#যে_আসে_অগোচরে
পর্ব ৬ (শেষপর্ব)
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
তিনদিন নুহাকে বাইরে না দেখতে পেয়ে নিষাদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে অপারগ হয়ে স্বশরীরে চলে এসেছে নুভাদের বাড়িতে। তিনদিন সে হসপিটালে ডিউটিও করেনি। নুভাকে না দেখতে পেয়ে নিষাদ যেনো আর নিজের মধ্যে নেই। খাওয়া, ঘুমও তার বরবাদ হয়ে গিয়েছিলো। ধারণা করেই ছিলো নিশ্চয় কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। নুভার বন্ধু শান্ত ও রুমিকেউ তলব করেছিলো নিষাদ। তবে তাদের কাছ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি সে। তাই অগ্যতা বাড়িতেই চলে এসেছে সে একাই, কাউকে না নিয়েই।
নিষাদকে দেখে মিনারা নুভাকে গা’লিগালাজ করা বন্ধ করে, নিজের কপালের ঘাম মুছে, আগের রাগ সব উঠিয়ে রেখে, শান্ত স্বরে বললো,
” বাবা, এসেছো? এসে ভালোই করেছো, এই মেয়েকে আমি কোনোক্রমেই তোমার হাতে তুলে দিতে পারবো না!”
মিনারার কথা শুনে নিষাদের চোখে মুখে যুক্ত হলো একরাশ সংশয় ও দু:শ্চিন্তা। তবে সে চুপ থেকে মিনারাকে আরো কিছু বলার সুযোগ করে দিলো।
মিনারাও পুনরায় বলতে লাগলো কান্নারত স্বরে,
” বাবা, তুমি একজন উচ্চশিক্ষিত, সুযোগ্য পুত্র, ডাক্তার, তোমাদের পরিবারের সবাই অনেক উচ্চশিক্ষিত ও যোগ্য, সমাযে তোমাদের একটা উল্লেখযোগ্য স্টেটাস আছে। আমি সব জেনে শুনেই আমার এই গুন্ডি, অবাধ্য, নষ্ট ও উগ্র মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে পারিনা, এতে আমার অনেক বড় পাপ যে হবে…”
এবারে মিনারার মুখের কথা নিজের মুখে তুলে নিয়ে নিষাদ বলে উঠলো,
” শোনেন আন্টি, পাপ পূর্ণের জ্ঞান আমার চাইতে হয়তো আপনারি বেশি আছে। তবে আমার মতে, এতে পাপ হতো, যদি আপনি জোর করে তুলে দিতেন তবে, আমি নুহাকে ভালোবাসি আন্টি, আর আমি ওর সম্পর্কে হেন কোনো তথ্য নেই যা জানি না, আর সব জেনে বুঝেই আমি নুহাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছি, সুতরাং আপনি এর মধ্য পাপ, পূর্ণ ইত্যাদি বিষয় টেনে এই বিয়েটাকে থামিয়ে দিবেন না আন্টি, প্লিজ আপনার দোহাই লাগে। ”
এদিকে নিষাদের উক্ত কথাগুলো শুনে আমির আলী প্রায় স্তব্ধ ও বাকরুদ্ধ হয়ে থাকা মিনারার কাঁধ ঝাঁকালো। এতে মিনারাও তার বিমূর্ত মূর্তি হতে ফিরে এসে পুনরায় নিষাদকে শুধালো,
” বাবা, তুমি ভেবে বলছো তো? তুমি পারবে কি আমার নেশাখোর মেয়েকে বিয়ে করতে?”
মিনারার এক প্রশ্নেই নিষাদের বুকের ভেতর ধ্বুকপুক করে উঠলো, তদুপরি সে উত্তর করলো,
” আপনি ভেবে বলছেন তো আঙ্কেল? নুভা ঘুনাক্ষরেও নেশা করে না, আমি নুভাকে প্রতি পদে পদে দেখেছি, বুঝেছি, ওকে বিচার বিশ্লেষণ করেছি, নিশ্চয়ই এ কারো চক্রান্ত ওকে হেনস্তা করার জন্য। এতে আমাদের বিয়েতে কোনো পিছপা হবো না। এ নিয়ে আপনি ভাববেন…”
নিষাদ তার কথা শেষ করতে পারলো না।
দরজায় কলিংবেলের শব্দ ভেসে এলো।
বিমর্ষ মিনারা গেইট খুলতেই একগাদা ইউনিফর্ম ধারী পুলিশ টগবগে বুটের শব্দে এসে ঢুকে গেলো সারা বাড়িতে।
আমির আলীকে উদ্দ্যেশ্য করে একজন বলে উঠলো,
” আপনারা মেয়ে নুভাকে ডাকুন, ওর জরুরি তলব আছে!”
আমির আলীর হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেলো এসব শুনে। জীবনেও সে পুলিশের স্বরণাপন্ন হয়নি। পুলিশকে তার জমের ন্যায় ভয়।
সে আমতা আমতা করতে লাগলো। ভয়ে তার মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করলো।
” একি? শেষ পর্যন্ত তার মেয়েকে পুলিশে ধরে নেবে? আর তার পুলিশের পেছনে পেছনে ধন্না দিতে হবে? সে প্রায়ই বলে থাকে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা ”
তাই নিষাদ আমির আলীর উদ্দ্যেশ্যে ছোঁড়া আদেশের বিপরীতে নিজেই পুলিশ অফিসারকে উদ্দ্যেশ্য করে বলতে লাগলো,
” আপনাদের নিশ্চয়ই কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে অফিসার, নুভা কিছুই করেনি”
অফিসার রুষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
” আপনাকে আমি চিনি, আপনি ডক্টর নিষাদ না? ডাক্তার হয়েও আবার উকালতি কবে শুরু করলেন? শুনুন মিস্টার নিষাদ, আমরা জেনে শুনেই এসেছি, ভুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে যে, ওই মেয়ে এক নেশাজাত দ্রব্য পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িত আছে, আর ওকে এরেস্ট করার অর্ডার আছে উপর হতেই, এই দেখুন সব এভিডেন্স, সো লেট আস ডু আওয়ার ডিউটি”
মিনারা আর ক্ষণকালও বিলম্ব করলো না। নিজের মেয়েকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারলেই যেনো তার স্বস্তি। আর এ জন্যই যেনো সে তার মেয়েকে আটকে রেখেছিলো সযত্নে। সে তাই দরজা খুলে নুভাকে বের করে আনলো ঝটিকা বেগে। কে জানে মিনারার কোনো আক্ষেপ হচ্ছিলো কিনা? তবে আমির আলী নিজের মেয়ের হয়ে আবারো অনুনয় করে বলা শুরু করলো পুলিশের বড়কর্তার কাছে,
” অফিসার বিশ্বাস করুন, আমার মেয়ে বেয়াদব হতে পারে, মা’রামারি করতে পারে, রগচটা হতে পারে, তবে নেশা পাচারকারী ও কস্মিনকালেও না…!”
আমির আলি হাঁটু গেড়ে কান্না শুরু করলো।
নিষাদ অফিসারকে কিছু বুঝাতে উদ্যত হলো। তবে নুভা নিষাদকে ধমকালো,
” আরে আরে! ডাক্টার ডাক্টার! বাদ দাও তো, আমার মায়েই যেখানে কিছু বলছে না, সেইখানে তোমার এত এংজাইটি মানায় না আমার জন্য, তবে জীবনে সবকিছুর এক্সপিরিয়েন্স রাখা ভালো, জীবনে কোনোদিন জেল খাটিনি, তবে মনে হয় এই উছিলায় আমার এবার জেল খাটারও এক্সপেরিয়েন্স টা হয়ে যাবে, হা হা হা! আমি তো মহাখুশি! ”
অফিসার চোখের ঈশারা করতেই সেন্ট্রিরা এসে দ্রুত হাতকড়া পড়িয়ে দিলো নুভার হাতে।
যেতে যেতে সামান্য পিছু ফিরে মা বাবাকে উদ্দ্যেশ্য করে হাসতে হাসতে সে বললো,
” আব্বা, আম্মা, তোমরা তো জানোই আমি কোনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারি না, সুতরাং এইটাও জেনে রাখো আমি কয়েকদিনের মধ্যেই আবার ফেরত চলে আসবো, আমি জেলখানার ব্যাপারে খুউব এক্সাইটেড। হুররে! আমি জেলখানায় যাচ্ছি!
নুভার হাসি দেখে নিষাদের বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠলো। তার মনে হলো,
এ মেয়ে কি বদ্ধ উন্মাদ নাকি? এর নূন্যতম ধারণাও নেই, জেলে গেলে এর কি হাল হবে? আর মান-সম্মানের কি বারোটাই না বাজবে এর?
মিনারা ভৎসনা করে বলে উঠলো,
” নে গিয়া তোর এক্সপেরিয়েন্স কর গিয়া, আর ম’র গিয়া গরদে, আমি যদি মানুষের জন্মা হয়ে থাকি, তাইলে তোরে কোনোদিন বাইরে বের হইতে দিবো না, তোর বাপেরেও দিমু না বাইর করতে!”
এতসব গরলবাক্য শুনেও নুভা দুষ্টের হাসি হাসতে হাসতে পুলিশের সাথে চলে গেলো হাতকড়া পড়ে।
নুভা কে নিয়ে চলে গেলে মিনারা বুকফাটা আর্তনাদে কাঁদতে লাগলো।
.
.
গোটা শহরে মুহূর্তেই রটে গেলো, নুভার এরেস্ট হওয়ার খবর। বিশেষ করে নিষাদের মায়ের কানে খবরটা চলে গেলো টর্নেডোর বেগে।
এলাকার মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো।
তবে এতদিন যারা নুভার দ্বারা উপক্রিত হতো তারাও বেশি ক্ষমতাধর ছিলো না বলে আফসোস, অনুতাপ করেই ক্ষান্ত হলো।
যেখাবে তার নিজের মায়ের মধ্যেই কোনো হেলদোল নেই, সেখানে অন্য লোকেদের কি যায় আসে?
নিষাদ দ্রুত যেখানে যেখানে পারে যোগাযোগ করতে লাগলো। এক ল’ইয়ার এর সাথেও তার পাকা কথা হলো। যে নুভার জন্য লড়তে রাজী হয়েছে।
এক সপ্তাহ পর।
গোটা এলাকা হইহই রইরই করছে নিষাদ নুভাকে ছাড়ানোর জন্য উকিল নিয়োগ দিয়েছে এই খবরে। গোটা শহরের বার্নিং ইস্যুতে পরিনত হয়েছে এটা।
এলাকার মুরুব্বিরা বলাবলি করছে,
” মেয়েটা ভালো না, এক্কেবারে খারাপ। খারাপ কাজের লিস্টে হেন কোনো কাজ নেই সেই মেয়ে করে নাই। তবে ছেলেটা বোকা। তুই ডাক্তার ছেলে! কত ভালো মেয়ে পাবি, আর এইরকম একটা মেয়েরে তোর বিয়ে করতে হবে? তাও বিয়ে করার জন্য দিওয়ানা হয়ে যাবি? ছি:ছি:”
সায়রা নিজের ছেলের এসব খবরে জ্ঞাত হয়ে বেশ উদ্বীগ্ন হয়ে গেলেন।
অসুস্থ্য হয়ে হসপিটালের বেডে তার ঠাঁই হলো।
সে ম’রবে তাও ছেলেকে নুভার সাথে বিয়ে দিবে না।
নুভা সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ছাড়া পেলো। ইভটিজ করা ছেলেদের উচিত শিক্ষা দেওয়ায় তারা যড়যন্ত্র করে নুভার বাইকে নেশাদ্রব্য দিয়ে রেখেছিলো, এমনই প্রমাণ করলো নিষাদের নিয়োগ করা উকিল। কিন্তু সায়রা এবার নিজের ছেলেকে এ বিয়ের ব্যাপারে মানা করে দিলো।
যে সায়রা কয়েকদিন আগেও ছেলের ইচ্ছাকেই প্রাধাণ্য দিতো এখন সে যেনো এই বিয়ের ভাঙ্গার প্রধান উদ্যোক্তা। সাথে মিনারাও আছে। কেউ ই আর চাচ্ছে না, নুভার সাথে নিষাদের মিলন হোক।
এমন সময় নুভাও লাপাত্তা। নিষাদের মন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। যে নিষাদ এত অপমান, অপবাদ সহ্য করেও নুভাকে জেল থেকে বাইরে এনেছে সে নুভাই এত অকৃজ্ঞের ন্যায় আচরন?
মনমরা নিষাদ সবকিছু থেকেই অব্যাহতি নিয়েও আবার বিধবা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে সংবরন করলো।
মিনারা মেয়ের অজ্ঞাতবাসে যাওয়াতে দারুন মর্মাহত হলেও, মনে মনে তার বিশ্বাস ছিলো নুভা যেখানেই যাক আর যেখানেই থাকুক না কেনো, নিজেকে সে ভালো রাখবেই।
সত্যিই তাই ই হলো।
নিষাদের কাছে একদিন শান্ত ও রুমি দৌড়ে এলো।
” দুলাভাই, দুলাভাই, খবর আছে, খবর আছে ” বলে তারা নিজেদের মোবাইলের স্ক্রিন নিষাদের সন্মুখে তুলে ধরলো। ”
নিষাদের চোখে ভেলকি লাগলো যেনো।
অবাক করা বিষয়! নুভার গায়ে দেশের লাল সবুজের জার্সি!
জাতীয় নারী ক্রিকেট টিমের সদস্য সে এখন। প্রথম দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে যাচ্ছে সে।
তার হাতে মাইক, কিছু বলার জন্য সঞ্চালক তার হাতে তুলে দিয়েছে।
কাঁপা কাঁপা স্বরে মাইক হাতে স্টেজে উঠে নুভা ক্যামেরার দিকে চেয়ে বলে উঠলো,
” থ্যাক্স ডাক্টার নিষাদ! তুমি আমার অনুপ্রেরণা, চেয়ে দেখো, শুণ্য হাতে বাড়ি ছাড়া আমি আজ আন্তর্জাতিক ভাবে খেলতে যাচ্ছি, সেদিন ম্যাচ ফিক্স করে আমাকে জিতিয়ে তুমি আমার মুখের হাসি দেখতে চেয়েছিলে। সেদিন মেকি হাসি দেখেছিলে, আজ দেখো আমার মুখে আসল হাসি, আর চোখে আনন্দের অশ্রু। এই অশ্রুই কি বলে না, যে এই নুভা তোমাকে ভালোবাসে? একদিন না বলেই চলে গিয়েছিলাম, আর আজ দেখো কি সারপ্রাইজ দিলাম। আজ সারা দেশের সামনেই আমি তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি, আমিও তোমাকে ভালোবাসি! ”
নিষাদ আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো।
নুভার এত বড় কৃতিত্বের খবর অতিদ্রুত শহরে রটে গেলো। কয়েক বছর আগেও যারা নুভার বদনাম করতো, আজ তারা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যাচ্ছে। মাইকে তার নাম ঘোষিত হচ্ছে।
এলাকার টক অব দ্যা টাইম এখন নুভা।
মিনারা ও আমির আলীর মুখ গর্বে উজ্জ্বল।
কিছুদিন বাদে নুভা ম্যাচজয়ী হয়ে দেশে ফিরলো।
বিজয়ী নুভাকে বরণ করে নিলো গোটা শহর। সাথে নিষাদের পরিবারও।
বিশাল ধূমধাম সহযোগে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হলো।
(সমাপ্ত)