#যে_আসে_অগোচরে
(সূচনা পর্ব)
লেখিকা:জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
“আর ইউ ভার্জিন মিস নুভা?”
ভীত হয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে এই প্রশ্ন করার সাথে সাথে কষে একটা চ’ড় পড়লো প্রশ্নকর্তার গালে। প্রশ্নকর্তার ফর্সা গাল চিবুক মুহূর্তেই লাল আভা ধারণ করে গেলো। একদিকে লজ্জার লাল আর অন্যদিকে আ’ঘাতের দরুন লাল, দুই লাল মিলে সে একেবারে লালে লাল হয়ে গেলো। চ’ড়দাতা কন্যার নাম নুভা। আর যার গালে চ’ড়টা বসলো তার নাম নিষাদ। নিষাদ বেচারা প্রেমিক পুরুষ, যে কিনা নুভাকে দেখতে এসেছে পাত্র সেজে।
ওদিকে নুভা, যার রাগের খবর জানে গোটা এলাকাবাসী। এককথায় যে রাগের জন্য বিখ্যাত!
পিঠ পেছনে নুভাকে কে কি বললো তা নিয়ে নুভা কোনোদিন মাথা না ঘামালেউ এই প্রশ্ন সামনা সামনি নুভাকে কেউ করার সাহস রাখে তা নুভা কোনোকালেই ভাবেনি।
চড়ের শব্দ পেয়ে পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এলো নুভার মা মীনারা। মীনারা আগেই ভেবেছিলো তার মেয়ে কোনো একটা গন্ডগোল করবেই করবে। যে রাগ তার মেয়ের! তাই কান খাড়া করেই ছিলো সে। নুভার বাবা আমীর আলী ও ছোটো বোন তূর্ণাও দৌড়ে এলো সাথে সাথে। সবার চোখে মুখেই আতঙ্ক।
পাত্রবেশী বেচারা ছেলেটা গাল ধরে ঝিম মেরে বসে রয়েছে। হয়তো তার দু একটা আক্কেল দাঁতও নড়ে উঠেছে এই চড়ের ফলে। তবে তার চোখ দুটিতে খুশির জোয়ার বইছে। যেনো সে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জিতেছে।
মীনারা ভয়ার্ত চোখে ভ্রু নাচিয়ে কন্যা নুভাকে ঈশারায় জিজ্ঞেস করলো, ” ব্যাপার কি?”
নুভা কিছু বলার আগেই গালে হাত রেখেই সেই পাত্র নিজেই এগিয়ে এসে হাস্যোজ্জ্বল বদনে মীনারার দিকে চেয়ে বলে উঠলো,
” কিছু হয়নি আন্টি, গালে একটা মশা বসেছিলো মাত্র আন্টি, তাই উনি মশাটাকে একটা চ’ড় মেরে তাড়িয়েছে আর কি! থ্যাংস মিস নুভা মশাটাকে মে’রে ফেলার জন্য! ”
শেষের ধন্যবাদ সূচক শব্দটা সে নুভার দিকে তাকিয়েই দিলো বিনয়ের সাথে।
ওদিকে নুভা তার দাঁতে দাঁত কটমট করছিলো প্রচন্ড ক্রোধের দাপটে।
নিষাদের উত্তর শুনে মীনারা আশ্বস্ত হয়ে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে বিষম দু:শ্চিন্তা হতে মুক্তি দিলো।
মনে মনে বললো, ” যাক বাবা! বড় বাঁচা বাঁচলাম! মেয়ে আমার চড় টড় মারে নাই ছেলেটাকে অন্তত:!”
নুভা এখনো রেগেমেগে অগ্নীমূর্তী ধারণ করেই আছে। দাঁত কটমট করছে সে মায়ের পানে চেয়ে।
সে তার মা কে নিষাদের সামনেই শাসিয়ে বললো,
” মা, এই ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না, তোমরা জানো, আমি যা বলি সরাসরি সামনাসামনিই বলি, তা তোমরাও শুনে রাখো আর এই ডাক্টারও শুনে রাখো, আমি তোমাকে বিয়ে করবো না করবোনা, জীবনেও করবো না। আর আমি এখন ড্রেস চেইঞ্জ করবো, এই শাড়ীতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, সো, তোমরা বেরোও এখান থেকে! রাইট নাউ!”
অগ্যতা পাত্র নিষাদ সহ সব কয়জন উক্ত রুম হতে বের হয়ে গেলো।
মীনারা বেগম বের হতে হতে নিষাদকে বললো,
” বাবা, তুমি রা’গ করো না ওর কথায়, মেয়ের বয়স কম তো, তাই এরকম রগচটা! তাছাড়া আমরা বিয়েতে রাজী থাকলে মেয়েও আমার রাজী থাকবেই থাকবে, ভারী লক্ষী মেয়ে আমার! ”
নিষাদ মনে মনে হাসলো। চোখ মুখেও তার সেই হাসির প্রতিফলন ঘটেছে। কারন সে জানে মীনারা বেগমের মেয়ে কেমন!
তাই সে মনে মনে বলছে, ” আপনার মেয়ে লক্ষী হোক আর না হোক, সে আর কাউকে বিয়ে না করুক, আমাকেই করবে, আর বিয়ে যে করতে তাকে হবেই!”
মীনারা বেগমের বুক দুরুদুরু করছে। তার এমন রাগী, অভদ্র, বেহায়া আর গুন্ডী মেয়ের জন্য এই প্রথম এত ভালো কোনো সম্বন্ধ এসেছে। আর মেয়ের অসভ্যতার জন্য এই বিয়েটাই না আবার ভেঙ্গে যায়!
ছেলে পেশায় ডাক্তার। শহরেরই ছেলে। ভদ্রতার খ্যাতিতে সে যেমন সর্বেসর্বা, নুভা তেমনি অভদ্রতার অখ্যাতিতে তেমনি সর্বেসর্বা। দুই জন দুই মেরুর মানুষ।
এখন নুভা এই বিয়েতে রাজী হলেই মীনারা বেগমের গলায় আটকে থাকা দম যেনো মুক্তি পাবে। এত যোগ্য পাত্রে কণ্যা দান করতে পারলে সমাজে এতদিন সে যে হেনস্থা হয়েছে, তার বিপরীতে সে যোগ্য সম্মানও পাবে।
নিষাদ এসে ড্রয়িং রুমে বসলো। নানা পদের নাস্তার আয়োজন করা হয়েছে তার জন্য। নিষাদ আর তার এক বন্ধু ও একমাত্র মামা এসেছে পাত্রী দেখার জন্য।
নুভাকে নিষাদ প্রথম দেখেছিলো বাইকে। বাইকে দুই ছেলে বন্ধুর মাঝখানে বসে চুল উড়িয়ে সে প্রথম নিষাদের সামনে এসেছিলো মেডিক্যালে। গায়ে ছিলো সাদা জেন্টস টি শার্ট ও জিন্স প্যান্ট। পনি টেইল করা লম্বা স্ট্রেইট চুলগুলো ক্যাপের পেছনের ফোকর দিয়ে বের হয়ে ছিলো।
সেদিন ছিলো এক বৃষ্টির দিন। সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে সবে রাত পড়েছে। চারদিকে আধো আলো আধো অন্ধকার। সদ্য বৃষ্টি শেষ হয়ে গিয়ে এক মখমলে সুন্দর সমীরন বইছিলো। সে বাতাসে নুভার চুল উড়ছিলো। হসপিটালের রোগী বলতে ছিলো না। তাই ডক্টর নিষাদ দোতলার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। ঠিক তখনি বাইকটা হসপিটালের গেইট দিয়ে ঢুকে। আর নিষাদ প্রথম নুভাকে দেখে। নিষাদ প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারে মেয়েটা দারুন বোল্ড, পোষাক আশাক বা চলাফেরার ক্ষেত্রে সে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দেয়। কিন্তু নুভার পায়ের তলায় এক লোহার তার ঢুকে গিয়েছিলো। এক পা তুলে দুইজনের কাঁধে ভর দিয়ে সে নিষাদের কেবিনে প্রবেশ করলো। হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে একমাত্র ডক্টর নিষাদই ছিলো তখন, আর একজন নার্স ছিলো মাত্র। নুভার চোখ মুখে ক্রোধ উপচে পড়ছিলো। সে বারবার কাকে জানি মা’রতে চাচ্ছিলো, আর তার দুই বন্ধু তাকে বারংবার শান্ত হতে বলছিলো। শান্ত ও রুমি নামের সেই দুই বন্ধু নুভাকে বারবার বলছিলো,
” আগে নিজে সুস্থ্য হয়ে নে, তারপর ওদেরকে ক্যালানি দিস!”
কিন্তু নুভা শান্ত হচ্ছিল না কোনোক্রমেই। তার চোখে মুখে প্রতিশোধের আগুন।
নিষাদ নুভাকে দেখে বিমোহিত হলো। বৃষ্টির জলে তার সর্বাঙ্গ ভেঁজা। ছেলের পোশাকে থাকলেও ভেঁজা কাপড়ের আড়ালে তার যৌবন ডগমগে সৌন্দর্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। তার আদ্র নরম মোলায়েম তনু দিয়ে যেনো এক মোহনীয় দ্যুতি বিকিরিত হচ্ছিলো। গোলাপী ওষ্ঠযুগলকে জল ছিটানো গোলাপী প্রস্ফূটিত গোলাপের পাঁপড়ি বলে বোধ হচ্ছিলো। নিষাদের চোখ আটকে গেলো রোগীনির ঠোঁটের পানে।
হঠাৎই নুভা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” এই যে মিস্টার ডক্টর? আমার মুখে কি দেখছেন, ব্যথা তো পেয়েছি পায়ে? লুইচ্চা ডাক্টার!”
নিষাদের প্রচন্ড কষ্ট হলো নুভার ঠোঁট হতে চোখ ফেরাতে। তবে এবারও সে আর নুভার পায়ের দিকে তাকালো না, বরং সে তাকালো সরাসরি তার চোখের দিকে। ডাগর ডাগর আয়তাকার চোখ; অগ্নীশর্মা! গাঢ় ভ্রু যুগল দেখে মনে হচ্ছিলো কোনো এক লোহিত সাগর! যে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে হাজার বার ম’রা যায়।
রাগলে কোনো মেয়েকে এত সুন্দর দেখায়? তা প্রথমবারের মতো দেখতে ও বুঝতে পেলো নিষাদ।
নিষাদ তার মনোযোগ ঐ মনোহরিনী চোখ আর ওষ্ঠদ্বয় হতে কোনো ক্রমেই দূরে সরাতে পারছিলো না।
এমতাবস্থায় পুনরায় চিৎকার!
” কি ডক্টর? পায়ে ব্লিডিং হচ্ছে, তা কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?”
” ইশ! ” শব্দযোগে ডক্টর নিষাদ এবার নুভার পায়ের পানে চাইলো।
” আহা! আপনার তো অনেক ব্লিডিং হচ্ছে!”
বলেই নুভাকে দ্রুত তার কোলে তুলে নিয়ে পাশের ওটির বেডে শুইয়ে দিলো। নুভা যার পর নাই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
কোলে নিয়েই নিষাদ বিড়বিড় করে বলতে লাগলো।
ওজন পঞ্চাশ কেজি, উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ, কোমড় ছত্রিশ, বডি চল্লিশ, নিতম্ব?
নুভা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” এই ডাক্টার নামাও আমাকে জলদি! আমার পায়ে ব্লিডিং হচ্ছে আর সে আমার ওজন মাপছে! লুইচ্চাডার কাছে আনছে কেনো আমাকে?”
নিষাদ কোনো প্রত্তুত্তর না করে তাকে বেডে শুইয়ে দিলো হাসিমুখে। লুইচ্চা ডাকলে ডাকুক, মুখে তার জয়ীর হাসি। কারন, এতদিনে যারে সে খুঁজেছিলো, আজ সে তার দেখা পেয়ে গেছে!
নিষাদ নুভার পায়ে হাত দিতেই ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো নুভা।
” কিকরে এত বড় তার ঢুকলো?” নিষাদের প্রশ্ন
নুভা পুনরায় চেঁচিয়ে বললো,
” এত প্যাঁচাল না পেরে আগে ঐটা বের করেন, ইডিয়ট ডাক্টার!”
এই প্রথম কোনো মেয়ের মুখে ইডিয়ট সম্বোধন পেয়েও খুশি হলো নিষাদ। ইডিয়ট বলার সাথে সাথে সে নুভার মুখের দিকে চাইলো। আর বলে উঠলো,
” কি বের করবো আমি?”
নুভা পুনরায় চেঁচিয়ে বললো,
” ধুর! পায়ে যেটা ঢুকছে সেটা বের করেন..! ”
নিষাদ এবার বুঝতে পারলো, তার মনোহারিণীকে তাড়াতাড়ি সুস্থ্য করতে হবে, ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে সে।
সে তার ইকুয়েপমেন্টস গুলো নিতে নিতে মনে মনে বললো,
” ইশ! কি সুন্দর! কি সুন্দর! হাউ বিউটি! রাগান্বিত অবস্থায় এই মেয়ের রুপ দেখে তো আমি ম’রেই যাবো!”
অত:পর নুভার পায়ের তারটাকে সে এক বিশেষ কৌশলে এক চিমটাসদৃশ যন্ত্র দিয়ে টেনে বের করে আনলো। নুভা চিৎকার করে উঠলো, আর নিষাদ নুভার পা টা জড়িয়ে ধরলো যাতে সে বেশি নাড়াচাড়া না করে। এতে এক ছলকা মেরে ক্ষাণিক র’ক্ত নিষাদের মুখে ছিঁটে এলো।
দ্রুত এনেস্থাশিয়া দিয়ে সেলাইয়ের কাজ সেরে, ব্যান্ডেজ করে, পেইনকিলার দিয়ে সে নুভার সামনে এলো। মেয়েটাকে এক নজর কতক্ষণ দেখা যাক! এবার সে শান্ত হয়ে শুয়েছে চোখ দুটি বুজে।
নুভা চোখ বন্ধ করে ততক্ষন বেডেই শুয়ে আছে। আর ডক্টর নিষাদ তাকে কাতর হয়ে দেখছে একদৃষ্টে।
নাস্তা সামনে নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই নুভা আবার তার সামনে চলে এলো। শাড়ী খুলে এবার সে পুনরায় টি শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে এসেছে। চোখে সানগ্লাস। একটা লেডি মাস্তানের মতো স্বরে সে তার মা মীনারাকে উদ্দ্যশ্য করে বলে উঠলো,
” মা বাইকের চাবিটা দাও, আমি বের হবো, এক ইতরকে ক্যালানি দিতে হবে এক্ষুণি!”
নুভার এমন কথা শুনে নিষাদ বিষম খেলো।
চলবে?