রক্তাক্ত হাত

0
774

রাজউকের সাবেক বড় কর্মকর্তা মহিউদ্দিনের কপালে ঘাম; বয়সকালে ঘাম ভালো লক্ষণ না; প্রেসার বাড়ার লক্ষণ বলে মনে হচ্ছে। কিছুদিন আগেও ব্যাংকক থেকে পুরো শরীর চেকআপ করে এসেছেন; ডাক্তার বলেছে কোন সমস্যা নাই; শুধু দুশ্চিন্তা করবে না; তাহলে আরো একশ বচ্ছর বাঁচবে;

মহিউদ্দিন শুনে হেসেছে; ব্যাংককের ডাক্তারদের সাথে কথা বললে মন ভালো হয়ে যায়; কিভাবে রোগীদের মন ভালো করা যায় তারা খুব চিন্তা করে; আর দেশের ডাক্তারদের সাথে কথা বললে

মহিউদ্দিন সাহেব অনেক বচ্ছরতো বাচলেন; এইবার আল্লাহ খোদার নাম নিন; আমার বাড়িতে একটা মাদ্রাসা করেছি; আপনাকে একজন ডোনার মেম্বার করতে চাই; জীবনেতো কম টাকা কামান নাই; কিছু সদকায়ে জারিয়া করেন;
মহিউদ্দিন মনে মনে গালি মারে; টাকা কি কামিয়েছি তোকে দেয়ার জন্য; শালা শয়তান; তুই মাদ্রাসা করেছিস তুই চালা; আমি নিজে মাদ্রাসা দিয়ে নিজেই চালাবো; দশজনের কাছে হাত পাতবো না;

মহিউদ্দিন বিড়বিড় করে বলতে থাকে; পরকালের কাজও করে যেতে হবে; ইদানীংকালে মনে কুডাক আসে; ব্যাংককের ডাক্তার যাই বলুক না কেন মনে হয় বেশীদিন বাকি নাই; যাওয়ার আগে সদকায়ে জারিয়ার ব্যবস্থা করে যেতে হবে;

আজ মহিউদ্দিন টেনশনে মরে যাচ্ছে; বনানীতে যেই বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে এই বিল্ডিংয়ের এপ্রোভাল প্রসেসে মহিউদ্দিন একজন ছিলেন; প্রথম দিকে মহিউদ্দিন দিতে রাজি হচ্ছিলো না; বাড়ির মালিক এবং ডেভলপারদের মধ্যে ঝামেলা চলছিলো;

মহিউদ্দিনের বস বলেছে; চুপচাপ বোবা হয়ে থাকেন; ওদের উপায় নাই; নিজের থেকেই ঝামেলাও মিটাবে এবং টাকাও বাড়াবে;

মহিউদ্দিনের মাঝে মাঝে নীতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে;

কিন্তু স্যার; বাড়ির এপ্রোভাল নিচ্ছে ১৮ তালা করছে ২৩ তালা; কোনসময় পত্রিকাআলারা রিপোর্ট করে দেয়;

হায়রে মহিউদ্দিন সাহেব; এখনো এই দেশের সিস্টেম চিনলেন না; পত্রিকার মালিক কারা; সব ব্যবসায়ী; বুঝেন না ব্যবসায়ীরা পত্রিকা, টিভি চ্যানেল চালায় কেন? ওদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য; এই বিল্ডিংয়ে ওদের কয়েকজনের স্বার্থ উদ্ধার হবে; আমার সাথে অলরেডি কথা হয়েছে; কোন চিন্তা করবেন না; ওরা নিজেরা নিজেরা একজোট; বোবা হয়ে থাকেন; আপনারওতো চাকরীর বয়স বেশীদিন নাই; এইখানে থেকে বড় অংকের টাকা পাবেন; ছেলেটাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিন পড়াশুনা করার জন্য; দেশে রেখে কি করবেন; এই দেশে জীবনের নিরাপত্তা নাইরে ভাই;

মহিউদ্দিন সাহেব টাকা পাওয়ার পর প্রথম উমরাহ করতে চলে যান; আল্লাহর ঘরে গিয়ে মাপ চেয়ে এসেছেন; জীবনে অনেক ঘুষ খেয়েছেন; মাপ করার মালিক আল্লাহ; ছেলেকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিয়েছেন; ছেলে পড়াশুনা শেষ করে দেশে এসেছে; মহিউদ্দিন সাহেবের বউ ছেলের বিয়ে ঠিক করেছে; তিনি অবশ্য পুরো জানেন না; মেয়ে কি ছেলের পছন্দ নাকি মায়ের পছন্দ; তিনি ঘরোয়া ব্যাপারে খুব বেশী হস্তক্ষেপ করেন না; ছেলে যে অস্ট্রেলিয়া থেকে সাদা চামড়ার কাউকে বিয়ে করে আনেনাই তাতেই তিনি খুশী; মহিউদ্দিন সাহেব কিছুটা তার বউকে ভয়ও পান; দুর্নীতিগস্ত লোকজনের হৃদয় দূর্বল হয়; মহিউদ্দিন সাহেবেরও হৃদয় দুর্বল;

মহিউদ্দিন টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন; হটাত দেখা যাচ্ছে কয়েকজন উপর থেকে নামার চেষ্টা করছে; এর মাঝে একজন উপর থেকে পড়ে গেলো; তিনি টিভি বন্ধ করে দিলেন; তার বুক ধড়ফড় করছে; এইসব জিনিস তিনি দেখতে পারেন না; টিভি চ্যানেলগুলো এইগুলো কিভাবে প্রচার করে তিনি বুঝতে পারেন না; তিনি নিশ্চিত তদন্ত কমিটি গঠন হবে; তদন্তে তার নামও আসবে; মহিউদ্দিন সাহেব তার বসকে ফোন দেন;

ভাই, টিভি-তে দেখেছেন;

হুম; দেখছি; তোমার কণ্ঠস্বরে মনে হচ্ছে খুব চিন্তায় পড়েছো;

কি বলেন চিন্তায় পড়বো না; তদন্ত কমিটি গঠন হবে; সেখানে অনিয়মের সাথে জড়িত হিসেবে আমাদের নাম আসবে; আপনিতো জানেনই আগামী মাসে ছেলের বিয়ে; কি একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার;

শুনো নাকি তেল দিয়ে ঘুমাও; আমরা এপ্রোভাল দিয়েছি কিন্তু আবার এই বিল্ডিংয়ের নামে রিপোর্টও করেছি; এরা নিয়ম মানে নাই; কিন্তু সেই রিপোর্ট আমরাই ধামাচাপা দিয়ে রেখেছি; এখন যখন এই বিষয়ে তদন্ত হবে তখন দেখা যাবে আমরাতো রিপোর্ট দিয়েছি; চিঠি পাঠিয়েছি; আমরা সেইফ;

কিন্তু ভাই; এতোগুলো লোক মারা যাচ্ছে; মনটা কেমন জানি হুহু করছে; সহ্য হচ্ছে না;

শুনো; বাঙ্গালী মারা যাবেই; ডারউইন কি বলেছিলো যোগ্যতমের জয়; এখানে টিকে থাকতে হলে যোগ্যতম হতে হবে; তুমি যদি যোগ্য না হও; তুমি মারা যাবেই; বাঙ্গালী গাড়ির নীচে পড়বে, আগুনে পুড়বে; পানিতে ডুববে করার কিছু নাই; এই দেশে একটাই নিয়ম নিজে বাচলে বাপের নাম;

মহিউদ্দিনের ভালো লাগে না;

ঠিক আছে ভাই; কোন খবর থাকলে জানাইয়েন;

আরে কোন চিন্তা করো না; এই দেশ পুরার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত; কম আর বেশী; সুতরাং কিছু হবে না;

মহিউদ্দিনের ঘরে হন্তদন্ত হয়ে ছেলে ঢুকে; মহিউদ্দিন শঙ্কিত হন; প্রকৃতি নাকি কোন কিছুকে ক্ষমা করে না; তার ছেলের বউ এখানে আটকা পরে নাইতো; তার শরীর অবসন্ন লাগছে;

বাবা, দেখেছো?

পিঙ্কি কই? মহিউদ্দিন ভয়ার্ত কন্ঠে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে;

পিঙ্কি আছে বাবা; কোন সমস্যা নেই; এটা দেখার পর দেশে থাকতে ইচ্ছে করছে না; আমি বাইরে চলে যাবো; এই দেশে কোন কিছুর নিরাপত্তা নাই;

ঘাম দিয়ে মহিউদ্দিনের জ্বর ছাড়ে; প্রকৃতি তাকে ক্ষমা করেছে; তার পরিবারের কেউ আক্রান্ত হয়নি; এসময় রুনু এসে ঘরে ঢুকে; রুনুর চোখ লাল;

এই বিল্ডিংয়ের এপ্রোভাল তুমি দিয়েছো; তাই না?

দেখো এপ্রোভাল একটা প্রসেসে দেয়া হয়; একজন মানুষ কখনো এপ্রোভাল দিতে পারে না; আমি প্রসেসের একজন ছিলাম;

তোমার হাতে রক্ত লেগে আছে;

মহিউদ্দিন চমকে উঠে; কি সব উল্টা পাল্টা কথা বলছো; শুনো আবেগ দিয়ে সংসার চলে না; এই যে এতো আলিশানভাবে আছো, ছেলেকে দেশের বাইরে পড়িয়েছো; বেতনের টাকায় সম্ভব ছিলো না; তোমাদের সুখের জন্যই আমাকে করতে হয়েছে; আর আমি একা না; এটা সবাই করছে; বরং আমি না করলে আমি টিকে থাকতে পারতাম না;

রুনু ঘর থেকে বের হয়ে যায়;

মহিউদ্দিন আবার টিভি ছাড়ে; লোকজনের কান্নাকাটি দেখাচ্ছে; মানুষ হাত তুলে দোয়া করছে; একটা মেয়ের সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে;

মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদছে; আমার মা এই বিল্ডিংয়ে আটকা পড়েছে; প্লিজ আমার মাকে উদ্ধার করুন; উনার সাথে আমার একটু আগেও কথা হয়েছে; ১২ তালায় আছে;

একজন বাবার সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে; আমার ছেলে ১৩ তালায় আটকা পড়েছে; বলেছে বাবা আমাকে মাপ করে দিয়ো;

লোকজন সমস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে; এই বিল্ডিং অবৈধ; কিন্তু এরপরও রাজউক কিভাবে এটার এপ্রোভাল দিলো; সিঁড়িগুলো কি পরিমার সরু চিন্তাই করা যায় না; আমরা সেই সব লোকদের বিচার চাই; তাদের ফাসি চাই;

মহিউদ্দিন টিভি বন্ধ করে দেয়; তার শরীর কাপছে; গোসল করলে ভালো লাগতে পারে; তিনি গোসলখানায় ঢুকেন; পানি ছাড়তেই তার মনে হয় কল দিয়ে রক্ত পড়ছে; মহিউদ্দিন চিৎকার করে পরে যান;

তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়;

রুনু ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে;

ওর কি হয়েছে?

উনি আসলে মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন; সবকিছুতেই তিনি রক্ত দেখতে পারছেন; খেতে পারছেন না, ঘুমাতে পারছেন না; আপনারা উনাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন অথবা কোন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারেন; উনি ট্রমায় আছেন; এইসব ট্রমা খুব সহজে ভালো হয় না;

রুনু গাড়িতে মহিউদ্দিনের হাত ধরে বসে আছে;

[এই পৃথিবীতে আমরা ভাবি এক কিন্তু হয় আরেক; আমরা ভাবি যেকোন ভাবেই টাকা আয় করতে পারলেই হলো; অর্থ, ক্ষমতাই সকল সুখের মূল; মানসিক শান্তি এবং প্রশান্তি এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত প্রায়; কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ধনী হওয়ার পর আমরা যে জিনিসটা খুব চাই তা হচ্ছে মানসিক শান্তি; কিন্তু ধন, সম্পদ, বিত্ত, বৈভব, ক্ষমতা এদের থেকে মানসিক শান্তি অনেক দূরে থাকে; যত সম্পদ, যত ক্ষমতা তত মানসিক চিন্তা, প্রেসার; তাইতো বলা হয় সুখী মানুষের জামা থাকে না; আসলেই তাই]

#আমিনুলের_গল্প_সমগ্র

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে