রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব-৬+৭

0
642

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ০৬
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১১,
রাতের ২টা, সবাই যখন খেয়েদেয়ে ঘুমাতে ব্যস্ত, তখন একহাতে বারান্দার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে রিয়ানা। রাতের নিকোষ কালো আধারের সাথে চোখের কোণায় জমা অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত সে। আজ ভীষণ করে কাঁদতে মন চাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে একটু চিৎকার করে কাঁদতে। নিজপর বাড়ি হলেৃএতক্ষণে ছাঁদে উঠে কান্না করে দিতো। কিন্তু অন্যের বাড়িতে তা সম্ভব হচ্ছে না। নিজের ভেতরটায় আফসোস জমতে জমতে কেমন একটা দম বন্ধকর পরিস্থিতি এসে গেছে তার জীবনে। আহারে জীবন, সুন্দর ভয়ংকর সুন্দর। প্রতি মুহুর্ত কাঁদিয়ে ছাড়ে৷ অন্য হাতে থাকা ফোন টা সুইচ ওন করে ডাটা ওন করলো রিয়ানা। আইডি লগ ইন করে কাঙ্ক্ষিত একটি আইডি সার্চ করে তাতে ঢুকলো। প্রোফাইল পিকে জ্বলজ্বল করছে প্রিয় পুরুষের ছবি সাথে অন্য একজন নারী। রিয়ানা মুচকি হাসলো। ঠোঁটের কোণো হাসির রেখা প্রশস্ত করে আনমনে বিরবির করে বললো,

“আপনি আমার অনেক শখের দূরের মানুষ। আপনাকে ছুয়ে দেখেও, জড়িয়ে ধরিয়েও বাঙালির নারীর শাড়ির মতো আপনাকে লেপ্টে রাখতে পারলাম না সর্বাঙ্গে। আমার সব সৌন্দর্য, আপনিহীন বড্ড ফিকে। কিন্তু আপনি অন্য নারীর স্বামী। আপনাকে নিয়ে ভাবাও আমার জন্য বড্ড অন্যায়। এর শাস্তি আপনার দহনের অনলে আমায় পুড়তে হয়। আমি পুড়তে চাই না। সুস্থ থাকতে চাই। যাকে শুধরে দিতে এসেছিলেন! যে আপনাকে পেয়ে একটু একটু করে শোধরাতে শুরু করলো? আপনি তাকেই ছেড়ে গেলেন! সেই উচ্ছৃঙ্খল জীবনের দোহায় দিয়ে সরে গেলেন? ভাগ্যিস গিয়েছিলেন। নয়তো আমার রাত্রীর দ্বিপ্রহরের আফসোস কে হতো বলুন তো! আমার ভাগ্য টাই এমন। কারোর ভালোবাসা আমি ডিজার্ভ করিনা। সেখানে আপনার ভালোবাসা পেয়ে গেলে হয়তো আমার সব পাওয়া হয়ে যেতো। আর মানুষ সব পেয়ে গেলে তার আফসোস থাকেনা। আর আফসোস বিহীন মানুষ হয় না। যে মানুষ আফসোস হীন সুখের একটা জীবন পায়! তার আফসোস থাকে আমার এতো সুখ কেনো? আমার লাইফটা কেনো একটু স্ট্রাগল পূর্ণ নয়! কিন্তু ট্রাস্ট মি, আপনাকে পেলে আমার এ আফসোস টুকুও হতো না। এজন্য হয়তো আপনাকে আমার পাওয়া হলো না। আপনি বড্ড ভালো মানুষ জানেন তো! অবশ্য জানবেন কি করে! সব সময় তো অসভ্যতামি করেছি। আপনাকে আমায় শুধরে দেবার সুযোগ দিয়েও আপনার কথা শুনিনি। পরাজয় টা আমারই! আমি আপনার ভালোবাসা বুঝতে পারিনি। ভাবতাম লোক টা তো আছে-ই আমার সাথে। কি দরকার অযথা তার কথা শুনে নিজেকে বদলানোর! আমি যেমন, তেমনই তো ভালোবাসা উচিত! কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম, আমার লাইফ স্টাইল কোনো বাঙালি পরিবার, তার মা-বাবা এলাউ করবেনা। উফফ কি দীর্ঘশ্বাস এসে যায় দেখলেন! আপনার সাথে কথা হয়না বছর হয়ে আসলো। আপনার কণ্ঠস্বর শোনার প্রচন্ড নেশা চাপে। কিন্তু অন্যের স্বামীকে কি করে কল দিই! অথচ দেখুন অন্যের স্বামীকে নিয়ে ঠিকই ভাবছি। যা একদমই উচিত নয়, অনুচিত এক কথায়। আমি আপনাকে নিয়ে আর ভাববো না। দেখলেন এর আগেও কত একলা রাত জাগতে গেলে আপনার ভাবনা চলে আসতো। অথচ বারবার বলাম আপনাকে নিয়ে আর ভাববো না। ভাবতে না চাইলেও যে ভাবনায় চলে আসেন! এটার ক্লারিফিকেশন কি বলুন তো?”

রিয়ানা আনমনেই ছবি টার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন টা করে থেমে যায়। হু হু করে ছবি-টা বুকে জড়িয়ে কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“তুমি ভাগ্যবতী মেয়ে, তাকে আগলে রেখো। সে আমার অনেক শখের, অনেক অনেক শখের।”

“রিয়ানা আপু! তুমি না আমার সাথে শুয়ে পরলে? অথচ না ঘুমিয়ে এখানে এসে দাড়িয়ে আছো? কিছু হয়েছে তোমার?”

অকস্মাৎ রোজার কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন শুনে দ্রুত চোখের জল মুছে নেয় রিয়ানা। পিছন ফিরে তাকায়। ড্রিম লাইটের মৃদু মন্দ আলোয় মানুষের আবছা অবয়ব ভালো মতোই দেখা যায়। সে হালকা হাসির রেখা ঠোঁটে টেনে বললো,

“কিছুই তো হয়নি রোজা। তুমি না ঘুমিয়ে উঠে আসলে যে!”

“ওয়াশরুমে যাবো বলে উঠেছিলাম। তোমায় খুজে না পেয়ে বারান্দায় আসলাম। হালকা কান্নার আওয়াজও কানে আসলো। তুমি কাঁদছিলে আপু?”

১২,
“উফ পিচ্ছি, এত প্রশ্ন করো কেন? ঘুমাবে চলো।”

রিয়ানার জবাবে সন্তুষ্ট হলো না রোজা। সে রুমে যাওয়ার বদলে রিয়ানার পাশে দাড়িয়ে আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিগাসা করলো,

“আকাশকে দেখছ আপু? কতটা বিশাল আর সাদা মেঘ নীল রঙে সুন্দর! আবার রাত হলে অন্ধকারে তারার জ্বলজ্বলে আলোয় সে সুন্দর। পূর্ণিমার সময় গোল থালার মতো চাঁদ টায় সে সুন্দর। তুমিও তেমন সুন্দর আপু৷ বিষাদের হাতছানির মাঝেও তোমার এই জোড় করে হাসার বিষয় টা নিকোষ অন্ধকার আকাশে গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদের মতো সুন্দর। ”

“আমার সৌন্দর্যের তুলনা করার জন্য তোমায় রাত জাগতে হবে না মেয়ে। এসো ঘুমাবে৷”

রিয়ানা হাত ধরে টেনে এনে রোজাকে বিছায়নায় শুইয়ে দেয়। নিজেও পাশে কাথা টেনে ঘুমিয়ে পরার চেষ্টায় মত্ত হয়।

সময় টা সকাল ১০টা। হানিফ সাহেব সকালের নাস্তা সেরে নিজ রুমে বিছানায় আধশোয়া হয়ে রেস্ট করছিলেন। তখনই আয়াত বাবার রুমের দরকার সামনে দাড়িয়ে দরজায় ঠোকা দেয়। হানিফ সাহেব দরজার দিকে তাকিয়ে বড় মেয়েকে দেখে স্ব আনন্দে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“ভেতরে আসো আম্মু। ভেতরে আসতে আবার তোমার অনুমতি লাগে?”

“আব্বু আমার কিছু জরুরী কথা বলার ছিলো।”

আয়াত বাবার সামনে এসে দাড়িয়ে কথাটা বললো। হানিফ সাহেব চিন্তিত চাহনীতে মেয়েকে একবার দেখলেন। আয়াত একমাত্র রিয়ানার বিষয়ে কথা বলতে এতটা সিরিয়াস থাকে। তবে রিয়ানা কি আবার কোনো অঘটন ঘটালো? হানিফ সাহেব এসব চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে পরলেন। আয়াত বাবার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে হানিফ সাহেবের সামনে বসে সরাসরি মুখের দিকে তাকিয়ে জিগাসা করে,

“বাবা! রিয়ানাকে আমাদের সাথে বাড়িতে আনলে কি হত? অযথা নিজের মেয়েকে পরের বাড়িতে অপমানিত হতে রেখে এসেছো। দিনশেষে তোমারই মেয়ে। এত রাগ পুষে রাখছো কেনো?”

আয়াতের কথাগুলো হানিফ সাহেবে কর্ণগোচর হতেই তিনি আলতো হাসলেন। হাসি বজায় রেখে বললেন,

“হয়তো ভাবছো তোমার বোনের খারাপ করছি বা চাইছি! আসলে তা নয়। ওখানে থাকলে নিজেকে একটু সামলে রাখবে। বাড়িতে আসলে কি করতো! ভুলে গেছো? ও যে কতটা ডেস্পারেট! এটা তোমার থেকে ভালো তো আমিও জানিনা।”

হানিফ সাহেবের জবাবে আয়াতের মুখের কথা ফুরালো। বাবার সামনে বসেই হাতের আঙুলগুলো ফুটাচ্ছে এক এক করে। হানিফ সাহেব ফের বললেন,

“তুমি তো জানো ওকে না আনার কারণ। কেনো ঐ বাসায় গিয়ে ভুল কিছু দেখলে? ওরা কি রিয়ানার যত্ন ঠিকঠাক নিচ্ছে না? হঠাৎ ঐ বাসা থেকে ফিরে বারবার একই কথা বলে যাচ্ছো। আসার পর থেকে এ কথা।”

“না বাবা, রিয়ানা একদন পাল্টে গেছে বিশ্বাস করো। যাকে ভাষা শিখাতে গিয়ে বা বা বা করতো! সে আজও বাবা পাগল মেয়ে আব্বু। শুধু তুমিই ব্যস্ত থাকো।”

আয়াত ফিচেল হেসে উত্তর দিলো। হানিফ সাহেব বিছানা ছেড়ে দাড়িয়ে স্যান্ডেল পায়ে ঢোকাতে ঢোকাতে বললো,

“একে তো দোষের শেষ নেই! তার মাঝে দোসর কিছু মানুষ। যাদের প্রশয়ে আমার মেয়ে একদম উচ্ছন্নে গেছে। এর আগের বার দেশে এসে কি কি করেছিলো! তোমায় কতটা অপমানিত হতে হয়েছিলো! ভুলে গেছো? এ বাড়িতে আনলে কত যে রঙ তামাশা খাড়া করিয়ে দিতো মানুষ! চিন্তা করতেও পারবে না। আমি চাইনি সেই ঘটনার আবারও রিপিট হোক। মানুষ তোমায় বলুক! বোন বেশ সুন্দর সিগারেট খায় অথচ বোন হাজি! এটাও বিশ্বাস করতে হবে? এসব কথা একজন বাবা হয়ে ব্যর্থ বাবা-ই বলা চলে। সেই বাবা-টা শুধুমাত্র বড় মেয়েকে ভালোবাসে এমনটাই ভাবে! কিন্তু ছোটো মেয়েটার জীবনে আমার শাসন কতটা গুরুত্বপূর্ণ!এটা কেউ বলেনা। বাদ দাও। নিজের সবকিছু গুছিয়ে নাও। আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি।”

আয়াত বিস্মিত হয় হানিফ সাহেবের শেষের কথায়। চলে যাচ্ছি মানে? সে উত্তরের আশায় বলে,

“যাবো তো ঠিক আছে, কিন্তু যাবে কোথায়? ”

চলবে?

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ০৭
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১৩,
“রায়াদ! এই রায়াদ? কোথায় তুই?”

ফাতেহা খানমের চেঁচামেচিতে নিজের রুম থেকে বের হয়। সামনে ফাইনাল এক্সামের ডেইট এগিয়ে আসছে। সব ছেড়েছুড়ে একটু পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টায় মত্ত হয়েছে। মায়ের চেঁচামেচিতে সেটাও হবে না বলে মনে হচ্ছে! বাড়িটা হোটেলের মতো হয়ে গেছে। যার যখন ইচ্ছে হচ্ছে আসছে। আবার বাড়ি-টা চিল্লিয়ে মাথায় উঠাচ্ছে। কি যে হচ্ছে এসব! মাথায় ঢুকছেনা রায়াদের। ভালো লাগে না আর। বাড়ি ছেড়ে জুবায়েরের বাসায় উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। ধ্যাত! মেজাজ খারাপ করে আনমনে এসব ভেবে রায়াদ ড্রইং রুমে আসে। তার মা এক হাতে বাজারের ব্যাগ আরেক হাতে লিস্ট বানিয়ে দাড়িয়ে আছে। সে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে,

“আমায় কি বাজারে পাঠানোর ধান্ধায় আছো তুমি?”

“হ্যাঁ, তোর আঙ্কেল এবং আয়াত মা আসবে। যে ক’মাস দেশে থাকবেন হানিফ ভাই! আমাদের বাসাতেই তিন তলার ফাকা ফ্ল্যাট টায় থাকতে চেয়ে তোর বাবাকে বলেছেন উনি৷ বাড়িতে নাকি সমস্যা হচ্ছে। উনি এসে মেয়েদের নিয়ে থাকবেন! এসেই তো আর রান্না করে খেতে পারবেনা। আমাদেরই বিষয় টা দেখতে হবে। একটু বেশি করে বাজার করতে হবে
আর বাজারে যেতে হবে তোর।”

“বাসায় কি বাজার করে দেওয়ার লোকের অভাব পরলো? ড্রাইভার আংকেলকে বললে উনি কি এনে দিবেন না?”

রায়াদ কিছু-টা রেগেই কথা-টা বললো। তখুনি রিয়ানা খালি কফির মগ হাতে নিজের রুম হতে বের হলো। রায়াদের কথা কানে যেতেই সে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বললো,

“বড়দের সাথে এভাবে কথা বলে কেউ! বলা মানুষ টাও দেখছি বড়দের সাথেই চেচিয়ে চলছে। নিজের পিছনে ঝাড়ুর বারি রেখে, তা অন্যের দিকে ঘুরিয়ে দিতে এক্সপার্ট দেখছি।”

রায়াদের রাগ দ্বিগুণ হলো রিয়ানার কথায় । তার কথা তাকেই ঘোরানো হচ্ছে। সে চকিতে রিয়ানার দিকে ফিরে তাকায়। রিয়ানা কিচেনের দিকে পা বাড়িয়েছে। সে রিয়ানার উদ্দেশ্যে জোড়েই বলে,

“মা উনি আমার। উনাকে যা খুশি বলার অধিকার আমার আছে। আপনার নেই।”

রিয়ানা থমকে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে রায়াদকে দেখলো। মা শব্দ-টা মনে হতেই বুকের মাঝে কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো। রায়াদের কথার প্রতিত্তোর দেওয়ার শক্তি পেলোনা। ফিচেঁল হেসে স্থান ত্যাগ করলো। রায়াদ বিস্মিত হলো। রিয়ানার নিস্তেজ রুপ মানতে একটু কঠিন-ই লাগে বটে। এ মেয়ের যা তেজ! তবুও বিষয়-টা গায়ে মাখলো না রায়াদ। ফাতেহা খানম এতক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে দুজনের ঝগড়া দেখছিলেন। রিয়ানা চলে যেতেই উনি পুত্রের দিকে এগিয়ে আসলেন। নিস্তেজ কণ্ঠে বললেন,

“মেয়ে-টাকে এভাবে না বললেও পারতি বাবা। জানিস-ই তো ওর মা সেই ছোট্ট বেলায় ওর মা ওদের ছেড়ে চলে যায়। এর পরপর-ই তো হানিফ ভাই দেশ ছাড়েন। মায়ের কথা শুনে মেয়ে-টা না জানি কষ্ট পেলো!”

ফাতেহা খানমের কণ্ঠে আফসোসের সুর৷ রায়াদের মনে মায়ের কথায় কিছুটা অপরাধ বোধ দেখা দিলো। আসলেই তার এতটা রুড হওয়া ঠিক হয়নি। একবার ভাবলো কিচেনে গিয়ে স্যরি বলবে। কিন্তু মায়ের সামনে তো যাওয়া যায় না। এজন্য নিশ্চুপে রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে এসে মায়ের হাত থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে গেলো। নিচতলায় গেইটের সামনে এসে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে পকেট থেকে ফোন বের করে রায়াদ৷ জুবায়েরকে ফোন দেয়। জুবায়ের রিসিভ করতেই কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে,

“রাতে বাসায় আসিস। জরুরী দরকার৷”

এরপর পূর্বের ন্যায় কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কল কেটে দেয়। জুবায়ের ফোন হাতে নিয়ে হতভম্ব। ফোন দিয়ে তাকে কিছু বলার সুযোগও দিলো না! তার মতো চঞ্চল ছেলের কপালে এমন একটা বদমেজাজি বন্ধু কি করে জুটলো! তা বুঝলোনা জুবায়ের। পরবর্তীতে মনে পরলো, বন্ধুত্ব তো একটা কারণেই হয়েছে৷ ভাগ্যিস হয়েছিলো, নয়তো রায়াদ শাহনেওয়াজের মতো এটিটিউড বয় তার বন্ধু হতো না ইজিলি। জুবায়ের বিছানায় চার হাত পা ছড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। পুরো রাত ঘুম হয়নি কিছু কাজের জন্য। উপরে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যান টার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জুবায়ের। আনমনে ভাবে,

“বাবার এতকিছু থাকতে! ঢাকা শহরে একা এক বাসায় পরে থাকতে হচ্ছে। এত খাঁটুনি করতে হচ্ছে। জীবনটা সিলিং ফ্যানের মতো ঘুরেই যাচ্ছে। থামাতে চাইলে সেই এক বিন্দুতেই থামছে। যে বিন্দুতে থামতে চাই না আমি। কিন্তু অন্য বিন্দু! সেটা বহুদূর। খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ইদানিং। জীবন তুমি ভয়ংকর সুন্দর।”

১৪,
রায়াদের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ফাতেহা খানম রিয়ানার উদ্দেশ্যে হাঁক ডাক ছাড়েন। রোজা আর রিয়ানা নিজেদের রুমে বিছানায় বসে লুডো খেলছিলো ফোনে। অলস সময় কাটছে রিয়ানার। কি করবে! কি করবে করতে করতে লুডো খেলতে বসে রোজার কথায়। বিদেশে থাকলে এতক্ষণে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরতো। এই বন্দীদশা অসহনীয় হয়ে পরছে রিয়ানার জন্য। ভালো লাগেনা তার। ফাতেহা খানমের ডাক শুনে রোজা একবার দরজার দিকে তো একবার রিয়ানার দিকে তাকায়। ফাতেহা খানম তার রুমে আসলো কিনা! এটা দেখতেই তাকাচ্ছে সে। রিয়ানা অলস ভঙ্গিতে বিছানা ছেড়ে দাড়াতে দাড়াতে বললো,

“আন্টি আবার কি কারণে ডাকছে কে জানে! আমার প্রচুর আলসেমি লাগছে রোজা।”

“শুনে আসো আম্মু কি বলে!”

রোজা ছোট্ট করে উত্তর দিলো। রিয়ানা শরীরের ওরনাটা সামলে নিয়ে পা চালালো। ফাতেহা খানমের রুমের সামনে দাড়িয়ে বললো,

“আন্টি আসবো?”

“আয়, অনুমতি নিতে হয় আবার?”

রিয়ানা গুঁটি পায়ে ফাতেহা খানমের সামনে এসে দাড়ায়। তিনি বসে ছিলেন বিছানায় বোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে। ফাতেহা খানমের কোমড়ের বা দিকে একটু সমস্যা থাকায় উনি সময় পেলে শুয়ে বসেই কাটিয়ে দেন। ঘরের সব কাজ লোক রাখা হয়েছে, তারা করে দেয়। রান্না-টা শুধু নিজেই করেন। অসুস্থতার জেড় ধরে নিজের সংসারের কাজ মানুষ দিয়ে করাতে হয়! অথচ যে ছোট্ট সংসার উনার! সব একাই করতে পারতেন৷ ফাতেহা খানম দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। অসুস্থতার জন্য নড়াচড়া করাও আজকাল কঠিন বিষয়। যার দরুণ রিয়ানাকে রুমে ডাকলেন তিনি। ফাতেহা খানম রিয়ানার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“দাড়িয়ে আছিস কেনো? বোস আমার সামনে।”

রিয়ানা উনার কথায় চুপচাপ বসে পরে৷ ফাতেহা খানম রিয়ানার মাথায় হাত বুলালেন এগিয়ে এসে। বুকে জড়িয়ে ধরে নেন চট করে। আচমকা এমন হওয়ায় রিয়ানা ভড়কে যায়। সে কাঁপা কণ্ঠে বলে,

“তোমার হঠাৎ কি হলো আন্টি! এত আদর করছো যে!”

ফাতেহা খানম রিয়ানার কাঁধে থুতুনি ঠেকিয়ে বললেন,

“মেয়েকে একটু জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো। মেয়ের কি মায়ের আদর ভালো লাগছেনা?”

রিয়ানার গলার মাঝে কান্না-রা সব দলা পাকিয়ে যেতে লাগলো। এত আদুরে স্বরে তার মা মারা যাবার পর কেউ বলেছে কিনা! রিয়ানার মনে পরে না। স্মৃতিতে তো মায়ের কথা আবছা আবছা মনে আছে তার। দীর্ঘ বারো বছর পর আবারও কেমন মা মা গন্ধ পাচ্ছে সে। ফাতেহা খানমকে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো রিয়ানা। ফাতেহা খানমের আদরগুলো উপভোগ করার চেষ্টা করায় মত্ত হলো সে৷ ফাতেহা খানম রিয়ানকে ছেড়ে কপালে চুমু দিলেন। গালে হাত রেখে আলতো স্বরে বললেন,

” আমার মেয়ে-টা ছোট্ট বেলায় কত্ত শান্তশিষ্ট, গুড গার্ল ছিলো। বড় হয়ে এমন পাল্টে গেলি কেন মা? কি এমন হয়েছে যে এতটা বিপথে চলে গেছিস? মায়ের কাছে শেয়ার করবিনা মা? আয়াতের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তোর অলক্ষ্যে। সে যাওয়ার আগে বিদায় জানাতে এসে বলে গেছে, সবই তোর ব্যক্তিগত বিষয়। জানতে হলে তোকেই যেনো জিগাসা করি। মা’কে ভালোবাসিস তো! মায়ের কাছে বলবিনা তোর মনের কষ্টগুলো? সন্তানের কষ্টে মা-ও তো কষ্ট পায়। একটা বার বল না মা! দেখবি তোর সব কষ্ট কমে যাবে। জানিস কি মায়েরা ম্যাজিশিয়ানের মতো।”

রিয়ানা মুচকি হাসলো ফাতেহা খানমের কথায়। বললো,

“জানার জন্য আদর করলে?”

“তুই না বললে আমার সমস্যা নেই রিয়ু। জানার জন্য আদর করি এটা মনে হলো তোর? এছাড়া তোকে আদর করিনা আমি? ভালোবাসি না? তুই না বললেও আমি চেষ্টা করবো তোকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার। আগলে রাখবো নিজের মেয়ে হিসেবে।”

“তোমার মাঝে আমার মা মা গন্ধ লাগে আন্টি। সেই স্থান টা নড়বড়ে হয়ে যায়! এমন কিছু কখনও করো না।”

“আচ্ছা বাদ দে এসব। তুই কি সত্যি বলবিনা আমায়? ভালোবেসেছিলিস কাউকে? সে ধোঁকা দেওয়ায় এমন কঠিন হয়ে গেছিস তুই? বল মা-কে!”

“সে আমার ১৬বছর বয়সের আবেগ, ১৮বছর বয়সের ভালোবাসা, ২০বছরে বয়সের আমি-টার শোক। এখন তো আমি জানিনা আমি তাকে ভালোবাসি কিনা! আমি এক রঙিন খাম। যেখানে জমা হাজারও বিষাদের চিঠি। যেগুলো একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিষাদ। এগুলো কাউকে জানাবার কথা নয় আন্টি। তুমি জানতে চেয়ো না। আমি বলতে পারবো না। আমায় ক্ষমা করে দিয়ো।”

রিয়ানা একছুটে রুম ছাড়লো। সোজা রোজার রুমে গিয়ে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে পরে। নিজের মনের কষ্টগুলো দমন করার চেষ্টায় নিমিত্ত হয় রিয়ানা। রোজা বারান্দায় দাড়িয়ে কলেজের এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলো। কথা বলা শেষ হলে রুমে এসে রিয়ানার এই অবস্থা দেখে রিয়ানার শিয়রের কাছে বসে রোজা। রিয়ানার মাথায় হাত রেখে জিগাসা করে,

“মা কি তোমায় বকা দিয়েছে রিয়ুপি? কাঁদছো কেনো তুমি?”

রিয়ানা আচমকা একটা কাণ্ড করে বসলো। রোজার ধারণাও ছিলো না রিয়ানা এমন করবে। রিয়ানা তার কোলে মাথা রেখে কোমড় পেঁচিয়ে ধরে শুয়ে পরেছে। রিয়ানা সচরাচর এমন করেনা। তারা একসাথে থাকে এক বেডে। তবুও রিয়ানা দূরত্ব রেখেই শুয়ে থাকে। তাকে কখনও এভাবে ধরেনা। এজন্য রোজা অবাক হলো। এরমাঝেই রিয়ানা রোজাকে উদ্দেশ্য করে অস্ফুটস্বরে বললো,

“তোমার বয়স-টা আবেগের বয়স রোজা। আবেগের বশে পরে কখনও ভুল মানুষকে মন দিয়ে বসো না। একটা সময় গিয়ে না মন-টা বড্ড পোড়ায়।”

রোজা বুঝতে পারেনা রিয়ানার কথার মানে৷ সে অবাক হয়ে রিয়ানাকে প্রশ্ন করে,

“হঠাৎ এসব কথা বলছো যে? কি হয়েছে রিয়ুপি?”

ভুলত্রুটি মার্জনীয়, আসসালামু আলাইকুম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে