রঙ তুলির প্রেয়সী
১৭.
‘সাহিল, বল দে। তাড়াতাড়ি দে বল, ও তো অলরেডি দুই রান নিয়ে নিছে। আরে ওই চুলকাইস পরে আগে বল দে বে।’
জোরে জোরে চিল্লাচ্ছে রিয়াদ। জাওয়াদ দের ছোট মামার ছেলে, সাত বছর বয়সি সাহিলের কানে এই চিৎকার পৌঁছাচ্ছেই না। সে মাঠে বসে বল হাতে নিয়ে উবু হয়ে পা চুলকাচ্ছে। একটা ছেলে গিয়ে বল চেয়েছিলো কিন্তু সে দেয়নি। ওর চুলকানো শেষ হলে পরে সে বলটা ইটা মেরে রিয়াদের কাছে দিবে। কিন্তু ওর তো চুলকানো ও শেষ হচ্ছেনা। কেউ জোর করে আনতেও পারছেনা। জোর করে আনতে গেলেই মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদবে। যতোক্ষণে ওর চুলকানো শেষ হলো ততোক্ষণে জাওয়াদ জিতে গিয়েছে দৌড়ে দৌড়ে ছয় রান নিয়ে। রিয়াদ কোমরে হাত দিয়ে রাগী চোখ নিয়ে তাকালো সাহিলের দিকে। সাহিল দুহাতে বল ধরে ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে থাকলো। জাওয়াদ হাসতে হাসতে সাহিলের কাছে গিয়ে ওর গালে একটা চুমু খেলো। সাহিল বললো, ‘আমি এক্ষুণি ইটা মেরে স্টাম্প ফেলে দিতাম। শুধু মশাটা কামড় দিয়ে বাগড়া দিলো।’
‘এখন রিয়াদ ব্যাটিংয়ে যাবে। ফেলে দিস ওর বেলা।’ বলে হাসলো জাওয়াদ।
রিয়াদ এগিয়ে এসে বললো, ‘এইজন্যেই আমি তোকে নেইনা খেলায়। দুধভাত বানাই। এমনভাবে চুলকানো শুরু করলি যেন তোর খুজলি হইছে।’
‘এমন করলে কিন্তু বল দেবোনা। এটা আমার বল। তখন কীভাবে খেলো দেখে নেবো।’ বলে একবার মুখ ভেংচি দিলো সাহিল।
রিয়াদ বড় বড় চোখ করে বললো, ‘কতো বড় ব্ল্যাকমেইলার বে তুই! একেতো স্কুল থেকে এসে ফ্রেশ না হয়েই খেলতে এসছিস তার ওপর হুমকি দিচ্ছিস? ছোট মামাকে বলে দেবো কি আমি যে গোসল করিসনি এসে?’
সাহিল কাঁদো কাঁদো হয়ে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ভাইয়া দেখো রিয়াদ ভাইয়া কেমন করছে।’
জাওয়াদ রিয়াদকে একটা ধমক দিলো। সাহিল তা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। জাওয়াদ রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘শোন, এই কাদার মধ্যে আমি আর থাকতে পারবোনা। খেল তোরা। আমি গেলাম।’
‘বুঝি বুঝি, কেন যেতে চাচ্ছিস।’ চোখ টিপ দিলো রিয়াদ।
জাওয়াদ হাঁটতে হাঁটতে পিছু ফিরে তাকিয়ে বললো, ‘এক চামচ বেশি বোঝার অভ্যাস টা ছাড় রিয়াদ। এটা অপকারী।’
রিয়াদ হাসলো। তারপর সাহিলের মাথায় আস্তে করে একটা গাড্ডা দিয়ে বললো, ‘চল বলটা অভিক কে দে। আর চুপচাপ এইখানে দাঁড়িয়ে থাক। বল আসলে ধরিস।’
‘আচ্ছা।’ বলে দাঁড়িয়ে থাকলো সাহিল।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
সিঁড়িতে বসে হাঁপাচ্ছে আর কাঁদছে তিথি। হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। নাকে অনেক পানি ঢুকেছে মনে হচ্ছে, জ্বলছে নাকে। অনেক পানি গিলেছেও। একটু পর পর কাশছে সে। কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ালো তিথি। তারপর কাপড় পাল্টাতে লাগলো। তার মনে হচ্ছে সে যেন এক্ষুণি মরার মুখ থেকে ফিরে এলো। পানিতে যখন মনে হচ্ছিলো যে এক্ষুণি সে ডুবে যাবে, কিন্তু এখনও কেউ আসছেনা, তখনই আল্লাহর নাম নিয়ে এলোমেলো ভাবে হাত নেড়ে নেড়ে কোনোমতে সামনে এগিয়ে এসেছে। এইভাবে এগিয়ে আসতে গিয়ে অনেক পানি নাকেমুখে ঢুকেছে তার। সিঁড়িতে এসে কোনোমতে পা ফেলে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে নিশ্বাস নিলো সে। একটু আগের কথা যতোবারই মনে হচ্ছে তিথির, ততোবারই তার কান্না বাড়ছে। ভেজা কাপড় পাল্টে আবার গিয়ে এজটা শুকনো সিঁড়িতে বসলো তিথি। কান্না থামছে না তার। নুহা এমন করলো কেন ভেবে পাচ্ছেনা তিথি। কাউকে নিয়ে এলো না কেন? তিথি যদি মরে যেতো? এসব ভাবতেই আরো বেশি কান্না পেলো তিথির। দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো সে এবার শব্দ করে।
পায়ে একটু একটু কাদা লেগে আছে জাওয়াদের, তাই সে বাড়িতে ঢোকার আগে পুকুরে আসলো পা ধুতে। কিন্তু এসে দেখলো কেউ একজন বসে বসে কাঁদছে শব্দ করে। মাথায় তোয়ালে পেছানো, পেছন থেকে বোঝা যাচ্ছেনা কে। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করলো, ‘কে? কী হয়েছে?’
তিথি মাথা তুললো। কণ্ঠটা শোনার সাথেসাথেই চিনেছে সে। পেছন ফিরে তাকালো সে। তিথিকে দেখে অবাক হলো জাওয়াদ। সে তাড়াতাড়ি তিথির পাশে গিয়ে অবাক কণ্ঠে বললো, ‘তিথি! কী হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি?’
তিথি উঠে দাঁড়ালো। এক মুহূর্তও দেরি না করে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো জাওয়াদকে। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ঐ মুহূর্তে জাওয়াদের মনে হলো তার শরীরে কেউ বিদ্যুতের তার ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। বারংবার বিদ্যুৎ খেলছিলো তার সর্বাঙ্গে। কোনোরকমে কাঁপা কাঁপা হাত দুটো সে তিথির পিঠে রাখলো। জাওয়াদের শরীর অসাড় হয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু সে নিজেকে কোনোমতে সামলালো। ঢোঁক গিললো। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে, তিথি? কাঁদছো কেন? আমাকে বলো।’
তিথি কিছু বলছে না। কেঁদেই যাচ্ছে। জাওয়াদ একটু ধাতস্থ হলো। তার মাথায় এলো, তিথি এখানে একা। তারপর খেয়াল হলো তিথির মাথায় তোয়ালে পেছানো, মানে সে গোসল করেছে। এক মিনিট, তিথি তো সাঁতার জানেনা! জাওয়াদ তিথিকে ছাড়িয়ে তার দু’কাঁধে হাত রেখে চোখের দিকে তাকালো। তিথি তখন কান্না বন্ধ করেছে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। তার চোখ মুখ অস্বাভাবিক রকমের লাল। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে? এই অবস্থা কেন তোমার? নাক মুখ এমন কেন?’
তিথি কিছু বলতে নিলো আর তখনই পেছনে আদিয়ার গলা শোনা গেল, ‘তিথি! কী হয়েছে? বড় ভাইয়া, কী হয়েছে?’
উদ্ধিগ্ন হয়ে ছুটে এলো আদিয়া। তার পেছন পেছন ফাহি। তিথি তখন মোটামুটি স্বাভাবিক। সে নিচের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। জাওয়াদ বললো, ‘ওকে একা এখানে আসতে দিলি কেন? তোরা কেউ এলিনা কেন?’
‘আরে নুহাপু নিয়ে এসেছিলো তো। পরে নুহাপু চলে গেল ঘরে। জিজ্ঞেস করতেই বললো তিথি ওর সামনে গোসল করতে সংকোচ বোধ করছিলো আর বলেছিলো নাকি সে একা পারবে। তাই চলে গেছে।’ তিথির পাশে এসে দাঁড়িয়ে দু’হাতে তিথিকে ধরে বললো আদিয়া। ফাহিও একই কথা বললো। তিথি এই কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে এমন মোটেও বলেনি। আর নুহা এমন কথা বললো কেন? এভাবে ওকে এখানে ফেলে গিয়ে… নাহ, গড়মিল আছে কিছু একটা। কিন্তু সেটা কী?
‘হোয়াট! তোরা নুহার সাথে ওকে এখানে পাঠিয়েছিস?’ চেচিয়ে ওঠে জাওয়াদ। তিথি কেঁপে ওঠে জাওয়াদের চিৎকারে।
‘কেন কী হয়েছে? আমরা খেলছিলাম তাই…’ ভয়ে ভয়ে বললো আদিয়া। ফাহি একেবারেই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। জাওয়াদ রাগে দাঁতে দাঁত ঘষে। মাটিতে পা দাপায় দু’বার। তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছিলো তিথি? সত্যি করে বলো।’
‘কি-কিছুনা!’ ঢোঁক গিলে তিথি। জাওয়াদকে দেখে ভয় পাচ্ছে সে। সত্যিটা বলে দিলে যে এখন কিয়ামত হয়ে যাবে সেটা ভালোই টের পাচ্ছে সে। রাগে জাওয়াদের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।
‘কিছুনা তো এখানে বসে কাঁদছিলে কেন? আর নাক মুখ লাল কেন?’ চেচিয়ে উঠলো আবার জাওয়াদ।
তিথি আবার কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘মায়ের কথা মনে পড়ছিলো। মাও পুকুরে গোসল করতো।’
জাওয়াদ যেন একটু নরম হলো। সে বললো, ‘ঠিক আছে কেঁদোনা। যাও ভেতরে যাও।’
তিথি উবু হয়ে বসে নিজের কাপড় কাচতে লাগলো। জাওয়াদ বিরক্তি নিয়ে ফাহি আর আদিয়ার দিকে তাকালো। ফাহি তাড়াতাড়ি বললো, ‘এই তিথি, কাপড় কাচার মানুষ আছে। তুমি উঠে আসো তো।’
তিথি নিঃশব্দে উঠে গেলো। আদিয়া তিথির হাত ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে লাগলো। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে দেখলো তিথি। জাওয়াদ তাকিয়ে আছে। তিথির মনে পড়লো, একটু আগে সে জাওয়াদের আষ্টেপৃষ্টে ছিলো। তখন একদম লজ্জা লাগেনি। কিন্তু এখন যেনো সমস্ত লজ্জা এসে জড়ো হলো তিথির দু’গালে। তিথি মুখ ফিরিয়ে হেসে দিলো।
যাকে ভালোবাসা যায়, তার চোখের ভাষা নাকি পড়া যায়? সে মিথ্যা বললে নাকি চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেলা যায়? তিথির চোখের দিকে তাকিয়ে জাওয়াদের মনে হয়েছিলো, তিথি মিথ্যা বলছে। কিছু একটা হয়েছিলো যা তিথি আড়াল করেছে। একইভাবে তিথিরও মনে হয়েছে, তার মা-কে মনে পড়ার যে মিথ্যা কথাটা সে বলেছে সেটা জাওয়াদ বিশ্বাস করে নি। একদম করে নি।
__________
চলবে……..
@ফারজানা আহমেদ