#যে_আসে_অগোচরে
পর্ব ৪
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
“বন্ধু ও যখন রেগে থাকে না! আমার মনে হয় ওর দিকে শুধু চেয়েই থাকি রে! চোখ দুটিতে উছলে পড়ে ওর ভেতরের তেজ, ঠোঁট দুটি গোলাপি লাল বর্ণ ধারণ করে, গাল দ্বয় গোলাপী হয়ে যায়! এত সুন্দর লাগে ওরে!আমি এক্সট্রিম ভাবে ওর প্রেমে পড়েছি রে! স্পেশালি ওর রাগান্বিত চেহারার। ইটস কোয়াইট ইমপসেবল টু কন্ট্রোল মাইসেল্ফ!”
নিষাদ তার বন্ধু অয়নকে তার আবেগের সর্বচ্চো শৃঙ্গে থাকা এসব কথা বলছিলো নিষাদের বেডরুমে শুয়ে শুয়ে। তার হাতে নুভার একটা আপাদমস্তক ছবি। শাড়ী পরিহিত। চেহারা দেখে বুঝাই যাচ্ছে, এ শাড়ী পড়ে সে মোটেই কমফোর্ট জোনে নেই। মুখ বিষ করে রেখেছে। নিষাদ ও অয়ন দুজনেই সেই বাল্যকালের বন্ধু। হেন কোনো আবেগ নাই যে তারা একে অপরকে শেয়ার করে নি। অয়ন প্রতি মাসেই একবার করে প্রেমে পড়লেও, নিষাদ যে কোনোদিন প্রেমে পড়বে তা সে কোনোদিন ভাবে নি। নিষাদ ছিলো ছোটোকাল হতেই ছুঁকছুঁকে স্বভাবের। এটা খাবো না, এটা পড়বো না, এটা নেবো না, ওটা কিনবো না, এরকম নাক শিঁটকানো ছিলো নিষাদের জন্মগত অভ্যাস। আর সেই নিষাদই আজ প্রেমে পড়লো একটা রাগী মেয়ের?
অয়ন নিষাদের পিঠে সজোরে একটা চাপড় বসালো।
” কি বলিস তুই বন্ধু! মানুষের মুখে স্লিপিং বিউটি, লাফিং বিউটি শুনেছি, তবে তোর মুখে এংগ্রি বিউটি কথাটা শুনলাম, এই প্রথম! রাগ করলে তারে সুন্দর লাগে! অদ্ভুত তো! ”
নিষাদ আগের মতোই কথাগুলোকে আরেকটু ঝাঁজ মিশিয়ে দিয়ে বললো,
” সেই জন্যই ওরে আমি বারবার রাগিয়ে দেই, ওর সৌন্দর্য্য দেখার লোভে! আর যাদের রাগ বেশি তাদের মনটা অনেক নরম হয় আমি জানি! ”
অয়ন একথা শুনে প্রথমে তার মুখ ক্যাবলাকান্তের মতো করলো অত:পর সজোরে হেসে বললো,
” তাই বলে ওর সৌন্দর্য দেখার লোভে বারবার ওকে রাগালে, ওকে আর তোর বিয়ে করা লাগবে না, ও অন্য কারো বগলদাবা হয়ে ভাগবে তোর জীবন থেকে, বুঝলি! আর ঐ মেয়ে যার তার লগে মারামারি করে, যারে তারে গালিগালাজ করে! আর রাত বিরেতেও বাইরে থাকে। ”
নিষাদ গাল ফুলিয়ে আহলাদির স্বরে বললো,
” আচ্ছা, বুঝলাম! ওর খারাবি গাইতে হবে না আমার সামনে। আমার চোখ এখন ওর প্রেমে অন্ধ, আমাকে ওর নামে উল্টাপাল্টা কিছু বলিস না, আবার তোরই নাক ফাটিয়ে দেবো এক ঘুঁষিতে। বুঝলি? তবে বন্ধু, আমার এখনি ওকে দেখতে প্রচন্ড মন চাইছে!”
অয়ন বিস্ময়ের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে বললো,
” এক্ষুণি? এত রাতে? ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা। বুঝিস?”
নিষাদ বন্ধুকে জেঁকে ধরে বললো,
” হ্যাঁ, এত রাতেই, তুই মাকে বুঝাবি, তোর বাসায় আমার দাওয়াত, তাই আমি বের হবো, কেমন?”
অয়ন জোরপূর্বক মাথা নেড়ে বললো,
” আজ দুপুরেই না ওর লগে দেখা করে এলি,খেলার মাঠে? এখনি আবার দেখা লাগবে?”
নিষাদ পূর্বের চেয়ে দ্বীগুন জেঁকে ধরে বললো,
” দোস্ত! আম ক্রেজি ফর হার! যত দ্রুত পারিস বিয়ের ব্যাপারটা এগিয়ে নে, নইলে আমি কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে দেবো, আমার ওকে ছাড়া একটুও ভালো লাগে না , আর এখন না দেখলে আমার রাতে ঘুম হবে না!”
অয়ন বুঝালো,
” আচ্ছা আচ্ছা, মেয়ের মায়ের কন্টাক্ট নাম্বার আছে আমার কাছে। কল দিয়ে দেখি, কোনো কূল কিনারা করতে পারি কিনা?”
মিনারার ফোনে অয়ন কল দিলো, মিনারা আধোঘুমে ছিলো। ছোটো মেয়ে তূর্ণাকে সাথে নিয়ে সে ঘুমিয়েই পড়েছিলো। নুভা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইভ টিজিং এ আক্রান্ত এক মেয়ের মায়ের ডাকে সে সেই বিকেলে শান্তর বাসায় গিয়েছিলো এখনো ফেরার খবর নেই। ফোন ও বন্ধ। সে সে কখন বাড়ি ফিরবে তার জানা নেই। সে ভয়ে ভয়ে থাকে সবসময়, কখন না তার গুন্ডি মেয়েটা পুলিশ কেসে ফেঁসে যায়।
অয়ন দ্বীধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” হ্যালো আসসালামু আলাইকুম আন্টি”
” ওয়ালাইকুম আস সালাম বাবা, কেমন আছো?”
” আন্টি, একটা জরুরি দরকার ছিলো, ভাবীর সাথে, একটু দেবেন ফোনটা?”
” ও বাবা, ইয়ে মানে বাবা নুভা তো বাসায় নেই, ও কি জানি কাজে শান্তর বাসায় গেছে!”
” আচ্ছা আন্টি” বলে অয়ন ফোন রেখে দিলো।
আর রাগান্বিত স্বরে বললো,
” দেখছিস! তোর বউ এখন তার ছেলে ফ্রেন্ড এর বাসায়! এত রাত! ”
নিষাদ যেনো কিছুই হয়নি এমন স্বরে বললো,
” আচ্ছা, ব্যাপার না, শান্ত নুভার অনেক জুনিয়র। একচুয়ালি আমি ওর সব ছেলে ফ্রেন্ডকেই আমি চিনি। সবাই এলাকারই ছেলে, সবাই জুনিয়র। এই ধর নাইন টেনে পড়ে। আর আমি শান্তর বাসার ঠিকানা জানি! চল এক্ষুণি যাবো!”
দুজনে নিষাদের মা সায়রা বেগমকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাত এগারোটার সময় ছুটলো শান্তর বাসায়।
শান্তর বাসার পাশেই এক ঝোপের ধারে কারো অপেক্ষায় ছিলো নুভা ও শান্ত।
নুভা পা ঝুলিয়ে বাইকের উপর বসা। আর শান্ত দাঁড়িয়ে। ওদের সাথে দুই দুইটা হকেস্টিক।
নুভাকে বলতে শোনা গেলো,
” মেয়ে পাইলেই ইভটিজ করিস! আজ মজা বুঝবি!”
তার চোখে মুখে যেনো প্রতিশোধের আগুন ঠিকরে পড়ছে।
ওদিকে নিষাদকে দেখেই শান্ত নুভাকে অগ্রাহ্য করেই জিহবায় কা’মড় দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” আরে দুলাইভাই আইছে, হুশিয়ার! এই দলবল তোরা সবাই ঝোপ হতে বাইর হইয়া আয়! দুলাভাই আইছে!”
এভাবে হাঁকানোর সাথে সাথেই ঝোপের মধ্যে থেকে আরো চার পাঁচ জন বের হয়ে এলো। সবাই মিলে নিষাদকে সালাম ঠুকলো সজোরে।
” আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই!”
নিষাদও সালামের প্রত্তুত্তর দিলো সজোরে।
কুশল বিনিময় শেষে হঠাৎ ই নিষাদ শান্তর হাতে কি একটা গুঁজে দিতেই সবাই সেখান থেকে দৌড়ে পালালো।
নুভা এতক্ষণ না বুঝলেও, এখন যেনো সব বুঝে বলে উঠলো, এক লাফে বাইক থেকে নেমে তেড়েমেরে সামনে এগিয়ে এসে বললো,
” ঐ ডাক্টার, টাকা বেশি হয়ে গেছে না? আমার সাগরেদ সবাইকে টাকা দিয়ে, ঘুষ দিয়ে কিনে নিচ্ছো, না? সবাই দেখি তোমার ভক্ত হয়ে গেছে ”
নিষাদ হেসে বললো,
” কই কিনলাম? টাকা দিয়ে যদি তোমার মন কেনা যেতো তবে সেটাই প্রথমে কেনতাম? তবে আমি তোমাকে ভালোবাসি, মন দিয়েই মন কিনবো। ”
একথা শুনে নুভার সাঙ্গপাঙ্গরা করতালি দিয়ে উল্লাস করে উঠলো। আর একে অপরকে ঈশারা করে দূরে চলে গেলো নুভা আর নিষাদকে একা কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে। নুভা ওদের যাওয়ার পানে চেয়ে থেকে রাগান্বিত স্বরে বললো,
” ডাক্টার, তুমি ওদের এখান থেকে সরিয়ে দিয়ে ভালো করোনি, আশেপাশেই আমাদের এন্টি পার্টি অপেক্ষা করছে আমাদের মারতে, পোলাপানদের পাঠিয়ে দিয়ে এখন নিজেই মাইর খাবা!”
কথাটা বলার সাথে সাথেই নিষাদ নুভার মাথাটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে সপাটে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
লাঠির আঘাতটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।
নুভা শত্রুর উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত উঠে গিয়ে নিজের হকেস্টিক উচিয়ে ধরলো। একে একে তিনজনকে নিজ হাতে পিটিয়ে মাটিস্থ করে দিলো।
নিষাদও নিজের হাতকে কাজে লাগালো।
তিনজনই দ্রুত জান নিয়ে পালালো।
পাঁচ মিনিটেই জায়গা ক্লিয়ার।
নুভা নিষাদের দিকে ফিরে বললো,
” ঐ ডাক্টার! তুমিও দেখি ভালো ঢিসুম ঢাসুম করতে পারো! কই শিখলা এসব? ”
নিষাদের স্বীকারোক্তি,
” হুউম, তাছাড়া তোমার সাথে মিলবে কিভাবে? মানুষ বলবে কি? ”
নুভা এবার সহজ হয়ে বললো,
” তাইলে আমাকে বিয়ে করার ভূত তোমার মাথা থেকে সরলো না?’
” মাথা যতদিন আছে, ভুতও ততদিনই থাকবে, তোমাকে বিয়ে আমি করবোই করবো মিস নুভা!”
নুভা হাসলো। সে হাসি প্রতিধ্বনিত হলো পাশের বাঁশবনে।
নিষাদ অপলক চেয়ে রইলো নুভার পানে,
” আরে! হাসলেও তো এ মেয়েকে অপূর্ব লাগে!”
নিষাদ হঠাৎই নুভার হাত চেপে ধরলো। আর অপ্রস্তুত নুভা তার হাত ছাড়িয়েই ভোঁ দৌড়।
.
.
ডক্টর নিষাদের চেম্বারে একটা ছেলে এসেছে। পা ভাঙ্গা তার। বা পায়ের ফিবুলা অস্থি প্রায় পুরোপুরিই ফ্র্যাকচার। ছেলেটার বয়স আঠারো উনিশ হবে। পা ভাঙ্গা স্বত্ত্বেও ছেলেটার মা তাকে গালে পিঠে উপর্যুপরি চড়াচ্ছে। কি সব অশ্লীল ভাষায় গা’লি গালাজ করছে আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে,
” তোরে জন্ম দেওয়াই আমার ভুল ছিলো, মাইয়া মানুষের হাতে মাইর খাস, এইবার সুস্থ্য হ, তারপর তোরেই মেয়েদের মতো থ্রি পিছ, লিপস্টিক, কাজল পড়াইয়া ঘরে বসায়া রাখমু হারা’মী”
ছেলেটার চোখ মুখ ব্যথায় নীল হয়ে গেছে। নিষাদের বুঝতে আর বাকি রইলো না যে, উক্ত কাজ নুভারই। নুভা ছাড়া আর কোন মেয়ে এমন মা’রপিট করে?
নিষাদ ছেলেটার পা যেখানে ফ্র্যাকচার হয়েছে সেখানটায় মুচড়ে হাড় বসিয়ে দিয়ে দ্রুত প্লাস্টার করতে লাগলো।
ব্যথায় ছেলেটা চিৎকার করে উঠলো।
ক্ষানিক বাদে ছেলেটা রাগে গরগর করে বলে উঠলো,
” আম্মা! শুনছিলাম, কয়দিন বাদে ঐ হারামী মাইয়ার বিয়া, আমি ওরে কোনোদিন বিয়া হইতে দিমু না, এই নাউ তোমার কীড়া, আমি ঐ মাইয়ার জীবন হেল কইরাই ছাড়মু, জবান দিলাম!”
নিষাদ পাশ থেকে সব শুনছিলো।
ভয় না পেলেও এক অজানা শঙ্কা তার মনে হানা দিলো আচমকাই।
(চলবে)