#রংধনুতে_প্রেমের_বাড়ি
®ফারজানা মুমু
৬
চাঁদের নানার বাড়ির উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে সবাই। অক্ষর এবং চৈতালি ব্যাথিত। চয়নের ইচ্ছে ছিল না চৈতালিকে একা রেখে যাওয়ার কিন্তু বাধ্য হয়েই যেতে হলো। দুপুর বেলা নিজ কক্ষে বসে আছে চৈতালি। অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে তাঁকে। পুরো বাসায় মাত্র দু’জন লোক। চয়ন অবশ্য কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিচ্ছে। বলেছে, আমি আগামীকাল চলে আসবো। ভয় পাবি না। অক্ষর ভাইয়া রাগী থাকলেও খারাপ না। তারপরেও ভয় থাকলে রুম থেকে বের হওয়ার দরকার নেই। রান্নাবান্না করতে হবে না। হাত পু’ড়িয়ে ফেলবি। অনলাইন থেকে অর্ডার করিস। আর শোন, সবদিকে নজর রাখিস। সন্দেহনজর দেখতে পেলে অক্ষর ভাইয়াকে বলিস।
ভাইকে আশ্বস্ত দিয়ে চৈতালি বলল,ওকে ভাইয়া। তুমি চিন্তা করো না। ভালোভাবে পৌঁছে ফোন দিও।
দখিনা হাওয়াতে ভেসে আসা মিষ্টি সুবাস চৈতালির নাকে এসে ঠেকেছে, চোখ বন্ধ করে মিষ্টি অনুভবের পরিচিত নিচ্ছে । বাগানে শিউলি ফুল ফুটেছে। ফুলের সুবাসে চারদিন মৌ মৌ।
-” খাবার টেবিলে আপনার জন্য বিরিয়ানি রাখা আছে। খেয়ে নিন। ভয় পাবেন না আমাকে। আমি আপনাকে বিরক্ত করব না। বাসায় কেউ নেই এখন তাই বুঝতে পারছি আপনার মনের কথা। বিশ্বাস রাখুন কেউ না আসা পর্যন্ত আপনাকে বিরক্ত করব না। অস্বস্তিতে ফেলব না। প্রমিজ।”
ম্যাসেজটা পড়ল চৌতালী। হুট করেই লোকটাকে সামান্যতম ভালো লাগতে শুরু করল। ঠোঁটকাটা সত্ত্বেও ভালো মানুষের কাতারে রাখা যায়। যতটা খারাপ ভেবেছে ততটা খারাপ নয়। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে ম্যাসেজের উত্তর দিল, ঠিক আছে ধন্যবাদ। আমাকে বুঝার জন্য।
চৈতালি নিচে নেমে আসলো। খাবার টেবিলে বিরিয়ানির প্যাকেট সেই সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট,
-” শুনেছি বয়লার মুরগি খেতে পারেন না সেজন্য মাটন বিরিয়ানি নিয়ে আসলাম। দেখেছেন কত কেয়ার করি তবুও আপনার মন পাচ্ছি না। আমার মত কেয়ারিং সঙ্গী আপনি কখনোই পাবেন না ম্যাম। আমাকে নিয়ে একটু ভেবে দেখতে পারেন। ব’দ’মেজাজি হলেও মানুষ আমি খারাপ নই। বান্ধবীদের কাছে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন, ‘জিতছি’।”
চৈতালি লাজুক হাসল। পুরোটা বিরিয়ানি শেষ করে নিজের রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়াল। আড়চোখে খুঁজলো অক্ষরকে। কিন্তু দেখতে পেলো না।
পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল অক্ষর। চৈতালিকে অস্বস্তিতে ফেলবে না বলেই সামনে আসেনি। তবে লুকিয়ে থেকে থেকেছে প্রেয়সীর ঠোঁটের লাজুক হাসি।
****
আজ আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে ক্ষেপে উঠছে চৈতালি। ছোট থাকতে একবার তাদের পাশের বাড়ির শুভ ভাইয়া বজ্রপাতে মা’রা যায় সেদিনের পর থেকেই তাঁর বজ্রপাতে ভয়। বৃষ্টি হলেই মায়ের আঁচল ধরে বসে থাকতো। যতবার বজ্রপাতের শব্দ কানে আসতো মাকে জড়িয়ে ধরে বলতো, মা বজ্রপাত কী ঘরের ভিতর পরে? মা আমরা যদি এখন বজ্রপাতে মা”রা যাই তাহলে খুব কষ্ট হবে?
মেয়ের ছেলেমানুষী কথাবার্তা শোনে চয়নের মা বলতেন, শোন মা , মৃত্যু যখন যার সামনে হাজির হবে তখন কেউ তাঁকে বাঁচাতে পারবে না। জন্ম হয়েছে সেজন্য একদিন না একদিন মরতে হবে। মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে সবসময় মনে রাখবি মৃত্যু তোর চারদিক ঘুরঘুর করছে। ভালো কাজের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলবি।
আজ মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে চৈতালির। ঝুমুর কিংবা চয়ন থাকলে আজ সারারাত তাঁর সাথে থাকতো। চয়ন ঝুমুরকে বলেছে চৈতালির বজ্রপাতে ভয়। দরজা জানালা বন্ধ করে গায়ে কম্বল জড়িয়ে বিছানায় ঘাপটি মে’রে শুয়ে আছে সে। এরই মাঝে মুঠোফোনের শব্দ কানে বাজতেই দেখল চয়ন ফোন দিয়েছে। ফোন রিসিভ করে কেঁদেকেটে একাকার চৈতি। চয়ন দ্রুত বলতে লাগল, বোন আমার কান্না করিস না। আমি এক্ষুনি চলে আসবো। তিন চার ঘণ্টা কষ্ট কর বোন। ভয় পাবি না বজ্রপাত রুমের ভিতর আসতে পারবে না বোকা মেয়ে।
এই ঝড় বৃষ্টিতে ভাইয়ের আসার কথা শোনে আরো ভয় পেল চৈতি। যদি ভাইয়ের কিছু হয়ে যায়। ভ’য়ার্ত কন্ঠে বলল, তোমার আসতে হবে না ভাইয়া। তুমি কিন্তু এই বৃষ্টিতে ভুলেও রুম থেকে বের হবে না। তাহলে আমি আরো ভয় পাব।
চয়ন কিছু বলল না। সত্যি বলতে আজকের আবহাওয়া প্রচুর খারাপ। হুট করেই বিকাল থেকে পুরো আকাশ কালো রঙে পরিণীত হয়েছে। কথা নেই বার্তা নেই হুট করেই বৃষ্টির আগমন। রুম থেকে বের হওয়া দায়। তবুও ফোনকে অভয় দিয়ে বলল, ফোন কাটবি না। আমি লাইনে থাকবো। আমার সাথে কথা বল দেখবি মনে হবে আমি তোর সাথে আছি।
-” ওকে ভাইয়া।
ঝড়ের গতি বাড়ছে বৈ কমছে না। দূরের দুটো গাছ ভেঙে পড়ে আছে। চৈতালির কানে শব্দ আসতেই চেপে ধরল কান । বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। পুরো রুমে অন্ধকার বাসা তৈরি করেছে। শক্তপোক্ত মেয়েটি হুট করেই ভীতু হয়ে গেল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। এদিকে ফোনের চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হলো ফোন। চৈতালি এখন দিশেহারা। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। হুট করেই দরজার শব্দে সেদিকে দৌড় দিল। ফোনের টর্চ লাইট হাতে দাঁড়িয়ে আছে অক্ষর।
চৈতালির ভীতু মুখশ্রী, এলোমেলো চুল, অশ্রুতে টুইটুম্বর নয়ন, কাঁপা ঠোঁট, এক মুহূর্তের জন্য আ’ঘাত আনলো অক্ষরের হৃদয়ে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল, আপনি গিয়ে বিছানায় বসুন। আমি ওই চেয়ারে বসে আছি। ভয় পাওয়ার কারণ নেই।
চৈতালির মনে হলো সে ভরসার হাত পেয়েছে। ভদ্র মেয়ের মত কম্বল গায়ে জড়িয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে। অক্ষর তখন চেয়ার নিয়ে তারই দিকে মুখ করে বসেছে। ফোনের টর্চ লাইটের আলো অন্যদিকে ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল।
পিনপিন নীরবতা। মেঘের গুড়ুম শব্দ ভেসে উঠছে বারংবার। বিছানার চাদর খামচে ধরে বসেছে চৈতালি। হৃদপিণ্ডের ধুক ধুক শব্দ বেড়ে চলেছে। অক্ষর তখনও মাথা নিচু করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে। সবল মনের মেয়েটিকে দূর্বল দেখতে তাঁর ভালো লাগছে না। মনে পড়ে চার বছর আগের অতীত।
রাত তখন একটা। বৃষ্টিতে জড়োসড়ো হয়ে চৈতালির গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল অক্ষর। চৈতালির মা জরুরি তলেবে ডেকেছিলেন অক্ষরকে। কাজের চাপে সন্ধ্যায় যাত্রা দেওয়ার ফলে রাত হয় গ্রামে পৌঁছাতে। সেদিন ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। শ্রাবণের মেঘ তখন আকাশে উড়ে বেড়ায়। অন্ধকার হতে না হতেই আঁধার ঘনিয়ে বৃষ্টিদের তা’ণ্ডব শুরু হয়। পুরো কাক ভেজা হয়ে চৈতালির বাসায় সামনে দাঁড়ায়। পুরো বাড়িতে দুজন মানুষ । চৈতালি এবং তার মা। ক্লান্ত চেহারায় দরজায় শব্দ করতেই হারিকেন হাতে নিয়ে দরজা খুলে চয়নের মা। অক্ষরকে দেখতে পেয়ে ঠোঁটের কোণায় চমৎকার হাসি ফুটিয়ে বলে, বাবা তুমি এসেছ? তাড়াতাড়ি ঘরে আসো। ভিজে কাকভেজা হয়ে গেছ। জ্বর আসবে।
অক্ষর ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। শুনতে পায় এক রমণীর আ’র্ত’নাদ। কৌতুহল বশত প্রশ্ন করে, চৈতি কাদঁছে কেন?
মুখে হতাশার চাপ স্পষ্ট। করুন সুরে বলে, আমার মেয়েটার মেঘের শব্দে ভয় পায়। গ্রামের এক ছেলে বজ্রপাতে মা’রা যাবার পর থেকেই ওর মনে ভয় প্রবেশ করেছে।
ঠোঁট সরু করে ‘ ওহ ‘ শব্দ উচ্চারণ করে অক্ষর। তারপর বলে, আমাকে জরুরি ডাকার কারণ আন্টি?
-” তুমি জামার কাপড় বদলাও পরে বলছি। চয়নের তোলা নতুন জামা কাপড় রয়েছে বাড়িতে।
ভিজা কাপড় চেঞ্জ করে লুঙ্গি ও শার্ট গায়ে জড়িয়ে চয়নের রুমে বসে অক্ষর। লুঙ্গি জিনিসটা বড্ড অসহ্য। হায় হুতাশ অস্বস্তি মিলিয়ে কাবু অক্ষর। রুম থেকে বের হয়ে দৃষ্টি পড়ল পাশের রুমে ছোট্ট একটি মেয়ে মাকে জড়িয়ে বসে আছে। কান্নার কারণে কাজল লেপ্টে একাকার। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে দ্রুত গতিতে। কাঁপা ঠোঁটে মাকে বলছে, তুমি আমায় একা রেখে যেও না।
অক্ষর খেয়াল করল হারিকের মৃদু আলোতে মেয়েটি সদ্য ফুটন্ত গোলাপের মত লাগছে। লেপটানো কাজলে আঁখি পল্লব নিষ্পাপ শিশুসুলভ। আদলে রয়েছে আদর আদর ভাব। মনকে ধমকে উঠল অক্ষর, মেয়েটির বয়স কম অক্ষর। তোর ছোট ভাইয়ের থেকেও কম। লজ্জা করে না অন্য নজরে দেখতে? মন তখন তাচ্ছিল্য করে বলল, অনেক মেয়েকেই তো দেখেছিস কিন্তু কোনোদিন আলাদা ভাবে অনুভব করেছিস? করিসনি। তাহলে চৈতিকে দেখে আলাদা অনুভূতি আসলো কেন? নিশ্চয় হৃদয়ের আদান-প্রদান হবে।
অক্ষরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চয়নের মা মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। ঘুমিয়ে পড়েছে। আলতোভাবে বিছানায় শুয়ে দিয়ে অক্ষরের সামনে দাঁড়িয়ে কাচুমাচু হয়ে বলল, তোমার খুব কষ্ট হয়েছে বাবা। বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কী করব বলো? অনেকদিন ধরে পাড়ার কিছু বাজে ছেলে মেয়েটাকে বিরক্ত করছে। আমরা মা মেয়ে একা থাকি সেজন্য দূর্বল পেয়ে আমাদের সমাজ আমাদের পিছনে পড়েছে। আজ সকালে বিদ্যুতের তার কেটে দিয়েছে। ঘরের চালে পাথর ছুঁড়ে মা’রছে। এলাকার মেম্বারের ছেলে সেজন্য কিছু বলতে পারছি না। বাবা তুমি যদি একটু সাহায্য করতে।
-” ছেলেটির নাম?
-” ইমন।
সেদিনের পর আজ দ্বিতীয়বার চৈতিকে ছটপট,ভীতু হতে দেখেছে অক্ষর। বলল,
-” আপনার ভয় কমেছে চৈতি?
-” আমায় একা রেখে যাবেন না প্লিজ।
আচম্বিতে ঘর কাঁ’পানো বজ্রপাতে চৈতালি চিৎকার করে উঠল। অক্ষর গিয়ে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটার শরীর বেশ গরম। ভয়ে জ্বর বেঁধেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” কিচ্ছু হবে না চৈতি। আমি আছি তো!
অস্পষ্ট ভাষায় চৈতালি বলল, হুম।
অক্ষরের হৃদযন্ত্রে যেন কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে। এই প্রথম কোনো রমণীকে খুব কাছ থেকে আলিঙ্গন করে রেখেছে। রমণীর ভয়ার্ত হৃদয়ের ধুকধুকানি শব্দ অনুভব করতে পারছে। আচ্ছা যদি এমন হতো মেয়েটা আজ তার হৃদয়ের গভীরতা বুঝতে পারত। যদি বুঝতেই পারতো তাহলে জীবনেও ছেড়ে যাবার নাম মুখে আনতে পারতো না। বৃষ্টির তাণ্ডব শেষ হতে চলল। রাতের ভ’য়ংকর তা’ন্ডপের পর শুরু হবে রঙিন্ময় আলো। শেষ হবে কিছু অনুভূতি, সুন্দর মুহুর্ত। প্রেয়সীকে বুকে ঠাঁই দেওয়ার মত সময় কি আরো আসবে? জানা নেই অক্ষরের। তবুও মনেমনে বলছে, আবারও আসুক বরিষা। কোনো এক সময়ে শুনতে চাই প্রেয়সীর হৃদপিণ্ডের ধুক-ধুক শব্দ। স্পন্দনের হাহাকার বাড়িয়ে দিতে চাই দ্বিগুণ গতিতে। মাঝে মধ্যে ছুঁয়ে দিতে চাই ভয়ার্ত মুখশ্রী।
ঘুমিয়ে পড়েছে চৈতি। আগুন গরম শরীরে ক্লান্ত দেখাচ্ছে ভীষন। জলপট্টি দিয়ে জেগে আছে অক্ষর। হঠাৎ অনৈতিক একটি কাজ করে বসল সে। অনুমতি ছাড়াই, ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটির ললাটে নিজের ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দিলো ।
##চলবে,
®ফারজানা মুমু