যে জীবন পুতুলের

0
667

আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স চৌদ্দ বছর। বাংলাদেশ সরকার আইন করে মেয়েদের বিয়ের বয়স আঠারো বছর করলেও সে নিয়ম গ্রামে গঞ্জে তখনো অনেক পরিবারেই অচল। আমার পরিবারের এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে দুটো কারণ ছিল। এক আমার বড় বোন পালিয়ে বিয়ে করেছে এক বেকার যুবককে যাদের সংসারের ভরন পোষণ দিতে আমার বাবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। আর দ্বিতীয়ত বৈধ বিদেশী পাত্র যে কিনা খুব অল্প সময়ের মাঝে তার বৌ কে বিদেশ নিয়ে যেতে পারবে।

বড় বোনের পালিয়ে যাওয়ার পর ঘরে যাবতীয় অনুশাসন নেমে আসে আমার মাথার ওপর। প্রথমেই আমাকে স্কুল থেকে সরিয়ে নেয়া হয় মাদ্রাসায়, ধর্মীয় অনুশাসন আরো ভালোমত বুঝবার তাগিদেই বোধ করি। আপাদমস্তক বোরকায় ঢেকে শুধু চোখ বের করে রাখা আমার জীবনে পৃথিবীটাও ছিল ততটাই ক্ষুদ্র। বিয়ে ঠিক হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই দেখলাম কিভাবে আমার বয়স চৌদ্দ থেকে আঠারো হয়ে গেলো, কিভাবে সবাই আমার কাছে আঠারো বছরের মতো বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যবহার আশা করতে শুরু করলো। ফলাফল যা করি তাই ভুল হয়, যা বলি তাই ভুল বলি। বলা চলে আমি তখন জীবনের এই আকস্মিক পরিবর্তনে পুরোপুরি দিশেহারা। বাবার নেয়া এহেন সিদ্ধান্তে শুধু কান্না ছাড়া আর কিছুই যে আমার করার থাকেনা।

আমার স্বামী আতাহার ইতালী চলে যায় বিয়ের এক মাসের মাথায়। শ্বশুরবাড়ির লোকের সাথে খাপ খাইয়ে চলার কষ্টটুকু আমার পেতে হয়নি সেভাবে আমার বাবার অনুরোধে। মেয়ে কয়েকদিন পর বিদেশ চলে যাবে এই কয়েকটা দিন আমাদের কাছে থাকুক, এই অনুরোধ আমার শ্বশুরবাড়ির লোকে রাখে। ছয় মাসের মাথায় কাগজ হয়ে গেলে আমি বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে একাকী চেপে বসি হাওয়াই জাহাজে। গন্তব্য ইতালী, আমার পুতুল খেলার সংসার ছেড়ে বাস্তবের কাঠিন্যে মোড়া সংসার। জীবন আমার জন্য কি পসরা সাজিয়ে রেখেছে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে সে বোধটুকুর চেয়ে চারদিকের ঝিকমিক পৃথিবীর আনন্দ আয়োজন দেখাতেই বড় ব্যস্ত ছিলাম আমি। এক কিশোরীর বদ্ধ পৃথিবী থেকে মুক্ত পৃথিবীর আলোয় অবগাহনের দিন যেন ছিল সেদিন। মনে ভয় ছিল রাস্তায় কোন বিপদ হলে কি হবে? তবে ঐ যে বললাম চারদিকের অচেনা পৃথিবীর আলো শুষে নেয়ায় ব্যস্ত কিশোরী ভুলে গেছিল সব শংকার কথা।

আমার চৌদ্দ বছরের জীবনে সংসার বলতে আমার মায়ের ঘর দেখা। না অন্য কোন বন্ধুর বিয়ে হয়েছে তখন না আমার সুযোগ মিলেছে অন্যের বাড়ি যেয়ে লম্বা সময় থাকার ব্যাপার। বাড়ি ছাড়ার সময় মা পইপই করে বুঝিয়ে দিয়েছে এখন থেকে আতাহারই আমার সব। ও যা বলবে তা ই যেন শিরোধার্য মেনে চলি। শুনবোনা, পারবোনা এমন বলার মতো বয়স বা মনের জোর কোনটাই যে আমার ছিল না সে বয়সে তাই মায়ের কথাকেই বেদবাক্য মনে করে নিয়েছি। নতুন জীবনের প্রথম এক মাস খুব হাসি আনন্দে কাটলেও এক মাস পরে আতাহার আমাকে নিয়ে যায় এক রেস্টুরেন্টে। এতোদিন বোরকায় মুড়ে থাকা আমার জীবনে সেই প্রথম শার্ট প্যান্ট পরার অভিজ্ঞতা। নিজের শরীর ঢাকতে ব্যস্ত আমি আতাহার আর রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের কোন কথায় মন দিতে পারিনি। অবশ্য সব কথা বোঝার মতো বয়স হলে তো?

‘এরকম বিদেশী কাপড় পরতে চাইনা, রেস্টুরেন্ট বারে কাজ করতে চাইনা’ মিনমিন করে একবার বলেছিলাম আতাহারকে। জবাব এসেছিল, ‘ তা নবাবজাদীকে বসে খাওয়ানোর জন্য আনসি নাকি এই দেশে?’ এই কথার পরেও এক আধবার আপত্তি তুলেছিলাম। মুখের সাথে হাতের ব্যবহারে ধোপে টেকেনি আমার কথা। বুঝে যাই আমার নিয়তি। নিজেকে জীবনের কঠিন স্রোতে মানিয়ে নেয়ার খেলাটা এতো কম বয়সে শুরু করতে হবে সেটাই শুধু মানতে কষ্ট হতো। সপ্তাহে পারলে সাতদিনই কাজে যেতে হতো, ফিরে এসে রান্না, ঘর গোছানো; একেকদিন মনে হতো আজ বোধহয় আর বাঁচবোনা। এতো পরিশ্রমের পরও কোন পারিশ্রমিক আমার হাতে আসতো না। এতো কষ্টের বিনিময়ে আমার আয়ের খুব অল্প অংশ দেশে আমার বাবামা কে পাঠিয়ে সে ভালো মেয়েজামাই সাজতো। আর আমার জন্য বরাদ্দ থাকতো আরো কয়েক ঘন্টার অতিরিক্ত কামলার জীবন। আমার বেতনের টাকা আর তার টাকা যেয়ে জমতো দেশে তার নামে থাকা নিজস্ব একাউন্টে।

বছর ঘুরতে টের পেলাম আমার শরীরের পরিবর্তনগুলো। না পারতে কাজের ঘন্টা কমানোর অনুমতি মিলেছে কিন্তু ছুটি মেলেনি সংসারের চাপ থেকে। মাত্র ষোল বছর বয়সে যখন আমার ছেলে আমার কোল জুড়ে আসে মাতৃত্ব্র মায়ায় সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম গত নয়মাসের। ঠিক দুমাস পরে আমাকে ফিরে যেতে হয় কাজে। দুধের শিশুকে ঘরে রেখে সারাদিন কাজ শেষে যখন ফিরে আসতাম আমার মনে হতো আমি কি জন্য বেঁচে আছি? নিজের বাচ্চাটার সাথে সময় কাটাতে পারিনা, নিজের বুকে দুধ খাওয়াতে পারিনা, পারিনা রাতে বুকে জড়িয়ে ধরে মায়ের ওমটুকু দিতে।

ছেলের এক বছরের মাথায় আতাহার কিভাবে যেন আমার বাবা মাকে বুঝিয়ে ফেলে বাচ্চা এখানে পালা অনেক কষ্টের, আমি সব সামলে বাচ্চার যত্ন নিতে পারিনা; তারা যদি আমার বাচ্চাটাকে পেলে দেয় কিছুদিন। স্কুলে যাবার সময় হলে বাচ্চাকে নিয়ে যাবে। এক প্রকার জোর করেই আতাহার আমার রাতুল কে রেখে আসে বাংলাদেশে। দেশে যাবার আগেই আমাকে শাসিয়ে নিয়েছিল এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে আমাকে তালাক দেবে। আগেই বলেছি আমার বাবা মা আতাহার অন্তঃপ্রাণ। বলতে পারেন, আমি কেন বাবা মাকে কিছু বলিনি? বললে কি হতো? আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতেন? যে বাবা মায়ের চৌদ্দ বছরের মেয়েকে আঠারো বানিয়ে বিয়ে দিতে বুক কাঁপেনি, যারা শুধু মেয়ে জামাই থেকে অর্থ সাহায্য পেয়েই বর্তে গেছেন, আমি আর আতাহারের সংসার করতে চাইনা এ কথায় ওনারা আমার পক্ষে চলে আসতেন?

বুকের আহাজারি মনের গোপন ঘরে লুকিয়ে ছেলেকে বাবা মায়ের কাছে রেখে ফিরে আসি বিদেশে। রোজ রাতে ভেজা বালিশে চোখ বুজে নিজেকে সান্ত্বনা দেই থাক বাবা মায়ের কাছেতো আমার চেয়ে যত্নে থাকবে অন্তত। আরো কাজ করতে হবে, আরো টাকা লাগবে কারণ এখন ছেলের খরচ ও দিতে হয়। তবে ছেলের অনুপস্থিতিতে আমার কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়ে যায়। আমি কাজ চালিয়ে নেয়ার মতো এখানকার ভাষা কাজেই একটু একটু করে শিখে ফেলেছিলেম। আতাহারকে বোঝালাম এ সংক্রান্ত একটু পড়াশোনা আর ভাষাটা আরো একটু ভালো করে শিখে ফেললে আরো ভালো বেতনের কাজ পেতে পারি। কি মনে হতে এবেলা অনুমতি মিলে যায়।

মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় সে তখন যে কোন একটা কাজ করে; হয় পুরোপুরি ভেঙে পরে নয়তো দেয়ালটাকে পিঠে তুলে আবার জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে। আমি দ্বিতীয় পথে পা বাড়ালাম। এদেশে ততদিনে আমার থাকা এবং কাজের কাগজ সব স্থায়ী হয়ে গেছে। ছেলেটা যখন ফোনে মা বলে ডাক দেয় আমার ইচ্ছে করতো সব ছেড়েছুড়ে চলে যাই। এরমধ্যে হুট করেই আতাহারের শরীর খারাপ করে কিন্তু আমি তার তেমন কোন সেবাই করতে পারিনা। কিভাবে করবো, আমার দিনের সময়সীমা তো আর বাড়িয়ে ত্রিশ ঘন্টা করতে পারিনা। রোজদিন বাড়ি ফিরে ওর চিৎকার শুনতে হতো, ‘আমি ওর কথা শুনিনা, ওর যত্ন নেইনা, বড় বাড় বেড়েছে আমার’। দিনদিন আতাহারের দেয়া চাপগুলো আর নিতে পারছিলাম না আমি। একদিন চিৎকার করে এতোদিনের জমিয়ে রাখা সব ক্ষোভেরা বাক্য হয়ে বেরিয়ে আসে আমার মুখ দিয়ে। ফলাফল অসুস্থ শরীরেও বিছানা থেকে উঠে এসে আমার মাথাটা ঠুকে দেয়া হয় দেয়ালে সজোরে। হিসহিস কন্ঠে জানিয়ে দেয়া হয় আর কোনদিন এমন বাড়াবাড়ি করলে তালাক দেয়া হবে নিশ্চিত।

অনেকদিন ধরেই অন্য শহরে একটা কাজের প্রস্তাব পেলেও একাকী এতোদূর যাবো ভেবে কাজটা নেইনি। সেই রাতে মাথায় বরফ ঘসতে ঘসতে সত্যিকারের আঠারো পেরুনো এই আমি সিদ্ধান্ত নেই আর না। শরীর খাটিয়েই যখন বেঁচে থাকতে হয় তখন কেন রোজদিন বাড়তি অত্যাচার মেনে নেবো? ভোরের আলো ফুটতেই নিজের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসি আমার এতোদিনের সংসার ছেড়ে। পাল্টে ফেলি ফোনের সিম। আতাহার পুলিশের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিল আমার সাথে। এ বেলা শক্ত গলায় বলেছিলাম আমি আর যেতে চাইনা তার সংসারে। বিনিময়ে জুটেছে ডিভোর্স, ছেলেকে এক জীবনের তরে হারানো আর বাংলাদেশে আমার নামে হাজারো বদনাম।

আমার ছেলেটা সৎ মায়ের ঘরে ভালো নেই শুনে অনেক বছর পরে ছেলের কাছে ফোন দিয়েছিলাম, ছেলে বলেছে আমার মতো মায়ের তার প্রয়োজন নেই। এ কথার জবাবে কি আর বলা যায়? মেনে নিয়েছি আমার নিয়তিকে। আর ফিরে যাইনি দেশে। শুধু মাসে মাসে পাঠিয়েছি মা বাবার জন্য আগের চেয়েও অনেক বেশী টাকা। তারা অনেকবার বলেছে দেশে ফিরে যেতে। জবাব দিয়েছি, যে জীবন পুতুলের তা কাঁচবন্দী শোকেসেই মানায়, ধুলোমাটির মায়ার পৃথিবী তাদের জন্য নয়।

……………..

কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভেঙে কতক্ষণ সময় লাগলো বুঝতে কোথায় আছি। এখনো কেন যে হঠাৎ করে ঘুম ভাঙলে মনে হয় আমি বাংলাদেশে আছি জানিনা। এতো ভোরে কে এলো আমার বাসায়?

– কাকে চাই বাছা?

এটা কি দিলারা হাসানের বাসা? আমি একটু ওনার সাথে দেখা করতে চাই।

– আমিই দিলারা হাসান।

আমি রাতুল।

কতগুলো বছর পর আমার নাড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা আমার আত্মার একটা অংশ আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো স্হান কাল পাত্র ভুলে আমি কেন যেন সেটাই গুণতে শুরু করলাম। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলে যদি স্বপ্ন ভেঙে যায় তাই শুধু তাকিয়ে থেকেই মনের তৃষ্ণাটুকু মিটিয়ে নিচ্ছিলাম। বড় ইচ্ছে করছিলো ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। কাঁচের পুতুলেরও যে মানুষের জীবন পেতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। সৃষ্টিকর্তা সে সুযোগ কি সত্যিই দিলেন এতোটা বছর পরে?

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে