রঙ বেরঙের খেলা পর্ব-০১+০২

0
1314

#রঙ বেরঙের খেলা
#আলিশা
#পর্ব-০১+০২

— আম্মাহহ, আম্মাহহহহ। আমি ঐ কালো ভুতের সাথে সংসার করবো না।

সাবিহার রাগ উপচে পরা কঠিন গলা। গলার স্বরটার দাপটও আকাশচুম্বী। ঘরই যে তার বাহির। পরই যে তার আপন। বাপের বাড়ির মধ্যে তার শশুর বাড়ি। ঘন্টাখানেক আগে বিয়ে হয়ে গেছে তার চাচাতো ভাই সভ্যর সাথে।

— ছিহ মা এসব বলতে হয় না। চুপ চুপ। সভ্য এখন তোর জামাই।

মেয়ের মুখে হাত চাপা দিয়ে কুণ্ঠিত হয়ে বললেন রাহেলা ইসলাম। সাবিহা থামলো না। বরং সে ফুঁসে উঠলো বিষধর কোবরা অহির মতো। ততক্ষণে ড্রইংরুমে হুটোপুটি খেয়ে জর হয়েছে বাড়ির সদস্যরা। সাথে আত্নীয়রা।

— আমার রং দেখেন আম্মা আর তার রং দেখেন। আমি একজন রাজশাহী ভার্সিটির স্টুডেন্ট। আমার ভবিষ্যৎ আছে, ফ্রেন্ড সার্কেল আছে। তাদের সামনে আমি তাকে তুলে ধরবো কেমনে। বলেন আপনি। শুধু তো মানসম্মান বাঁচানোর খাতিরে হুট করে বিয়ে দিয়ে দিলেন যার তার সাথে। আমারও কি হয়েছিল কে জানে। একটানা তিনটা কবুল বলে গেলাম।

সাবিহার অত্যধিক সুন্দর মুখের ছটফটিয়ে উঠা বাক। যেন আফসোসে সে কুল কিনারাহীন৷ রাহেলা ইসলাম অসহায় চোখে তাকালেন নিজের জা-য়ের পানে। সাবিহার সদ্য হওয়া শাশুড়ি সভ্যর মা। তিনি চোখ ফিরিয়ে নিলেন জা-য়ের চোখ হতে। ছেলে তার কালো। বউ হয়েছে ধবধবে ফর্সা হুর পরির মতো। ঠিক মুখ ফুটে শক্ত বাঁকে জব্দও করা যাচ্ছে না। তবুও তিনি মুখ খর্ন করে সাবিহার উদ্দেশ্যে বললেন

— তোমার বিপদ ছিল বলেই আমার ছেলে বিয়ে করেছে। অহংকার না করে নিজের খুঁতটা দেখতে শেখ।

সাবিহা নাক কুঁচকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো আপন চাচি সাথে সদ্য হওয়া শাশুড়ি হতে। অবজ্ঞায় আকাশ পাতালের বিস্তর ফারাক পূরণ করে দিয়ে বলল

— ওই উপকার কেন করেছে আমি জানি না? সময়ের সৎ ব্যাবহার করেছেন আপনারা। সুন্দর একটা বউ পাওয়া তো আপনার ছেলের জন্য বহুত কষ্টের। সেখানে তুরি মেরেই পেয়ো গেছেন। আপনিও কালো, আপনার ছেলেও কালো। মাঝখান থেকে বউ পেয়ে গেছেন দুধের মতো। ভাববেন না যে জিতে গেছেন। আমি তো এই সংসার করবোই না। আজও না কালও না।

সকলে অবাক নেত্রে বুকপূর্ণ ঘৃণা নিয়ে শুনে যাচ্ছে নির্মম সাবিহার কথা। ফারজানা বেগম থমকে গেছেন। আটকে গেছেন তিনি বেশ আগে সেখানেই। কালো কালো বলে সাবিহা যেথায় খোঁচা দিয়েছে। মনটায় নির্মমভাবে আঘাত করেছে। নিষ্ঠুরভাবে একই প্রভুর হাতে নির্মিত হয়েও সাবিহা বলেছে তারা ‘কালো’। চোখ অনিচ্ছায় সিক্ত হলো ফারজানা বেগমের। ঘরভর্তি মানুষের সম্মুখে লজ্জায় মাথা নুইয়ে পরলো নিমিষেই। কালো হওয়া সত্যিই কি দোষের? জীবনভর অসমাদরের খাদে পরে থেকেছে সংসারে। স্বামী, শাশুড়ির আদর, ভালোবাসা কি সম্ভার তা উপলব্ধি হয়নি ফারজানা বেগমের এই এক জনমে। আজ বহুদিন পর আবারও আকাশ কাঁপিয়ে দেওয়া অপমান। নিজের রূপ নেই তা সভ্যর মা জানেন, সইয়ে আসছেন এমন অজস্র কথা। কিন্তু বুকের একমাত্র মানিককে কেউ হেয় করলে সহ্য হবে মায়ের? হবে না তো কখনো! অন্যের না হয় সোনা বরণ রাজপুত্র থাকুক। কিন্তু মায়ের কাছে যে তার সন্তানই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রূপের রচনা। কে দিয়েছে সাবিহাকে তার সভ্যকে অপমান করার অধিকার? রাগ হলো ফারজানা বেগমের। তিনি নত মুখ কঠোর, ঘৃণাপূর্ণ করে উঁচু করলেন। সাবিহার পানে চাইলেন। ততক্ষণে রাহেলা ইসলাম ও আশরাফুল ইসলাম মেয়েকে খ্যান্ত করতে নিবিষ্ট। যেন আদরের কাচের পুতুল অতি যত্নে নাড়াচাড়া করছে তারা। নেই ধমকাধমকি। নেই শাসনের বিন্দুমাত্র সুর।

— রূপ নিয়ে তোমার অনেক বড়াই সাবিহা। করে যাও। আমি তোমার চাচি। কিন্তু তুমি গণ্যই করলে না আমাকে। শোন, রূপ কিন্তু একদিন থাকবে না। নষ্ট হবেই।

— তাই বলে আমিও কালো স্বামীর সংসার করবো না।

দৃঢ় গলায় প্রত্যুত্তর করলো সাবিহা। প্রচন্ড বেয়ারা ছিল তার কন্ঠস্বর।মেয়ের কথায় দাপিয়ে উঠলো রাহেলা ইসলাম। কিন্তু অতি আদরের একমাত্র আত্মার আত্নজাকে কঠোর হয়ে দমাতেও পারছেন না।৷ মাত্রই তিনি অসহায়, অপ্রস্তুত আর ক্ষমাপ্রার্থী দৃষ্টিতে আকুল হয়ে তাকিয়ে রইলেন ফারজানা বেগমের পানে।

— মা চলে আসো। ওর রূপে একদিন ও নিজেই ঝলসে যাবে। বিচার আল্লাহই করবে।

পাথর চোখে হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে, শক্ত চোয়ালে বলে উঠলো সভ্য। সাবিহা মুখ ফিরিয়ে নিলো। সভ্য মায়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এতোক্ষণ সে মৌনতার সনে সখ্যতা গড়ে নিশ্চুপ ছিল। বাসর ঘরের দরজার নিকট ঠাঁই দাড়িয়ে দেখে গেছে সব নাটক। কিন্তু একপর্যায়ে আর অপমান পান করতে পারলো না হৃদয়।

ফারজানা বেগম ছেলের কষ্টে ভেঙে গুড়িয়ে গেলেন ভেতরে বাহিরে। সভ্যর কন্ঠের তীব্র ঘৃণা আর দুঃখের আভাস মায়ের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলেছে। কালো বরণে আচ্ছাদিত সে পুরুষ হোক আর নারী। আপন কর্ণে তারা নিজের রং নিয়ে হেয় বাণী শুনলে কষ্ট পায়। মাত্রাহীন, অসহ্য, অকুলান সেই কষ্ট। যখন কেউ বলে ‘তুমি কালো’। ভূমিকম্পের ন্যায় এক পলকে কোনো এক দূর্যোগে মনটা ভেঙে গুড়িয়ে গিয়ে বারবার জানতে চায় ‘ কেন আমি কালো হলাম?’

— মা আসো।

চলতি পথে ঈষৎ বাঁধা পেয়ে সভ্য আবারও মাকে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানালো। ফারজানা বেগম ফুপিয়ে ছুটে আসা কান্না ঢোগ গিলে আটকে দিলেন। ছেলের হাতটা পরম মততায় ধরলো। যেন তার পিত্রি হারা ছোট খোকাকে কেউ আঘাত করেছে প্রচন্ড। মা হয়ে তা তিনি একদমই সহ্য করতে পারেননি।

— আমি কারো মা হয়ে বলে যাচ্ছি সাবিহা। তোমার গায়ের রং তোমার কাল হোক। তোমার সৌন্দর্যের অহংকার একদিন তোমায় পুড়িয়ে দিক।

মায়ের কথা সভ্যর কানে প্রবেশ করতেই বুকে একটা ধাক্কা লাগলো। সাবিহার ঘরভর্তি লোকের সম্মুখে করে যাওয়া অপমান গুলো তড়াক করে জেগে উঠলো। বুকের চিনচিন ব্যাথার আধিক্য এতোটাই বৃদ্ধি পেলো এখন যে তা অনুভবের বাহিরে। মস্তিষ্ক আর ধরতে পারছে না তার গতি৷

কি দোষ ছিল সভ্যর? যেতে এসে বিয়ে করেছে সে? না তো! সাবিহার বিয়ের জন্য দাওয়াত দেওয়া হলো। মা আর ছেলে চলে এলো সাবিহাদের বাসায়। সভ্যর দাদা, চাচা, বংশের বাড়িতে। চাচতো বোনের বিয়ে। কত দায়িত্ব, কত ঝড় ঝাপটা সামাল দিলো সে এক হাতে। চাচার কোনো দায়িত্ববান ছেলে নেই। যেটা আছে সে মাত্র বারো বছরের বালক। ফুফাতো দু’টো ভাই আর সভ্য মিলে এই গরমের উত্তাপ নিয়ে বিয়ে বাড়ির অতিথিদের আপ্যায়ন করলো। সময় হলো বিয়ের। বর এসেছিল। ঠিক বিয়ে পরানোর আগ মুহূর্তে হঠাৎ বর বলে উঠলো তার জরুরি ফোন এসেছে। উঠে গেলো বিয়ের আসন হতে কবুল বলার আগ মুহূর্তে। সেই যে গেলো তো গেলোই। ফিরলো না আর। মিনিট যায়, ঘন্টা যায়। এক ঘন্টা, দু ঘন্টা পেরিয়ে তিন ঘন্টার মাথায় হৈ চৈ পরলো বাড়িতে। বর পালিয়ে গেছে। প্রথমে ছেয়ে গেলো সকলের মুখ আঁধারে। মানসম্মান হানা দিলো নষ্ট হওয়ার তরে। ধুপধাপ ধুপধাপ বুক নিয়ে সাবিহার বাবা ভেঙে পরলেন। নিস্তেজ, গুড়িয়ে যাওয়া মন নিয়ে চলে গেলেন না হওয়া বেয়াইয়ের সাথে শলাপরামর্শ করতে। কিন্তু তখনই আসল ধোকা। ছেলের বাবাও নেই। ও পক্ষের কোনো মুরব্বির চিহ্ন নেই মেয়ের বাড়িতে। যা আছে শুধু মেয়ে আত্নীয়। তাও মাঝ বয়সী। সমস্যা নিয়ে আলাপ করবার মতো নায় তারা। এ পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে কান্নাকাটি জুড়ে গেলো সাবিহার মা খালাদের। কি হলো এটা? মেয়ের ভবিষ্যত কানা। হঠাৎ করে এমন কেন? উপায়টা মেলে না। তমরাচ্ছন্ন সব দিক। মাথা ঝিমঝিম সবিহার বাবার। পারা প্রতিবেশীদের মুখে সুর উঠেছে, ” ওরা মেয়ের কোনো গোপন দোষ জেনেছে মনে হয়। না হলে এভাবে সব হাওয়া হবে কেন?”। মানা, সহ্য করা অকুলান হলো। সভ্য চিন্তিত মুখে দাড়িয়ে ছিল নিশ্চুপ চাচার পাশে। সাবিহার সমস্ত কাজিনও ছিলো। মোট চারটে বিয়ের যোগ্য পাত্র ছিল ওঘরে। এরমাঝে কপাল পুড়তে হুট করে সাবিহার বাবা হাত ধরে মিনতি জানায় সভ্যর কাছে। “বিয়ে করবে বাবা আমার মেয়েকে? বাচাও এই পরিস্থিতি থেকে আমায়”। সভ্য থতমত খেয়ে যায়। চতক পাখির মতো খুঁজছিল তখন তার মাকে। সাবিহার বাবা ছাড়লেন না। এই ভদ্র, শিক্ষিত, মার্জিত ছেলেকে তিনি চেপে ধরলেন। সভ্যর মা না করতে পারে নি। স্বামী হারা তিনি। একটা পুত্র নিয়ে তার বসবাস। ছেলেকে বিয়ে তো আগে পরে দিতেই হবে। কেমন হবে সে আত্মীয় কে জানে? তার চেয়ে আপনের হাত ধরলে আজীবনের জন্য একটা শক্ত খুঁটি আরো শক্ত হবে। সবদিক বিবেচনা করলে দেখা যায় ভালোি হবে। কিন্তু এ ভালো তো একটা অহংকারী, রূপের বড়াইয়ের মেয়ে দিয়ে হয় না। সভ্য যখন বাসর ঘরে ঢুকলো এক আকাশ সম দ্বিধা, অস্বস্তি নিয়ে তখন সাবিহা লালা রাঙা ওড়নার নিচে রাগে ফোঁস ফোঁস করে। সভ্য ছিল বেজায় অপ্রস্তুত। বোনের মতো না সাবিহা? সে আবার বউ হয়ে গেলো। তাও আবার হুট করে। অজানায়। সভ্য হয়তো কিছু বলতো। থতমত ছিল তার চেহারা। কিন্তু তার আগেই সাবিহা হুড়মুড় করে নেমে যায় বিছানা থেকে। কঠোর কন্ঠে হাত উঁচিয়ে বলে

— আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে মানি না সভ্য ভাই। দূরে থাকবেন আমার থেকে।…. ওয়েট আমি এক্ষুনি সবাইকে জানাবো আমি আপনার মতো কালো মানুষের সাথে সংসার করবো না। আমার এতটুকু ইচ্ছাও নেই। আপনার সাথে আমায় কোন দিয়ে মানায় বলেন?

চলবে……

#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_২

রাত যাচ্ছে রাতের মতো। অপমানের অসহ্য খোঁচায় পুড়ছে সভ্যর বুক। এই অপমান নিয়ে না দাড়ানো যায় প্রভুর কাছে, আর না দাড়ানো যায় অপমান করে যাওয়া হীন মানসিকতার মানবদের কাছে। ত্যাক্ত উত্তপ্ত গরমের সাথেই যোগ হয়েছে যন্ত্রণা। সভ্যর দেহ স্থির কিন্তু মন অস্থির। এক তলা বাড়ির ছাদে নিগূঢ় অন্ধকারকে সঙ্গে নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে ছাদে। বাজে হয়তো রাত তিনটার মতো। বাড়ির সবাই নিজ নিজ ঘরে। সাবিহাও হয়তো বাসর ঘরে বসে এখনও ছটফট করে যাচ্ছে কেন তার বর কালো হলো বলে। সভ্য হাসলো। ঠোঁট বাঁকান হৃদয় পোড়া হাসি। নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের মাঝে চোখে জল আসতে সঙ্কোচ করলো না। দুমড়ে মুচড়ে যেন যাঁতাকল বুকের মাঝে সব পিষিয়ে দিচ্ছে। সভ্য আক্রোশে রাগে দুঃখে একটা আঘাত করলো রেলিঙের ইট বাঁধা দেওয়ালে। সঙ্গে সঙ্গে চোখের জল নাক বেয়ে ভূমিতে গমন করলো। হাতে ব্যাথা পেলেও মস্তিষ্ক রাখলো না সে খোঁজ। সত্যিই কি সভ্য অনেক কালো? নিগ্রদের মতো? সবাই তো বলে সভ্যের গায়ের রং মলিন হলেও সে রাজপুত্র। নাক, মুখ দেহের গড়নে সে ফর্সা মানুষকেও হার মানায়। হয়তো সাবিহার পাশে দাঁড়ালে তাকে অনেক বেশিই কালো মনে হয়। তাই বলে কি সে মানুষ না? এতো দেমাগ কেন সাদা চামড়ার মানুষদের? সভ্যরও একদিন সময় আসবে। সে মলিন,সাবিহা রঙিন তাই তো? থাকবে না বিভেদ। রং নিয়ে খেলার অব্দ এখন ইতিতে। এখন অব্দ, যুগ হলো যোগ্যতার। সভ্য সাবিহার অহংকার টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনবে একদিন। আনবেই সে। রূপ দিয়ে নয়। পরিশ্রম আর যোগ্যতা দিয়ে সে একদিন রঙিন হবে। সেদিন সাবিহার স্থান হবে তার পায়ের নিচে। ঠিক জুতোর তলে।

এমনই সব জেদ বিগড়ে উঠলো মনে। সভ্য ভিজে যাওয়া চোখ আর আটকে আসা দম নিয়ে আকাশপানে চাইলো। মিটিমিটি তারার মাঝে একটা এক ফালি চাঁদ হাসছে। সভ্য খেই সরিয়ে নিলো। হঠাৎ ভাঙা মন নিয়ে সে সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিমান লুকিয়ে রেখে বলে উঠলো

— আমায় কেন কালো বানিয়েছেন এই কৈফিয়ত আমি চাইবো না আপনার কাছে। যে যাই বলুক। আমি খুশি আমার বর্ণ নিয়ে। শুকরিয়া আমি সুস্থ সকল, আমার হাাত পা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ত্রুটিহীন। তবে আমার একটা আবদার রাখবেন আল্লাহ? আমার অপমানের জবাব দেওয়ার মতো একটা সুযোগ আমায় করে দিন।

বড্ড মায়াবী ছিল সভ্যর কন্ঠ। প্রভুর প্রতি তার গাঢ় বিশ্বাস, সন্তুষ্টি আর একবুক যন্ত্রণা নিয়ে বলে ওঠা বাকিগুলো যে অন্ধকার চিঁড়ে পৌঁছে গেছে আরো একটা মানুষের কানে তা কি সভ্য জানে? ফারজানা বেগম কেঁদে উঠলেন অচিরেই। কিন্তু ভুলেও শব্দ করলেন না। শুধু ছেলের কথার পিঠে নীরবে বলে গেলেন ” আমিন, আমিন, আমিন ইয়া রব” এরপরই মুখে হাত চেপে অবাধ্য কান্না আটকানোর প্রচেষ্টা। এক পা দু পা করে পেছানো। ডাকতে আসলেও ডাকা হলো না আর ছেলেকে। তিনি টর্চ হাতে নিঃশব্দে ছেলের অগোচরে প্রস্থান করলেন। পরে রইলো বেদনা নিয়ে সভ্য।

.
তন্দ্রা এলো না গত রাতে। সে সুযোগই পায়নি। ছাদ থেকে সভ্য তখনই নেমে এলো যখন আকাশে বাতাসে লেপিয়ে দেওয়া হলো প্রথম আজান। ফজরের আজান কানে আসতেই সে বেখেয়ালি মনে চলে যায় মসজিদে। নামাজ পরে মন একটু হালকা হলে সে চলে আসে বাসায়। আশরাফুল ইসলামও গিয়েছিলেন মসজিদে। লজ্জায় মেয়ের জামাইয়ের সাথে কথা বলতে পারেননি। সভ্য তাকে দেখলেও এড়িয়ে চলে এসেছে। অন্য দিন হলে চাচার সাথে গল্পে গল্পে আসা হয় মসজিদ হতে।

— আজই চলে যাচ্ছিস সভ্য?

— হুম। কালকে আমার চাকরির ভাইবা আছে।

সভ্য মায়ের কথার উত্তর অত্যন্ত ব্যাস্ত ভঙ্গিতে দিলো। ফর্মাল ড্রেসে সে পরিপাটি। ব্যাগ গোছাচ্ছে। রাজশাহী থেকে ঢাকা যেতে হবে। যদিও দিনভর সময় লাগবে না কিন্তু এই সাত সকালেই তার যাওয়ার তাড়া। সহ্য হচ্ছে না এবাড়ির ছায়াও।

— এটা কিন্তু তেরও বাড়ি সভ্য। তোর বাবার ভিটা। মুখ লুকিয়ে থাকার মতো ছেলে কিন্তু আমি জন্ম দেইনি।

সভ্যর হাত থমকে গেলো। মা ঠিকই তার মনে বিচারণ করে নিয়েছে। ফারজানা বেগম কথাটা বলে ছেলের দিকে স্থির নয়নে তাকিয়ে রইলেন ক্ষণকাল। অতঃপর হনহন করে চলে গলেন ঘর থেকে।

মায়ের ওমন একটা কথার পরপরই সভ্য বাড়ি ত্যাগ করতে পারলো না। নিজ ঘরেই বসে রইলো। ন’টা বাজাতে চলল যখন তখন তার শাশুড়ি এসে ডেকে গেলো তাকে। খাবারের টিবিলে। সভ্য খুঁত খুঁত করা মন নিয়ে চলে গেলো। খাওয়ার টেবিলে সাবিহাও ছিল। নাক মুখ কুঁচকে সে খাচ্ছে। সভ্যর জন্য বিশেষ ভাবে বিশেষ কিছুর আয়োজনও করা হয়েছে। জামাই আদর যাকে বলে। খাওয়ার টেবিল জুড়ে শুধু হরেক পদের খাদ্য। টেবিলে আশরাফুল ইসলাম, সাবিহা আর সাবিহার ভাই ব্যাতিত কেউ নেই। সভ্য দলা দলা অস্তিত্ব নিয়ে বসে যায় চেয়ারে। নেহায়েত সাবিহার মায়ের জোরাজুরিতে।

— সভ্য ভাই আপনার সাথে আমার আমার কথা আছে। আগেই খেতে বসবেন না।

চেয়ার টেনে বাতে না বসতেই সাবিহার তিক্ত মুখের কথা। রাহেলা ইসলাম আপত্তি জানিয়ে বললেন

— আগে খেয়ে নে তারপর কথা বলিস।

সাবিহা শুনলো না। ত্যাড়ামো আর বেয়াদবির উচ্চ পর্যায়ে উঠে সে চলে গেলো বেসিং-এ। হাত ধুয়ে দু মিনিটের মাথায় আবার ফিরে এলো। সভ্য কপালে দু আঙ্গুল চেপে টেবিলে উবু হয়ে ছিল। সাবিহা পেছন থেকে বলে উঠলো

— শুনলাম আপনি চলে যাবেন। তা যাওয়ার আগে আমায় তালাক দিয়ে যান।

সাবিহার সহজ সরল গলা। উপস্থিত সকলে চমকে উঠলো। রান্নাঘর হতে রান্না ফেলে ছুটে এলো ফুফু, খালারা। সকলেই বাক হারিয়ে ফেলেছে। সভ্য মাথা তুলল না। নিজ অবস্থানে অটল থেকে সে বলে উঠলো

— ডিভোর্স দিতে অন্তত তিন মাস লাগে।

— আরে ডিভোর্স তো দিবেনই। এখন শুধু মুখে তিন তালাক দিয়ে যান। বিয়ের বন্ধনটা কেটে উঠুক।

সকলে দমে দমে বিচলিত হচ্ছে। কিন্তু সভ্য স্থির। সে এবার উঠে দাড়ালো। সাবিহার থেকে দু হাত দূরে দাড়িয়ে বলল

— তালাক নিবা?

সাবিহা খুশি মনে বলল

— হ্যা। আমার জন্য ছেলের অভাব নেই। লাইন লেগে আছে। আর তালাক না নিলে বলা তো যায় না আপনি কখন আবার স্বামী হয়ে আমার সামনে এসে দাড়ান।

— হুম ঠিক।

কথাটা বলে সভ্য বেশ স্মার্টলি দাঁড়ালো। নড়ে চড়ে দাড়িয়ে প্রস্তুতি নিলো আপন কর্মের। একবার চোখ ঘুরিয়ে নিলো ঘরের উপস্থিত সদ্যদের উপর। সবাই আছে মোটামুটি। বলা যায় মোরোব্বিরাই আছে। সভ্য আবার চোখ ফেলল সাবিহার দিকে। রয়ে সয়ে অদ্ভুত সুরে তার কন্ঠ হতে উঠে আসছে

— এক তালাক…

এখানেই বাঁধা দিয়ে চেচিয়ে উঠলো রাহেলা ইসলাম। কম্পিত, ভিত কন্ঠে বললেন

— সভ্য বাপ ওর কথা শুনিস না। ও একটা অবুঝ, পাগল।

সভ্য শুনলো না। বরং সে নিজের নজরেরই হেরফের করলো না। তার ছোট মার গলার উপর গলার স্বর তুলে উঁচু কন্ঠে বলল

— দুই তালাক…

সাবিহা চরম খুশি। আনন্দে সে যেন ভেসে যাচ্ছে। ভাইরাল টিকটকার সাবিহার মানসম্মান বেঁচে যাচ্ছে। ভাবনা তার উড়াল দিচ্ছে। সভ্য হাসলো। প্রচন্ড রাগ হয়েছে তার। সকলকে আশ্চর্যের চূড়ায় নিয়ে গিয়ে সে আচমকা সজোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসলো সাবিহার গালে। মুখে বলে উঠলো

— ক্যান্সেল সব তালাক।

সব কিছু এক থাপ্পড়ের শব্দে স্তব্ধ। যেন বোবা হয়েছে সব। সাবিহা তাল সামলাতে না পেরে পিছয়ে গেছে কয়েক কদম। মস্তিষ্ক ফাঁকা। কি হলো এটা?

— আমার সংসারই তোমার করতে হবে। আমার বাচ্চার মাি তোমার হতে হবে। বেয়ার ইন মাইন্ড সাবিহা। তোমার স্বামী সভ্যই থাকবে।

সাবিহা হুঁশ ফিরে পেলো। চোখে তার জল। গড়াগড়ি খেলছে তারা গালে। তীব্র জেদ, রাগ নিয়ে সে এগিয়ে এলো সভ্যর কাছে। হুট করে শার্টের কলার চেপে ধরলো। তেজ আর ঝাঁঝ নিয়ে বলল

— আমায় থাপ্পড় মারার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? আমার উপর জোর করার কে আপনি?

সভ্য সাবিহার কথার পিঠে নিজের কলার হতে ছাড়িয়ে নিলো সাবিহার হাত। মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। অতঃপর হুট করে আবারও থাপ্পড়। সকলের সম্মুখে। সাবিহার বাবা মা এবার এগিয়ে এলেন। সভ্য বলছে

— এই যে থাপ্পড়ের উপর থাপ্পড় মারছি এগুলো আমার অধিকার।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে