রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব-০৫

0
651

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ০৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৯,
ড্রাইভিং সীটে বসে আছে রায়াদ। পাশেই আয়াত বসা। আয়াত জানালায় কনুই ঠেকিয়ে থুতুনিতে হাত মুঠো করে বসে আছে। দৃষ্টি বাইরে নিবন্ধ। সে চিন্তিত রিয়ানাকে নিয়ে। রায়াদদের বাসায় যাওয়ার পর গতকাল যেমন ব্যবহার দেখলো! সকালের ব্যবহারের সাথে বিস্তর ফারাক। কোনো ভাবে ফাতেহা খানম যদি তার বাবার কাছে বলে দেয় কথার ছলে! তবে রিয়ানার উপর আবারও একটা ঝড় আসবে। মেয়ে-টা কি জীবনে সুখ পাবেনা! একজন যোগ্য মানুষ যদি ওর জীবনে এসে ওর জীবন-টা গুছিয়ে দিতো! কত যে ভালো হতো। আয়াত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিন্তু চট করে মাথায় কিছু ভাবনা আসতেই সে পাশে বসা রায়াদের দিকে তাকায়। রায়াদ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে। বাসস্ট্যান্ড ২০মিনিটের মতো দূরত্বে তাদের বাসা থেকে৷ বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি আসতেই লম্বা জ্যামে থেমে গেলো গাড়ি। আয়াত রায়াদকে এক পলক দেখে কিছু টা তুতলিয়ে বললো,

“আপনাকে একটা কথা জিগাসা করবো?”

“জি, করুন?”

“কিছু টা পারসোনাল কিন্তু! ”

” ইট’স ওকে, প্রশ্ন করুন।”

” আচ্ছা রিয়ানা তো কারোর কথা শোনেনা। অথচ আপনার কথা শুনে নিজের ড্রেসআপ ঠিক করে নিচ্ছে! এটা কি নিছকই কাকতালীয়! ও কাউকে সম্মান বা ভালো না বাসলে তো কারোর কথাই শোনেনা ”

রায়াদ এ পর্যায়ে আয়াতের দিকে দৃষ্টি ফেললো। ভ্রু কুঁচকে জিগাসা করলো,

“হোয়াট ডু ইউ মীন বাই দ্যাট? এই সম্মান বা ভালোবাসা? আপনি কি ভাবছেন? রিয়ানা আর আমার মাঝে কিছু চলছে?”

“না না, একচুয়ালি আমি এটা মীন করিনি।”

“তবে?”

” মানে একটাই ও কারোর কথা শোনেনা। বড্ড বেপরোয়া। আপনার কথা শুনে চলছে। এটাই অবাক করার বিষয়। ও কোনো মানুষকে মন থেকে পছন্দ করলে বা ভালোবাসলে তবেই কথা শোনে। হোক সেটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক বা অন্যকিছু! আর আপনিও ওকে বেশ শাসন করেন দেখলাম। এজন্য জিগাসা করলাম।”

“আমার বাসায় কোনো মেয়ে অসভ্য, বেয়াদবের মতো চলাফেরা করবে! আমার পছন্দ নয়। ওনার জায়গায় আমার ঘরের কোনো মেয়ে হলে! কি যে অবস্থা করতাম! আল্লাহ ভালো জানেন।”

“আমার বোন এতটাও বাজে মেয়ে নয়।”

“কিন্তু আপনার বোন আপনার মতোও নয়।”

“আমার বাবা ছোটো থেকে আমার সাথে ওর কম্পেয়ার করতো। কিছু করতে গিয়ে ভুল হলে বলতেন, বড় বোনকে দেখে শিখতে পারোনা! একই মায়ের পেটের দু’বোন হয়ে দু’জন দুই মেরুতে যাচ্ছো কেনো! ওর এসব পছন্দ হতো না। ওর কথা ছিলো, ও ওর মতো। ওর ভুল হলে শিখিয়ে দেওয়া হোক, কিন্তু অন্য কারোর মতো হতে হবে! কেনো হবে? ও আর সেই মানুষ-টা কি এক? প্রতিটা মানুষ তো তার জায়গা থেকে যোগ্য। অন্যের সাথে তুলনা করে ছোটো করা! বিষয়-টা ওর বড্ড গায়ে লাগতো।”

” তুলনা করা পছন্দ নয় বলে একেবারে এরকম অভদ্র হবে?”

“কেউ সাধে বিগড়ে যায় না। পেছনের কারণ-টা আপনাদের জানা নয়। আমার জানা। এজন্য আপনারা খারাপ-ই ভাববেন। আমি তো জানি আমার বোন কেমন।”

আয়াত কথাটুকু বলে সীটে গা এলিয়ে দিলো। জ্যাম কিছু টা ছেড়ে আসায় রায়াদ গাড়ি স্টার্ট দেয়। রিয়ানার বিষয়ে তার এতটুকুও ইন্টারেস্ট নেই। কেনো বিগড়ে গেলো! সেটা জেনে তার-ই বা কি কাজ! তাই আয়াতকে এসব বিষয় নিয়ে ঘাটালো না। আবারও মনোযোগ দিলো ড্রাইভিং এ। আয়াত চোখ বন্ধ করে ফের অনুরোধের সুরে বলে,

“আমার বোন-টাকে একটু শুধরে দিবেন? আমি অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। আপনাদের পরিবারে গিয়ে ও অনেক বদলেছে। আমি চাই ও আরও পাল্টে একটু স্বাভাবিক লাইফ লীড করুক। আমার বোনের এই পরিণতি আমায় রোজ কষ্ট দেয়।”

রায়াদ ড্রাইভিং এর ফাঁকেই আড়চোখে এক পলক আয়াতকে দেখলো। আয়াতের চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু পরছে। রায়াদের খারাপ লাগলো একটু। সে আয়াতকে আশস্ত করে বললো,

“আমি চেষ্টা করবো ওনাকে একটু ভদ্র মেয়ে বানানোর।”

আয়াত কান্নারত অবস্থাতেই ভরসা পেয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুললো। রায়াদ নিষ্পলক একবার দেখে বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি এসে গেলো। আসতেই রোদের তেজ খেয়াল করে রায়াদ বললো,

“২-৩ ঘন্টারই তো দূরত্ব, আমি পৌছে দিয়ে আসি! অযথা বাস দৌড়ানোর প্রয়োজন নেই।”

” সমস্যা নেই, আসার সময় ভোরেই বাসে উঠেছি। ৯টা বাজতেই পৌছে গিয়েছিলাম। একা যেতে পারবো সমস্যা নেই। বাস থেকে নামার পরপরই বাবা এসে নিয়ে যাবে।”

” চুপ করে বসে থাকুন। বেশি কথা আমার পছন্দ নয়। ”

আয়াত আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ আগের ন্যায় সীটে গা এলিয়ে পরে রইলো। রিয়ানাকে সাথে নিয়ে যেতে পারলে শান্তি লাগতো। মন-টা বড অশান্ত তার। রায়াদ ফের একদফা আয়াতকে দেখে নিয়ে ফোস করে দম ফেললো। মনযোগ দিলো ড্রাইভিং এ।

১০,
রোজার ক্যাম্পাসে এসে গেইটের সামনে ফুচকার স্টল চোখে পরায় বসে পরেছে রিয়ানা। রোজার ৩টা ক্লাস ছিলো। রোজা ক্লাস সেরে এসে বসেছে রিয়ানার পাশে। রিয়ানা এতক্ষণ নিজমনে পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে টইটই করেছে। সাভার মডেল কলেজে ইন্টার ১ম বর্ষে ভর্তি হয়েছে রোজা। বাসা থেকে কাছাকাছি মাত্র এই একটাই কলেজে ভর্তি হতে পেরেছে সে। ফুচকা খেতে বসে ঝালে চোখমুখে পানি এসে গেছে রিয়ানা। রোজা তা দেখে হন্তদন্ত হয়ে নিজের পানির বোতল বের করে রিয়ানার সামনে ধরে। রিয়ানা এক টানে পানির বোতল ফাঁকা করেও ঝাল কমাতে পারলো। তখনই কেউ একজন তার সামনে চকলেট বারিয়ে দেয়। রিয়ানা চকলেট দেখে কে দিলো! এটা খেয়াল করলো না। সে কাগজ ছিড়ে কামড় বসায় চকলেটে৷ ডেইরি মিল্ক সিল্ক এর একটা চকলেট৷ ঝাল একটু কমপ আসতেই রিয়ানা মাথা উচিয়ে তাকায়৷ রোজা আর জুবায়েরকে ঠোঁট টিপে হাসতে দেখে। রিয়ানা জুবায়েরকে অসময়ে তাদের সামনে দেখে চোখ মুখ কুঁচকে তাকায়। কিছু টা বিরক্ত হয়েই জিগাসা করে,

“আপনি অসময়ে এখানে?”

“ঝাল কমেছে?”

জুবায়ের মৃদু হেসে প্রশ্ন করলো। রিয়ানা স্থির হয়ে দাড়িয়ে বললো,

“কমেছে কিছু টা।”

“ঝাল খেতে জানেন না! অথচ খেলেন? জোড় করে খাওয়ার কি দরকার ছিলো?”

” আর বইলেন না ভাই, কতবার আপারে বললাম, ঝাল হবে, খাইতে পারবেন না। উনি নিজেই আগ বাড়ায়া ঝাল বেশি নিছে।”

ফুচকা ওয়ালা পাশ থেকে কথা-টা বলে উঠে। জুবায়ের রোজার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“তুমি কোথায় ছিলে? দেখোনি ইনি পরিমাণ ছাড়া ঝাল দিয়ে খাচ্ছেন?”

রোজা কাচুমাচু করতে করতে বললো,

“আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম। এসে দেখি আপু খেতে বসে গেছে। আমি তো জানিনা ফুচকার আলু ভর্তার মাঝে এত ঝাল মিশিয়ে নিয়েছে।”

“রোজা! তোমরা কি তোমাদের গসিপ স্টপ করবে? তাহলে ফুচকার দাম দিয়ে এই স্থান ত্যাগ করতে পারি।”

রিয়ানা মৃদু ধমকে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো। জুবায়েরের হাতে চকলেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,

“ঝালে না হয় ম”রে যাই! আগ বারিয়ে বাঁচাতে আসার প্রয়োজন নেই।”

রিয়ানা কথাটা বলেই ফুচকাওয়ালার থেকে দাম জেনে নিয়ে নিজের পার্স থেকে টাকা বের করে দেয়। এরপর হনহনিয়ে হেঁটে রিকশার জন্য রাস্তার সাইডে দাড়ায়। রোজা এবং জুবায়ের হতভম্ব হয়ে একবার রিয়ানার দিকে তাকায় তো একবার একে অপরের মুখের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। রোজা বিস্মিত হয়ে বলে,

“এটা কি হলো জুবায়ের ভাই?”

“আমিও বুঝতে পারছিনা রোজা। জীবনে প্রথম বার হয়তো কোনো মেয়েকে দেখে দফায় দফায় অবাক হতে হচ্ছে আমায়। ঝালে লাফাতে দেখে চকলেট এনে দিলাম, ঝাল কমতেই রাগ দেখালো। বিষয়টা হলো কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরালেই পাজি।”

“সেসব বাদ আগে বলেন তো, আপনি এখানে কি করতে আসছেন?”

” আমি তো পাশেই একটা স্টুডেন্টকে টিউশন পড়ানো শুরু করলাম। সেজন্য এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। যেতেই এসব নজরে পরলো। তাই এগিয়ে আসলাম।”

“কিন্তু আপনি তো পার্ট টাইম জব করেন। এই টিউশন আবার কই থেকে উদয় হলো!”

“বইন এতো কথা বলিস কেন? বাঘিনীর মুখে এগিয়ে যা। দেখছিস না রিকশা না পেয়ে বাঁদরের মতো লাফাচ্ছে। বিদেশী মেয়ে, সে তো বুঝবেনা এভাবে দাড়ালে রিকশা পাওয়া যায় না। ”

রিয়ানার দিকে দৃষ্টিস্থির করে কথাগুলো বললে জুবায়ের। রোজা হাফ ছেড়ে রিয়ানার দিকে এগিয়ে যায় জুবায়েরকে বিদায় জানিয়ে। রিয়ানা কথায় কথায় কেমন একটা খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। যা সে আয়াত আসার আগ অব্দি হতো না। কি যে হলো রিয়ানার! রোজার মাথায় ঢুকছেনা। সে রিয়ানার পাশে এসে দাড়িয়ে ভীতু কণ্ঠে বললো,

“এভাবে হাত পা ছুঁড়াছুড়ি করে রিকশা পাওয়া যায় না রিয়ুপু। একটু শান্ত হয়ে দাড়াও। আমি রিকশা ঠিক করছি।”

“কি করে ঠিক করবে রোজা? দেখছোই তো যে রিকশা আসে, তাতেই মানুষ।”

রিয়ানা খিটখিটে মেজাজে বলল। রোজা কপাল চাপড়ে বললো,

“একটু তো ধৈর্য ধরবে?”

“এটা ছাড়া আমার সবই আছে রোজা।”

রিয়ানা স্থির হয়ে দাড়িয়ে আনমনা হয়ে কথাটা বললো। রোজা হাফ ছেড়ে একবার রিয়ানাকে দেখে রাস্তার দিকে তাকালো। রিকশার অপেক্ষা করতে করতে এদিক ওদিক তাকালো। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে আসছে। বাসায় ফিরতে দেরি হলে তো তার মা চিন্তায় পরবে। এরমাঝে সাথে আছে রিয়ানা। চিন্তায় না হাই প্রেশার জেগে যায় তার মায়ের। ধ্যাত, কি একটা অবস্থা! রোজা মেজাজ হারালো। আজকেই যেনো রিকশার অভাব পরে গেলো দেশে।

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়, আসসালামু আলাইকুম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে