#রংধনুতে_প্রেমের_বাড়ি
®ফারজানা মুমু
৫
কমলা রঙের ঔজ্জ্বল্য জ্বলজ্বল করছে অন্তরীক্ষ। সাঁইসাঁই করে মৃদুমন্দা হাওয়া পুলকিত করছে চিত্ত। কাঠের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে অক্ষর ও চৈতালি। ওড়না হাতে বারংবার পেঁচিয়ে ঐকান্তিক ভেবে চলেছে। মুখশ্রীতে চিন্তার চাপ। শান্তা ও কান্তা এখনও পৌঁছায়নি। নির্জন পরিবেশে অক্ষরের সাথে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে তাঁর। ধসে পড়া আরেকটি বেঞ্চের পানে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে বারবার। গলা কেশে চৈতালির ধ্যান ভাঙিয়ে অক্ষর বলে উঠল, চুপচাপ প্রণয় করা যায়?
হতাশ গলায় উত্তর দিল চৈতালি, আমি কিন্তু এখন বেশ সিরিয়াস মুডে আছি। সত্যি করে বলুন তো আপনার উদ্দেশ্য কী?
-” আপনাকে বিয়ে করা।
-” আমাকে চিনেন আপনি? হাতে গোনা কয়েকদিনে আমার প্রেমে পড়ে গেলেন? বিশ্বাস করব আমি ভাবলেন কীভাবে?
-” কে বলেছে আপনার সাথে আমার কিছুদিনের পরিচয়? আমি আপনাকে সাড়ে চার বছর ধরে চিনি জানি।
আশ্চর্য হলো চৈতালি। কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল,বানোয়াট কথা বলবেন না। ভাইয়ার বাসায় এসেছি ছয় মাস হলো। ছয় মাসে আপনাকে আমি কখনও দেখিনি। সাড়ে চার বছর ধরে চিনেন। আমি অবুঝ নই।
“- কে বলল, আপনাকে আমি ঢাকায় দেখেছি? আমি তো আপনাকে আপনার গ্রামে দেখিছি। তখন আপনি দশম শ্রেণীতে পড়েন।
-” আমার বিশ্বাস হয় না।
দুর্বল নয়নে তাকাল অক্ষর। দৃষ্টিতে আফিম মেশানো। চৈতালি কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে সরিয়ে ফেলল দৃষ্টি। অক্ষর তখন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধাল, আপনার মা আমাকে ভালো করেই চিনতেন জানতেন।
মায়ের কথা কানে আসতেই আঁতকে উঠল বুক। কৌতূহল কণ্ঠে বলল, আপনি আমার মাকে চিনতেন?
-” চিনতাম বললে ভুল হবে। ওনাকে আমি ভালো করেই চিনতাম এমনকি অনিও।
-” কীভাবে? মা তো কোনোদিন আপনার কথা আমায় বলেনি। যেখানে ভাইয়া ভাবিকে মা মেনে নেয়নি সেখানে আপনাকে মা চিনত। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
-” আপনার ভাইকে না মানার জন্য একটি কারণ আছে ম্যাম। সেটা এখন বলব না। সময় হলে সবকিছুই জানতে পারবেন। কীভাবে আপনার মায়ের সাথে আমার পরিচয় সবকিছুই সময় হলে জানতে পারবেন। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।
একঝাঁক রহস্য নিয়ে কথাগুলো বলল অক্ষর। চৈতালির মন তখন উৎসুখ করছে সবকিছু জানার। প্রশ্ন করতে যাবে ঠিক সেই সময় শান্তা ও কান্তা এসে হাজির। অক্ষরের পাশে বসল শান্তা। তারপর ভাব নিয়ে প্রশ্ন করল, চাচা আপনার বয়স কত? এক পা ক’বরে আরেক পা টানে। শেষ বয়সে ইভটিজিং করতে ভয় হলো না? জাহান্নামের ভয় নেই মনের ভিতর?
আশ্চমিক অসহ্য কথা বার্তায় বিরক্ত হলো অক্ষর। শান্তা কান্তাকে সে খুব ভালো করেই চিনে। চৈতালির ভালো বান্ধবী তারা। কান্তাকে নিয়ে সমস্যা না থাকলেও তারই কার্বন কপি শান্তাকে নিয়ে বিরাট সমস্যা অক্ষরের। ভাগ্যিস দুনিয়াতে এই একটা পিছই ল্যান্ড করেছে। কান্তা যদি শান্তার মত হতো তাহলে ভেসে যেতে বাংলাদেশ। নিজের রাগকে দমিয়ে উত্তর দিল, কিছুদিন আগে ভার্সিটির স্যারকে প্রপোজ করেছেন। ওনার বয়স কত জানেন? চল্লিশ। দুই বাচ্চার বাবা। ওনাকে চাচা ডাকলেন না কেন? ইদানিং শুনছি স্যারকে দেখলে হার্টের ব্যামো হয়। আমার থেকে তো বয়স তাঁর অনেক বেশী?
শান্তা অক্ষরের কথায় হকচকায়,ভড়কায় , চমকায়। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জান্তা লোককে জ্বা’লাতে এসে নিজেই জ্ব’লে পুড়ে শেষ। তবুও আশা না ছেড়ে কানেকানে বলল, এই বয়সে বিয়ে করলে দুদিন পর পরলোক গমন করবেন তখন আমার বান্ধবীর কী হবে? বেচারি না পাবে স্বামীর সোহাগ না পাবে স্বামী। এত বড় অবিচার তো বেচারীর সাথে করা যায় না।
অক্ষরের ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ধরে চ’ড়িয়ে চ’ড়িয়ে পরলোকে পাঠাতে কিন্তু ধৈর্য ধরার বিশেষ গুণ আছে তাঁর। সেজন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বিড়বিড় করে বলল, আপনি তো বদ মহিলা। বান্ধবীকে বিধবা বানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। বর্তমানে দুনিয়াতে নিঃশ্বাস নিচ্ছি শান্তি হচ্ছে না আপনার? বিধবা বান্ধবী দেখতে চান?
হতবিহ্বল গলায় শান্তা বলল, দুদিন পর ব্যাটারির চার্জ কমে যাবে তবুও আপনার বিয়ের শখ যাচ্ছে না। সঠিক বয়সে বিয়ে করলে দশ বাচ্চার বাপ হতেন।
এবার ধৈর্য্যর শেষ পর্যায় চলে গেছে অক্ষর। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, জয়কে চিনেন? জয় কিন্তু আমার বন্ধু। বয়স আমার সমান। জয়কে ফোন দিয়ে বলতে হবে ব্যাটারির চার্জ কমে যাবার কাহিনী।
এক মুহুর্ত দেরি না করে উঠে দাঁড়াল শান্তা। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, প্লিজ জয়কে কিছু বলবেন না। আমি শান্তা নই কান্তা। বিজয়কে বলবেন চার্জের কাহিনী।
এক দৌড়ে পালাল শান্তা। কান্তা ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝার চেষ্টা করল কী হচ্ছে। কাহিনী সাজালো এক, হলো আরেক। শান্ত হয়ে চশমাটা ঠিক করে অক্ষরের উদ্দেশ্য বলল, আমি কান্তা ভাইয়া। জয় কিংবা বিজয়কে কিছু বলতে হবে না। আমরা বুঝেছি আপনি আটঘাট বেঁধেই মাঠে নেমেছেন। চৈতালি দোস্ত শোন, ছেলেদের বয়স কিছু না। দেখতে কেমন সেটাই আসল। অক্ষর ভাইয়া দেখতে খুবই সুন্দর। তোর সাথে ভালো মানাবে। বিয়ে করে সংসার শুরু করে দে। বেস্ট অফ লাক ডেয়ার।
কান্তা চলে গেল। চৈতালি তখন সশব্দে নিঃশ্বাস ছেড়ে অক্ষরের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখল। লোকটা ঠোঁট চেপে হাসছে। তৈরি করা ফাঁ’দে নিজেই আটকে চটপট করছে বুঝতে সময় লাগল না। হতাশ কণ্ঠে প্রশ্ন করল, জয় বিজয় আপনার লোক তাই তো?
মাথা ঝাঁকাল অক্ষর। শান্তা ও কান্তার সাথে যখন চৈতালির ভালো সখ্যতা গড়ে ওঠে তখনই তার দুজন কাজের মানুষকে পাঠায় যমজ বোনদের সাথে প্রণয় করতে। জয় ও বিজয় যমজ ভাই। যমজ ভাইরা তখন উৎসাহিত হয়ে প্রেমে পড়ে যমজ দুই তরুণীর। শান্তা ও কান্তা ভাবেনি তাঁদের জীবনে যমজ ভাইদের আগমন ঘটবে। কৌতুহল বশত তারাও প্রেমে পড়ে যায়। তখন চৈতালির খোঁজ খবর পাওয়া আরও সহজ হয়ে দাঁড়ায়। ওদের মাধ্যমেই জানতে পারে চৈতালিকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে। চয়নের বন্ধুর ভাই। ব্যাস সে তাঁর মত পরবর্তী প্ল্যান করে কাজে লেগে পরে।
-” চলুন বাদাম খাওয়া যাক। চুপচাপ থাকতে ভালো লাগছে না।
অক্ষরের কথায় সায় দিল চৈতালি। চৈতালির মনে এখন নানান চিন্তা। আকাশসম প্রশ্ন কিলবিল করছে মাথায়। সবকিছুর উত্তর একমাত্র অক্ষর দিতে পারবে। রহস্যর বেড়াজাল ছিন্ন করার জন্য হলেও অক্ষরের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। অক্ষরকে কীভাবে তাঁর মা চিনে? ভাইয়াকে না মানার কারণ। সবকিছু জানতে হবে। তাছাড়া ভাইয়া কেন এই লোকটাকে ভয় পায় তবে হ্যাঁ চৈতালি খেয়াল করেছে চয়ন অক্ষরকে সহ্য করতে পারে না। ভ’য়টা অন্যকিছু। কিন্তু কী?
******
অফিসের এক কোণে মাথায় হাত রেখে বসে আছে চয়ন। চোখে মুখে ক্লান্তি। বাসা থেকে বের হয়ে সোজা গিয়েছিল একজনের খোঁজে কিন্তু আফসোস লোকটি লাপাত্তা। কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরল সে। কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। চয়ন ভাবছে লোকটা আদৌ বেঁ’চে আছে কি’না!
-” স্যার আপনার কোল্ড কফি।
-” টেবিলে রেখে যাও।
কফি দিয়ে লোকটি বের হতেই চয়ন প্রশ্ন করল,স্যার গতকাল কোথাও বেরিয়েছিল?
-” জি স্যার।
-” কোথায়?
-” আমাকে সাথে নিয়ে যায়নি। ওনি একাই চলে গিয়েছিলেন।
হতাশ গলায় বলল চয়ন, তুমি যেতে পার। স্যারকে বলো না আমি ওনার কথা জিজ্ঞাসা করেছি।
-” ওকে স্যার।
চয়নের মাথা ব্যাথা করছে ভীষন। গতকাল রাতে অক্ষরের দেখানো ভিডিওটা হলো ব্যাথার কারণ। একজন ছেলে এ’সি’ড নিয়ে ঘুরছে ঝুমুরের পিছন। ঝুমুরকে দেখা যাচ্ছে চাঁদকে নিয়ে শিশু পার্কে ঘুরাঘুরি করছে। এ’সি’ড ছুঁড়বে ঠিক সেসময় স্বর্ণব এসে লোকটাকে ধরে। এ’সি’ড গিয়ে পরে স্বর্ণবের হাতে। ঝুমুর ও চাঁদ তখন রিক্সা চড়ে বেরিয়ে পরে পার্ক থেকে।এতটুকু ভিডিও দেখেই চয়নের মাথা গরম হয়ে যায়। পার্কের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ধরা পড়ে এই ভিডিও।
-” আমি জানি ছেলেটার নি’খোঁ’জ হবার পিছনে আপনিই রয়েছেন স্যার। হলফ করে বলতে পারি ছেলেটি দুনিয়াতে আর বেঁ’চে নেই।
******
শাওয়ার নিয়ে চুল ছেড়ে বসে আছে চৈতালি। অক্ষরের সাথে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে বাসায় চলে আসে সে কিন্তু অক্ষর আসেনি। জরুরী কাজে কোথাও বেরিয়ে যায় অক্ষর। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত তবুও বাসায় ফিরেনি। চৈতালি চটপট করছে কখন লোকটি বাসায় আসবে সে গিয়ে জিজ্ঞাসা করবে অনেক কথা। রহস্য না জানা অব্দি তার শান্তি হচ্ছে না।
-” তুপ্পি তুপ্পি এটা তোমাল।
চাঁদের হাতে একটি প্যাকেট। চৈতালি প্যাকেট হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, কে দিয়েছে মামুনি?
-” পাপ্পা। আমলা বেলাতে যাব।
-” ঘুরতে যাবে। ভালো কথা কিন্তু কোথায়?
-” নান্নার বালি।
চৈতালির কপালে ভাঁজ পড়ল। হঠাৎ চাঁদের নানার বাড়িতে কেন যাবে?
-” কে বলেছে মামুনি?
-” সাক্ষর মামা এসেছে, নিয়ে যাবে। আমলা তকালে বেল হবো।
ওড়না মাথায় দিয়ে চৈতালি ড্রইং রুমে চলল। সাক্ষর বসে আছে। চৈতালিকে দেখে প্রসারিত হেসে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছো চৈতি?
-” জি ভালো। আপনি?
-” ভালো।
মনেমনে হাসল চৈতি। সাক্ষরের বড় ভাই অক্ষর তাঁকে আপনি বলে সন্মেধন করে আর ছোট ভাই তুমি। তবে দুই ভাইয়ের হাসিটা বেশ চমৎকার। ঠোঁট চেপে ধরে হাসে। কথার মাঝে ভ্রু কুঁচকে ফেলে।
ঝুমুর বলল,
-” চৈতি, বাবার শরীর খুব খারাপ। আমাদের দেখতে চেয়েছে।
-” কিন্তু ভাবি আমার তো ইনকোর্স পরীক্ষা শুরু হবে।
-” চয়নকেও যেতে বলেছে বাবা। তাহলে তুমি বাসায় দাদাভাইয়ের সাথে থাকতে পারবে?
অক্ষরের কথা শোনে বিস্ময় গেল চৈতালি। বাবার অসুখ সবাই যাবে কিন্তু এই লোকটা যাবে না? কিন্তু কেন?
-” আংকেলের শরীর খারাপ অক্ষর ভাইয়া যাবে না? ওনি তো বড় ছেলে।
-” বাবার সাথে দাদাভাইয়ের সম্পর্ক ভালো নয় চৈতি।
-“তাই বলে অসুস্থ্যতার কথা শুনে বাবাকে দেখতে যাবেন না। কীরকম কথা!
সাক্ষর মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ল। আফসোস কণ্ঠে শুধাল, দাদাভাই অন্য রকম চৈতি। ওর মনমত কাজ করে। কারো কথা শুনে না। যখন যা ইচ্ছে তাই করবে। আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। আমরা এখন আর চমকাই না। বরং দাদাভাই আপুর বাসায় থাকবে বলে আমরা আশ্চর্য হয়েছি।
চৈতালি কথা বাড়াল না। অক্ষরের বিষয়ে যাবতীয় কার্যকলাপে সে অবাক হচ্ছে। নিত্য নতুন লোকটির প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে। রহস্য ঘেরা লোকটি। যার প্রতিটি লোমকূপে শুধুই রহস্য আর রহস্য।
##চলবে,