রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব-৮+৯

0
614

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ০৮
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১৫,
২০১৯, সেপ্টেম্বর মাস। জার্মানির উরজবার্গ শহর। নিজেদের হাউজের ব্যালকনিতে দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে চলেছে একজন কিশোরী। শরৎ এর প্রথম বৃষ্টি! ইশশ, অনুভূতিটাই অন্য রকম। প্রাথমিক শিক্ষার স্তর পেরিয়ে সদ্য গেমনেজিউম বা হাইস্কুল স্তরে পা দেওয়া ১৬বছরের কিশোরী সে। পড়াশোনা করছে গ্রেড ইলেভেন বা ইন্টার ১ম বর্ষ-ই বলা চলে। সকাল ৮-৫টা কলেজ দৌড়ে এসে বাসায় পা দিতেই বৃষ্টির পানি টুপটাপ করে পরতে শুরু করেছে। কিশোরীর মন মানলো না। কাঁধ থেকে ব্যাগ ছুড়ে মেরে ঝাপিয়ে পরলো বৃষ্টির বুকে। বৃষ্টির বুকে সে পরলো! নাকি তার বুকে বৃষ্টির ফোঁটার প্রশান্তি ঝাঁপিয়ে পরলো! বুঝতে পারলো না সে। দুহাত শূন্যে মেলে চোখ বন্ধ করে আকাশপানে মুখ উঁচিয়ে নিজমনে ভিজতে ব্যস্ত সে। প্রায় আধঘন্টা এভাবে কেটে যেতেই ভেতর থেকে তার বড় বোনের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো। শুনতে পেলো,

“রিয়ু আর কত ভিজবি? আব্বু বাসায় আসবে একটু পর। তোকে ভিজতে দেখলে বকবে! খুব করে বকবে বলে দিলাম।”

রিয়ানা বড় বোনের কথা শুনে স্মিত হাসলো। বকা! সে তো রোজই শুনে। কোনদিন আবার বাদ না যায়! রিয়ানা নড়লো না। বৃষ্টির ফোঁটা থামার অপেক্ষায় ব্যালকনির গ্রিলে হাত রেখে একটু উবু হয়ে আগের ন্যায় ভিজতে মত্ত হলো। আয়াত রিয়ানার রুমে এসে সোজা ব্যালকনির দরজার সামনে এসে দাড়ালো। এক হাত বাড়িয়ে বোনের টিশার্ট টেনে ধরে ঘরে ঢুকিয়ে দিলো৷ রিয়ানা বিরক্ত হলো। বললো,

“এটা কেমন কাজ আপু? শান্তিতে বৃষ্টিতেও ভিজতে পারবো না? দেখছিস তো চারিদকে বৃষ্টির ফোঁটা! প্রকৃতিতে কত শান্তির ছোঁয়া। একেকটা বৃষ্টির ফোঁটা প্রকৃতির সমস্ত কষ্ট, আবর্জনা ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভালো-ই তো লাগছিলো।”

আয়াত কটমটিয়ে বোনের দিকে তাকালো। শাসনের সুরে বললো,

“তোর ঠান্ডা বেশি। অনেক ভিজেছিস, যা ভিজেছিস! তাতে না জ্বর বাঁধিয়ে বসিস।”

রিয়ানা কথা বাড়ালো না। ক্লোজেট হতে নিজের পছন্দ মতো শর্ট জিন্স আর স্লিভলেস টপস নিয়ে ঢুকে পরলো ওয়াশরুমে। আয়াত তাকিয়ে দেখলো এক ঝলক। হলো! আজও বাবার সাথে তুমুল কান্ড বাঁধবে ছোটো বোনের, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ রইলো না আয়াতের৷ সে রিয়ানার রুম ছেড়ে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচতলায় নেমে কিচেনের দিকে পা বাড়ালো। আজ বাসায় নতুন অতিথি আসবে একজন৷ তার বাবা সে-ই অতিথিকে রিসিভ করতে চলে গিয়েছে রেস্টুরেন্ট থেকে। আয়াতের বাবা হানিফ সাহেবের নিজস্ব ছোটোখাটো একটা রেস্টুরেন্ট রয়েছে জার্মানিতে। যেটা চালিয়েই তাদের জীবিকা চলে। ১০বছরের কাছাকাছি হলো তারা জার্মানিতে আছে। আয়াতের বাবা হানিফ সাহেবের বাড়ি, গাড়ি, নিজস্ব কর্মসংস্থান, জার্মানির সিটিজেনশিপ সবকিছু মিললেও আফসোস একটা জায়গাতে। তা হলো ছোট মেয়েকে মানুষ বানাতে পারলেন না। ঠিক এই জায়গা টাতেও বাবার সাথে আফসোস হয় আয়াতের। তার বোন-টা যদি একটু তার মতো হতো! তবে বাবার সাথে সুন্দর একটা সুসস্পর্ক হতো। দিনদিন রিয়ানা বড় হচ্ছে! তাতে তার উচ্ছৃঙ্খলতা যেন আরও বাড়ছে। দিনশেষে বাবা-মেয়ের সম্পর্ক-টা ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে থামে! এটা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই আয়াতের। রিয়ানার থেকে সাড়ে চার বছরের বড় সে। বড় হয়েই যেন বিপদ! মা বিহীন পুরো সংসারের ঝামেলা টানতে হয় তাকে। রিয়ানার মতো ছোট হলে জীবন-টা একটু উপভোগ করেই পার করতে পারতো হয়তো। কিচেনে দাড়িয়ে চুলোয় তরকারি চাপিয়ে আনমনে এসবই ভাবছিলো আয়াত। তখুনি কিচেনে আসে রিয়ানা। এসে বোনকে উদ্দেশ্য করে শুধালো,

“কি ভাবছিস আপু?”

আয়াত খেয়াল করেনি রিয়ানা এসেছে। তাই রিয়ানার প্রশ্ন কর্ণগোচর হতেই মাথা দুলিয়ে বললো,

“না, কিছু ভাবছিনা।”

“আ’ম ড্যাম সিওর, তুই কিছুনা কিছু তো অভিয়্যাসলি ভাবছিলি। ঝটপট বলে ফেল কি ভাবছিস?”

আয়াত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নিজের চিন্তাভাবনা সবটুকুই রিয়ানাকে বললো। সব শুনে রিয়ানা আলতো হাসলো। সে এসেছিলো কফি বানিয়ে নিয়ে যেতে। আয়াতের চিন্তা-ভাবনা দেখে সে আর কথা বাড়ালো না। কফি মেকারে নিজের জন্য কফি বানিয়ে নিজের কক্ষপানে পা বাড়ালো। আয়াত সেদিকে খেয়াল করে রিয়ানার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো,

“আজ একটু লং ড্রেস পরিস! বাসায় অতিথি আসবে।”

“কে আসবে?”

১৬,
রিয়ানা থেমে পিছন ফিরে বোনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো। আয়াত উত্তর দিবে! এর আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো। বাবা এসেছে ভেবে একবার বোনের দিকে তো একবার দরজার দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো আয়াত। কিচেন ছেড়ে লিভিং রুম পেরিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই দেখলো সামনে দাড়িয়ে আছে তার বাবা এবং উনার অতিথি। অতিথি বললে ভুল হবে। তার এবং রিয়ানার কাজিন। সে এসেছে ভিজিট ভিসায় জার্মানিতে ঘুরতে। আয়াত এবং রিয়ানার বড় বাবার ছেলে সে। আয়াত দরজা থেকে সরে দাড়াতেই দুজনে বাসায় ঢোকে। আয়াত দরজা আঁটকিয়ে তার বাবার সাথে আসা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে জিগাসা করে,

“কেমন আছেন সাজ্জাদ ভাই!”

ছেলে-টা ততক্ষণে লিভিং রুমের সোফা বসে পরেছে। বৃষ্টির পানি বেশ শরীরে পরেছে তার। মাথা ব্যথা ধরে গেছে। সে আয়াতের কথার উত্তরে বললো,

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো ছিলাম। তোমাদের শহরে পা রেখে আপাতত মাথা ব্যথা ধরেছে। এক কাপ ব্ল্যাক কফি হবে আয়াত? মাথা-টা হালকা করা জরুরী।”

সাজ্জাদ, তার সাথে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা বলেছে আয়াত। তাই দুজনের মাঝে তেমন সংকোচ নেই। আয়াত সাজ্জাদের কথামতো কফি বানানোর জন্য কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলো। হানিফ সাহেব সাজ্জাদকে বললেন,

“কফি বানাক আয়াত, ততক্ষণে ফ্রেশ হবে চলো। রুম দেখিয়ে দেই তোমায়।”

“না চাচ্চু, আমি আগে কফি পান করবো, এরপর ফ্রেশ হওয়া। সত্যি মাথা-টা প্রচুর যন্ত্রণা দিচ্ছে। কফির মাঝে সাঁতার কাটি তো! এজন্য কফি ছাড়া চলছেনা। পুরো ফ্লাইট নিজের মন মতো কফি পান করতে পারিনি।”

হানিফ সাহেব হাসলেন, বললেন,

“তবে তুমি বোসো। আমি তোমার লাগেজ-টা নিয়ে যাই। এরপর রুমে চলে এসো।”

সাজ্জাদ হেসে মাথা দুলালো। দৃষ্টি স্থির হলো সিড়ির কাছে অবস্থান রত কিশোরী রিয়ানার উপর। কিন্তু রিয়ানা! সে সাজ্জাদকে দেখে তেমন একটা গায়ে মাখলো না। ছোটো ছোটো চাহনীতে সাজ্জাদকে একবার পরখ করে হাতে থাকা কফির মগ সেখানে দাড়িয়েই ফাঁকা করে ফেলেছে। বাবা এবং সাজ্জাদের সামনে দিয়েই কফির মগ কিচেনে রেখে হনহনিয়ে হাঁটা ধরে নিজের রুমের দিকে। হানিফ সাহেব একবার মেয়েকে দেখলেন। আয়াতের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন। আয়াত বাবার দৃষ্টি বুঝতে পেরেই ভয়ে ঢোক গিললো। তার বাবা বলে দিয়েছিলো, আজ যেন সে রিয়ানাকে লং ড্রেস পরায়। কিন্তু সে হওয়ার আগেই তো বাসায় নতুন মানুষ হাজির। কোনো চেচামেচি না হলেই ভালো। কফি বানানো শেষ হতেই আয়াত কফির মগ টা সাজ্জাদের সামনে এসে এগিয়ে দিলো। সাজ্জাদ কফির মগ-টা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বললো,

“ও রিয়ানা! তাই তো চাচ্চু?”

“হ্যাঁ, বাবা।”

“আমি বড় ভাই এসেছি। এভাবে কথা না বলেই চলে গেলো?”

” ও একটু এমনই, বদমেজাজি।”

“ওহ, পিচ্চি মেয়ের এত এটিটিউড! পুরোই এটিটিউড কুইন।”

সাজ্জাদ বিস্মিত হয়ে আনমনে কথা-টা ভাবলো। আয়াতকে দেখলেও রিয়ানা-কে দেখা হয়নি সাজ্জাদের। ফোনে কখনও কথাও হয়নি। ৭-৮বছরের একটা পিচ্চিকে দেখেছিলো সে। এরপর! সময়ের স্রোতে চাচ্চু, বড় চাচাতো বোন আয়াতের সাথে কথা হলেও রিয়ানার কথা তাদের মুখে শুনলেও ফোনে কথা বলা হয়ে উঠেনি। আর নিজের জীবনের ব্যস্ততার জন্য রিয়ানাকে নিয়ে ততটা মাথাও ঘামায়নি সাজ্জাদ। তাই রিয়ানা বড় হওয়ার পর তাকে সরাসরি এটাই প্রথম দেখা সাজ্জাদের। ছবিও দেখা হয়নি রিয়ানার। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার এসব নিয়ে ভাবতে গিয়েই বাকি কোনো বিষয় নিয়ে ভাবার সময় হয়নি তার।দেখা হওয়ার পর যে এটিটিউড দেখলো রিয়ানার! মনে বেশ আগ্রহ জমলো এই এটিটিউড কুইনের সাথে ভাব জমানোর। সে কফি পান করা শেষ করেই হানিফ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“চাচ্চু, রিয়ানার সাথে তো আমার তেমন কথাও হয়নি, পরিচিতও নই আমরা। এখানে লং টাইম থাকবো। একটু আলাপ করে আসি! ওর রুমটা!

হানিফ সাহেব মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে বললেন,

” উপরের তলায় ১ম রুমটা। উপরে উঠতেই প্রথম রুমের পর ২য় যে রুম! ওটা তোমার জন্য ঠিক করা হয়েছে। তুমি চাইলে ওর সাটাইম কথা বলে রুমে গিয়ে ফ্রেয় হতেও পারো।”

মুখে হাসি রেখে কথা-টা বললেও হানিফ সাহেব মনে মনে ভয়ও পেলেন। রিয়ানা না বাজে বিহেভিয়ার দেখায় সাজ্জাদকে। সাজ্জাদ চাচার কথামতো লাগেজ হাতে নিয়ে সিড়ি বেয়ে সোজা উপরে উঠলো। প্রথম রুমটা নজরে পরতেই দরজায় গিয়ে নক করলো। দরজা ভেজানো ছিলো। ভেতর থেকে শব্দ আসলো,

“,আপু হলে রুমে আয়, ড্যাড হলে আপনার আসার প্রয়োজন নেই। অন্য কেউ হলে গো টু হেল। আমার রুমে আসবে না অপরিচিত কেউ। একদম নয়।”

সাজ্জাদ মৃদু হাসলো রিয়ানার কথা কানে আসতেই। সে দরজা হালকা খুলে মাথা ঢুকিয়ে বললো,

“হেই এটিটিউড কুইন!”

রিয়ানা ফোন নিয়ে রাতে নাইট ক্লাবে যাবে বলে ফ্রেন্ড’স দের সাথে মেসেজিং করছিলো। এটিটিউড কুইন শব্দ-টা কানে যেতেই চকিতে চমকে দরজার দিকে তাকায় রিয়ানা। সাজ্জাদ হাসিমুখে দরজা হালকা খুলে দাড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আচ্ছা বিরক্তিকর লোক তো!

১৭,
বর্তমান, রোজার কোমড় জড়িয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে রিয়ানা অতীতের স্মৃতির পাতায় বিভোর হয়ে পরেছিলো। কান্না করতে করতে মাথা ব্যথাও ধরে গিয়েছে তার। রোজা রিয়ানা-কে কাঁদতে দেখে কিছু বললো না। শান্তিমতো কাঁদতে দিলো রিয়ানাকে। কান্না করে যদি মন হালকা হয়! এজন্যই রিয়ানাকে কান্না করতে ছেড়ে রেখেছিলো রোজা। তখুনি তার রুমের সামনে আসলো রায়াদ। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বললো,

“তখন মা’য়ের কথা বলায় আপনি বেশিই কষ্ট পেয়েছেন বোধ হয়! এজন্য কান্না করছেন তাই তো? দেখুন কথার আঘাত তো ফিরিয়ে নেওয়া যায় না! তবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী আপনার কাছে৷ প্লিজ আমায় ক্ষমা করবেন।”

রিয়ানার কানে রায়াদের কথা গুলো কানে যেতেই তার কান্না থেমে গেলো। এই লোক মায়ের কথা মনে করিয়ে দিলো আবার! রিয়ানা রোজাকে ছেড়ে উঠে দাড়ালো। বারান্দার দিকে পা বাড়িয়ে কণ্ঠ শক্ত করে বললো,

“আপনি আপাতত আমার সামনে আসবেন না। মানে এই রুমের আশেপাশে। আমার আপনাকে বিরক্ত লাগছে প্রচুর।”

রায়াদের মনে ক্ষোভ জন্মালো। মেয়ে-টার কষ্ট বুঝে ক্ষমা চাইতে আসলো! আর এ মেয়ে তাকে বিরক্তিকর বলে অপমান করে দিলো! কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে, এমন সময় রোজা ভাইয়ের সামনে এসে দাড়ায়। ইশারায় বোঝায় কিছু না বলতে। এরপর বললো,

“রিয়ানা আপু, তুমি যাওয়ার পর পর মা ডেকেছিলো, এরপর থেকেই কাঁদছে। এত কেঁদে নিশ্চিত মাথা ধরেছে তার। কিছু বলো না। প্লিজ আপাতত দুজন নিজেদের মাঝে দ্বন্দ করো না।”

রায়াদ থেমে গেলো। বোনের কথা মতো স্থান ত্যাগ করলো। ড্রইং রুমে আসতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। রায়াদ আন্দাজ করলো হয় জুবায়ের নয়তো হানিফ আংকেল এসেছে। দুজনের কে এসেছে! এটা চিন্তা করতে করতেই দরজা খুলে দিতে সেদিকে এগিয়ে যায় রায়াদ।

চলবে?

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ০৯
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১৮,
সকালবেলায়, নিজের স্বভাব সুলভ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে কফির জন্য রুম থেকে বের হলো রিয়ানা। পরনে লেডিস ট্রাউজার, হাফ স্লিভ টপস। কত্তগুলো দিন পর গলায় ওরনা ঝুলাতে হলো না। অনেকদিন পর শান্তি শান্তি লাগছে রিয়ানার। গতকাল রাতেই তার বাবা-বোন এসে পরায় আলাদা ফ্লাটে যে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে! সেখানে এসে পরে ডিনার করে। এই ফ্লাটে তো আর রায়াদ নামক মানুষের অসুবিধা হওয়ার মতো কিছু ঘটবেনা। তাই রিয়ানা নিজের সস্তি অনুযায়ী ড্রেস পরে বের হলো রুম থেকে। আয়াত কিচেনে হয়তো ব্রেকফাস্ট বানাতে ব্যস্ত। তা আন্দাজ করে রিয়ানা কিচেনের দিকে পা বাড়ালো। ইয়াসিন আংকেলের সাহায্যে তার বাবা যে এখানে থাকার জন্য যা যা জরুরী, সব করে ফেলেছেন। তা জানে রিয়ানা। তার বাবা আসার সময়ই সব নিয়ে এসেছে। রাতে রায়াদ, ইয়াসিন সাহেব এবং তার বাবা মিলে সবটা সেট করে ফেলেছে। তাই আন্দাজ মতো কিচেনে আসলো সে। কিন্তু কিচেনে এসে অবাক হলো রিয়ানা। পুরো কিচেন ফাঁকা। তার বোনকে কোথাও নজরে পরলো না। হয়তো ফাতেহা আন্টির কাছে গেছে। এই ভেবে রিয়ানা কিচেন জুড়ে কফি মেকার খুজতে লাগলো কফি বানানোর জন্য। কিন্তু কোথাও সেটি খুজে পেলো না। রিয়ানা কিচেন থেকে বেরিয়ে একটু চেঁচিয়েই ডাকলো,

“আপু, এই আপু।”

কিন্তু তার কণ্ঠই প্রতিধ্বনি হয়ে তার কানে আসলো। কোনো সাড়াশব্দ নেই। স্ট্রেঞ্জ! সবাই গেলো কোথায়। রিয়ানা বাবার সামনে যাবেনা ভেবেও তার বাবা যে রুমে থাকবেন বলে ঠিক করেছেন! সেদিকে পা বাড়ালো। কিন্তু সেখানে গিয়েও রিয়ানা হতাশ হলো। তার বাবাও রুমে নেই। আচ্ছা ইয়াসিন আংকেলের বাসায় যায়নি তো! এই চিন্তা মাথায় আসতেই সে তাড়াহুড়ো করে বাসার মেইন ডোর খুলে বেরিয়ে সিড়ির সামনে এসে সিড়ি বেয়ে নিচে নামার জন্য পা তুলতেই রিয়ানার নিজের ড্রেসের দিকে নজর গেলো। এভাবে গেলে আবার কোনো বকা দিবে তার বাবা? মোটামুটি ড্রেস তো ঠিক-ই আছে। এত ড্রেস পাল্টানো যায় নাকি রিয়ানা সেদিকে নজর দিলো না। হনহনিয়ে হেঁটে নিচতলায় এসে রায়াদদের বাসার সামনে দাড়িয়ে দরজায় কলিং বেল বাজালো৷ বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দরজা খুলতেই রায়াদের ক্ষিপ্ত গলার স্বরে ভেসে আসে কিছু কথা,

“তোকে আসতে বললাম রাতে! তুই সকালে কি করতে আসছিস? কিল খাইতে?”

রায়াদের কথা শুনে রিয়ানা হতভম্ব। সে ভ্রুকুটি করে তাকায় রায়াদের দিকে। কোনো জবাব দেয়না বা প্রশ্নও করেনা। রায়াদকে পাশ কাটিয়ে বাসায় ঢুকে পরে। রায়াদ নিজেও এই ঘটনায় কিছু টা অপ্রস্তুত হয়ে পরে। সে তো ভেবেছিলো জুবায়ের। গতকাল রাতে আসতে বলায় তো আসেনি। সেজন্য ভেবেছে হয়তো সে-ই এসেছে। কিন্তু রিয়ানা আসবে এটা ভাবেনি সে। তাছাড়া এই মেয়ের সকাল ৮টায় ঘুম ভেঙেছে! এটা একটু আশ্চর্যজনক-ই মনে হলো রায়াদের। সে দরজা লাগিয়ে দিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। সবাই নাস্তার টেবিলে সকালের নাস্তা করতে বসেছে। রায়াদের খাওয়া আগেই শেষ হওয়ায় সে উঠে দরজা খুলে দিতে যায়। আর এই কাণ্ড ঘটে বসে। রায়াদ ডাইনিং টেবিলের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। কি জাতের মেয়ে-রে বাবা। একটা টু শব্দ করলো না। রায়াদ হাফ ছাড়ে। যে ছেলের কপালে এ মেয়ে আছে, তার জীবন নিশ্চিত শেষ। রিয়ানার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে রায়াদ। ফোন হাতে নিয়ে কল লাগায় জুবায়েরের কাছে। কিন্তু সুইচ ওফ পায় জুবায়েরের নাম্বার। ফোনে জুবায়েরের নাম্বারের দিকে তাকিয়ে অবাক হয় রায়াদ। ওর ফোন তো কখনও ওফ থাকে না। তবে এখন ওফ দেখাচ্ছে! আসতে বলেছে, অথচ আসেওনি। এমন টা আগে কখনও হয়নি যে, জুবায়েরকে রায়াদ ডেকেছে আর জুবায়ের আসেনি৷ ছেলে-টার কিছু হলো না তো! এই চিন্তায় রায়াদ বাইকর চাবি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পরে বাসা থেকে। যাওয়ার সময় ফাতেহা খানম ছেলেকে লক্ষ্য করে চেঁচালেও গায়ে মাখলোনা রায়াদ। গুরুত্ব পূর্ণ কাজ আছে বলে বেরিয়ে যায়।

১৯,
রিয়ানা এসে বসে পরেছে আয়াতের পাশে। বাবা আর আয়াতকে খুজতে এসে এই বাসাতেই পেলো। ইয়াসিন সাহেব নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে আজকের দিনের দাওয়াত দিয়ে এসেছিলেন গতকাল রাতেই। নিজের রুমে ঘুমিয়ে থাকায় রিয়ানা এই বিষয় টা জানতোনা, আর আয়াতও তাকে কিছু বলার সুযোগ পায়নি। সমস্যা এক জায়গাতেই। রিয়ানাকে ঘুম থেকে উঠালে ওর মাথা ব্যথা করে। নিজ ইচ্ছেয় যতক্ষণ না উঠবে, রিয়ানাকে ঘুমাতে দিতে হয়। এজন্য জানানো সম্ভব হয়নি। আয়াত, রিয়ানা, রোজা একপাশে বসেছে। ইয়াসিন সাহেব এবং হানিফ সাহেব একপাশে। ফাতপহা খানম সবাইকে সব টা সার্ভ করে দিয়ে দাড়িয়ে আছেন। হানিফ সাহেব উনাকে বসতে বলার পরও বসাতে পারলেন না। খাওয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে সবারই। রিয়ানা শুধু কোনো রকমে ডিম ভাজি দিয়ে একটা পরোটা খেলো। তেলযুক্ত খাবার সে খেতে পারেনা। কিন্তু আজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে সব-ই বাঙালি খাবার। কোনো জুস, স্যান্ডুইচ, ব্রেড পেলোনা রিয়ানা। এজন্য পেটে ক্ষুধা নিয়েই উঠে পরলো। ফাতেহা খানম বিষয়-টা খেয়াল করলেন। রিয়ানা উঠতেই ফাতেহা খানম তার হাত ধরে কিচেনের দিকে নিয়ে গেলো। সবাই বিষয় টা খেয়াল করলেও কিছু বললো না। নিজ মনে খাবার শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো সবাই। এদিকে ফাতেহা খানম কিচেনে এসে রিয়ানার হাত ছাড়লো। হাত ছাড়তেই রিয়ানা প্রশ্ন করলো উনাকে, বললো,

“এভাবে টেনে আনলে কেনো আন্টি?”

“খাবার তো ঠিকমতো খেলি না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে উঠে যাচ্ছিলি তো! এজন্য টেনে আনলাম।”

ফাতেহা খানম রিয়ানার গালে হাত রেখে আদুরে স্বরে বললেন কথাটা। রিয়ানা মৃদু হাসলো। বললো,

“না আন্টি, আমার পেট ভরে গিয়েছে।”

ফাতেহা খানম কিচেনে থাকা একটা টুল এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“চুপ। মায়ের কাছে আসছে কষ্ট লুকাতে। চুপচাপ টুলটায় বোস। আমি তোর পছন্দ মতো খাবার বানিয়ে রেখেছি। খেয়ে নে। আমি কফি বানিয়ে ফেলি এরমাঝে। তোর তো কফি ছাড়া চলে না।”

এরপর ফাতেহা খানম কিচেনে থাকা র‍্যাক থেকে রিয়ানার জন্য স্যান্ডুইচ বের করে দিলেন। ফ্রিজ থেকে ওর জন্য বানিয়ে রাখা জুস গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে দিলেন। এরপর কফি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। রিয়ানা জুস টুকু আগে খেয়ে স্যান্ডুইচে কামড় বসিয়ে উঠে দাড়ালো। প্লেট-টা চুলার একপাশে রেখে ফাতেহা খানমকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“তুমি বড্ড ভালো আন্টি। তুমি আমার মা হলে না কেনো বলো তো? আমার মা দেখেছো কতটা নিষ্ঠুর মানবী। আমায় একা করে দিয়ে নিজে ঘুমিয়ে পরেছে। যার দায়ভার আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার মা-কে বড্ড মিস করি আন্টি। তোমায় পেয়ে আমার আফসোস কিছু টা কমে এসেছে জানো। অথচ দেখো! আমার ছুটি শেষ হলেই ব্যাক করতে হবে। অথচ হয়তো এর আগেই। এদেশে আমার আর মন টিকছেনা।”

রিয়ানা কথাগুলো বলার ফাঁকে কেদেও ফেলেছে। মায়ের কথা মনে পরায় মন-টা বড্ড পুড়ছে তার। ফাতেহা খানমের কাঁধে গিয়ে ঠেকলো রিয়ানার চোখের জল। ফাতেহা খানম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। রিয়ানার গালে হাত রেখে আফসোসের সুরে বললেন,

“তোকে আমার কাছে রেখে দিতে পারলে বড্ড শান্তি পেতাম রে মা। এক মেয়ে বড় হচ্ছে। বিয়ে দিলেই ফুরিয়ে যাবে। তোকে কাছে রেখে দিতে পারলে! কি যে শান্তি হতো আমার। তোকে বলে বোঝাতে পারবোনা।”

রিয়ানা কান্নার মাঝেই মুচকি হাসলো। বললো,

“আমি সারাজীবনই তোমার মেয়ে হয়ে রয়ে যাবো। শরীরে হয়তো তোমার কাছে উপস্থিত থাকতে পারবো না। কিন্তু মনে সবসময় তোমার কাছেই থাকবো।”

ফাতেহা খানমও হাসলেন রিয়ানার কথায়। কফির জন্য গরম করা দুধ নামিয়ে নিয়ে কফি রেডি করে রিয়ানার দিকে এগিয়ে দিলেন। রিয়ানা হাসিমুখে কফির মগে চুমুক দেয়। ফাতেহা খানমের ডাক আসায় তিনি কিচেন ছেড়ে বেরিয়ে এলেন রিয়ানাকে রেখেই। কিচেনের দরজায় দাড়িয়ে ফাতেহা খানম এবং রিয়ানার এই সুন্দর মুহুর্ত গুলো দেখছিলো আয়াত। ফাতেহা খানম বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে দরজা থেকে সরে দাড়ায় যেনো ফাতেহা খানম তাকে খেয়াল না করে এমন ভাবে। উনি চলে যেতেই আয়াত রিয়ানার কাছে গিয়ে দাড়ায়। রিয়ানা কিচেনের সাইডে মাঝারি সাই জলের জানালা থাকায় জানালার কাছে দাড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিলো আর কফিতে চুমুক দিচ্ছে। আয়াত গিয়ে ওর পাশে দাড়ালো।। রিয়ানা বোনকে লক্ষ্য করে একবার তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না। আয়াত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। দিনকে দিন রিয়ানার শান্ত থেকে আরও শান্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়-টা বড্ড পোড়াচ্ছে তাকে। রিয়ানা আগে যেমন তার সাথে খুনশুটি করতো! এখন সেসব করা একদমই কমিয়ে দিয়েছে। আয়াত ওর পাশে দাড়িয়েই রিয়ানার দৃষ্টি লক্ষ্য করে শূ্ণ্যে দৃষ্টি মেলে। জানালার গ্রিলে হাত দিয়ে বলে,

“আন্টির কাছে মা মা বিষয়-টা বেশ ভালো লাগে তোর! তাইনা?”

“হুম।”

রিয়ানার ছোট্ট জবাব। আয়াত ফোঁস করে দম ফেললো। একটা কথা বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছে না। যদি রিয়ানা রেগে যায়! তবুও ইতস্তত করতে করতে আয়াত সাহস করে বলেই বসে,

“তোকে একটা কথা জিগাসা করি?”

“মুড খারাপ হয়, এমন কথা কিছু বলিস না আপু।”

“মুড খারাপ হবে কি না জানিনা। তবে আমার আগ্রহ দমন করতে পারছিনা।”

রিয়ানা এবার আয়াতের দিকে তাকালো। সে ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

“কি কথা বলে ফেল। তোর কথার ধরণ দেখে আমারও এখন জানার আগ্রহ হচ্ছে।”

আয়াত ইতিউতি করে বলেই ফেললো, বললো,

“রায়াদ ভাইকে তোর কেমন লাগে?”

রিয়ানার চোখে মুখে বিস্ময় প্রকাশ পায়। তার বোনের এটা কেমন প্রশ্ন!

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে