি তাকে অফার করছে কখনো টিভিসির জন্য কখনো ফ্যাশন মডেলের জন্য। ইতিমধ্যে সভ্যর ফেসবুক পেইজ খোলা হয়ে গেছে। ফলোয়ার এক মিলিয়ন পারিয়ে দুই ধরধর। থিয়েটারের শুটিং নিয়ে তো আছেই। আবার ইদানীং দেখা যাচ্ছে মিডিয়া জানাচ্ছে সভ্য দুর্দন্ত ক্রিকেট খেলছে। ঢাকা ম্যাট্রো তে একজন কোচও ধরেছে। মিডিয়ায় নাম জশ বেশ থাকায় সে তো এখন হাতের তুড়িতেই প্রায় সব খানে যেতে পারছে। তারউপর ছোট বেলায় বেহুঁশ হয়ে খেলেছে ক্রিকেট। সাবিহার মনে পরে গেলো ছোট বেলার কথা। সভ্য পড়ালেখায় ছিল দুর্দান্ত ফাঁকি বাজ। পাজির পা ঝাড়া ছিল সন্তপর্ণে। বড় বাবা আর বড় মা যখন যার যার কর্মক্ষেত্রে যেতে তখন সভ্য স্কুল পালিয়ে ঝট করে চলে আসতো সাবিহাদের বাসায়। রাহেলা ইসলামের কাছে গিয়ে ঘুরঘুর করতো। তার আঁচলে থাকতো সভ্যর রুমের চাবি। সভ্য অত্যন্ত ভদ্র সেজে আলাভোলা একটা হাসি দিয়ে কখনো নিজের ঘরের চাবি জয় করতো কখনো বা চুপিসারে ছোট মায়ের আঁচলের গিট খুলে চাবি নিয়ে ঝটপট রুম খুলে টর্নেডোর গতিতে ব্যাট বল নিয়ে দৌড়ে চলে যেতো। তার স্কুল মাঠে গিয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অহরহ বার ক্রিকেট খেলার কাহিনি আছে। কত যে বাচ বিচার হলো তাকে নিয়ে। শিক্ষকরা সভ্যর মা বাবার কাছে বিচার দিয়ে দিয়ে হয়রান। সভ্য ধরা খেয়ে কাচুমাচু মুখে বলতো
” সরি, আমি আর ক্লাস ফাঁকি দেবো না। ”
কিন্তু ঘরির কাটা সেকেন্ডের ঘর পেরোতে না পেরোতেই তার সরি পরি হয়ে উড়ে যেতো। ক্লাস ফাইভ থেকে এই জ্বালাতন শুরু হলো। ছয় মাস এভাবে দেখার পর সভ্যর বাবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। এগারো বছরের একটা ছেলে এতো বাঁদরামি করলে কেমন লাগে? ক্রিকেটের প্রতি তার নেশা ভয়াবহ হতে ভয়ংকর হতে লাগলো দিনকে দিন। উপায়ান্তর না পেয়ে সভ্যর বাবা বিকেএসপিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে বলে ছেলেকে। সভ্য মহা আনন্দ আর জেদ নিয়ে ওটুকু বয়সেই শুধু করলো অনুশীলন। তাকে কোচ ঠিক করে দেওয়া হলো। সকলে ভেবেই নিলো ছেলেকে দিয়ে আর লেখাপড়া হবে না। এই ছেলের অজানা ভবিষ্যত ক্রিকেটের দিকে এগোচ্ছে। প্রথম বার সভ্যর চান্স হলো না। পরীক্ষার মাধ্যমে টিকলেও ছোট হওয়ায় তাকে স্পোর্টস সায়েন্টিস্ট রিজেক্ট করে দিলো। সভ্যর কান্না দেখার মানুষের অভাব হলো না। সে কি কান্না! তারপর সকলে বুঝিয়ে সুজিয়ে আবার চেষ্টা করতে বলল। পরেরবার আর কপাল ঘুমোয়নি। জেগে ছিল। অতঃপর দু বছরের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বিখ্যাত স্পোর্টস স্কুল বিকেএসপিতে সভ্যর জায়গা হলো। সাবজেক্ট নিলো সে ব্যটসম্যানের। তাকে রাখা হলো খালার বাসায়। মহা আনন্দ আর খুশি নিয়ে সে ব্যাট বল আকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্ন বুনলো। দিন গেলো, মাস গেলো, বছর কাটলো। সভ্যর স্বপ্ন আর কর্ম গড়িয়ে গড়িয়ে যেতে লাগলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। কিন্তু এই কিশোর ছেলের স্বপ্ন থমকে যায় ঠিক সে সময়। যখন সে পনেরো বছরে পা দিয়ে অনূর্ধ্ব ১৫ দলের সদস্য হলো, দুর্দান্ত খেলে অনূর্ধ্ব ১৭ তে জায়গা করে নিলো কিন্তু অনূর্ধ্ব ১৮ খেলার দিন তার বাবা পৃথিবী থেকে চলে গেলো। সভ্য খেলার পোশাক পরে সেদিন তৈরি। বাবার সাথে ফোনে কথাও হলো তার। প্রায় এক ঘন্টা পর যখন খেলার মাঠে নামতে যাবে সে ঠিক তখন এই সংবাদটা তার কানে আসে। আর খেলা হয় না তার। তার আপনজন, অত্যন্ত ভালো বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে শোনা মাত্র সভ্য খেলার মাঠে আচমকা ধুপ করে পরে যায়। হয়তো অতো ছোট হৃদপিণ্ড মেনে নিতে পারেনি এতো বড় একটা দুঃসংবাদ। জীবনের গতিপথ, স্বপ্নের মহল সেখানেই ভেঙে গুড়িয়ে যায়। ফিরে আসতে হয় মায়ের কাছে। কোনোভাবে সেখানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পৃথিবী চেনার জন্য পথিক হতে হয়। মা বোঝালো, পড়ালেখা করে সরকারি চাকরি কর। ক্রিকেটার হওয়ার ভাগ্য তোর কপালে নাও থাকতে পারে। অন্ধকারে হাঁটিস না।
.
— আপনি নাকি আজ চলে যাচ্ছেন?
ব্যাস্ত ভঙ্গিতে সভ্য আরশিতে শার্টের কলার ঠিক করছিলো। পাশে দাড়িয়ে মেকআপ ম্যান তার মাথায় স্প্রে করছিলো কিছু একটা। পরিপাটি করে দিচ্ছে। সুষ্মিতারও চুল বেঁধে দিচ্ছিলো একটা মেয়ে। এহেন ব্যাস্ত মুহূর্তে সভ্যকে দুরুদুরু বুকে সুষ্মিতা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো। সভ্য সুষ্মিতার পানে তাকিয়ে কৃত্রিম এক চিলতে হাসি হেঁসে বলল
— হুম। দুদিনের শুট একদিনে করার চেষ্টা করলাম। সফল আমি।
— কিন্তু সিম কোম্পানি থেকে মনে হয় ডেকেছিল আপনাকে।
— না করে দিয়েছি।
সুষ্মিতা অবাক হলো। বিষ্ময় নিয়ে হুট করে বলে ফেলল
— সত্যি? কিন্তু ওটা তো বড় রকমের কিছু ছিল।
সভ্যর পরিপাটি হওয়া শেষ। সে হাত ঘড়িটা পড়তে পড়তে শুধু মুচকি হাসলো সুষ্মিতার কথার নিমিত্তে। তার অনেক কাজ। গত দুই রাত হলো ঘুম তাড়িয়ে রিহার্সাল করেছে। যে যে শুট গুলো একক সব করলো। মোটামুটি দু’দিন আর তার না আসলেও চলবে। সন্ধ্যা বা সাম্য আবার রাগ করবে। পৃথিবীতে এসেই বলবে
” বাবাই তুমি ভালো না। মাম্মার মধ্যে যখন থাকতাম তখন তুমি আমার খোঁজ নাও নি। শুধু দুই একটা খবর নিছো দাদির থেকে। এটা বড্ড নিষ্ঠুর কাজ”
ভাবনার মাঝে সভ্য হাসলো। জীবনটাই যাচ্ছে সাবিহার ওপর জেদের তড়ে যুদ্ধ করতে করতে। সুষ্মিতা আড় চোখে তাকিয়ে সভ্যর ঠোঁটের হাসি চোখ দিয়ে দেখে মনে গেঁথে রাখলো। যেন চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে প্রিয়র একফালি চাঁদের মতো এক চিলতে হাসি। দিন যাচ্ছে সভ্য সুন্দর ও সফল হচ্ছে। সুষ্মিতার প্রেম নদী থেকে সমুদ্রে পরিণত হয়ে গেছে। ভালোবাসা হয়ে যাচ্ছে ভয়াবহ পর্যায়ের। এবার প্রকাশ করার সময় এসেছে। আচ্ছা সুষ্মিতাকে কি সভ্য রিজেক্ট করে দেবে? ভাবতেই সুষ্মিতার মন ইতি উতি করে যুক্তি খুঁজে এনে বলে, মোটেই না। বাবা বলে সুষ্মিতার মতো শাহজাদী সকল শাহজাদার স্বপ্নের কুমারী। এমন অসাধারণ, রূপবতী, গুণবতী, বুদ্ধিমতীকে কেউ রিজেক্ট করার কথা কল্পনাই করতে পারে না।
চলবে……
#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#বোনাস_পার্ট
সেলিব্রিটিরদের জীবন নব নির্মিত পদ্মা সেতুর মতন। যে-ই দেখে সে-ই একবার ধাক্কা মারতে চায়। নাট খুলে হুলস্থুল কান্ড বাজিয়ে দেওয়ার বাসনা মনে লালন করে। এই নাট খোলার মতো বেখাপ্পা চিন্তা ধারা অবশ্য শুধু রিপোর্টাররাই করে থাকে। তবে সব রিপোর্টার আবার একই ঘাটের মাঝি না। রাস্তায় এখন আর পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক কায়দায় চলতে পারে না সভ্য। কেউ পদ্মা সেতুর পুল ভেবে ধাক্কা মারতে আসে, কেউ আসে স্মরণীয় করে ফোন ফ্রেমে বন্দি করতে, কেউ বা আসে নিউজ নিতে। আবার দুচারজন আসে ইমেজ পুলের নাট আগলা করতে। এই জ্বালায় পড়ে সভ্যর অবস্থা যাচ্ছেতাই ছিল দিন কয়েক পূর্বে। এই গত তিন দিন আগে একটা প্রাইভেট কার কিনে রক্ষা। মোটামুটি ধাঁচের তার কার। ত্রিশ লক্ষ দিয়ে কেনা হয়েছে। ফারজানা বেগমই মোটামুটি জোর করে কিনিয়েছেন। সভ্যর কাছে এতো টাকা এখনো হয়ে ওঠেনি। মা-ই কিনে দিলেন। সভ্যর বাবার জমিয়ে রেখে যাওয়া টাকা দিয়ে। ছেলে তো সেলিব্রিটি। একটা প্রাইভেট কার না হলে চলে নাকি! কার কিনে ড্রাইভিং শিখে সভ্য আজ নিজেই ড্রাইভ করে বাসায় ফিরছে। একটা আ্যাসিসটেন্ট লাগবে এখন। কিন্তু সভ্যর রাখার ইচ্ছে নেই। ভাব গতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে।
.
মাগরিবের আজান হয়েছে। সাবিহার বড় মা, আম্মাহ নামাজ পরতে নিজের ঘরে জায়নামাজ বিছিয়ে হয়তো বসে আছে। ভাইটাও একটু আগে মসজিদে চলে গেলো। বাসা থেকে বেশি দূরে নয় মসজিদ। সাবিহা ড্রয়িং রুমে বসে ছিল। চোখ তার বন্ধ। ঝিমোয় সে ঘুমে। উঠে নিজ ঘরে গিয়ে আরাম করে ঘুমের বন্দবস্ত করার মধ্যেও আছে মহা অলসতা। উঠতে ইচ্ছে করছে না। চোখে প্রায় ঘুম এলো। মাথা ক্রমশ হেলিয়ে পরতেই হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ। টুংটাং আওয়াজ কাঁচা ঘুমটা দমলাম পাকিয়ে উড়িয়ে দিলো হুট করে। সাবিহা চকিতে চোখ মেলল। মৃদু ক্ষুব্ধ না হয়ে পারলো না মন। অসময়ে সবার আগমন। সাবিহা বিরক্তি নিয়ে যখন উঠতে যাবে ঠিক তখনই ফারজানা বেগম এলেন। সাবিহাকে বললেন
— থাক তুমি আমি দরজা খুলছি।
সাবিহা স্বস্তি নিয়ে বসে রইলো। কিন্তু ঘুনাক্ষরেও সে বুঝলো না একটু অলসতা তার বুকের প্রশান্তি কেড়ে নিলো। ওপাশে যে সভ্য দাড়িয়ে আছে তার জন্য অবাকতা নিয়ে। সাবিহার মন খুশি হয়ে যাওয়ার মতো ছোট কিছু নিয়ে। প্রিয়র অনবদ্য মুখটা আর তার কিছু উপহার সাবিহার দেখার ভাগ্য হলো না। ফারজানা বেগম দরজা খুলে দিতেই সভ্য ব্যাসৃত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলো। হাতে তার বড়সড় একটা মিষ্টির প্যাকেট। অন্য হাতে আরো একটা ব্যাগ আছে। দু’হাতের বদ্ধতা দূর করতে সভ্য দরজার ওপাশ হতেই মায়ের হাতে ধরিয়ে দিলো ব্যাগ। বলে উঠলো ব্যাস্ত ভঙ্গিতে
— এর মধ্যে ওই টক ঝাল টাইপ কিছু আছে সাবিহাকে দিও। আমি একটু আসছি। একটা ট্রাক আসার আসার কথা আসেনি মনে হয় এখনো।
ফারজানা বেগম ছেলের এমন ব্যাস্ত ভঙ্গি দেখে অবাক হলেন। সভ্যর কথাও তার হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে না। তিনি মিষ্টির ব্যাগ হাতে নিয়ে অপর হাতের ব্যাগটার মুখ খুলে উঁকি দেওয়া দশায় বললেন
— কি আছে এই ব্যাগে? আর ট্রাক কেন আসবে? তুই তো ট্রাকের কথা কিছু বলিসনি আমাকে।
সভ্য ব্যাগের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল
— ট্রাকে কিছু জিনিসপত্র আসার কথা। আজকেই হুট করে কিনে ফেললাম। বলার সময় পাইনি মা।
এরপর আর একটা বাক্যও বলার সুযোগ না দিয়ে সভ্য পা বাড়িয়ে চলে গেলো। ফারজানা বেগম বিষ্ময় দমিয়ে পেছন ঘুরলেন। সাবিহা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। চোখে তার আকাশসম বিস্ময় আর অবিশ্বাস। সভ্য এলো? তার জন্য এসেছে? আবার বলল সাবিহার জন্য কিছু এনেছে? কি এনেছে? সাবিহার অন্তঃপুর ছেয়ে গেলো শুধুই বিস্ময়ে বিস্ময়ে। সভ্যর মা মুচকি হাসলেন। সাবিহার মুখের অভিব্যাক্তি তখন কেমন হবে যখন সভ্যর দেওয়া টক ঝাল মিষ্টির প্যাকেকটা ফারজানা বেগম ধরিয়ে দেবে সাবিহার হাতে? সাবিহা পলিথিন রকমের একটা প্যাকেটের ভেতর দৃষ্টি তাক করে দেখবে সভ্য তার জন্য ফুসকা, চটপটি, তেঁতুলের চাটনি আর রসমালাই দিয়ে টক ঝাল মিষ্টির প্যাকেজ তৈরি করেছে। সাবিহা বুঝি তখন তব্দা লেগে যাবে আশ্চর্যের ঘোরে। চোখের পলক ফেলতে বেমালুম ভুলে যাবে।
আজ যেন সকলের অবাক হওয়ার পালা। সভ্য দমে দমে প্রতি পদক্ষেপে চমকে দিলো সকলকে। সে ঢাকা থেকে ফিরতি পথে ফার্নিচার কিনে এনেছে। তার ঘর পূর্বে ততটা সাজানো গোছানো ছিল না। ফার্নিচার ছিল খুবই কম। সবসময় তো থাকতো মায়ের সাথে তাদের ফ্লাটে৷ সাবিহাদের এখানে প্রয়োজন ছাড়া তেমন যাওয়া আসাও হতো না তাই জাঁকজমক যা করারা তাদের ফ্লাট করা হয়েছে। কিন্তু আজ এ বাড়িতে তার ঘরটা সাজানো হলো স্বপ্নের মতো করে। জানালার পর্দাগুলো পর্যন্ত পাল্টে ফেলা হলো সভ্যর আদেশে। সে নীল রাঙা পর্দা লাগালো। নিজেই বাইরের মানুষদের সাথে ছোটাছুটি করে আসবাবপত্রের স্থান ঠিক করলো। ঘরে তুলল নতুন সোফা, আলমারি, ড্রেসিন, বিছানা, টেবিল ল্যাম্প, ফুলদানি, ফুল আরো অনেক কিছুই। ঘরের লাইট গুলোতে পর্যন্ত বৈচিত্র্য আনলো। সব যেন তার আগেরই পরিকল্পনা ছিল। গুছিয়ে গুছিয়ে সব ক্রয় করে এনেছে। ফারজানা বেগম ছেলের পরিবর্তন দেখে মুচকি হাসলেন। হাত লাগালেন কাজে। ইলেকট্রনিক মিস্ত্রি বিদায় হওয়ার পর সে ঘর ঝাড়ু দিয়ে বিছানা পত্র সুন্দর করে গুছিয়ে দিলেন। ফার্নিচার মুছে পরিষ্কার করে দদিলেন। সভ্য পোশাক না পাল্টেই, বিশ্রাম না নিয়েই মায়ের সাথে কাজে লেগে পরেছে। ক্লান্তি তার চোখ মুখ ভরা। তবুও জানালার পর্দা লাগালো, ফুলদানিতে ফুল নিয়ে এখানে ওখানে রাখলো। তারপর আবার বহু কষ্টে খুঁত খুঁত করা মন নিয়ে একটা জায়গায় স্থির করলো। দেওয়ালে কিন্তু পেইন্টিং ঝুলিয়ে দিলো ফুলের। এসব করা কালে মাকে ডেকে বারবার জিজ্ঞেস করলো
” মা এখানে কি মানিয়েছে? সুন্দর লাগছে কি?”
ফারজানা বেগম ছেলের কথায় কটমট দৃষ্টি তাক করেছেন। কখনোবা সাঁই জানিয়েছেন। কখনো বা বিরক্ত হয়েছেন। এভাবেই মা ছেলে ঘর পরিপাটি করলো। রাত এগারোটা বেজে গেলো তাদের কর্ম সম্পাদন হতে হতে। সাবিহা ভয়ে বা সঙ্কোচে কাছে যায়নি। রাহেলা ইসলাম পরে আছে রান্নাঘরে। জামাইয়ের জন্য রান্না করছেন তিনি।
সভ্য ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে গেলো গেলো প্রায় রাত বারোটায়। সাবিহাও ছিল তখন। যথারীতি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সভ্য খাবার টেবিলে বসেছিল। রাহেলা ইসলাম প্লেটে খাবার সাজিয়ে দিলেন। সভ্য এক লোকমা ভাত মুখে নেওয়ার আগ মুহূর্তে হঠাৎ থেমে যায়। হুট করে তার মনে হলো যাদের জন্য আজ এখনই ক্লান্ত শরীর নিয়ে এতো কিছু করলো তাদের বলা উচিত। ভাবনা অনুযায়ী সভ্য পূর্বের রাগ দুঃখ দমিয়ে রেখে সাবিহার পানে চেয়ে এক চিলতে হেঁসে বলল
— আজ থেকে আমার ঘরে উঠে যেও। ঘর গুছিয়ে দিয়েছি। ছোট মা মেয়ের কাপড় চোপড় গুছিয়ে দিয়ে শশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েন।
চলবে……..