রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব-১+২

0
1088

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#সূচনাপর্ব
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১,
“রিয়ানার সাথে তোর বিয়ে হলে কেমন হবে?”

“ঐ তাড়ছিড়া আধ-পাগল মেয়েকে বিয়ে কে করবে মা? মেয়েটার সংস্পর্শে তুমিও কি পাগল হতে চললে?”

“আমি তাড়ছিড়া আধ-পাগল কে বলেছে আপনাকে? আমি পুরো-টাই পাগল। এটা বুঝতে এখনও বাকি আছে আপনার?”

নিজের কথার মাঝে আচমকা নারীকণ্ঠ শুনতে পেয়ে দরজার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রায়াদ। দরজায় দাড়ানো মেয়ে-টিকে দেখে তার মুখের কথা ফুরিয়ে আসলো যেনো। সামনে অবস্থানরত মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফোঁস করে দম ফেললো। এরপর বসা থেকে উঠে হনহনিয়ে হেঁটে তৎক্ষনাৎ মায়ের রুম ত্যাগ করলো সে। দরজার সামনে গিয়ে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে অগ্নিচক্ষু বর্ষণ করে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে। ফাতেহা খানম ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে চোখের চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছলেন। মেয়েটিকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন। মেয়েটি নিজের স্কার্ট দু’হাতে উঁচু করে আলগোছে হেঁটে ফাতেহা খানমের সামনে এসে দাড়ালো। ফাতেহা খানম বললেন,

“দাড়িয়ে আছিস কেনো তাড়ছিড়া? বোস এখানে।”

“আন্টি এট লিস্ট তুমি ঐ নাম টায় ডেকো না। আমার বিরক্ত লাগে, প্রচুর বিরক্ত লাগে।”

“নিজেই তো নিজেকে তাড়ছিড়া বলে উপস্থিত করলি! আমার ডাকা না ডাকায় কি যায় আসে?”

“আমার একটা কিউট নেইম আছে আন্টি, রিয়ানা । তুমি তুমি প্লিজ ওতো লম্বা নামে ডাকতে না পারো! রিয়ু বলো! আমি মেনে নিবো। বাট ঐ ওয়ার্ডে ডেকো না৷”

“চুপ কর, তোকে এতো পাকনামি করতে কে বলেছে?”

“আচ্ছা বাদ দাও, তোমার ছেলেকে আমায় বিয়ে করার কথা বললে কেনো তুমি?”

ফাতেহা খানম এবার ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেলেন৷ চোখে চশমা-টা পরে ইতিউতি করে আশপাশে দেখতে লাগলেন। রিয়ানা নিজেও ফাতেহা খানমের দৃষ্টি লক্ষ্য করে চারপাশে নজর বুলিয়ে জিগাসা করলো,

“কিছু খুজছো আন্টি?”

“হ্যাঁ, পানির জগটা দেখছি না যে!”

“পানি খাবে তুমি?”

ফাতেহা খানম ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক ইশারা দিলেন। রিয়ানা নিজেই উঠে ফাতেহা খানমের রুম ছাড়লো। সে যেতেই ফাতেহা খানম হাফ ছেড়ে বাঁচলেন যেনো। তিনি তো এমনিই ছেলের মনের ভাব বোঝার জন্য কথার ছলে জিগাসা করেন রিয়ানার কথা। কিন্তু কে জানতো মেয়েটার কাছেই সোজা ধরা পরে যাবেন! রিয়ানা গ্লাস ভর্তি পানি এনে ততোক্ষণে এসে পরে ফাতেহা খানমের রুমে। ফাতেহা খানম এক নজর রিয়ানাকে দেখে পানির গ্লাস টা নিয়ে ঢকঢক করে একদমে পানি টুকু পান করেন। পানি খাওয়া হতেই রিয়ানা বেড সাইড টেবিলে পানির গ্লাসটা রেখে কোমড়ে হাত দিয়ে জিগাসা করে,

“এবার বলো আন্টি উনার সাথে আমার বিয়ের কথা কেনো বলেছো?”

“এমনি, রায়াদের তো বিয়ের বয়সও হয়েছে। তাই ওর মনোভাব জানতে। এরবেশি কিছু না। তোরা দুটোই যে প্রাণী! তোদের বিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। একদম না।”

“এই তো আমার গুড গার্ল। রেস্ট করো। আমি আমার রুমে গেলাম, ঘুমাবো। তোমার মেয়ে কলেজ থেকে ফিরলে দয়া করে আমায় উঠিয়ে দিতে বলো। কেমন?”

রিয়ানা দু’হাতে ফাতেহা খানমের গাল টেনে দিয়ে কথাগুলো বললো। মনে হচ্ছে ফাতেহা খানম মেয়ে আর তাকে তার মা গাল টেনে দিলো। রিয়ানা দ্রুত পদে রুম ছাড়লো ফাতেহা খানমের। সে যেতেই ফাতেহা খানম হাফ ছাড়লেন। ভাবলেন, ‘তোকে আমার ছেলের বউ করে পেলে ভালোই হতো রে রিয়ু।’

২,
মায়ের রুম থেকে নিজের রুমে এসে বিছানায় বোসে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিস্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে রায়াদ। দুনিয়ায় আর মেয়ে খুজে পেলো না তার মা! একদম রিয়ানার কথা-ই বলতে হলো? মেয়েটি তাদের বাড়ির অতিথি। তার বাবার বেস্টফ্রেন্ডের মেয়ে। ৩মাস থেকেই চলে যাবে। সেই ছোটোবেলায় মেয়েটিকে দেখেছিলো একদম বাচ্চা অবস্থায়। এরপর তার বাবার বন্ধু দেশের বাইরে চলে গেলে মাঝখানে আর মেয়েটিকে দেখা যায়নি। ফোনে যদিও বা মেয়েটির বাবার সাথে মাঝে মধ্যে কথা হতো! কিন্তু মেয়েটিকে দেখতোনা। সেই মেয়েটিকে দেখলো এতো বছর পর৷ কিন্তু দেশে এসে তার বাবার বন্ধু মেয়েকে নিজের সাথে না রেখে তাদের বাসায় কেনো রেখে গেলেন! বিষয়টা আজও বুঝে উঠতে পারেনি রায়াদ। একসপ্তাহ হলো এসেছে তাদের বাড়িতে আর তাতেই একদম তার মা তার গলায় মেয়েটিকে ঝোলানোর কথা ভেবে ফেললো! মেয়ে-টার মাঝে না আছে বাঙালি শিক্ষা! না আছে বাঙালি মেয়েদের মতো চালচলন। থাকবেই বা কি কারণে! বাবার অতি আদরের উচ্ছন্নে যাওয়া কন্যা। তারমাঝে থেকেছে জার্মানির মতো উন্নত দেশে। একটা মেয়ে যে কি করে এরকম হয়! মাথায় ঢোকেনা রায়াদের। যতোই বিদেশে থাকুক! বাঙালি মেয়ে তো!, বিদেশ গিয়েছে বলেই বাঙালিয়ানা ভু্লতে হবে? সে মেয়েটিকে নিয়ে ভাবছেই বা কেনো? পুরো একটা বাসা! মানুষ তিনজন। রায়াদ, তার মা এবং মেয়েটি। শরীর-টা একটু খারাপ লাগায় আলসেমি করে ভার্সিটিতে যায়নি রায়াদ। মাস্টার্সে পড়াশোনা করছে সে। পাশাপাশি বাবার ছোট্ট কাপড়ের বিজনেসে সাহায্য করে। আজ বাসায় থাকায় মায়ের কাছে গেলো একটু মায়ের সাথে সময় কাটাবে বলে! তার মা-ও মেজাজ টা বিগড়ে দিলো। নিজের বাড়ি ছেড়ে তিন মাস ধরে অন্যের বাড়িতে এসে থাকার কোনো মানে হয়! ঘুরতে মানুষ আসে, তাই বলে এতোদিন! বাড়ির মাঝে অপরিচিত কন্যার আনাগোনা রায়াদের অসস্তি অনুভব হয়। বাবা মা-কে বলেও তো লাভ নেই! আসেই না কোনোদিন সেভাবে! এসেছে যেতে কি করে দেয় তারা! নিজের বাড়িতেই নিজের অশান্তি লাগছে রায়াদের। বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো রায়াদ। টিশার্ট বদলে চট জলদী শার্ট পরে নিলো। বেড সাউড টেবিল থেকে নিজের বাইকের চাবি বের করে নিয়ে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে হাঁটা ধরলো বাইরে যাওয়ার জন্য। ড্রইং রুমে আসতেই রিয়ানার মুখোমুখি হয় রায়াদ। রিয়ানার আচমকা ক্ষুধা লাগায় সে ঘুমানো বাদ দিয়ে খেয়ে রুমের দিকে যাচ্ছিলো। তখনই রায়াদের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে যায়। রায়াদ রিয়ানাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই রিয়ানা মুখ ভেঙচি কাটে। রায়াদের কোন পাকা ধানে সে মই দিয়েছে! কে জানে? আসার পর থেকে তার ড্রেসআপ, চলাফেরা সবকিছু নিয়েই রায়াদের সমস্যা। জিন্স, টিশার্ট পরা দেখতেই পারেনা। যার ফলে স্কার্ট-টপস আর গলায় ওরনা ঝুলিয়ে চলছে সে। যা এ অব্দি সে কখনও পরেনি। স্কার্টে পা বেজে উস্টা খাওয়ার ভয়েতে স্কার্ট উঁচু করে ধরে হাঁটতে হচ্ছে তার। এ ছেলে নাকি কড়া শাসনের বয়াম! বুঝতে পারেনা রিয়ানা। রায়াদ চোখের অগোচর হতেই রিয়ানা রুমে ঢুকে। ফোন টা হাতে নিয়ে আয়েশ করে বিছানায় শুয়ে পরে৷ ঘুম আর ধরবেনা তার। যখন ধরেছিলো! ক্ষুধার চোটে ঘুমায়নি। দুপুরে খাবার টেবিলে রায়াদ আর সে একসাথেই বসেছিলো। অবশ্য ফাতেহা খানমও ছিলেন। তবুও অসস্তি বোধ হওয়ায় পেটপুরে খায়নি রিয়ানা। কিন্তু ক্ষুধা লাগলেও সহ্য করার উপায় নেই। এজন্য কিচেনে গিয়ে হাড়িপাতিল হাতরে চুপিসারেই খেয়ে আসতে হলো তাকে। রিয়ানা ফোনের গ্যালারি ঘেটে নিজের বাবার ছবিটা বের করে এক নাগারে তাকিয়ে রইলো। চোখের কোণে অশ্রু-রা ভীড় জমাতে শুরু করলো। কখন জানি টুপ করে ঝড়ে পরে। রিয়ানা বুড়ো আঙুলের মাথা দিয়ে জল মুছে ঠোঁট নাড়িয়ে বিরবির করে বললো,

“দেখলে বাবা, তোমার জন্য নিজের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যের বাড়িতে পরে আছি। যদিও বা সব মানুষই ভালো। শুধু তোমার বন্ধুর ছেলে টা আমায় ভালো চোখে দেখেনা। আমি কি করবো বলো! ছোটো থেকেই উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করে গোছালো জীবন টা মানতে আমার প্রচুর কষ্টের হয়ে যাচ্ছে। তবুও তোমার কথা ভেবে মেনে নিচ্ছি। তুমি তো যা চেয়েছো, তার মান রাখতে গিয়ে আমার নিজেকে অনেক খেসারত দিতে হচ্ছে বাবা। তবুও তুমি, বড়ো আপু যদি এতেই খুশি হও, রায়াদ সাহেবের করা সব অপমান মেনে নিলাম মাথা পেতে। অথচ আমায় অপমান করে কেউ কিছু বললে তা মাটিতে পরার আগেই জবাব পেতো। হাহ জীবন, দেখো কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! ২০বছরের বসন্ত পেরুনো জীবন টায় রঙিন ধরা দেখার বদলে শুধু একপাক্ষিকতা দেখে আসলাম। আচ্ছা বাবা! আমি এতোটাই খারাপ মেয়ে তোমার? যে আমায় একটু আদর করে নিজের কাছে রাখা গেলো না? আমার বড়ো বোনের বিয়ে! অথচ আমিই বাড়ি থাকবোনা। কি অদ্ভুত বিষয়, বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে বাবা। আমি তোমায় আর আপুকে বড্ড মিস করে যাচ্ছি। মাত্র একসপ্তাহ পেরুলো! আরও কতোগুলো দিন, তোমাদের ছেড়ে কি করে থাকবো! যদিও বা আন্টির মাঝে মা মা গন্ধটা আনন্দের বিষয়। কিন্তু তোমাদের ছেড়ে থাকা! নিদারুণ কষ্টের শামিল।”

রিয়ানা কথাগুলো নিজ মনে বলেই ফোনটা বুকে চেপে বালিশে মুখ গুজে কেঁদে উঠলো। বাড়িতে যাওয়ার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। অথচ তার বাড়ি ফেরার উপায় নেই। কি এক বাঁধা! বাঁধা-টা যে কবে কাটবে! জানেনা রিয়ানা।

চলবে?

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ০২
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩,
বেলা বেশ গড়িয়েছে, রিয়ানার আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরিই হয়ে গেলো। মোবাইল হাতে নিয়ে সময় দেখে, দশটা বাজতে চলেছে। ঘুম থেকে উঠেই রায়াদের বোন রোজা কলেজে গেছে কিনা! দেখার জন্য ড্রইং রুমে এসেই সোফায় নিজের বোন আয়াতকে বসে থাকতে দেখে চমকালো রিয়ানা। ফাতেহা খানম এবং উনার স্বামী ইয়াসিন শাহনেওয়াজের সঙ্গে বসে হেসে গল্প করতে ব্যস্ত আয়াত। রায়াদ আর রোজা হয়তো ক্লাস করতে চলে গেছে তাদের কলেজ এবং ভার্সিটিতে তার দিকে দৃষ্টি স্থির রিয়ানার। সে এক-পা দু-পা করে এগিয়ে বোনের সামনে দাড়ালো। আয়াত কথার মাঝেই রিয়ানাকে দেখতে পেয়ে উঠে দাড়ালো। রিয়ানার বিস্ময় কাটছেনা। বারবার মনে হচ্ছে সে এখনও ঘুমোচ্ছে, আর ঘুমের ঘোরে আয়াত এসেছে, সেই স্বপ্ন দেখছে সে। আয়াত বোনকে রিয়ানা কিছু বুঝে উঠার আগেই জড়িয়ে ধরে। নম্র স্বরে জিগাসা করে,

“কেমন আছিস রিয়ু!”

“যেমন রেখে গেলে! তুমি এসেছো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই এসেছো?”

আয়াত ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। রিয়ানকে ছেড়ে গালে হাত রেখে বললো,

” হ্যাঁ সত্যি এসেছি। তোর ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় ছিলাম। তোর তো নিজে ঘুম থেকে না উঠলে কেউ উঠালেই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। এজন্য জাগাইনি।”

ফাতেহা খানম দু-বোনের কথার মাঝে বললেন,

” রিয়ু তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করে নিয়েছি। টেবিল সাজাই, ব্রেকফাস্ট করবি আয়।”

আয়াত উনার কথা শুনে চট করে বললো,

” আন্টি আমি একটু সাহায্য করি! ও তো ফ্রেশ হতেই যাবে। আপনি একা কাজ করার বদলে আমি একটু হাতে হাতে এগিয়ে দিই?”

ফাতেহা বেগম মুচকি হাসলেন। মানা করলেন না। দুজনে পা বাড়ালো কিচেনের দিকে। ওরা চলে যেতেই ইয়াসিন সাহেবের উদ্দেশ্যে রিয়ানা বললো,

” গুড মর্নিং আংকেল।”

” গুড মর্নিং মামনি।”

” রাতে লেইট করে ঘুমানোর ফলে লেইট হলো উঠতে। আপনি তো এই সময় কাজে থাকেন! আজ বাসায় যে?”

” ঐ তো তোমার আব্বু ফোন করে বললো, আয়াত মা আসবে। এজন্য তাকে সাথে নিয়ে বাসায় আসলাম। তুমি ফ্রেশ হও গিয়ে।”

“জি আংকেল।”

রিয়ানা ইয়াসিন সাহেবের সাথে কথা শেষ করে তার জন্য বরাদ্দকৃত বর্তমানের নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। এদিকে কিচেনে ফাতেহা খানমের হাতে হাতে নাস্তা সাজিয়ে টেবিলে এনে রাখছে আয়াত। সবার লাস্টে ফাতেহা খানমের সাহায্যে বোনের জন্য তার হাতের বানানো প্রিয় একটা আইটেম বানানোর কাজে লেগে পরে আয়াত। সপ্তাহে দুদিন আয়াতের হাতের বানানো আইটেম-টা খাবেই রিয়ানা। অথচ এক সপ্তাহ হলো! বোনকে চোখের দেখাও দেখতে না পেয়ে তার ছুটে আসা। রিয়ানার জন্য আয়াত চিকেনের একটা আইটেম করছে, সেটা ঢাকনায় ঢেকে দিয়ে দাড়াতেই ফাতেহা খানম আয়াতের উদ্দেশ্যে বললেন,

“আচ্ছা আয়াত মা, তোমায় কিছু কথা জিগাসা করি! যদিও বা এটা পারসোনাল কথা। তবুও জানার জন্য আগ্রহ হচ্ছে।”

আয়াত ফাতেহা খানমের দিকে ফিরে তাকালো উনার কথা শুনে। সম্মানের সহিত মাথা নাড়িয়ে বললো,

“জি বলুন আন্টি, সমস্যা নেই। ”

” তোমরা দেশে ফিরে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা রিয়ুকে এখানে রেখে গেলে! এ ক’দিনে যা বুঝলাম, ও ভীষণ মিশুক মেয়ে সাথে ভালো মনের একজন মানুষ। তোমার বাবা মানে হানিফ ভাইও তোমার আংকেলের কাছে রিয়ুকে রেখে বলে গেলেন একটু মানুষ বানিয়ে পাঠাতে! জার্মানিতে থেকে অমানুষ হয়েছে রিয়ু। বাড়িতে সবার মাঝে নিয়ে গেলে কথা শুনতে হবে! এমন কিছুই বলেছিলেন তোমার বাবা৷ কোথায়! ওর মাঝে তো এমন কিছু রিয়ুর মাঝে পেলাম না! রায়াদ শুধু একবার ওর ড্রেসআপ নিয়ে চেচামেচি করায় পরে রোজার ড্রেস ও শান্ত মেয়ের মতোই পরে নিলো। পরে তোমার আংকেল আলাদা ভাবে ওর জন্য ড্রেসও এনেছে। ওগুলোই পরে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে। আমার সাথে কি সুন্দর মিশে গেছে। তাহলে ওর মাঝে কিসের এতো খামতি যে, তোমার বাবা নিজের মেয়েকেই সবার মাঝে নিয়ে যেতে লজ্জায় এখানে রেখে গেলেন?”

৪,
আয়াত আন্দাজ করেছিলো এমন কিছু কথার সম্মুখীন হতে হবে। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্রাই-প্যানের ঢাকনা উচিয়ে রিয়ানার জন্য বানানো খাবারটা নাড়াচাড়া করে দেখলো হয়েছে কিনা! হয়ে যেতেই নামিয়ে নিলো। সার্ভিং বোলে ঢেলে নিয়ে ফ্রাই প্যান ক্লিন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ফাতেহা খানম নিজেই এবার অসস্তি পরলেন। কথাগুলো না জিগাসা করেও থাকতে পারছিলেন না! আবার জিগাসা করেও আয়াতের উত্তর না পেয়ে কেমন একটা অসস্তি পরলেন। আয়াত হাতে কাজ শেষে ফাতেহা খানমকে ইশারা করলো ডাইনিং টেবিলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ফাতেহা খানমও ইশারা বুঝে আয়াতের সাথে হাঁটা ধরলেন। দুজনে ডাইনিং টেবিলে এসে সবার খাবার সার্ভ করে দিলো। এরমাঝেই আয়াত বললো,

“আপনার কথাগুলোর উত্তর একান্তই আপনার সাথে বসে দিতে হবে আন্টি। কথা বলার সময় রিয়ুর কানে গেলে মেয়েটা কষ্ট পাবে। ”

“তোমরা কি নিয়ে কথা বলছো?”

আয়াতের কথা ফুরোতেই রিয়ানা এসে দাঁড়িয়েছে ডাইনিং টেবিলের কাছে। টেবিলের একমাথায় চেয়ারে হাত রেখে দুজনকে কথা বলতে দেখে প্রশ্ন করে। আয়াত বোনের দিকে দৃষ্টি মেলতেই অবাক হওয়ার পাশাপাশি মুগ্ধ হয়ে যায়। রিয়ানা হালকা কমলা রঙের সুতির একটা থ্রিপিস পরেছে৷ রঙটা রিয়ানার ফর্সা শরীরে দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে। আয়াত অবাক হয়েছে কারণ এই প্রথম বার রিয়ানাকে থ্রিপিস পরতে দেখলো সে। এ যাবত তো শুধু, জিন্স, টপস, শার্ট, টিশার্ট, পাতলা সোয়েটার, জ্যাকেট এসব পরতেই দেখেছে। সে শতো চেষ্টা করেও কখনও বাঙালি কাপড় পরাতে পারেনি আয়াত। তার বোন-টা আপাদমস্তক পুরোটাই বিদেশী চালচলনে চলেফিরে বড়ো হয়েছে। সেখানে থ্রিপিস পরা অবস্থাতে দেখে সে অবাক না হয়ে পারলোনা। বোনের দিকে এগিয়ে এসে দুগালে হাত রেখে মুগ্ধ কণ্ঠে বললো,

“মাশাল্লাহ, তোকে তো দারুণ লাগছে রিয়ু। ”

“রাখ তোর দারুণ লাগা আপু। ওরনা বারবার স্লিপ কেটে পরে যায়। এাব ড্রেস মেয়েরা হ্যান্ডেল করে কি করে! হাউ?”

রিয়ানা বিরক্তিমাখা কণ্ঠে কথাটা বলে। আয়াত হালকা হেসে বললো,

“হ্যান্ডেল করতে পারিস না তবে পরলি যে! তোর তো কিছুতে কমফোর্ট ফিল না হলে কিছুতেই সেটা সহ্য করিস না। তাহলে থ্রিপিস পরে আছিস যে!”

“বাবা তো এটাই চায়! তাইনা? একটু মেয়েলি ভাব আসুক আমার মাঝে। যেনো চাচ্চু, ফুফুমনি, খালামনিদের মাঝে বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন মেয়েদের ভীনদেশেও মানুষের মতো মানুষ করতে পেরেছেন! অথচ সময় দেওয়ার বেলায়!”

“থাম তুই, আমার কথার উত্তর না দিয়ে কথা অন্যদিকে টানছিস!”

আয়াত রিয়ানার হাতে চাপড় মেরে কথাটা বললো। ফাতেহা খানম নিরবে দাড়িয়ে দুবোনের কথা শুনছিলেন। এরমাঝেই উনি ফোঁড়ন কেটে বললেন,

“রায়াদ ওর ড্রেসআপ দেখতে পারেনা বললাম না তোমায়! সেজন্যই থ্রিপিস পরেছে হয়তো।”

রায়াদ আর রোজা আংকেল আন্টির ছেলেমেয়ে, এটা জানে আয়াত। আার পরও বেশ কয়েকবার উনাদের কথার মাঝে দুজনেরই নাম শুনলো আয়াত। এখন আবার রায়াদ নামক মানুষটিকেও রিয়ানা এতো ভয় পেয়েছে যে নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে বাঙালি ড্রেস পরছে! রায়াদ নামক মানুষ-টা কেমন! দেখার জন্য মনের মাঝে উশখুশ বোধ হতে শুরু করলো আয়াতের। রিয়ানা আয়াতকে চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ঝাঁকি দিয়ে বললো,

“কিরে আপু! কোথায় হারালি?”

আয়াত রিয়ানার ঝাঁকিতে সম্বিত ফিরে পেয়ে থতমত খেয়ে উত্তর দিলো,

“না কোথাও না। বোস, আগে ব্রেকফাস্ট সেরে নে। এরপর দুবোনে একটু শপিং এ যাবো। তোর পছন্দ ছাড়া কিছু কিনতে ইচ্ছে করেনা রিয়ানা।”

রিয়ানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আয়াতের কথায়। চুপটি করে বসে পরে খেতে। সে বসতেই ফাতেহা খানম বললেন,

“তুমিও খেতে বসে পরো আয়াত।”

“আংকেল কে ডাকলেন না!”

আয়াতের কথায় ফাতপহা খানম ইয়াসিন সাহেবকেও ডাকলেন। অতঃপর চারজনে একত্রে বসে খাওয়াদাওয়া শেষ করে নেয়। এরপর ড্রইং রুমে সোফায় বসে আয়াত, ফাতেহা খানম, ইয়াসিন সাহেব নিজেদের মতো টুকটাক বাসার সবার খোজ খবর নেওয়ার কথাবার্তার আলোচনা শুরু করতেই ইয়াসিন সাহেব জিগাসা করেন আয়াতকে,

“হানিফ তো তোমার বিয়ের জন্যই দেশে ফিরেছে! সেই বিয়ের খবর কতোদূর মা?”

নিজের বিয়ের কথা নিজের মুখে বলতেই কেমন একটা লজ্জা লাগছিলো আয়াতের। সেজন্য সে ছোট্ট করে জবাব দেয়,

“আপনি বরং বাবার সাথেই একবার কথা বলে নিয়েন আংকেল।”

ফাতেহা খানম, ইয়াসিন সাহেব বুঝলেন আয়াত হয়তো লজ্জা পাচ্ছে। উনারা দুজনই আয়াতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। রিয়ানা গেছে ড্রেস পাল্টাতে। স্কার্টের সাথে তবু ওরনা গলায় পেচিয়ে রাখা যায়। থ্রিপিসে সেভাবে রাখলে দেখতে তো ভালো লাগেই না, আবার নরমাল ভাবে রাখলে দুমদাম ওরনার একমাথা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাবার যোগার। এজন্য ড্রেস পাল্টাতে গেছে সে। ড্রেস পাল্টে ড্রইং রুমে এসে বোনকে উদ্দেশ্য করে রিয়ানা বলে,

“আপু চল, আমি রেডি। ”

আয়াত এবং ইয়াসিন সাহেব উঠে দাড়ায়। তিনজনই যাবে একসাথে। ইয়াসিন সাহেবের কাপড়ের দোকান থেকেই কাপড় কিনবে আয়াত। মার্কেটে উনার নিজস্ব তিনটা দোকান আছে কাপড়ের, সাথে একটা জুয়েলারী শপও আছে উনার। এসবই দেখাশোনা করে জীবনটা স্বচ্ছন্দে চলে যাচ্ছে ইয়াসিন সাহেবের৷ ফাতেহা খানম দরজা আটকে দিতে ওদের পিছু পিছু আসলো। কিন্তু রিয়ানা দরজা খুলতেই মুখোমুখি হয় রায়াদের। রায়াদকে আচমকা দেখে ঘাবড়ে যায় সে। দরজা থেকে সরে দাড়ায়। ইয়াসিন সাহেব ছেলেকে হঠাৎ করে দেখে প্রশ্ন করেন,

“তুমি তো ভার্সিটিতে গেলে, এই অসময়ে বাসায় আসলে যে!”

রায়াদের তার বাবার বলা কথাগুলো কর্ণগোচর হলো না। তার দৃষ্টি আঁটকে আছে রিয়ানার পাশে অবস্থানরত আয়াতের দিকে। আয়াতও রায়াদকে একপলক দেখে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়েছে। তখনই হন্তদন্ত হয়ে রায়াদের পাশে এসে দাড়ায় এক যুবক। ইয়াসিন সাহেব আর ফাতেহা খানমকে দেখতে পেয়ে জোড় গলায় বলে,

“আসসালামু আলাইকুম আংকেল, আন্টি। ভালো আছেন আপনারা? ”

রিয়ানা যুবকটির দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আনমনে ভাবে,

“এ আবার কোন পাগল! দেখতে তো পাগলদের সর্দার ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না।”

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়, আসসালামু আলাইকুম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে