#যোগদান_পত্র
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১
অরুণিমা, তোমাকে আমি প্রথম থেকে সবটা বলি। তুমি শুনো। সেটি ছিল শীতের সন্ধ্যা। বাস কুয়াশার চাদর গায়ে ঢাকা থেকে বগুড়া যাচ্ছিল। আর আমি যাচ্ছিলাম ডিপ্রেশনে। আরো একটা চাকুরি হাতছাড়া করে বাসে উঠলাম। তখন না আমি বাড়ি যেতে চাইতাম না। তবুও বাস বাড়ি যাচ্ছে। বাস কি বুঝে না বাড়ি গেলেই আমাকে দেখতে হবে মায়ের ছেঁড়া শাড়ি, বাবার ক্লান্ত মুখ, ছোট বোনগুলোর অত্যাবশ্যকীয় প্রসাধনীর অভাব আর বর্ষাকালে কান্না করা টিনের চাল? ওসব ভাবতাম। শীত শীত লাগতেই খেয়াল হলো তখন শীত চলছে। শীতকালে ফুটো হওয়া টিনের চাল কান্নাকাটি করে না। স্বস্তি পেলাম। কি কপাল ছিল আমার জানো? সামান্য সস্তিও বেশিক্ষণ জুটল না। কারণ যিনি পাশের সিটে বসেছিলেন তিনি আর কেউ নন আমার চাকুরি মেরে দেয়া ইন্টারভিউয়ার। তিনি আমায় চিনলেন না, কিন্তু আমি চিনলাম। শত শত মানুষের ইন্টারভিউ নেয়া ম্যাডাম ছাপোষা আমায় চিনবেন তা সম্ভব নয়। কি করব ভাবছিলাম। বাস থামিয়ে নেমে পড়ব? নাকি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিব? আরো ভাবলাম, তাঁর গলা টিপে ধরলে কেমন হয়? আমি আমার হাত দুটোর দিকে তাকালাম, উল্টেপাল্টে পরখ করলাম। যথেষ্ট শক্ত, হাতের জোরও কম নয়। তাঁর গলা টিপে বলব, “গলা টিপে ধরলে কেমন লাগে ইংরেজীতে বলুন। আমেরিকান নয় ঝকঝকে মুখ গোল করে অর্ধেক শব্দ খেয়ে ফেলা ব্রিটিশ ইংরেজী দরকার আমার।”
তিনি হাঁসফাঁস করতে করতে জিহ্ব বের করে দিবেন। গলা ব্যথায় আমার হাত থেকে ছাড়া পেতে চাইবেন। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে কুঁইকুঁই করবেন। তবু কোনো কথা বলতে পারবেন না। একটি শব্দও নয়।
অসহনীয় কষ্টে পাগল পাগল হয়ে এসব ভাবলেও শেষ পর্যন্ত হাত গুটিয়ে, সিটে মাথা এলিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তোমাকে আমার তখনকার অবস্থাটা বুঝানো সত্যিই খুব কঠিন। কেউ জানে না, আমি প্রায়ই অসহায়ের মত কাঁদতাম। আমার কান্না বর্ষাকালের টিনের চালের কান্না ছিল না যে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে কাঁদতে হবে। চোখ বন্ধ করে মনে মনে চিৎকার করে কাঁদতাম। যাইহোক, বাসের তালে দুলতে দুলতে ঘুম ঘুম ভাব চলে এলো। তখনই আচমকা ম্যাডাম আমায় ডাকলেন, “এক্সকিউজ মি, আপনার কাছে পাঁচশ টাকার ভাঙতি হবে?”
আমি চোখ বন্ধ রেখেই শক্তভাবে বললাম, “বেকারদের পকেটে এত টাকা থাকে না।”
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, “মনে হচ্ছে আপনাকে কোথাও দেখেছি!”
জবাবে কিছুই বলিনি। অবিলম্বে, তিনি আমায় চিনে ফেললেন। বললেন, “দুঃখিত, এত মানুষের ইন্টারভিউ নেওয়ায় সবার চেহারা মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।”
আমি চোখ খুললাম। আমার চোখজোড়া টকটকে লাল। কঠিন মুখ করে কড়া গলায় বললাম, “আমিও এত এত ইন্টারভিউ দিয়েছি যে সব ইন্টারভিউয়ারদের চেহারা মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
উঠে দাঁড়ালাম, সুপারভাইজার সাহেবকে ডেকে বাস থামালাম এবং দুমদাম করে রাতের অন্ধকারে বাস থেকে নেমে গেলাম। আরেকটু বসলে আমি বোধহয় উনাকে সত্যি সত্যি মেরেই ফেলতাম। এত অসহ্য লাগছিল! বাড়ি তো আর যাওয়া হয়নি। ঢাকায় ফিরে গেলাম। আবারো দিন কাটতে লাগল পত্রিকা, চাকুরির বিজ্ঞপ্তি এবং পিশাচ ইন্টারভিউয়ারদের দুয়ারে দুয়ারে। এর মাঝে আব্বা এলেন গ্রাম থেকে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “বাড়িতে সব ঠিকঠাক?”
আব্বা গম্ভীর হলেন, “তোর নাকি বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল?”
আমি মিথ্যে বললাম, “নাতো।”
আব্বাও আমার মত মিথ্যে বললেন, “রোজ রোজ কান্নাকাটি শুনতে কার ভাল্লাগে? তাই বাধ্য হয়ে আসতে হলো।”
আমি মনে মনে হাসলাম। আম্মা আব্বার সামনে কাঁদেন না। আম্মা কাঁদেন লুকিয়ে লুকিয়ে কলতলায়।
“তোর চাকরি কতদূর?”
“অনেকদূর। কটার গাড়িতে এলেন? ভাত আনি ভাত খান।”
আব্বা চুপ করে রইলেন। আমি সেন্টু গেঞ্জি গায়েই ঘর থেকে বেরুচ্ছি। ঠিক দরজার কাছে চলে এসেছি তখন শুনলাম তিনি আপন মনে বিড়বিড় করছেন, “কিবরিয়ার না কত ভালো সিজিপিএ ছিল? এমন কেন হচ্ছে? আর কতদিন, আল্লাহ?”
মুমূর্ষু মনে আমি গলির সস্তা হোটেলের ভাত, ডাল আর সবজি নিয়ে ফিরে গেলাম। আব্বা চৌকিতে বসে খাচ্ছেন। আমি মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বসে বললাম, “ইন্টারভিউয়ারকে তোষামোদ করতে হয়, সিজির কোনো দোষ নেই।”
আব্বা কাঁচা মরিচ কামড়ে বললেন, “ঠাশ ঠাশ কথা একটু কম বললে কি হয়?”
আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে শব্দ না করে হাসলাম। আব্বা আর কিছু বললেন না। খাওয়া দাওয়া করে মেস থেকে চলে গেলেন। ওহ ভালো কথা মনে পড়ল। তোমাকে বলাই হয়নি তখন আমি বন্ধুর দয়ায় বন্ধুর মেসে থাকতাম। মেস ভাড়া দেয়ার মত পয়সা ছিল না। থাকার অন্য কোনো জায়গাও ছিল না। এমন দিনগুলোতে একদিন মেসে ফিরতেই বন্ধু আমার কাঁথা বালিশ আমার মুখে ছুঁড়ে ফেলল। চেঁচিয়ে বলল, “বের হো।”
আমি ছেঁড়া কাঁথা আর পুরোনো নরম বালিশটা বুকে নিয়ে বললাম, “কি করেছি?”
বন্ধু বিছানার তোশকের নীচ থেকে একখানা খাম বের করে বাতাস করতে করতে বলল, “তুই না বললি তোর একটা ইন্টারভিউও ভালো হয়নি? তোকে ডেকেছে কেন?”
আমার হাত থেকে কাঁথা বালিশ পড়ে গেল। খাম হাতে অবাক হলাম। বন্ধু হাসতে হাসতে পিঠ চাপড়ে বলল, “এবার অন্তত বের হো, শালা। আমার চৌকির জোর কম। দুজনে থাকলে লড়েচড়ে। আরামে ঘুম হয়না।”
আমার বিশ্বাস হয়নি। তখনও পর্যন্ত এটিকে সত্যি মনে করতে না পারা আমি পরদিন সেই অফিসে গেলাম। ভাবছো বিশ্বাস না হলে কেন গেলাম? কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, কতটুকু স্বপ্ন আর কতটুকু বাস্তব তখন অতসব ভাববার মত পরিস্থিতি আমার ছিল না। সাহারায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের মত মরীচিকা পেলেও খুশি হতাম। মরীচিকার পেছনে ছুটে গিয়ে সেখানে পিশাচ ইন্টারভিউয়ারদের জায়গায় দেখা মেলল পিশাচিনী ইন্টারভিউয়ারের। পিঠ সোজা করে শক্ত হয়ে বসলাম, “আসসালামু আলাইকুম, ম্যাডাম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি বোধহয় আপনার ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। চাকুরিটা আপনাকে দিইনি। আপনি কি নিজেকে সেই চাকুরিটা পাবার যোগ্য মনে করেন?”
আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, “জি, ম্যাডাম যোগ্য মনে করি।”
ম্যাডাম ভ্রু উঁচিয়ে মাথা দুলাতে দুলাতে প্রশ্ন করলেন, “তাহলে চাকুরিটা আমি আপনাকে দিইনি কেন? অন্যায় করেছি আপনার সাথে?”
“আপনি কোনো অন্যায় করেননি।”
“আপনি যোগ্য আবার আমিও কোনো অন্যায় করিনি তাহলে হলোটা কি?”
“সেটি আমার নিজের কাছেই অজুহাত মনে হচ্ছে। তাই বলছি না।”
ম্যাডামকে না বললেও কারণটা তোমাকে বলছি, গুনগুন। ইন্টারভিউর দিন আমার ছিল তীব্র জ্বর। জ্বর নিয়ে ইন্টারভিউ খুব একটা ভালো হয়নি। ম্যাডাম হেসে কটাক্ষ করলেন, “অনেক ভালো সিজিপিএ থাকলেই কেউ চাকুরি পাবার যোগ্য হয়ে যায় না।”
আমি নিশ্চুপ। ম্যাডাম’ই আবার বললেন, “যাই হোক, আপনাকে এখানে চাকুরি দেয়ার জন্য ডাকা হয়নি।”
আমি বললাম, “জি, জানি।”
“তাহলে কেন এলেন?”
“আগে বুঝিনি। আপনাকে দেখে বুঝেছি। আমি কি চলে যাব?”
“জি চলে যাবেন। তার আগে আমার কাছে ক্ষমা চাইবেন।”
“ক্ষমা চাইছি। আপনি কোনো অন্যায় করেননি। বরং, বাসে আমি আপনার সাথে বেয়াদবি করেছি।”
ম্যাডাম আমার দিকে একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আমিও তাই মনে করি।”
আমি কার্ডটা হাতে নিলাম। তিনি আরো বললেন, “আমাদের অফিসে আপনাকে নিয়োগ দেয়ার মত একটাও কারণ খুঁজে পাইনি। আপনি বরং এখানে যোগাযোগ করুন।”
আমি কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম। তার আগেই তিনি হাত দিয়ে দরজা দেখালেন।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম, “জি, আসসালামু আলাইকুম।
ম্যাডাম কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে পড়তে বললেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম সেখানে যাব কি যাব না। একবার ভাবছিলাম কেন যাব? আমি একদিন নিজের যোগ্যতাবলেই চাকুরি পাব। আরেকবার ভাবলাম সেখানে গেলেও চাকুরিটা নিজের যোগ্যতাবলেই আমাকে অর্জন করতে হবে। আমি গেলেই তো ওরা আমায় চাকুরি দিয়ে দেবে না। যোগ্য মনে করলে দেবে আর নাহয় দেবে না। সোজা হিসাব। অবশেষে, দ্বিধা নিয়েই ম্যাডামের দেয়া কার্ডকে সম্বল করে ঐ অফিসে হাজির হলাম। সাদা ধবধবে চুল মাথার স্যার চশমার উপর দিয়ে আমাকে দেখে বললেন, “আজ হচ্ছে না। আপনাকে সামনের সপ্তাহে আবার আসতে হবে।”
এসব নতুন কিছু নয় তাই গায়ে লাগানোর প্রয়োজন মনে করিনি। চুপচাপ দিন গুনতে লাগলাম। দিন সপ্তাহে রূপ নিলো। সেখানে আবার গেলাম। তাঁরা আমার ইন্টারভিউ শুরু করল। বলে রাখি, অরুণিমা এটা আমার দেওয়া শেষ ইন্টারভিউ ছিল। এটিই আমার জীবন বদলেছে, আমাকে বদলেছে। এখান থেকেই শিখেছি আঘাত বা অপমানের আরেক নাম শিক্ষা। এজন্যই সবসময় সবাইকে বলি, যে আঘাত করে তাকে ভালবাসো। সে যাই হোক, ইন্টারভিউ রুমে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ল মোটা ফ্রেমের চশমা পরা সেই সাদা ধবধবে চুল মাথার স্যারকে। মিথ্যে বলব না, চশমা ভেদ করে দেখা তার চোখ দুটো আমার আত্মবিশ্বাসে একটু হলেও চিড় ধরিয়েছিল।
যত দূর মনে পড়ে তাঁকে প্রসন্ন করতে সর্বোচ্চ সুন্দর হাসি দিয়েছিলাম। কিন্তু, স্বাভাবিকভাবেই তিনি হাসির প্রত্যুত্তর করেননি। আর আমাকে কোনো প্রশ্নও করেননি। পুরো সময় জুড়ে তিনি বারবার হাত ঘড়ি দেখছিলেন। যেন শুধু শুধু আমার পেছনে তাঁর সময় নষ্ট হচ্ছে।
প্রশ্ন করলেন বাকি দুজন। বাকি দুজনের একজন ছিলেন থমথমে মুখের অথচ, সুদর্শন এক স্যার। অল্পবয়স্ক তবে মুখ জুড়ে ছিল চালাক চতুর একটা ভাব। ভাবছ, তোমাকে এত এভাবে কেন বলছি? বললাম না, সেদিনটি ছিল পরিবর্তনের দিন। তাই হয়তো সব এভাবে মনে রেখেছি। পাশের হাস্যজ্জ্বল এক বয়স্ক ম্যাডাম প্রথমেই জানতে চাইলেন, “এটি আপনার কততম ইন্টারভিউ?”
“গুনে বলতে হবে, ম্যাডাম।”
কমবয়সী স্যারটির চোখে মুখে তখন উপহাস, যেন এমনটিই তিনি আশা করেছিলেন। মুচকি হেসে বলে উঠলেন, “নিজেকে প্রমাণ করতে এত সময় কেন?
আমিও ঝটপট উত্তর দিয়েছিলাম, “প্রমাণের জন্য তো শুধু নিজেকে না বরং খাঁটি জহুরির চোখও দরকার পড়ে।”
উত্তরে ম্যাডামকে প্রসন্ন করতে পেরেছি বলেই মনে হয়েছিল। তিনি হেসে আমার দিকে কলম আর খাতা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “প্রমাণের জন্য নিজেকে আরো একটু প্রকাশ করুন। আপনি যে চাকুরি পাচ্ছেন না আপনার সর্বোপরি অবস্থাকে আপনি কীভাবে প্রকাশ করবেন? ভয় নেই, আমরা খাঁটি জহুরির চোখ নিয়েই বসে আছি।”
আমি খাতা কলম নিয়ে দাগ টেনে বললাম, “ধরুন, আপনার সামনে এই একটা কর্দমাক্ত পথ। পাশেই এই আরেকটি ভালো পথ। কর্দমাক্ত পথটির অপরপাশে গন্তব্যস্থান। একটি কুকুর আর একটি মানুষকে এই একই জায়গা অর্থাৎ কদর্মাক্ত পথটির পাশ থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। বলুন তো কে আগে গন্তব্যস্থানে পৌঁছুবে?”
চশমা নাকের স্যার এ পর্যায়ে তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠেই পড়লেন। নীরবে বুঝিয়ে দিলেন আমি ওয়েস্ট অব টাইম।
কমবয়সী স্যারটি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আপনার কাছে উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছে, প্রশ্ন না।”
আমি সোজা চোখে চোখ রেখে বললাম, “দুঃখিত। আমি প্রশ্ন করছি না, প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছি।”
ম্যাডাম বললেন, “কুকুরটি আগে পৌঁছুবে।”
আমি তখন বললাম, “সম্ভবত, আমি উত্তরটা দিতে পেরেছি।”
অল্পবয়সী স্যারটির কুঞ্চিত ভ্রু দেখে বুঝতে পারলাম আমাকে আরো ব্যাখ্যা করতে হবে। স্যারটি কীভাবে ভ্রু কুঁচকায় জানো, অরুণিমা? আচ্ছা এটা পরে বলছি। বাকিটা শোনো, আমি অধ্যবসায়ী শিক্ষকের মত তাঁদের বোঝালাম, “আমার কাছে আমার লক্ষ্যকে যেকোনো মূল্যে অর্জন করার চেয়ে ভালো এবং সঠিক পথ দিয়ে চলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর ভালো পথ দিয়ে চলতে গেলে সময় বেশি লাগবেই। আমাকে ধৈর্য্য রাখতে হবে। তাছাড়া, আগে পৌঁছানো মানে সবসময়ই ভালো বা সেরা হওয়া নয়। ভালোর জন্য সাধারণত সময় প্রয়োজন, সময়! ঠিক যেমনটি ভালো পথ দিয়ে যেতে ব্যক্তিটির কুকুরটির চেয়ে বেশি সময় প্রয়োজন হবে।”
কমবয়সী স্যারটির চোখে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সাথে সাথেই তিনি সেটি গোপন করলেন। মনে কু ডেকে উঠল, “তবে কি এখানেও আগে থেকেই প্রার্থী ঠিক করা আছে? আবারও শুধু শুধু আসা? মেজাজ বিগড়ে গেল। ধৈর্য্য আর কত ধরা যায় বলো, অরুণিমা? নাটক দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। যতটা উদ্দ্যম আর প্রবল আগ্রহের সাথে প্রথমদিকের প্রশ্নগুলোর মোকাবিলা করেছিলাম শেষে এসে ততটাই দায়সারাভাবে বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলাম। চাকুরী নয় তখন আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ঐ ঘর থেকে দ্রুত বের হতে পারা। একসময় এভাবেই ইন্টারভিউ পর্ব শেষ হলো। আমাকে বলা হলো, “ঠিক আছে আপনি আসতে পারেন।”
আর ইন্টারভিউ নয় এমন মনস্থির করেই সেদিন বের হয়েছিলাম। মন জুড়ে তখন শুধু রাগ আর ক্ষোভ। কিন্তু ভাবিনি পরদিন সব পাল্টে যাবে, সব। পরদিন দেখি মেসে আমার নামে খাকি রঙের খাম এসেছে একটা। সেই আমাকে বাতিল করে দেয়া ম্যাডামের পাঠানো। খামের ভেতরের কাগজে টাইপ করা কালো অক্ষরে লেখা:
জনাব,
গোলাম কিবরিয়া,
আপনার চরিত্রে তোষামোদি ব্যাপারটি নেই সেটি বাসেই টের পেয়েছিলাম। সত্যি বলতে পোড় খাওয়া ব্যর্থ এক যুবকের এমন স্বভাব অবাক করেছিল। চাকুরি পেতে একটু সহানুভূতি পাবার চেষ্টা তো অন্তত করতে পারতেন? করলেন না। বিশ্বাস করুন, গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা আপনার স্বভাব বারবার আমাকে জ্বালাতন করছিল। বারবার মন বলছিল, একে পাশ ছাড়া করিস না। তাই আমার অফিসে আপনাকে নিয়োগ দেয়ার মত একটিও কারণ খুঁজে না পেলেও, আমার জীবনে আপনাকে নিয়োগ দেয়ার মত কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম। এজন্যই আপনাকে আমি আমার বাবা, মা এবং ভাইয়ের সামনে হাজির করাতে বাবার অফিসে পাঠিয়েছি। এটি কোনো চাকুরির ইন্টারভিউ ছিল না। আমি পরিবারকে আপনার ঝলক দেখাতে চেয়েছিলাম। আমার এই অপরাধ ক্ষমা করবেন না? ইন্টারভিউর ফলাফলের কথা বললে বলব
আপনি নির্বাচিত হয়েছেন। আমি ভেবেছিলাম চাকুরিহীন বেকার কোনো যুবককে পছন্দ করার দায়ে পরিবার আমার পছন্দকে অগ্রাহ্য করবে। ভেবেছিলাম, আমাকে আলাদা করে আপনার জন্য সুপারিশ করতে হবে। কিন্তু তা করতে হয়নি বলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
আপনি কি ভাবছেন আমাকে দ্রুত জানাবেন। অফিস আওয়ারে দেখা করতে আসবেন না। আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটে।”
শুভাকাঙ্ক্ষী,
ডালিয়া শফিক।
চলবে…