#যে_আসে_অগোচরে
পর্ব ৫
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
শহরের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে এক নদী। দু তীর ঘেঁষে বনানীর ছায়ায় দুকূল যেমন ছায়াযুক্ত ও ঠান্ডা থাকে নদীর পানিও থাকে তেমনি থাকে শীতল। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে এ নদীর পানিই এলাকার দামাল ছেলেদের স্বস্তির একমাত্র উৎস। স্কুল,কলেজ থেকে ফিরেই দলেবলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীর ঠান্ডা পানিতে। ডুবসাঁতার, চিৎসাঁতার, চিলসাঁতার, উল্টাসাঁতার, ব্যাঙ্গসাঁতারে মেতে উঠে তারা। মেয়েরাও কম যায় না। স্কুল, কলেজগামী মেয়েদের কাছেও ইতিমধ্যেই এ নদী হয়ে উঠেছে ওয়াটার পার্ক। প্রকৃতির তপ্ততার সাথে পাল্লা দিয়ে তারা মেতে উঠে নিজেদের শীতল করার কাজে।
আর নুভা হলো এ দলের ছেলেমেয়েদের লিডার।
সবার আগে সেই ঝাঁপ দিয়ে সূচনা করে এই ঝাঁপাঝাঁপি পর্ব। বেশি গরমের দিনে একেবারে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত চলে তাদের এ ঝাঁপাঝাঁপি। আগে মেয়েরা এই ঝাঁপাঝাঁপিতে অংশগ্রহন করতে ভয় পেতো। কিন্তু নুভা যতদিন যাবৎ এলাকার সব ইভটিজারদের ঘুম হারাম করেছে, ততদিন ধরে এ এলাকার মেয়েরাও নির্বিঘ্নে এই জলে ঝাঁপাঝাঁপি করে জলকেলি করার সুযোগ পায়।
তারা একে অপরের গায়ে পানি ছিটায়, আনন্দ করে, এক মনোরম পরিবেশে। মাঝে মাঝে ছোটোদের সাথে বয়োবৃদ্ধরাও যোগ দেয়।
তবে কতিপয় সংশয়বাদী নারী পুরুষ, সমালোচনা না করলে যাদের ঘুম হয়না বা পেটের ভাত হজম হয় না, তারা একথা, ওকথা, কূকথা বলতেই থাকে।
সেদিনও সন্ধ্যার ঠিক আগে নুভা যখন পানি থেকে উঠে এলো, সদলবলে, তখন একদল নারী এটা ওটা বলাবলি করছিলো। নুভার কানে ভেসে এলো কেউ বলছে,
” ছি:ছি: এই মাইয়ার শরম ভরম কিছুই নাই। ছেলেদের পোশাক পইরা কেমন করে এই মেয়ে ছেলেগো সঙ্গে পানিতে ভিজে, এর তো বিয়া হইবোই না, এই মেয়ে এলাকার অন্য ভালো মাইয়াগোও বিয়া হবার দিবো না!”
নুভা এর আগেও এ জাতীয় কথাবার্তার স্বীকার হয়েছিলো। সে বেশির ভাগ সময়ই এসবের প্রত্তুত্তর করে না। তবে আজ তার অনেক বেশি রাগ হলো।
সে সহাস্যে কঠিন স্বরে বলে দিলো,
” আপনাদের এমন কুকথা অনেক শুনছি, তবে আমার বিয়ে হবে না এটা আপনি কিকরে জানেন? আপনি কি ভবিষ্যত বলতে জানেন? তাইলে কইরে শখিগো দল সবাই আয় দলবলে, এই চাচী তোদের সবার ভাগ্য বলে দেবে!”
এই কথা বলে সে তার গ্রুপের মেয়েদেরকে উছলিয়ে দিলো সেই চাচীর কাছে নিজেদের হাত দেখানোর জন্য। সেই চাচীস্বরুপ নারী এবার বেশ ক্ষেপে গেলো, সে আবার চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” এই মেয়ে, মুরুব্বীদের সাথে বেয়াদবী মার্কা কথা কউ কেন? নিজের দিকে তাকায় দেখো,পড়ছো তো পোলাগো পোশাক, আর চলোও স’ন্ত্রাসীদের মতো? এভাবে চললে কোনো পোলার ঘরেরই বউ হবার পারবা না আর, সারা জীবন আবিয়াত্তা থাকতে হবো।”
ঐ নারী এই কথা বলার সাথে সাথেই কোথা হতে যেনো ঝড়ের বেগে উদয় ঘটলো নিষাদের। সে সাইক্লোনের বেগে নুভার এক হাত ধরে বললো,
” ঐ চাচী কথাবার্তা একটু সাবধানে বলবেন, এই মেয়ে আমার হবু বঁধু, আর আমি হলাম ঐ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্টার নিষাদ, আর আগামী মাসেই এই মেয়ে আমার ঘরের ঘরনী হবে, সুতরাং বুঝে শুনে কথা বলুন।”
নিষাদের কথা শুনে সেই মহিলা সব আরো সব মহিলাদের মধ্যেই চঞ্চলতা শুরু হলো, আরে! সত্যিই এই মেয়ের ঐ ডাক্টারের সাথে বিয়ে হবে? অবিশ্বাস্য! এরকম গুন্ডি একটা মেয়ে এত ভালো বর পেলে ভালোই তো! মেয়েটার কপাল ভালো।
নিষাদ শুনে বলে উঠলো,
” না না চাচী, নুভার নয়, আমারই কপাল ভাল, যে নুভার মতো এক মেয়ে পেয়েছি। ”
নিষাদের একথা শুনে নদীতে ভিজতে আসা অন্য মেয়েরাও খুশিতে হর্ষ ধবনি দিয়ে উঠলো।
তারা জয় ধবনি করে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” দুলাভাই, দুলাভাই, দুলাভাই জিন্দাবাদ, দুলাভাই জিন্দাবাদ!”
তবে নুভার মুখটা মলিন হলো, নিষাদের চোখ সেটা এড়ালো না। নিজের অজান্তেই নিষাদের মাথায় প্রশ্ন এলো, ” তাহলে কি নুভা আমাকে এখনো মেনে নেয়নি?”
তবে সে প্রশ্নের উত্তর এলো না। নুভা নিষাদের হাতের মুষ্টির বন্ধনী হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যত্র স্থান ত্যাগ করলো দৌড়ে । নিষাদ এর মানে খুঁজে পেলো না। আরে! নুভা কি লজ্জা পেলো? নাকি বিরক্ত হলো। হয়তো লজ্জাই! বিরক্ত হবে কেনো? নিষাদ লজ্জা ভেবেই নিজের মনকে সুখ দিলো।
“আরে! আমার লজ্জাবতী বধূ!”
রাতে নিষাদ আর ঘুমাতে পারলো না, উত্তেজনায়। নুভার হাত ধরার উত্তেজনায়! ঠিক সেদিন রাতের মতো যেদিন সে প্রথমবারের মতো নুভাকে দেখেছিলো; কোলে তুলে নিয়েছিলো, নিজ হাতে পায়ের লোহা খুলে সেলাই করে, পা টা জড়িয়ে ধরেছিলো।
নুভা মা’রামারি কা’টাকা’টি করলেও, তার হাতের স্পর্শ এত মোলায়েম হবে তা ভুলেও ভাবতে পারেনি নিষাদ। আর হাত ধরাকে নুভা মেনে নিয়েছে, নইলো তো আরেকটা চড় পড়তো তার গালে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ই নেই। বরং নুভা লজ্জা পেয়ে দৌড়েছে। অর্থাৎ সে নিষাদের হাত ধরা ব্যাপারটায় মোটেও মনোক্ষুণ্ণ হয়নি।
নিষাদের মন খুব করে চাইছিলো নুভার সাথে সামান্য কথা বলতে। কিন্তু কোনোক্রমেই মেয়েটার কন্টাক্ট নাম্বার জোগাড় করা যায় নি। এর কারনো অবশ্য আছে। নুভা ফোন তেমন ব্যবহার করে না। সে যেহেতু বেশিরভাগ সময় ছোটো ছেলেদের সাথেই মেশে সেহেতু সে তার বন্ধুদের দলের মতোই ফোন ছাড়াই চলে। তারা চলে এনালগ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ একে অপরকে নির্দিষ্ট টাইম দিয়ে দেয়, তারা সবাই সেই টাইম মোতাবেকই দেখা স্বাক্ষাত সারে।
সকাল সকাল ক্লিনিকে গিয়েও সে নুভার স্মৃতির সাগরেই ডুবে থাকে। ক্লিনিক থেকে এসেও আবার সেই একই দশা। দূর থেকে সে প্রতিদিনই নুভাকে দেখে, অনুসরন করে, আবার কখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাফ বুনো সৌন্দর্য দেখে, শুধু দেখে। কখনো ফুটবল খেলারত নুভা, আবার কখনোবা ক্রিকেট, কখনো পাড়ার মোডে ক্যারাম, লুডু আবার কখনো সে নদীতে সাঁতরাচ্ছে, আবার কখনো বাইকে দৌড়াচ্ছে। কখনো মারামারি করা অবস্থায়, আবার কখনো কাউকে গা’লিগালাজ। নুভা জানে কিনা তাও নিষাদ জানে না। নিষাদ মনে মনে ভাবে, মেয়েটাকে কয়েকদিন সময় দেওয়া উচিত। এতে সেও তার মনটাকেউ বুঝে নিক।
.
.
নিষাদের মা সায়রা বেগম একজন বিধবা মহিলা। নিষাদ যখন কেবল ক্লাশ এইটে পড়ে তখনই সে তার বাবাকে হারিয়েছে। তখন তার বড় ভাই নোবেল অবশ্য ইন্টার পাশ করেছে। আর ছোটো বোনটাও ক্লাশ ফাইভে পড়তো। সায়রা বেগম একাই কঠোর পরিশ্রম করে ছেলে মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করেছেন। বড় ছেলে নোবেল বড় ইঞ্জিনিয়ার, স্ত্রী, পুত্র সহ সে জার্মানিতে থাকে। ছোটো ছেলে নিষাদ এম বি বি এস ডাক্টার, আর ছোটো মেয়ে নির্না; সে ও একজন বিসিএস ক্যাডার। নির্নার বিয়েও হয়েছে আর এক বিসিএস ক্যাডারধারী অফিসারের সাথে। সুতরাং একমাত্র নিষাদের বিয়ে করাতে পারলেই তার জীবনের ষোলোকলা পূর্ণ হবে। সাথে নিজের ছোটোভাই আব্দুল হকের বিয়েও দায়ও তার ঘাড়েই পড়েছে। নিষাদের বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইরাই সায়রা বেগমের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। তার তিন ভাই সায়রা বেগমের তিন সন্তানের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়। তাই ছোটো ভাই আবুল হকের দায়িত্ব তার সন্তানেরাই তুলে নিয়েছে। বড় ছেলে নোবেলের বয়সী আবুল হক এখনো ব্যাচেলর। ভালো মেয়ে পেলে হকের বিয়ে দিতে তার কোনো আপত্তি নাই। কারন আব্দুল হক এখন নিজের ব্যাবসায় মনোযোগী হয়েছে উপার্জনও ভালোই করে।
আজ আব্দুল হক নিজের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাবে। সায়রা বেগম কোনোদিন পাত্রী দেখার আসরে যান না। কারন তিনি বিশ্বাস করেন, অন্য মানুষের নয়, বরং যে বিয়ে করবে পাত্রী তার মনমতো হওয়া উচিত। সেজন্যই যে বিয়ে করবে তাকেই পাত্রী দেখতে যাওয়া উচিত।
মহল্লার অন্য মহিলারা অবশ্য সায়রা বেগমকে তোড়জোর করেছে যেনো নিষাদের পছন্দের মেয়েটাকে একবার হলেও দেখে আসে। কারন শহরে এই মেয়ের রিপোর্ট ভালো না। সারাদিন মা’রপিট করে বেড়ায় গুন্ডি এই মেয়ে! তবে সায়রা বানু মানুষের কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কাটকাট স্বরে বলেছে,
” যে সারাজীবন কাটাবে ঐ মেয়ের সাথে, তার পছন্দ হলে আপনাদের সমস্যা কোথায়?”
তাই সে নিষাদকেউ নিজেই নিজের পাত্রী নিজে দেখার জন্য পাঠিয়েছিলো। কিন্তু আব্দুল হক ও অয়ন যেনো নিষাদের সাথে তার ছায়ার মতো সাথী। তাই তাদেরকেউ সাথে পাঠিয়েছিলো।
কিন্তু তার ডাক্তার ছেলে যে ঐ গুন্ডি মেয়ের প্রেমে এভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে তা সে চিন্তাও করতে পারে নি।
.
.
মিনারা বেগম নুভাকে জোর আটকানো আটকিয়েছে, তিন দিন যাবৎ। সেদিন সন্ধ্যায় বাইরে বের হতে ধরেছিলো সে, মিনারা বহুবার নিষেধ করে, বের হওয়ার জন্য! কিন্তু নুভা সেই নিষেধ মানতে নারাজ। সে তার সিদ্ধান্তে অটল, নিজের মনের মতো চলতে সে বে পরোয়া। আর মিনারা বহু সহ্য করেছে, আর সে এসব সহ্য করবে না বলে দাঁত খিঁচে রয়েছে। তাই নুভাকে ভেতরে আটকে সেই রুম বাইরে থেকে লক করে দিয়েছে। সে যে করেই হোক নুভাকে আর বাইরে যেতে দেবে না। আশপাশের মানুষজন খুব খারাপ এক অপবাদ ছড়িয়েছে তার মেয়ের নামে, যা সে জীবনেও কল্পনা করে নি। সেটা হলো, ” নুভা তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে নাকি গাঁজা, ফেন্সিডিল ইত্যাদি খায়!”
এতদিন- মারপিট করে, রাত-বিরেতে ঘুরে বেড়ায়, ছেলেদের সাথে ঘোরাঘুরি ও খেলাধূলা করে এসব খবর শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা। আর এখন মেয়ে নেশা করে, এ খবর শুনে তো মিনারার হার্ট এটাক করার উপক্রম। মেয়েকে আর কি করবে সে, পারলে সে নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ে। মিনারা যেনো উন্মাদের ন্যায় কাঁদছে। তাকে বারবার বোঝানোর চেষ্ঠা করছে স্বামী আমীর আলী ও ছোটো মেয়ে তূর্ণা। ওদিক হতে নুভাও চিল্লাচিল্লি করে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবী করছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না।
মিনারা কারো বুঝ মানছে না। মেয়ে মরে গেলে যাক, সে এই মেয়েকে বাড়ি হতে এক পা ও বাইরে বের হতে দেবে না, এতে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এমন সময় সে বাড়িতে আগমন ঘটলো নিষাদের। নিষাদ সাথে তার বন্ধু অয়নকেউ এনেছে।
আসলে তিনদিন নুহাকে বাইরে না দেখতে পেয়ে নিষাদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়ে স্বশরীরে চলে এসেছে নুভাদের বাড়িতে। তিনদিন সে হসপিটালে ডিউটিও করেনি। নুভাকে না দেখতে পেয়ে নিষাদ যেনো আর নিজের মধ্যে নেই। খাওয়া, ঘুমও তার বরবাদ হয়ে গিয়েছিলো। ধারণা করেই ছিলো নিশ্চয় কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। নুভার বন্ধু শান্ত ও রুমিকেউ তলব করেছিলো নিষাদ। তবে তাদের কাছ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি সে। তাই অগ্যতা বাড়িতেই চলে এসেছে।
নিষাদকে দেখে মিনারা নুভাকে গালিগালাজ করা বন্ধ করে, নিজের কপালের ঘাম মুছে, শান্ত স্বরে বললো,
” বাবা, এসেছো? এসে ভালোই করেছো, এই মেয়েকে আমি কোনোক্রমেই তোমার হাতে তুলে দিতে পারবো না!”
( চলবে)