রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব-৩+৪

0
750

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ০৩
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৫,
“ওয়া আলাইকুম আসসালাম, জি বাবা ভালো আছি। এতদিন পর আংকেল আন্টিকে মনে পরলো জুবায়ের?”

ইয়াসিন সাহেব উপরোক্ত কথাটি বললেন যুবক-টির কথার জবাবে। রায়াদের পাশে দাড়ানো যুবক-টির নাম জুবায়ের। সে ইয়াসিন সাহেবকে জড়িয়ে ধরলো ফট করে। আহ্লাদের স্বরে বললো,

“আপনি জানেন ঢাকায় ছিলাম না। আসার পরপরই তো দেখা করতে চলে এলাম।”

“হয়েছে আর কৈফিয়ত দিতে হবেনা। দরজায় দাড়িয়েই বকবক শুরু করে দিয়েছো। বাসায় ঢোকো আগে।”

ফাতেহা খানম কথাটা বলেই জুবায়েরের হাত আকড়ে বাসায় ঢুকালেন। আয়াত এবং রিয়ানা দাড়িয়ে দাড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের দেখছে সবকিছু। রায়াদ সবাইকে পাশ কাটিয়ে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে জুবায়ের এবং ফাতেহা খানমকে এক ঝলক দেখে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। ইয়াসিন সাহেব ফাতেহা খানমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“ছেলেকে আচ্ছা মতো খাতির-যত্ন করো। আমি মেয়েদের নিয়ে ঘুরে আসি।”

ফাতেহা খানম হেসে মাথা নাড়ালেন। ইয়াসিন সাহেব হাতের ইশারা আয়াত এবং রিয়ানাকে পা বাড়াতে বললেন। আয়াত এবং রিয়ানা ইশারা বুঝে হাঁটতে শুরু করে। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে আয়াত ইয়াসিন সাহেবকে জিগাসা করে,

“একজন তো বুঝলাম আপনার ছেলে আংকেল। অপরজন কে?”

“জুবায়ের, রায়াদের বেস্টফ্রেন্ড। ধরতে গেলে আমার আরেক ছেলে-ই। কাজের জন্য জেলার বাইরে ছিলো। এমনিতে প্রতিদিনই বাসায় এসে দুজনে আড্ডা দেয় অনেক। আসেনি কয়েকদিন। তাই বাসা’টা খালি খালি লাগতো।”

“আপনি তো বাসাতেই থাকেন না আংকেল! তাহলে খালি খালি লাগার প্রশ্ন আসলো কোথা থেকে?”

রিয়ানা পাশ থেকে প্রশ্নটা করলো। ইয়াসিন সাহেব হেসে জবাব দিলেন, বললেন,

“আজ রাতেই টের পাবে কেনো বললাম। চলো আগে আমাদের কাজ সেরে আসা যাক।”

“হুম চলুন।”

রিয়ানা মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিলো। অতঃপর তিনজনে সিড়ি বেয়ে নেমে বাসা থেকে বের হয়ে গাড়িয়ে উঠে রওনা দেয় নিজ গন্তব্যে।

“নতুন একজনকে দেখলাম আম্মু। সে আবার কে?”

কফির মগ হাতে কিচেন থেকে বেরিয়ে সোফায় মায়ের পাশে এসে বসতে বসতে প্রশ্ন-টা করে রায়াদ। ফাতেহা খানম জুবায়ের এ ক’দিন কোথায় কি করলো, কি রকম ঘুরলো কাজের ফাঁকে! সেসবই জানতে গল্প জুড়ে দিয়ে বসেছেন। রায়াদ ফ্রেশ হয়ে এসে আগে নিজের জন্য কফি বানিয়ে এসে বসলো। ফাতেহা খানম ছেলের প্রশ্নের জবাবে বললেন,

“আয়াত, রিয়ানার বড়ো বোন।”

“তাড়ছিড়ার বোন, তাড়ছিড়ার মতোই নাকি!”

“ধ্যাৎ, তোর কাছে সবাইকে-ই তাড়ছিড়া মনে হয়? রোজাও তাড়ছিড়া, রিয়ানাও! আবার নতুন মানুষকেও বলছিস! চিনিস না জানিস না। অদ্ভুত।”

“না বলার কারণ তো নেই আম্মু। ৭দিন হলো বাসায় এসেছে, সবকিছু লন্ডভন্ড করা ছাড়া তো কাজ দেখলাম না। মেয়ে কম গোছালো স্বভাবের ছেলেদের হ্যাবিটও উনার নেই।”

“এই তোমরা কার বিষয়ে কথা বলছো?”

জুবায়ের মা-ছেলের কথার মাঝে কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন-টা করলো। রায়াদ কফির মগে চুমুক দিয়ে গা ছাড়া ভাবে বললো,

“কার কথা আর বলবো! একটা মেয়ে মানুষের পাশে আরও একজন দেখলি না! জিন্স টপস গলায় স্কার্ফ পেঁচানো এক অদ্ভুদ প্রাণী-কে?”

“হুম তো! সে অদ্ভুত হলো কি করে?”

“বাসায় কয়েকটা দিন থেকে দেখিস। বুঝবি কেন বললাম অদ্ভুত!”

“তুই থামবি রায়াদ! সব-টা সময় শুধু আমার মেয়ে-টাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা।”

“তোমার আবার সে মেয়ে হলো কবে থেকে?”

রায়াদ বিস্মিত কণ্ঠে নিজের মা’কে প্রশ্ন করে। ফাতপহা খানম একটু নরম স্বরে বললেন,

“যেদিন থেকে ও আমায় মায়ের মতো ভাবতে শুরু করেছে।”

“আর তোমার মেয়ে মানে আমার বোন। নামেও বেশ মিল আছে রায়াদ, রিয়ানা। সো ঐ তাড়ছিড়ার সাথে বিয়ের কথা ভুত ধরলেও ভাববে না। বড়ো ভাই হিসেবে ওরে ঠিক করার দায়িত্ব আমার।”

ফাতেহা খানম ছেলের যুক্তি শুনে আফসোসের স্বরে কপাল চাপড়ে বললেন,

“হায় খোদা! আমার ছেলের সুবুদ্ধি দাও একটু।”

“তোমরা মা-ছেলেতে আড্ডা জুড়ে দিয়ে আমায় দেখছি পাত্তাই দিচ্ছো না। নট ফেয়ার।”

জুবায়ের বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বুকে হাত বেধে কথাগুলো বললো। ফাতেহা খানম সেদিকে তাকিয়ে হাসলেন। বসা থেকে উঠে জুবায়ের পাশে বসে বললেন,

“থাক, তোকে পাত্তা এমনিও দিলাম না, ওমনেও দিবোনা। তুই বসে থাক, আমি তোর জন্য রান্না করি গিয়ে।”

ফাতেহা খানম চলে যেতে উঠে দাড়ালে রায়াদ উনার হাতে কফি পান করা হয়ে যাওয়ার দরুণ কফির মগ-টা ধরিয়ে দেয়। ফাতেহা খানম ছেলের মাথার চুল এলেমেলো করে দিয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়ালেন। রায়াদ আর জুবায়ের ব্যস্ত হয়ে পরে তাদের নিজেদের মাঝে আড্ডা দেওয়া নিয়ে।

৬,
শপিং শেষে দুবোনে একসাথে বাসার দিকে রওনা দিয়েছে। ইয়াসিন সাহেব নিজে আর বাসায় আসলেন না। কাজের মাঝে আটকে পরায় ড্রাইভার সহ ওদের পাঠিয়ে দিলেন। গাড়ির মাঝে জানালার ধারে বসপছে রিয়ানা। জানালার গ্লাস নামানো। সীটে গা এলিয়ে দিয়ে ব্যস্ত শহর ঢাকাকে দেখছে সে মনোযোগ দিয়ে। আয়াত ফোনে বাবার সাথে কথা বলছিলো। কথা বলার এক ফাঁকে আয়াত ফোন-টা রিয়ানার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

“ধর, বাবা কথা বলবে।”

“বাহ বা! মিঃ হানিফের মনে পরলো তার আরও একজন মেয়ে আছে! আর তার সাথে ফোনেও কথা বলতে হবে!”

রিয়ানা চাপাকণ্ঠে কান্নার দমক আঁটকে কোনোমতে কথা-টা বললো। বাবাকে এমনও মিস করে। সেখানে বাবার থেকে এতদূরে থাকা সত্বেও হানিফ সাহেব তার সাথে কথাও বলেনি। আজ কথা বলতে চাইলো, সেটাও আয়াতের মাধ্যমে। এজন্য একপ্রকার কান্না-ই পেয়ে বসলো রিয়ানাকে। আয়াত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বাবা আর বোনের মাঝে দূরত্ব কবে ঘুচবে কে জানে! তার আর ভালো লাগেনা দুজনের মন কষাকষি। সে ফোন-টা রিয়ানার হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,

“কথা বল।”

রিয়ানা ফোন-টা কানে ধরে কাঁপা স্বরে বললো,

“আসসালামু আলাইকুম বাবা।”

হানিফ সাহেব ফোনের এপাশ হতে নিজের ছোটো মেয়ের মুখে হঠাৎ সালাম আর বাবা ডাক শুনে অবাক-ই হলেন। মনে মনে সালাম নিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,

“হঠাৎ হ্যালো ড্যাড হতে সালাম দিয়ে বাবা ডাক! যাক ভালো-ই উন্নতি হলো তবে!”

“জি, হয়েছে হয়তো। ভালো আছেন?”

“হুম, তুমি কেমন আছো? ওখান কার সবাইকে আবার নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে না তো তোমার জন্য? ”

“আপনি সবসময় আমার খারাপ দিকগুলোয় দেখে আসলেন বাবা। কখনও এই খারাপ দিকগুলো তৈরি হলো কেনো? হাতড়ে দেখলেন না।”

“তোমার যে ভুল! সেটা কি ছোটো?”

“সেই আমি মানি আমার ভুল, স্যরি ওটা ভুল নয় অন্যায়। কিন্তু আপনি এটা ভেবে দেখেননি জেনে-বুঝে করিনি বা তখন আমি নেহাৎ-ই বাচ্চা ছিলাম, ছোটো ছিলাম। আমি ছোটো ছিলাম, আমার সাথে সাথে আপনার জিদও সেই ছোটো বাচ্চাদের মতো-ই হলো। যার খেসারত আমি দিই।”

“তর্ক করতে ফোন দিইনি রিয়ানা৷ তোমার আংকেল আন্টি, তাদের ছেলেমেয়ে, কারোর সাথে যেনো বেয়াদবির কথা না শুনি।”

“শুনবেন না। সেটা আপনার বড়ো মেয়ে-ই নিশ্চিত বুঝে গেছে। অনেক তো আপনার সম্মান ডুবালাম! এবার একটু এইদেশে উঠানোর চেষ্টা করি!”

“সেই চেষ্টার জন্য-ই রেখে এসেছি। সফল হও, দুয়া করি। ”

রিয়ানা কথা বাড়ালো না। ফোন-টা আয়াতের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আয়াত নিজে কথাবার্তা বলে কেটে দিলো কল। ফোন-টা পার্সে ঢুকিয়ে সীটে গা এলিয়ে বসলো। রিয়ানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কান্নার দমক থামানের চেষ্টায় ফাঁকা ঢোক গিললো বেশ কয়েকবার। বোনের দিকে নজর ঘুরিয়ে জিগাসা করলো,

“তোর বিয়ের তোড়জোড় কতদূর? দিনতারিখ ঠিক হলো?”

“আর বিয়ে! বিয়ে করে মানুষ? বিরক্তিকর।”

“কেনো কি হয়েছে?”

“বড়বাবা যে পাত্র-র কথা বলে দেশে আনলো! বাবার পছন্দ হয়নি। বাড়িতে কয়েকদফা ঝামেলা হওয়া শেষ। আবার এখন বাবা নেমেছেন। হারিকেন লাগিয়ে পাত্র খুজছেন।”

রিয়ানা আয়াতের জবাব শুনে ভীমড়ি খেলো। বিয়ে হবে না মানে! সে আয়াতের দিকে ফিরে বসে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিগাসা করলো,

“বাবার পছন্দ হয়নি মানে? কি সমস্যার জন্য পছন্দ হলো না? বাবা আর বড়ো বাবার তো গলায় গলায় মিল। ভাইয়ে ভাইয়ে মিল থাকা ভালো। কিন্তু ঝগড়া কেনো হলো! এতটাই বাজে পাত্র?”

“পাত্রের সাথে আমার কিছুই মিলে না।”

“যেমন?”

“পড়াশোনা আমার থেকে কম জানাশোনা, বনেদী পরিবার। ছেলের প্রফেশন নেই, বাপ দাদার সম্পত্তির উেপর ডিপেন্ড করে চলে। বাবা চান না আমি বনেদী পরিবারে গিয়ে বন্দী জীবন কাটাই।”

“বনেদী পরিবার মানেই কি বন্দী নাকি?”

“ঠিক তা নয়, কিন্তু উনারা আগের সময়ের চাল চলন মেনে চলে আজও। কিন্তু আমি মানিয়ে নিতে আদৌও পারবো কিনা! বাবা এটা ভেবেছেন।”

“থাক বাদ দাও, আমার বড়ো বোন হয়ে আজও একটা প্রেম করতে পারোনি। এর থেকে লজ্জার কিছু আছে? অথচ আমায় দেখো! এ অব্দি কত ছেলের সাথে ফ্লার্ট করেছি মেয়ে হয়ে! তার ঠিক নেই।”

“তুই এমন কেন হলি রিয়ু! এমন না হলে তো বাবা আর তোর মাঝে দূরত্ব আসতোনা?”

“তুই হয়তো সব ভুলে যাচ্ছিস আপু।”

রিয়ানার এই কথায় দমে যায় আয়াত। আর কথা বাড়ায় না। রিয়ানার মতো সে নিজেও গাড়ির জানালা দিয়ে চারপাশ টা দেখতে শুরু করে।

চলবে?

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ০৪
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৭,
রাতের খাবার শেষে আড্ডা দিতে বসেছে আয়াত, রিয়ানা, রোজা। ঘড়ির কাটায় সময় রাতের ১০টা পেরিয়ে ১১টা ছুঁই ছুঁই। তিনজনের আড্ডার টপিক বিদেশীদের জীবনযাত্রা নিয়ে। রোজা প্রশ্ন করে যাচ্ছে, আর আয়াত এবং রিয়ানা উত্তর দিচ্ছে। কথার এক পর্যায়ে রোজা প্রশ্ন করে বসে। রিয়ানা-কে উদ্দেশ্য করে জিগাসা করে,

“আয়াত আপুও তো বেশ সাবলীল বাঙালি মেয়েদের মতোই আভভাব রিয়ু আপু। কিন্তু তোমার মাঝে পুরোই বিদেশী বিদেশী ভাইব’স। তোমরা দু’জন আপন বোন। অথচ এতো অমিল কেনো?”

রিয়ানা রোজার এই প্রশ্ন শুনে নিরব হয়ে যায়। আয়াত উশখুশ করতে থাকে। এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবে রিয়ানা! নিজের উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কথা বুক ফুলিয়ে বলার বিষয় নয় নিশ্চিত। আয়াতের দৃষ্টি রিয়ানায় আবদ্ধ। রোজা আগ্রহ সহকারে দুজনের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। দৃষ্টি একবার আয়াতের দিকে, তো একবার রিয়ানার দিকে। দু’জনকে-ই চুপ থাকতে দেখে রোজা ফের জিগ্যাসা করে,

“আমি কি অতিরিক্ত পার্সোনাল কিছু জিগাসা করে ফেললাম? তোমাদের বলতে প্রবলেম হলে! ইট’স ওকে। বলো না, বাট এমন চুপচাপ থেকো না প্লিজ।”

“আরে বাচ্চা ইট’স ওকে। রিকুয়েষ্ট করতে হবে না। আমি-ই বলছি এতো অমিল কেনো? আসলে আমি ভীষণ বদমেজাজি আর অভদ্র মেয়ে। এজন্য দুজনের অমিল। বাবা তার বড়ো মেয়েকে বাঙালি শিক্ষা দিলেও আমি বাংলা ভাষা ছাড়া বাঙালি কালচারের ‘ক’ টাও আমার মাঝে ধারণ করিনি। সব-টা সময় যা করেছি, বিদেশীদের মতো। ওদের লাইফ স্টাইল আমার পছন্দ হয়েছে। আমি তেমনই হয়েছি। এজন্য পার্থক্য।”

রিয়ানা মুচকি হেসে কথাগুলো বললো। আয়াত এবং রোজার দৃষ্টির আড়াল হতে উল্টোদিকে ফিরে বসলো। বেশ কয়েক বার জোঠে নিঃশ্বাস নিয়ে আনমনে ভাবলো,

“আমার জেদ আমায় ধ্বঃশ করেছে। আমার পরাজয়ের গল্প-টা গর্ব করে বলার বিষয় নয়। স্যরি রোজা, মিথ্যা বলার জন্য।”

আয়াত বোনের বলার প্রতিটা কথা মিথ্যার ধরে ফেলেছে। হতে পারে রিয়ানা বদমেজাজি, বদরাগী। কিন্তু অভদ্র নয়। বিদেশীদের লাইফ স্টাইল তো ওর দুচোখের বিষ ছিলো! সেটা কি করে পছন্দের হতে পারে! তার বোন সবার সামনে হেসেখেলে মিথ্যা বলতেও শিখে গেলো! আয়াত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রোজা রিয়ানার উত্তর সন্তুষ্ট হতে পারলো না। সে মুখ ফুলিয়ে বললো,

“তুমি বদমেজাজি! অভদ্র! তুমি এসব মোটেও নও রিয়ু আপু। মিথ্যা বলছো কেনো? তুমি কি সুন্দর মিশুক, শান্ত মানুষ। আমায় এ ক’দিনে কতোটা আপন করে নিয়েছো! নিজের ছোটো বোনের মতো ভালবাসছো। অথচ নিজ সম্পর্কে এমন বলছো?”

রিয়ানা রোজার কথায় তার দিকে ফিরলো। রোজার গালে হাত রেখে বললো,

“আমাকে জানতে এসো না মেয়ে, ধাধায় পরে যাবে। সেই ধাধার সমাধান হলে ভালোবাসা নয় ঘৃণা জন্মাবে আমার জন্য। আমি মেয়ে-টা বড্ড খারাপ। আমায় জীবনের গল্পে নায়িকা নয় খলনায়িকা বলা চলে।”

“খলনায়িকা ব্যতিতও তো জীবনের ভালো মন্দ-র তফাৎ করা যায় না মিস।”

হঠাৎ পুরুষালী কণ্ঠে কথাটি শুনে দরজার দিকে দৃষ্টি গেলো সবার। দরজায় হেলান দিয়ে টাউজারের পকেটে হাত গুজে দাড়িয়ে আছে জুবায়ের। সে-ই যে কথাটা বলেছে তাতে সন্দেহ নেই। রিয়ানা ভ্রু কুচকায়। এই লোকের সাথে তো তার তেমন সখ্যতা হয়নি। আচমকা-ই তাদের কথার মাঝে এই লোক নাক গলাতে আসলো কেনো! রিয়ানার এসব আকাশ-কুসুম চিন্তা ভাবনার মাঝেই রায়াদের উপস্থিতি টের পাওয়া গেলো। রায়াদের হাতে কর্নেটো আইসক্রিমের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। রায়াদ আর জুবায়ের দুজন-ই খাওয়া শেষে বাইরে গিয়েছিলো। রায়াদ জুবায়েরের পাশে দাড়িয়ে রোজার দিকে তাকিয়ে বললো,

“এদিকে আয়।”

রোজা বেড থেকে নেমে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসলো ভাইয়ের দিকে। রায়াদ বরাবরই নিজের গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে চলে। এজন্য রোজার সাথে রায়াদের সম্পর্ক ততটা ফ্রি না হলেও রায়াদ বোনের প্রতি নিজের প্রতিটা দায়িত্ব সুন্দর ভাবে পালন করে। রোজা এসে রায়াদের সামনে দাড়াতেই রায়াদের আইসক্রিম তিনটা ধরিয়ে দেয়। পকেট থেকে ৩টা কিটক্যাট এবং ৩টা ডেইরি মিল্ক সিল্ক চকলেট বের করে দিয়ে বলে,

“খেয়ে তিনজনই ঘুমিয়ে পরিস। রাত জাগার প্রয়োজন নেই।”

৮,
কথাটা বলেই রায়াদ আড়চোখে এক ঝলক আয়াতকে দেখে নিলো। আয়াত বিছানায় বসে এক হাত অন্য হাতে কচলাচ্ছে। আর তাদেরই দেখছে যে! কি হচ্ছে এখানে? রায়াদের কথা ফুরোতেই জুবায়ের এবং রায়াদ সে স্থান ত্যাগ করে। জুবায়ের অনেকদিন পর আসায় ফাতেহা খানম আর তাকে নড়তে দেননি। যার দরুণ জুবায়ের রয়ে গেছে। রায়াদ এবং জুবায়ের চলে যেতেই রোজা বিছানায় নিজের স্থানে ফিরে আসে। রিয়ানা রায়াদ এবং জুবায়ের কে দেখে নিজের ফোন হাতে নিয়ে এমনিই নেট ঘাটাঘাটি করছিলো। রোজা আইসক্রিম, চকলেট গুলো তিনটা তিনটা করে তিনজনের ভাগ করে নিয়ে রিয়ানা এবং আয়াতের সামনে দিয়ে বলে,

“নাও, খেয়ে ফেলো। আইসক্রিম নরম হয়ে গলে যেতে বসেছে। চটপট খেয়ে ফেলো।”

রিয়ানা রোজার কথা গায়ে মাখালো না। সে বিছানা ছেড়ে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ালো। আয়াত বোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রোজা রিয়ানাকে না খেয়ে উঠতে দেখে বললো,

“একি রিয়ু আপু! তুমি খাবেনা?”

“ফ্রিজে রেখে এসো রোজা। পরে আবার খেয়ে নিও তুমি। আমি এসব খাইনা।”

রোজা রিয়ানার এমন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে আয়াতের দিকে তাকিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করে রিয়ানা সত্যি বলছে কিনা? আয়াতও ইশারা আশস্ত করে সত্যি। রোজা যেনো প্রতি পদে পদে থমকে যাচ্ছে রিয়ানার হাবভাব দেখে। সে আর প্রশ্ন করলোনা। নিরবে নিজের টুকু খেয়ে রিয়ানার ভাগের-টা ফ্রিজে রেখে আসলো।

পরদিন সকালবেলায়, নাস্তার টেবিলে নাস্তা করতে বসেছে সবাই। আজ সকাল সকালই ঘুম ভেঙেছে রিয়ানার। এজন্য সবার সাথেই খেতে বসতে পেরেছে। ইয়াসিন সাহেব হালকা পাতলা খেয়েই উঠে গেলেন। সকালের খাবার-টা ভারি কিছু উনি খেতে পারেন না। অল্প করে খেয়েই চলে যান কাজে। খাবার টেবিলে রায়াদ, জুবায়ের, আয়াত, রোজা এবং রিয়ানা। ফাতেহা খানমও বসেছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে আবার উঠে দাড়াচ্ছেন সবার খাবার এগিয়ে দিতে। খাওয়া দাওয়ার এক পর্যায়ে রোজা বললো,

“আমি বরং আজ রিয়ানা আপুকে আমার কলেজে নিয়ে যাই! সারাদিন বাসায় একাই থাকে। আপুকে আমার কলেজটা ঘুরিয়ে আনি!”

“তা মন্দ বলিসনি। কিন্তু রিয়ানা কি যাবে?”

ফাতেহা খানম প্রশ্ন করলেন। রিয়ানা ফাতেহা খানমের কথার জবাবে বললো,

“রোজা নিয়ে গেলে আমার আপত্তি নেই।”

আয়াত মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছিলো। রায়াদের সামনে বসে খেতে তার অসস্থি বোধ করছে সে। বেশ কয়েকবার রায়াদের সাথে চোখাচোখি বেশ ভালো ভাবেই হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। যখন মাথা উঁচু করে সবার দিকে তাকাতে গিয়ে রায়াদের দিকে নজর পরে! দেখা যায় রায়াদের দৃষ্টি তার দিকে। বিষয়-টা বেশ অসস্থিকর তার জন্য। রোজা রিয়ানার সম্মতি পেয়ে খুশিতে টেবিলেই লাফিয়ে উঠে। খাওয়া শেষ হওয়ায় রিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলে,

“তুমি রেডি হও খাওয়া শেষে। আমি রেডি হতে গেলাম।”

রোজা চলে যেতেই রায়াদ রিয়ানার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

“গতকাল রাতে পানি নিতে গিয়ে দেখলাম রোজা আইসক্রিম চকলেট ফ্রিজে রেখে গেলো। আমার আন্দাজ মতো আয়াত ম্যাম আর রোজা নিশ্চিত খাবে। যতো ঘাড়ত্যাড়া আপনি। আমি কিনেছি বলে খাননি নাকি?”

রিয়ানা বিরক্তবোধ করলো। এই লোকের এতো নজরদারি কিসের! জুবায়ের নিশ্চুপ খাচ্ছিলো। কিন্তু রায়াদের এই কথার পর্যায়ে আগ্রহ নিয়ে রিয়ানার দিকে তাকালো। সবার দৃষ্টি নিজের দিকে বুঝতে পেরে রিয়ানা খাওয়া ছেড়ে প্লেটের দু’পাশে হাত রেখে বললো,

“এভাবে আমায় দেখছো কেনো সবাই? আমায় ভিনগ্রহের এলিয়েন মনে হয়?”

আয়াত তো জানে কেনো খায়নি! সেজন্য তার মাঝে কোনো হেলদোল নেই। ফাতেহা খানম বিস্মিত কণ্ঠে রিয়ানাকে বললেন,

“আমার ছেলে অনেক হাড়কিপটে রিয়ু মা। কখনও কারোর জন্য বারতি দু পয়সা খরচ করেনা। সেখানে এতোকিছু এনেছে! আর তুই খাসনি?”

“আমার ওসব পছন্দ নয় আন্টি। চুপ করো, খেয়ে উঠো তো। খাওয়ার সময় এত কথা ভালো লাগেনা।”

রিয়ানা কিছু-টা বিরক্ত কণ্ঠেই কথাটা বললো। রায়াদের চোয়াল মুহুর্তেই রাগে শক্ত হয়ে উঠলো। বড়োদের সাথে এটা কেমন বিহেভিয়ার! সে ঝাঁজালো স্বরে বললো,

“বড়োদের সাথে ভদ্র নরম স্বরে কথা বলতে হয়। এটা কেমন আচরণ! আর কথা বলার ধরণ?”

ফাতেহা খানম ছেলের রাগ দেখে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বললেন,

“ছেড়ে দে রায়াদ, রিয়ানা তো শুধু তার খারাপ লাগার কথাটা উল্লেখ করেছে।”

“সেটা ভালো করেও উল্লেখ করা যেতো মা। মেজাজ দেখানোর কি আছে? মেয়ে মানুষ! আইসক্রিম চকলেটের পাগল, সেখানে এই মেয়ে খায় না! তো পছন্দ কি এই মেয়ের?”

“সিগারেট, নাইট ক্লাবে গিয়ে মদ খেয়ে মাতাল হওয়া। এসব পছন্দ বুঝেছেন? আমায় খাওয়ানোর শখ থাকে তো একদিন নাইট ক্লাবে নিয়ে যাইয়েন। আমি চিনিনা বলে যেতে পারছিনা।”

রিয়ানার এই কয়েক-টা কথায় উপস্থিত সকলে বি”স্ফুরিত নয়নে রিয়ানার দিকে চোখ বড়ো করে তাকায়। আয়াতের ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। রিয়ানা এমন আচরণ করেছে সবার সাথে! এটা তার বাবার কানে গেলে কি হবে? জুবায়ের রিয়ানার দিকে তাকিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে বললো,

“আপনি মেয়ে হয়ে মদ খান?”

“কেনো? মেয়ে বলে মদ খাওয়া নিষেধ নাকি?”

“কোনো ভদ্র বাঙালি পরিবারের ভদ্র মেয়ে এসব করেনা মিস রিয়ানা।”

রায়াদ অগ্নিচোখে তাকিয়ে কথাটা বললো। রিয়ানা হাসলো, হাসমুখেই বললো,

“আমি ভদ্র বাঙালি পরিবারের মেয়ে তো ঠিকই! কিন্তু আমি ভদ্র নই। চরম অভদ্র আমি।”

“কিন্তু আপনি এমন কেনো?”

জুবায়ের প্রশ্ন করলো। আয়াত কথা আর বাড়াতে দিতে চাইলো না। সে খাওয়া শেষ করে বললো,

“আমার বাড়ি ফিরতে হবে। এসব নিয়ে কথা না বাড়ানো-ই ভালো। আমায় একটু বাসস্ট্যান্ড অব্দি ছেড়ে আসলে ভালো হতো।”

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে