রঙ তুলির প্রেয়সী ৮.

0
2457

রঙ তুলির প্রেয়সী
৮.

ঠাস করে ডায়েরিটা বন্ধ করলো তিথি। অস্থির লাগছে ওর। খুব অস্থির লাগছে। চোখ জ্বলছে। নিশ্বাস পড়ছে থেকে থেকে। কান্নারা যেন বাঁধ মানছেই না। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তিথি। অনেকক্ষণ কাঁদার পরে জোরে জোরে বার কয়েক নিশ্বাস নিলো সে। তারপর উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখগুলো ফুলে গেছে কান্না করার কারণে। চোখ মুখ ভালো করে মুছে নিলো সে। নিজেকে খুঁতিয়ে দেখতে লাগলো তিথি। হালকা-পাতলা গড়ন, হ্যাঁ, তার গায়ের রঙ ও ফরসা। তিথি কয়েকবার চোখের পলক ফেললো, এইতো তার চোখের পাপড়িও ঘন। আরেকটু এগিয়ে গেল তিথি আয়নার দিকে। হাত বুলালো ঠোঁটের নিচের ডানদিকের তিল টার ওপর। খুলে দিলো নিজের চুলগুলোর খোঁপা। পিঠময় ছড়িয়ে পড়েছে তিথির চুলগুলো। কোমর ছাড়িয়ে হাঁটুর খানিকটা উপরে। এইতো, তার চুলও কোমরের নিচে… হাসলো তিথি। লজ্জারাঙা হয়ে গেল তার মুখটা। চোখে একটা অদ্ভুত খুশির জোয়ার। বুকে যেন প্রশান্তির ঢেউ। তিথি বিড়বিড় করলো, ‘সে কি একবারও আমাকে ঠিকমতো দেখেছে?’

বাইরে কারো চিৎকারে ঘোর কাটে তিথির। কিছু মুহূর্ত নীরব থেকে বোঝার চেষ্টা করলো কে চিৎকার করছে। তার কানে এলো জাওয়াদ চিৎকার করে বলছে, ‘আমার আলমারিতে কে হাত দিয়েছে? কে আমার ঘরে গিয়েছে?’

কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন নিশ্বাস বুকে আঁটকে গেল তিথির। ঢোঁক গিলতে চেয়েও গিলতে পারছেনা, গলায় আঁটকে আছে। এবার কী হবে! এবার… ভয়ে আত্মা কাঁপতে লাগলো তিথির। সে দৌড়ে গিয়ে ডায়েরিটা হাতে নিলো। তারপর উপরের দিকে মাথা তুলে বললো, ‘আল্লাহ! পাঁচটা মিনিট সময় দিলানা? এক্ষুণি নিয়ে রেখে দিতাম। এবার আমি কী করবো?’

ভয়ে ভয়ে দরজাটা হালকা ফাঁক করলো তিথি। মাথা বের করে দেখলো জাওয়াদ কোথায়। দেখতে পেলো জাওয়াদ নিচে নামছে। তাড়াতাড়ি করে তিথি সাবধানে জাওয়াদের ঘরে গেল। দরজাটা খোলাই ছিলো, ঘরের অবস্থা করুণ। আলমারি খোলা, কাপড়চোপড় সব এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে। তিথি একবার তাকালো ডায়েরিটার দিকে। এভাবে খুঁজছিলো! তিথি ডায়েরিটা আলমারিতে রাখার জন্য এগোলো। পরক্ষণেই চিন্তা করলো – নাহ, আলমারিতে রাখা যাবেনা। ওখানে খোঁজা শেষ। এদিক সেদিক তাকিয়ে হঠাৎ খাটের দিকে চোখ পড়তেই তিথির মাথায় বুদ্ধি এলো। সে ডায়েরিটা খাটের নিচে ছুঁড়ে দিলো। তারপর এক মুহূর্তও ওখানে না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল।
___________________

‘আদিয়া, আদিয়া…’ নিচে গিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো জাওয়াদ আদিয়াকে। হুড়মুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো আদিয়া। মুনতাহাও বেরিয়ে এলেন। হেলাল আহমেদ এর ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনিও চোখ কচলে বেরিয়ে এলেন। মুনতাহা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?’

‘আমার রুমে কে গিয়েছে?’

‘কে যাবে? কেউই তো না।’

‘কেউ একজন গিয়েছিলো। আমার আলমারিতে কে হাত দিয়েছে?’

‘কীসব বলছিস জাওয়াদ? তোর আলমারি কে নাড়তে যাবে?’

হেলাল আহমেদ বললেন, ‘কী হয়েছে সেটা বলোতো?’

জাওয়াদ চিৎকার করে বললো, ‘মাহির ডায়েরি খুঁজে পাচ্ছিনা আমি। কোথায়?’

হেলাল আহমেদ বললেন, ‘ঘরেই কোথাও আছে হয়তো। খুঁজে দেখো ভালো করে।’

‘দেখেছি। নেই।’ বলেই দু’হাতে চুল খামচে ধরে সোফায় বসে পড়লো জাওয়াদ। মুনতাহা তাড়াতাড়ি গিয়ে ওর পাশে বসে বললেন, ‘শান্ত হ। কোথায় যাবে? ঘরেই আছে।’

‘আমি খুঁজছি।’ বলে জাওয়াদের ঘরের দিকে গেল আদিয়া। হেলাল আহমেদ বললেন, ‘জাওয়াদ। রুমেই আছে। আরেকদিন একইভাবে রুমে রেখেই তুমি এমন করেছো।’

‘আমি বলছি আমি খুঁ…’ মাথা তুলে কিছু বলতে গিয়ে জাওয়াদ দেখলো সোফার কাছে জড়োসড়ো হয়ে তিথি দাঁড়িয়ে আছে। জাওয়াদের মনে পড়লো সকালে তিথি তার আলমারি নেড়েছে। মাথায় রক্ত উঠে গেল জাওয়াদের। সে ফোঁস ফোঁস করতে করতে তিথির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ এভাবে জাওয়াদ এসে দাঁড়ানোতে তিথির অস্বস্তি লাগলো। চোখ তুলে জাওয়াদের চোখের দিকে তাকাতেই যেন আত্মা কেঁপে ওঠে তার। আগুন ঝরছে চোখ দিয়ে। জাওয়াদ দাঁতে দাঁত ঘষে তিথির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ইউ! তুমি! ডায়েরি কোথায়?’

‘আ-আম-আমি জা-জা-জানিনা…’ বলেই কেঁদে দেয় তিথি। মুনতাহা উঠে গিয়ে তিথিকে জড়িয়ে ধরে জাওয়াদকে ধমকে উঠলেন, ‘কী করছিস? পাগল হয়ে গেছিস?’

‘এসব কী হচ্ছে জাওয়াদ? ও কীভাবে জানবে?’ হেলাল আহমেদও ধমকালেন।

জাওয়াদ জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে বললো, ‘ও-ই জানে। ও-ই সকালে…’

‘বড় ভাইজান, আফামণি আপনেরে ডাকে। আপনের জিনিস আপনের খাটের তলায় পাওয়া গেছে।’ জাওয়াদের কথার মাঝখানে এসে ভয়েভয়ে কথাটা বললো টুনি। মুহূর্তেই যেন জাওয়াদের মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে একবার তাকালো তিথির দিকে। তারপর বাবা মার দিকে। হেলাল আহমেদ বললেন, ‘দেখলে তো!’

জাওয়াদ তিথির দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে ‘দুঃখিত’ বলেই চলে গেল হনহন করে। তিথি নাক টানতে লাগলো। মুনতাহা তিথিকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে টুনিকে বললেন, ‘যা তো, এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়।’

‘আইচ্ছা।’ বলে চলে গেল টুনি পানি আনতে।

হেলাল আহমেদ এসে তিথির পাশে বসে বললেন, ‘কিছু মনে করো না তিথি মা। ছেলেটা এমনই।’

তিথি চোখ মুছলো। লম্বা একটা শ্বাস নিলো। তারপর ভাবতে লাগলো… এই ছেলে এমন থাকবেনা আর।
_____________________

বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বসে বই পড়ছিলো জাওয়াদ। হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পড়তেই খানিকটা চমকে গেল। তিথি দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। জাওয়াদ বইটা রেখে সোজা হয়ে বসলো। পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তিথির ওপর। কেমন অস্বস্তি লাগলো তার। মনে পড়ে গেল কেমন দুর্ব্যবহার করেছিলো। লজ্জিত বোধ করলো সে।

‘আসতে পারি?’ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো তিথি।

‘হুম। এসো।’ আস্তে করে বললো জাওয়াদ। তিথি ভেতরে এসেই জাওয়াদের পায়ের কাছে বিছানায় বসে গেল। জাওয়াদের পা লম্বা করে রাখা ছিলো, তিথি এভাবে হুট করে এসে বসায় খানিকটা লেগে গিয়েছিলো তিথির হাতে জাওয়াদের পা। তাড়াতাড়ি করে পা সরিয়ে নিলো জাওয়াদ। এমনভাবে সরালো যে তিথির ভ্রু কুঁচকে গেল। মনেমনে বললো, ‘আমার শরীরে কী ইলেক্ট্রিসিটি আছে নাকি? শক লাগছে?’ মুখে বললো, ‘ব্যাথা টেথা পেলেন নাকি? কাঁটা খোঁচা দিলো? আহ দেখি দেখি…’ বলে মাথা এদিক সেদিক নাড়িয়ে জাওয়াদের পায়ের দিকে তাকালো তিথি। হেসে দিলো জাওয়াদ তিথির অবস্থায়। জাওয়াদের হাসি দেখে হাসলো তিথিও।

‘স্যরি পিচ্চি। আসলে তখন, মাথাটা ঠিক ছিলোনা তো…’ একটু অস্বস্তি নিয়ে বললো জাওয়াদ।

‘ইটস ওকে, বাট আমার বয়স আঠারো বছর দুই মাস। দেখতেও মোটামুটি বিয়ের লায়েক, আর বয়সেও। কোনদিক দিয়ে পিচ্চি লাগে আমাকে?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো তিথি।

তিথির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসলো জাওয়াদ। মেয়েটা কী চটাং চটাং কথা বলে রে! সব কথার উত্তর ঝপাঝপ দিয়ে দেয় মাটিতে পড়ার আগেই।

তিথির আবার মাথা ঘুরতে লাগলো একটু একটু করে। এ কী হচ্ছে তার! এমন হওয়ার কথা ছিলোনা… এই হাসি দেখে কেমন যেন মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। বুক করছে ধুকপুক। ঘোরে চলে যাচ্ছে সে।

‘যতোই হোক, আমার তুলনায় অনেক পিচ্চি। নয় বছরের ছোট। আদিয়ার বয়সি মানেই আমার কাছে পিচ্চি।’ হাসি বজায় রেখেই বললো জাওয়াদ।

‘তার মানে আপনার বয়স সাতাশ। এতেই আমি পিচ্চি হয়ে গেলাম? এমন ভাব করছেন যেন মনে হচ্ছে বয়স সাতাশ না আপনার, সাতাশি।’

‘তুমি কি সবসময়ই ঝগড়া মুডে থাকো নাকি?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো জাওয়াদ।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
‘আমি কই ঝগড়া করলাম রে বাবা! যুক্তিতে পারলেন না এখন হয়ে গেলাম আমি ঝগড়াটে? বাহ বাহ।’

জাওয়াদ হালকা শব্দ করে হাসলো। এই হাসি দেখে আবারও মাথা ঘুরালো তিথির। দুরুদুরু বুক নিয়ে তিথি তাকিয়ে থাকলো। জাওয়াদ বললো, ‘আমি পারবোনা, সত্যিই কথায় তোমার সাথে পারবোনা।’

তিথি হেসে বললো, ‘দুই দিনের দুনিয়া। এতো ঝগড়াঝাঁটি করে কী ফায়দা? যতদিন বেঁচে আছি মিলেমিশেই থাকি। ডায়েরিটাতে কী এমন ছিলো?’

জাওয়াদ একটু থমকালো। তারপর মুচকি হেসে আস্তে করে বললো, ‘আমার বেঁচে থাকার কারণ।’

কথাটা কেমন যেন বুকে গিয়ে লাগলো তিথির। মুচড়ে উঠলো যেন হৃদয়টা। সে আস্তে করে বললো, ‘ও।’

‘তিথি, স্যার এসেছেন। পড়তে বসবি না?’ আদিয়া এসে রুমে ঢুকেই স্বাভাবিকভাবেই তিথিকে বললো কথাটা। কিন্তু আদিয়ার আগমনে জাওয়াদ আর তিথি দুজনেই কেমন অস্বস্তি বোধ করলো। জাওয়াদ আদিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘নাহিদকে বলিস পড়ানো শেষ করে থাকতে।’

‘আচ্ছা।’ বললো আদিয়া। তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘গল্প পরে করিস। চল চল।’ বলে সে চলে গেল।

জাওয়াদ তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘যাও। মন দিয়ে পড়াশোনা করো।’

তিথি কোনো কথা না বলে উঠে গেল সেখান থেকে। মনেমনে আদিয়ার টিচারের গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো। আর আসার সময় পেলো না!
_____________

চলবে……
@ফারজানা আহমেদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে