#যে_আসে_অগোচরে
পর্ব ৩
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
” ঐ ডাক্টার, আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্ঠা করো না খবরদার! আমি তোমাকে জীবনেও বিয়ে করবো না!”
নুভার একথাকে নিষাদ ফুঁ মে’রে উড়িয়ে দিয়ে বললো,
” আচ্ছা, না করলে বিয়ে, চলো প্রেম করি! বুঝতেই তো পারছো, লাভ ইন ফার্স্ট সাইট হয়ে গিয়েছে আমার সাথে! ”
নুভা এক ভিলেনী হাসি হেসে বললো,
” হাহা! আমাকে কোন এঙ্গেলে তোমার প্রেমিকা বলে বোধ হলো? হুহ!”
নিষাদের চোখে তখনো নুভার প্রতি রাজ্যের মুগ্ধতার চাহুনী। সে বলতে লাগলো,
” প্রেমিকা হতে হলে কি কোনো স্পেশাল যোগ্যতার প্রয়োজন আছে? নাকি মেন্টাল এটাচমেন্ট ই যথেষ্ঠ?”
নিষাদ চেয়ে আছে আর নুভা তার টি শার্টের হাতা সরিয়ে তার হাতের ফ্যাটি মাসল বের করে দেখালো,
” এটাচমেন্ট কি জিনিস বুঝি না! তবে এই দেখো আমার বাইসেপ্স! বডি বিল্ডিং করি, দৌড় ঝাঁপ করি, কুস্তি, ক্যারাটে, এথল্যাট করি! মানুষকে পিটাই। আরো কত্ত কি? দুনিয়ার অভদ্র এক মেয়ে আমি। আরে! যাও যাও! তোমরা ভদ্র পোলারা কোনো এক শাড়ী পড়া শুশীল, ভদ্র মেয়ের সাথেই প্রেম করো গিয়া! আমার মতো ছেঁড়া জিন্স আর টি শার্ট পড়া উচ্ছন্নে যাওয়া মাইয়ার লগে প্রেম হয় না!”
নিষাদ আগের ন্যায় হাস্যোজ্জল হয়েই বললো,
” প্রেম কি কখনো ভেবে চিন্তে আসে নাকি? নইলে আর এতো রা’গী মেয়ের প্রেমে পড়ি?”
নিষাদের সহজ স্বীকারোক্তি নুভার কাছে অতি সাধারণ বলেই বোধ হলো।
হঠাৎই বৃষ্টির তেজ বাড়লো। নুভা তার পায়ের কাছে জমে থাকা পানিগুলোকে তার নগ্ন পা দিয়ে জোরে একটা লাথি মে’রে ক্রোধান্বিত স্বরে বললো,
” আমি প্রেম টেমে বিশ্বাস করি না ডাক্টার, তোমার প্রেমেরে আমি এইভাবেই লাথি মা’রি! আর এখন ফুটো আমার সামনে থেকে! আমার অনেক কাজ আছে এখন। এসব আজাইরা আলাপ করার টাইম নেই আমার। আর ভাবটা এমন দেখাইছো যেনো তুমিই ঐ খেলোয়াডকে আউট করছো। টাকা দিয়ে ম্যাচ ফিক্স করে আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্ঠা করছো৷ তা কি আমি জানিনা? তাছাড়া তুমি আবার কাউকে আউট করো? ফারদার আমার পিছুপিছু আসবা না!”
নিষাদ তার ছাতাটা নুভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
” আচ্ছা, মানলাম আমি টাকা দিয়ে ফিক্স করে নিয়েছিলাম। তবে সেটা তোমার খুশির জন্যই। আর যাচ্ছি আমি, তবে এখন এই ছাতাটা ধরো, তাছাড়া সর্দি, জ্বর বাঁধিয়ে আমার কাছেই আবার ট্রিটমেন্টের জন্য আসতে হবে! ”
নুভা ছাতাটা না নিয়েই বরং বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে বড় বড় ঝাঁপ দিয়ে হাসিমুখে বললো,
” আয়রন বডি বানিয়েছি ডক্টর! কত ঝড়-ঝঞ্চা গেলো তল, আর এখন বলছো, বৃষ্টি বলে কত জল! সেই ছোটো থেকেই এমন কোনো বৃষ্টি নাই যে ভিজি নাই, কস্মিনকালেও জ্বর হয়না। তোমার ছাতা নিয়ে তুমিই থাকো, আর আমি গেলুম। কই রে শান্ত? কই রে নীল? রুমি, ইভান..”
এসব নামে চিৎকার করে ডেকে ডেকে নুভা দৌড় লাগালো তার বন্ধুদের উদ্দ্যেশ্যে। নিষাদও নুভার পিছুপিছু ছুটে গেলো।
বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। খেলোয়াড়দের দল যে যার মতো নিজেদেরকে বৃষ্টির তোপ হতে নিজেদের বাঁচাতে নিরাপদ স্থানে চলে গেছে নুভাকে রেখেই।
নুভা ” ধ্যাৎ” বলে তার পেছনে ছুটে আসা নিষাদকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো,
” ডাক্টার! তোমার সাথে প্যাঁচাল পাড়তে গিয়ে আমার সব বন্ধু মিসিং! তাই ভাইবো না আমি এখন তোমারে সময় দিবো! আমার এখনো করার মতো বহু কাজ আছে, সো যাও ভাগো! আর খবরদার আমার পিছুপিছু আসবা না! ভাল্লাগেনা!”
বলেই একটা ভোঁ দৌড় লাগালো নুভা।
নিষাদও নুভার পিছুপিছু লুকঝুক করে এগিয়ে গেলো, ” দেখা যাক! এই বৃষ্টিতে কি করে মেয়েটা!”
.
.
” বইন রে বইন! মেয়েটারে যে কি বানাইলাম! কেন যে ছেলেদের মতো করে মেয়েকে বড় করলাম? এত বেশি দস্যিগিরি দেখায়! আর যে রাগ! মুখের ভাষা যেনো না, আগুনের ফুলকি! আজ এরে মা’রে তো কাল ওরে মা’রে। পাত্রপক্ষকে যেভাবে অপমান করলো! আমি জীবিত থেকেও একশ গজ মাটির নিচে ঢুকে গেলাম রে!”
মিনারা বসে বসে তার ছোটোবোন মিতারার কাছে উক্ত আফসোস বাক্য সমেত একরাশ অনুতাপ ঢেলে দিচ্ছে।
মিনারার ছোটো বোন মিতারা বলে উঠলো,
” আপা, তোমার কি দোষ? পরপর তিন তিনটা কণ্যা সন্তান হওয়াতে তোমার শাশুড়ী তোমাকে বাপের বাড়ি পাঠায়া দিলো, তারপর দুলাভাইও বিদেশে গিয়ে লাপাত্তা হইলো। এই মেয়েটাই আবার তোমার শ্বসুর বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে পারলো। এত তেজওয়ালা মেয়ে বলেই তো বাপ দাদীকে শাসাতে পেরেছিলো। আর এই মেয়ের বুদ্ধির জোরেই তোমার চাকরি হলো। তুমি স্বাবলম্বী হলে। আর এই মেয়ের রাগ আর জেদের জোরেই তুমি তোমার হারানো সংসার পাইছো, তোমার স্বামি পাইছো! আবার বলো? রাগ, জেদেরও প্রয়োজন আছে জীবনে!”
মিনারা চুপ গেলো। সত্যিই মেয়েটার কি দোষ? এই মেয়েই তার অন্ধকার ঘরের চেরাগ! দ্বীর্ঘ এক শ্বাস বড় এক হাহাকার যোগে বাইরে নির্গত করে সে ভাবতে লাগলো তার অতীত দিন গুলোর কথা।
দিনগুলো তার ছিলো নির্মম কষ্টের। গর্ভবতী থেকেই সারাদিন পরিশ্রম করতে হতো স্বামীর সংসারে। শাশুড়ী তাহেরা বানু গ্রামের অন্য মানুষদের সাথে টক্কর দিয়ে নিজের জায়গা, জমি বাড়ানোর চিন্তায় ছিলো। নিজে দিন রাত এক করে সংসারে খাটতো, এবং ছেলের বউকেও খাটাতো। প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় শাশুড়ী তার মুখ কালো করলো। মেয়ের নাম রাখলো স্নেহা যদিও কেউ তাকে স্নেহ করলো না। মিনারা বুঝলো না ঘটনা কি! স্বামীও দোকান হতে ঠিকমতো বাড়ি ফেরে না। দাম্পত্যে দূরত্ব বনে গেলো বহুদূর।
বছর যেতে না যেতেই দ্বিতীয় সন্তান! সেটাও মেয়ে! নাম রাখলো নুভা। নুভার জন্মের পর শাশুড়ী প্রায়ই মিনারার সাথে মেজাজ দেখায়। কারনে অকারনে ভুল ধরে। বাচ্চা সামলিয়ে যখন সংসারের কাজকর্ম করতে পারে না ঠিকঠাক, তখনি বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। মিনারা বুঝলো একটা ছেলে সন্তানের জন্য শাশুড়ীর এত উদ্বেগ। তৃতীয় সন্তানও মেয়েই হলো। নাম রাখলো তূর্ণা। তূর্ণার জন্মের পর শাশুড়ী তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে আর ফিরে আসতে মানা করে দিলো। সেই সাথে আমীর আলিকে দ্বীতিয় বিয়ে করানোর জন্য পাত্রী খুঁজতে লাগলো।
আমীর আলী বিয়েতে রাজী না হওয়ায় তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেয় তার মা। একমাত্র ছেলের ঘরে কোনো ছেলে সন্তান নেই! তার ছেলের মৃত্যুর পর কে এই বংশের বাতি দেবে সে চিন্তায় অধীর হয়ে পড়ে তাহেরা। যার প্রভাব সে ফেলে তার পুত্রবঁধু মিনারার উপর। মিনারা অতি কষ্টে তিন কন্যা নিয়ে বাবার বাড়িতে দিনাতিপাত শুরু করে।
ওদিকে ছোটোবেলা হতেই মিনারা নুভাকে ছেলেদের মতো করে বড় করা শুরু করে। ছেলেদের পোশাক পড়িয়ে পাঠাতো ছেলেদের সাথেই কুস্তি করতে। নুভাও ওসব রপ্ত করে ফেলে খুব দ্রুত। দেখতে দেখতে নুভা বড় হয়। তবে সে যেনো কোনো ছেলেরুপী মেয়ে। দাঙ্গাবাজীতে ছেলেদেরকেউ সে টেক্কা দিতে লাগলো। সকল খেলাধূলায় ও শরীরচর্চায় সে এগিয়ে। কোনোকিছুর সামান্য হেরফের হলেই প্রচন্ড রাগ! ধীরে ধীরে এলাকার বাজে লোকদের ত্রাসে পরিনত হলো সে। এলাকার কোনো মেয়ে ই’ভটিজিং এর স্বীকার হলে নুভার ডাক পড়ে। নুভা মে’রে টেরে সেই ইভটিজারের হাত পা গুড়িয়ে দেয়। এলাকায় কোনো চোর ডাকাত ধরা পড়লেও নুভার ডাক পড়ে। সে নিজ হাতে চোর ডাকাতকে ক্যালানী দেয়। কেউ কোনো অন্যায় করে ধরা পড়লেও একইরকম ভাবে নুভাই সেটা দেখে নেয়।
তবে এত এত উপকারমূলক কাজ করে বলে সবাই তাকে ভালোবাসে ও স্নেহ করে। নুভার বুদ্ধিতেই মিনারা বাবার বাড়ি ছেড়ে শহরে আসে। কাপড়ের ব্যাবসা শুরু করে। নুভাই তাকে বাইরের সব কাজে সাহায্য করতো। নুভার ঝা’ড়ি খেয়েই দাদী তার মাকে পুনরায় স্বীকার করে নেয়। বাবাও বিদেশ হতে চলে আসে। তবে তারা আর গ্রামে যায় না। শহরেই স্থায়ী হয়। মিনারার ব্যাবসায় আমির আলীও অংশীদার হয়। ভালো ঘরে বড় মেয়ে স্নেহার বিয়ে দেয়। তবে মেয়ে মানুষ এত দা’ঙ্গাবাজী করে বলে অনেকেই তাকে অপছন্দ করে৷ এলাকার সবচেয়ে অভদ্র মেয়ের খেতাবও সে পেয়ে গেছে। আর এখন সেই নুভাকে নিয়েই চিন্তায় পড়ে আছে মিতারা।
মেয়েটাকে একটা ভালো পাত্রের হাতে সোপার্দ করতে পারলেই সে বাঁচে। সেক্ষেত্রে ঐ ডাক্তার ছেলে নিষাদের বিকল্প আর কেউ নেই।
(চলবে)