যেদিন মিনিকেট চালের বদলে দেখলাম মোটা চালের ভাত রান্না হয়েছে। মা ভাতের প্লেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে কেমন লজ্জামাখা চোখে তাকিয়ে ছিলো। সেদিন বুঝেছিলাম সামনে কি হতে চলেছে। হঠাৎ মোটা চালের ভাত খেতে একটু অস্বস্তি হলেও মাকে খুশি করার জন্য প্রবল আগ্রহ নিয়ে পুরো প্লেট সাবাড় করে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বলেছিলাম, “অনেকদিন পর পেট ভরে খেয়েছি মা!”
.
প্রতি শুক্রবারে আমাদের সবার জন্য গরুর গোশত বরাদ্দ থাকতো। নামাজ পড়ে এসেই পোলাও, মাংস, কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে সোফায় শুয়ে টিভি দেখতাম। যতদিন বাড়িতে ছিলাম এর ব্যতিক্রম হতে দেখিনি। বাবা নিজের প্লেট থেকে গরুর চর্বি তুলে আমাকে দিয়ে দিত। বলতো, “তোর না তেল খুব পছন্দ। আরাম করে খা। খেয়াল রাখিস দাঁতে যেনো না আটকে যায়।” যেদিন নিয়মের ব্যতিক্রম হলো। গরুর গোশতের বদলে আলু ভর্তা, বেগুন ভাজি রান্না হলো সেদিন আন্দাজ করতে পেরেছিলাম এ সংসারে অভাবের আগমন ঘটছে। বাবা মায়ের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে কী ভীষণ খারাপ লাগলো। কাঁদতে ইচ্ছে করেছিল খুব। কিন্তু কাঁদিনি সেদিন।
.
পাশের বাড়ির আদনানের ফতুয়া টা খুব পছন্দ হয়েছিল। বাবার কাছে বায়না ধরেছিলাম এরকম একটা ফতুয়া কিনে দিতে। বাবা দিতে পারেন নি। সেবার বাবার বন্ধুর স্কুল থেকে প্রথমবারের মতো আমি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। বাবাও যেমন খুশি, উনার বন্ধুও খুশি। আমাদের পরিবারের সবাইকে দাওয়াত করেছিলেন। কিন্তু আবদারের ফতুয়া না পেয়ে সকাল থেকে বাড়ির বাইরে ছিলাম। দুপুরে খেতেও আসি নি। আমাকে ছাড়াই সবাই দাওয়াত খেতে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেদিনও খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করেছিল। কাঁদতে পারিনি। বাবা কেঁদেছিলেন হয়তো!
.
প্রতিবার বাড়ি থেকে চলে আসার সময় মা শোল মাছের তরকারি, গরুর গোশত, মুরগি, পিঠা সব টিফিন বক্সে করে দিয়ে দিত। রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। যতক্ষণ আমাকে দেখা যায় ততক্ষণ কেমন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছে করে সবকিছু ফেলে রেখে বাড়ি চলে যাই। পৌঁছে যখন ফোন দেই তখন বলে, “বাবা গলা দিয়ে ভাত নামে না। তুমি চলে গেছো ঘর টা কেমন খালি খালি লাগে। ” কিছু বলতে পারিনা। ফোন রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকি। মন খারাপ হয় খুব। তবুও কাঁদতে পারিনা।
.
রেস্টুরেন্টে শেষবারের মতো দেখা করতে আসে প্রেমিকা। হাতে বিয়ের কার্ড। আঙ্গুলে আংটিও পরে ফেলেছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব উচ্ছ্বসিত সে। আর খুশি হবেই বা না কেন? শুনেছি ছেলে সরকারি চাকরি করে। শহরে বাড়ি আছে। ব্যাংক ব্যালেন্স ও কম নেই হয়তো। বেকার মানুষকে কেইবা বিয়ে করবে? আমি হয়তো প্রতিরাতে টিউশন শেষ করে আসার সময় ১০ টাকার বাদাম কিনে আনতে পারতাম। একটা কবিতার বই হাতে নিয়ে চাঁদনী রাতে ছাদে বসে কবিতা শোনাতে পারতাম। এসব আদিখ্যেতায় কি আর সংসার চলে! তার স্বামী তাকে ঠিকঠাক সময় দিতে না পারলেও হাত ভর্তি টাকা দিতে পারবে। ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারবে, শপিং করতে পারবে। সে চলে যাওয়ার সময় পথ আগলে রাখতে ইচ্ছে হয়েছিল। ইচ্ছে করছিল জোর করে কাছে রেখে দেই। কিন্তু বাস্তবতা যত কঠিন হোক মেনে নেওয়াই উত্তম। সে রাতে তার লেখা চিঠি গুলো পুড়িয়ে ফেলতে, মোবাইল থেকে সব স্মৃতি মুছে ফেলতে খুব কষ্ট হয়েছিল। সেদিনও কাঁদতে পারিনি!
.
যেদিন থেকে বড় ভাই বলে দিয়েছেন, “আর টাকা দিতে পারব না। নিজের খরচ নিজে বের করে নিস।” সেদিন মাথায় আকাশ ভেঙে পরেছিল যেনো। সাঁতার না জানা কাউকে হুট করে মাঝ সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার মতো অবস্থা। কত চেষ্টা করেছি নিজে ইনকাম করার। উপরওয়ালা ভাগ্যে লিখেন নি হয়তো। টাকা বাঁচানোর জন্য কিছুদিন একবেলা খেয়েই পার করতে হয়েছে। মাঝ রাত্তিরে সে কি ক্ষিদে! ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়ে দেই সারারাত। এর থেকে ওর থেকে টাকা নিয়ে চলতে হয়েছে। খুব লজ্জা লাগলেও কাঁদতে পারিনি।
.
সব খারাপ সময়ের মধ্যে থেকে উপলব্ধি হচ্ছে যে সব মানুষ ই জন্মগতভাবে অভিনয় করার শিক্ষা শিখে ফেলে। জন্মগতভাবে বললে ভুল হবে। পরিস্থিতি সবাইকে অভিনেতা অভিনেত্রী বানিয়ে দেয়। আপনি যাকে দেখে ভাবছেন, ওর মতো সুখী হয়তো কেউ নেই দেখা যাবে সেও প্রতিরাতে কান্না করে বালিশ ভিজাচ্ছে। যার বন্ধুদের সাথে আউটিং, শপিং দেখে ভাবছেন ওর মতো টাকা থাকলে আপনার কোনো কষ্টই থাকতো না খোঁজ নিলে দেখবেন ঘুমের ওষুধ ছাড়া সে ঘুমাতেই পারে না। গণিতের U এর মতো সবার জীবনের সাথে মিশে যাওয়া গান মনে হয় এটাই–
“হাসতে দেখো গাইতে দেখো
অনেক কথায় মুখোর আমায় দেখো
দেখো না কেউ হাসির শেষে নীরবতা। ”
অভিনয়শিল্পে দারুণ দক্ষতা, নিঁখুত অভিনয়ের জন্য এসব অভিনেতা অভিনেত্রী রা অস্কার দাবি করতেই পারে।
আজ দিন টা খারাপ যাচ্ছে তো কি হয়েছে? সামনে ভালো দিন আসতেও পারে এই চিন্তা করে আত্নহত্যার তারিখ টা পিছিয়ে ফেলার মানুষের সংখ্যাও হয়তো কম নয়।
এতকিছুর পরও কিছু কিছু মানুষ দিব্যি হেসে বেড়ায়।
কিছু মানুষ কাঁদতে না পারার অদ্ভুত গুণ (দোষ) নিয়েই জন্মায় হয়তো!!!
জহিরুল হক জাবেদ