যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫০. ( উপসংহার )
পাথরের মূর্তির ন্যায় শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে আফজাল সাহেব। গুমোট পরিবেশের সাথে পাল্লা দিয়ে পালন করছেন মৌন ব্রত। তার পাশে স্টিলের বেঞ্চিটাতে বসে ফুপিয়ে কাঁদছেন সাদিকা বেগম। আফজাল সাহেবের কানে সেই কান্নার শব্দ পৌঁছাচ্ছে না। খানিকক্ষণ আগে পার্থর কল পেয়েই তিনি হসপিটালে ছুটে আসেন। পার্থ জানায় সে শোভন এবং তূর্যকে নিয়ে হসপিটাল যাচ্ছে। এর বেশি আর কিছু বলে নি সে।
আফজাল সাহেবের মনে প্রশ্ন জাগে। তার ছেলে কি সামান্য আহত হয়েছে নাকি খুব বেশি আঘাত পেয়েছে? হসপিটালে আসার পর সামান্য ফার্স্ট এইড করলেই তার ছেলে সুস্থ হয়ে যাবে তো? আবার আগের মতো আফজাল সাহেবের কথার ত্যাড়া জবাব দিবে তো? আফজাল সাহেব আর কিছু ভাবতে পারে না। তিনি চোখ বুজে ফেলে। শোভনকে তিনি সবসময় বলতেন, বিপদ দেখলে সবসময় আগে নিজের জীবন যেনো বাঁচায়। কিন্তু তার বরাবরের মতো ঘাড়ত্যাড়া ছেলেটা উনার কথা কানে তুলেন নি। বিপদ দেখে পালায় নি।
আচমকা আফজাল সাহেবের কানে ভেসে আসে মেয়ে এবং পুত্রবধূর আর্তনাদ। তিনি চোখ মেলে তাকাতেই দেখেন করিডর হয়ে দুটো স্ট্রেচারে করে দুটো রক্তাক্ত দেহ দ্রুত গতিতে নিয়ে আসা হচ্ছে ওটির দিকে। সেই স্ট্রেচারের সাথে কদম মিলিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে বিধ্বস্ত পার্থ। আফজাল সাহেব নিস্তেজ শরীর টেনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। উনার চোখের সামনে দিয়ে শোভনকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ছেলের রক্তাক্ত দেহ দেখে আফজাল সাহেব অস্ফুটে বলে উঠে,
“ আমার বাবা! “
হুমায়ুন রশীদ এবং তরী স্ট্রেচারের সাথেই ওটির ভেতর প্রবেশ করে। চোখের সামনে ভাই এবং স্বামীকে এরকম বিধ্বংসী, রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে পৃথা নীরব বনে গিয়েছে। সে থম মেরে বসে রয়। মধুমিতার জমিয়ে রাখা আর্তনাদগুলো এই মুহুর্তে কান্নার সাথে বেরিয়ে আসছে। সাদিকা বেগম মধুমিতাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অশ্রুসিক্ত গলায় বলে,
“ আল্লাহ ভরসা মা। এমন করে না। একটু শক্ত থাকো। “
মধুমিতা শান্ত হয় না। বরং তার কান্নার প্রকোপ আরো বাড়ে। পার্থ আফজাল সাহেবের সামনে মাথা নত করে বলে,
“ আব্বা আমি… “
আফজাল সাহেব থমথমে গলায় বলে উঠে,
“ কয়টা গুলি চালিয়েছে ওরা আমার ছেলের শরীরে? “
আফজাল সাহেবের প্রশ্নের পিঠে পার্থর শক্ত খোলস ভেঙে গুড়িয়ে যায়। আচমকাই সে নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে একটা অভাবনীয় কাজ করে। আফজাল সাহেবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। শুধায়,
“ ওকে তো আমি ছোট থাকতেও কোলে তুলেছি আব্বা। তখন তো ওকে আমার ছোট তুলোর টুকরো মনে হতো। কিন্তু আজ ওর ভার এতো কিভাবে হয়ে গেলো? আমি আমার ছোট ভাইয়ের ভার কাধে তুলতে পারবো না আব্বা। কখনোই পারবো না। “
আফজাল সাহেব কোনো জবাব দেয় না। নীরবে নিজেকে পার্থর থেকে ছাড়িয়ে নেয়। এক পা দু পা করে হেঁটে করিডর পেরিয়ে সকলের আড়ালে যেতেই উনার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ব্যথিত স্বরে শুধায়,
“ তুমি আমার গর্ব শোভন। তুমি আমার অহংকার। আব্বাকে ভুল বুঝে যেও না। “
__________
তূর্যর সাথে অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তারদের পাশাপাশি তরীও উপস্থিত আছে। যদিও সে সার্জারি করার অনুমতি পাবে না তবুও সে জোর করে অন্তত নিজের ভাইয়ের পাশে থাকার অনুমতিটুকু নিয়েছে। হুমায়ুন রশীদও পাশের থিয়েটারে শোভনের সাথে আছে।
অপারেশন শুরুর ঠিক আগ মুহুর্তে তরী নিজের ভাইয়ের কপালে চুমু খেয়ে শান্ত গলায় শুধায়,
“ আপি আছি তোর সাথে। কিছু হবে না ভাই। “
কথাটুকু বলতে বলতেই তরীর চোখ দিয়ে এক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। শক্ত মস্তিষ্ক এবং চিত্ত নিয়ে দেখতে থাকে নিজের ভাইয়ের রক্তাক্ত বুকের উপর কাঁটাছেড়া। কিন্তু বেশিক্ষণ সেই দৃশ্য সহ্য করতে পারে না সে। দৌড়ে ওটি হতে বেরিয়ে আসে। ওটির এরিয়া পেরিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়েই দৌড়ে গিয়ে পার্থকে জড়িয়ে ধরে। হু হু করে কেঁদে বলে উঠে,
“ আমার ভাইয়ের বুকে কিভাবে গুলি চালালো অমানুষগুলো? “
পার্থ জবাব দিতে পারে না। একই রক্তক্ষরণ যে তার বুকের ভেতরও হচ্ছে। কি অদ্ভুত লীলা এই দম্পতির জীবনে। সুখের পাশাপাশি এই দুটো মানুষের দুঃখের সমীকরণও সবসময় সমান হয়।
__________
এভার ভিউ রেস্টুরেন্টে চালানো সেই জঙ্গি হামলায় জিম্মি ৪৬ জনের মধ্যে ২৭ জন নিহত হয়েছে। আহতের সংখ্যা ৯ জন। তারা সকলেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে। ১০ জনই কেবল সুস্থ ভাবে সেই ভয়াবহ রাতে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলো। দূর্ভাগ্যবশত আটজন জঙ্গিই নিহত হয়েছে। যাদের মধ্যে ছয়জনই অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরীর দ্বারা শুট হয়েছে। এই খবর ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে গণমাধ্যমে।
বিধ্বংসী সেই রেস্টুরেন্টের মধ্যেই নীরবে দাঁড়িয়ে আছে কালো শার্ট পরিহিত এক সুঠাম দেহী পুরুষ। রেস্টুরেন্টের প্রতিটা দেয়াল এবং ফ্লোরেই মেখে আছে সেই ভয়ানক দিনের রক্তাক্ত স্মৃতি চিহ্ন। সেরকমই এক দেয়ালে শরীরের লাল রঙের তরল পদার্থ দ্বারা লেখা একটা লাইন মনে মনে আওড়ায় সে।
“ দিজ ইজ জাস্ট দ্যা বিগিনিং। “
সেই পুরুষের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুলিশ অফিসার বলে উঠে,
“ সম্পূর্ণ ঘটনা থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছে যে এই হামলা শুধুমাত্র একটা ডেমো ছিলো। সাধারণ মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি করাই এই সংঘের মূল লক্ষ্য ছিলো। “
সেই পুরুষ মুখ ফুটে কিছু বলে না। পুলিশ অফিসার আবার বলে উঠে,
“ তদন্ত চলছে। শীঘ্রই এই ব্যাপারে আমরা কোনো না কোনো তথ্য খুঁজে পাবো। “
প্যান্টের দুই পকেটে হাত গুজে রাখা সেই পুরুষ বেশ শান্ত ভঙ্গিতে পিছু ফিরে মৃদু কটাক্ষ করে জবাব দেয়,
“ নিজেদের মূল্যবান সময় অযথা নষ্ট করবেন না। এই কেস এখন আর আপনাদের মাথা ব্যথা নয়। “
কথাটা বলেই সেই পুরুষ ধীর পায়ে হেঁটে রেস্টুরেন্ট হতে বেরিয়ে যায়। রেস্টুরেন্টের বাহিরে এসেই সে একজনকে আদেশের সুরে বলে উঠে,
“ অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরীর কাছে এই খামটা পৌঁছে দিবে। “
“ কিন্তু স্যার উনার কালকে মাত্র সার্জারি হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফিরে নি। বাঁচবে কিনা সন্দেহ। “
হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একবার সময়টা দেখে নিয়ে সেই কালো শার্ট পরিহিত পুরুষ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,
“ হি উইল গেট ওয়েল সুন। “
__________
পড়ন্ত বিকেলের মিঠে আলো ছড়িয়ে পড়েছে শহর জুড়ে। ঘন্টা খানেক আগে শোভনের জ্ঞান ফিরেছে। আইসিইউর ভেতর একসাথে অনেকজনের প্রবেশ করে দেখা করার অনুমতি নেই। যেকোনো একজনই কেবল দেখা করার সুযোগ পাবে। শোভন আশা করছিলো হয়তো মধু কিংবা আম্মা সবার আগে তার সাথে দেখা করতে আসবে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আইসিইউর দরজা দিয়ে আফজাল সাহেব প্রবেশ করেন।
আহত শোভন নীরব চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে উনার দিকে। একদিনেই আফজাল সাহেবের কঠিন চেহারা ভেঙে বেশ অন্যরকম দেখাচ্ছে উনাকে। আফজাল সাহেব শোভনের পাশে এসে দাঁড়ায়। গতকাল থেকে যেই ছেলের জন্য উনার অন্তর পুড়ছিলো এখন তার সামনেই উনার মধ্যে বেশ জড়তা কাজ করছে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও উনি বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলেন না।
অক্সিজেন মাস্কের মাধ্যমে কৃত্রিম অক্সিজেন নেওয়া শোভন নিজেই বেশ ভাঙা গলায় ডাকে,
“ আব্বা? “
আফজাল সাহেব উদ্বেগ নিয়ে জবাব দেয়,
“ হ্যাঁ বাবা। “
শোভন আদো হেসে শুধায়,
“ ভালো আছেন? “
ছেলের এই ছোট প্রশ্ন শুনে আফজাল সাহেব আবেগী হয়ে পড়ে। মৃত্যু শয্যায় শুয়ে থেকেও তার ছেলে নিজেকে ছেড়ে নিজের বাবার কথা চিন্তা করছে। এই ছোট বিষয়টাও আফজাল সাহেবের হৃদয় কাঁপিয়ে তুললো। তিনি বেশ রাশভারী গলায় কাঠিন্য বজায় রেখে বলে উঠে,
“ তাড়াতাড়ি সুস্থ হও বাঁদর ছেলে। বাপ হতে যাচ্ছো অথচ তোমার মাঝে বাপ হওয়ার কোনো লক্ষ্মণ নেই। আক্কেল বুদ্ধি এখনো হাঁটুর নিচেই তোমার। “
আফজাল সাহেবের মিছে রাগ দেখে শোভন মনে মনে হাসে। মুখশ্রী খুব নিষ্পাপ সেজে প্রশ্ন করে,
“ বাপ হওয়ার লক্ষ্মণগুলো কি আব্বা? “
এরকম একটা পরিস্থিতিতেও ছেলের রসিকতা দেখে এইবার আফজাল সাহেবও নিঃশব্দে হেসে উঠে। জড়তা ভুলে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠে,
“ সন্তানরা নাকি পিতার পরিচয়ে পরিচিত হয়। কিন্তু আমার কি সৌভাগ্য দেখো। আমি আমার সন্তানদের পরিচয়ে পরিচিত। রাস্তায় হাঁটার সময় সবাই এখন আমাকে দেখলে বলবে, ওইযে শোভনের আব্বা যাচ্ছে। ছয়জন টেরোরিস্টকে একা হাতে দমন করা শোভনের আব্বা উনি। গর্বে তখন আমার বুক ফুলে উঠবে। আমার কথাকে উপেক্ষা করে বিপদ দেখে না পালানোর জন্য আ’ম প্রাউড অফ ইউ। “
আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে শোভনের চোখ বেয়ে। ছোটবেলা থেকে সে এই একটা কথা শোনার জন্যই সবসময় মুখিয়ে থাকতো। গতকাল রাতে টেরোরিস্ট ইনকাউন্টারে মারা গেলে তার বহু আফসোস বুকে নিয়ে মরতে হতো। এসব ভাবনার মাঝেই আচমকা শোভন প্রশ্ন করে উঠে,
“ আব্বা? তূর্য ভাইয়া কেমন আছেন? “
__________
চব্বিশ ঘন্টার উপর হয়ে গিয়েছে। পৃথা চুপচাপ হসপিটালে আইসিইউর সামনে করিডরে বসে আছে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় কেউ তাকে জোর করেও বাড়ি নিয়ে যেতে পারে নি। সাদিকা বেগম বাধ্য হয়েই বেশ কয়েকবার মেয়েকে ধমকাধমকিও করেছেন। এমন তো না যে পৃথা এখানে থাকলে তূর্য সুস্থ হয়ে যাবে। উল্টো তারিণী মা কে না পেয়ে বাসায় উপোষ আছে। সাতদিনের বাচ্চাটা মাতৃদুগ্ধ ছাড়া আর কি-ই বা খাবে? কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে তরী এবং পার্থ বাসায় গিয়ে জমিলা খালার কাছ থেকে তারিণীকে হসপিটালে নিয়ে আসে।
পৃথা কেবল সময় হলে একটা নীরব কেবিনে মেয়েকে নিয়ে ফিড করে অত:পর আবার আইসিইউর সামনে এসে বসে থাকে। শোভনের জ্ঞান ফেরায় সে খুব খুশি। কিন্তু তার সেই খুশি চাপা পড়ে আছে তূর্যর প্রতি চিন্তার আড়ালে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় তিনটি বুলেটের একটি বুলেটও তূর্যর হৃৎপিণ্ড ভেদ করে যায় নি। তবুও জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত ডাক্তাররা সম্পূর্ণ আশংকামুক্ত ঘোষণা করতে পারছে না। অবশেষে ৩৬ ঘন্টা পরে পৃথার সেই দুঃশ্চিন্তার অবসান ঘটে। আইসিইউ হতে একজন ডাক্তার এসে জানায় তূর্যর জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু এখন ভিতরে প্রবেশের অনুমতি নেই কারো। পৃথার ছোট্ট মন অস্থির হয়ে আছে তূর্যকে দেখার জন্য। তরী তার উৎকণ্ঠা বুঝতে পেরে পৃথাকে সাথে করে আইসিইউ এরিয়ার ভেতর নিয়ে যায়। আইসিইউ রুমে প্রবেশ করার সুযোগ না পেলেও রুমের বাহির থেকে বিশাল স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে পৃথা তূর্যকে দেখতে পায়। তরী পৃথাকে একান্তে রেখে অন্যদিকে চলে যায়।
নিজের শুভ্র একটা হাত কাঁচের উপর রেখে পৃথা দু চোখ ভরে দেখতে থাকে ভিতরে বেডে শুয়ে থাকা মানুষটাকে। কিছুক্ষণ আগেও এই মানুষটাকে হারানোর ভয় তাকে কুড়ে খাচ্ছিলো। কি নিদারুণ সেই ভয়! পলকেই মনে হচ্ছিলো পৃথার এতো প্রাপ্তির শেষ অংকে একটা বিশাল শূন্য বসবে। তার একশো বছরের পথচলার স্বপ্ন বুঝি এই ফুরিয়ে এলো। এসব ভাবতে ভাবতেই পৃথার কান্না পেলো। ঠিক সেই মুহুর্তে তূর্যর ক্লান্ত চোখ জোড়া এসে পৃথার দিকে নিবদ্ধ হয়। সেই দৃষ্টি পৃথার হৃদয়ে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। পৃথা ফুপিয়ে কান্না করে উঠে। দূর হতে তূর্য এই দৃশ্য দেখে চোখ বুজে নেয়। এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করে সে। পৃথা নামক এই মেয়েটা তার ভালোবাসায় ভীষণ ভাবে আহত। এই আহত মেয়েটার ভালোবাসায় সে-ও ভীষণ ভাবে আহত।
__________
ক্যালেন্ডারে কাটা পড়েছে সাতটি বছর। হিমশীতল ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করছে প্রকৃতিতে। ঢাকার কোনো এক বিশাল সড়কে জনমানবের বিশাল ভীড়। সকলেই একসঙ্গে সমাগম করে অংশগ্রহণ করেছে জাতীয় সরকার দলের নেতা পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর সমাবেশে। স্টেজের উপর শুভ্র পাঞ্জাবি এবং কালো শাল গায়ে জড়ানো পুরুষটি বেশ গম্ভীর মুখে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে। মুখ জুড়ে তার ঘন কালো দাঁড়ি। কথার গাম্ভীর্যের সাথে তার মুখভাব বেশ মানানসই।
পার্থর ভাষণে ভাটা পড়ে আচমকা তার কানের কাছে বলা আসিফের কথায়। আসিফ আতংকিত গলায় শুধায়,
“ ভাই, আপনার হোম মিনিস্টার হাফ সেঞ্চুরি বার কল দিয়া ফেলসে। “
কথাটা শুনতেই পার্থর বুক কেঁপে উঠে। ডাক্তার তাকে এতো বার কল করেছে কেন? পার্থ বাকি ভাষণটুকু বেশ সংক্ষেপে শেষ করেই দ্রুত গিয়ে নিজের ফোন হাতে নেয়। হাফ সেঞ্চুরি ক্রস করে মিসড কলের সংখ্যা এখন সত্তরের ঘরে গিয়ে ঠেকেছে। পার্থ একটা ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নেয়। সাথে সাথে আবার তার ফোন বেজে উঠে। পার্থ কল রিসিভ করে কানে ধরতেই অপরপ্রান্ত হতে তীক্ষ্ণ নারী স্বর ভেসে আসে।
“ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী, বক্তৃতা শেষ হলে এখনই নিজের ছেলের স্কুলে যাও। আমার আধঘন্টা পর খুব ইম্পোরট্যান্ট একটা সার্জারি আছে। হাতে সময় নেই। “
পার্থ মিনমিনে গলায় শুধায়,
“ এখনো তো ওর ছুটি হতে সময় আছে। আর ছুটি হলে আব্বাই তো ওকে আনতে যাবে। আমি শুধু শুধু গিয়ে কি করবো? “
তরী কটাক্ষ করে বলে,
“ আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে সে আপনার ছেলে। ঘরে সারাদিন তুফান সেজে ঘুরে বেড়িয়ে আপনার ছেলের শান্তি হয়নি, এখন স্কুলেও ওর তুফান এক্সপ্রেস চালু হয়ে গিয়েছে। ফর্ম মাস্টার কল করে বলেছে আপনার ছেলের নামে নালিশ আছে। সেই নালিশ শুনতেই যাবেন আপনি। “
এতটুকু বলেই তরী ফোন কেটে দেয়। পার্থ অসহায় ভঙ্গিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে আসিফকে ডাকে। আসিফ কাছে আসতেই বলে,
“ আমি প্রসূনের স্কুলে যাচ্ছি। তোরা এদিকটা সামলে নিস। “
__________
টিচার্স রুমে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে আছে পার্থ এবং প্রসূন। তাদের সামনেই টেবিলের অপরপাশে বসে আছে প্রসূনের ফর্ম মাস্টার জহিরুল ইসলাম। পার্থ ফিসফিসিয়ে ছেলের কানের কাছে প্রশ্ন করে,
“ আবার কি করেছিস বাপ? “
প্রসূন এমন একটা ভাব নিয়ে তাকায় যেন সে ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না। ছেলের এমন নিষ্পাপ মুখশ্রী দেখে পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার এই নিষ্পাপ দেখতে বাচ্চা যে একাই সবার নাকে দম করার জন্য যথেষ্ট তা সে বেশ ভালো করেই জানে। তাই অযথা সময় নষ্ট না করে সে সোজা ফর্ম মাস্টারকে প্রশ্ন করে,
“ শুনলাম প্রসূনকে নিয়ে নাকি আপনার কমপ্লেইন আছে। কি করেছে আমার ছেলে? “
জহিরুল সাহেব মাথা নেড়ে বলে উঠে,
“ পার্থ সাহেব, আপনার ছেলে ক্লাসের একটা মেয়েকে গান শুনিয়ে সারাদিন বিরক্ত করে। সেই মেয়ে আমার কাছে কমপ্লেইন করায় আমি প্রসূনের মা’কে কল করতে বাধ্য হয়েছি। “
পার্থ আড়চোখে একবার ছেলের পানে চায়। প্রসূন আপনমনে চুইংগাম চাবাতে ব্যস্ত। পার্থ সামান্য গলা ঝেড়ে বলে উঠে,
“ এটা তো তেমন বড় কোনো বিষয় না। আমার ছেলের গানের গলা ভালো। ফ্রেন্ড হিসেবে গান শুনাতেই পারে। এতে কমপ্লেইনের কি আছে? “
জহিরুল ইসলাম এবার প্রসূনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ প্রসূন, রাইমাকে তুমি যেই গান শুনিয়েছিলে সেই গানটা একটু গাও তো। “
প্রসূন চুইংগাম মুখে রেখেই সাথে সাথে স্পষ্ট গলায় গেয়ে উঠে,
“ সোনা আজ শেষ করো দিন গোনা
বুঝেও কেন বুঝো না
আমি হেব্বি রোম্যান্টিক
আর অল্প ডিমান্ডিং।
রাণী তুমি আর সেজো না ফানি
আমি টানবো তোমার ঘানি
যদি সাচ্চা লাভার হও
আর একটু কেয়ারিং। “
এতদূর শুনেই লজ্জায় পার্থ বিষম খায়। একহাতে ছেলের মুখ চেপে ধরে বলে,
“ থাম বাবা, থাম। “
জহিরুল ইসলাম অসহায় মুখভঙ্গি করে বলে,
“ পার্থ সাহেব, আপনার ভাইয়ের দুই ছেলে-মেয়ে মহুয়া আর সোহানও প্রসূনের সাথে একই ক্লাসে পড়ে। ওরা কি শান্ত, চুপচাপ কিন্তু আপনার ছেলে একাই পুরো ক্লাস মাথায় তুলে রাখে। এরকম হলে কিভাবে চলবে বলুন? “
পার্থ ছেলের প্রতি খুব বিরক্ত অনুভব করে। এই কাহিনী তরীর কানে গেলে তরী ছেলের পাশাপাশি তারও ক্লাস নিবে। রাগী গলায় শুধাবে,
“ নির্লজ্জ বাপের নির্লজ্জ ছেলে। “
সেই দৃশ্য কল্পনা করতেই পার্থর গা শিউরে উঠে।
__________
পূর্ণ চন্দ্রের রজনীতে ছাদে বসে আছে তিন জোড়া যুগল। পৃথার ফাইনাল প্রফ এক্সাম ক্লিয়ার উপলক্ষে সবাই একসাথে চৌধুরী নিবাসে জোড়ো হয়েছে। এতক্ষণ সবাই পরিবারের সাথে নিচেই ছিলো। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়তেই তারা উপরে উঠে এসেছে। গল্প আড্ডার মাঝে মাঝে পৃথা আড়চোখে তূর্যর ভরাট মুখশ্রী পানে তাকায়। তূর্য চোখের ফ্রেমের চশমা ভেদ করে একবার পৃথাকে দেখে নিয়ে ফের আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়ে।
ছয়জনের এই আড্ডা মাতিয়ে রেখেছে শোভন ও মধুমিতা। পার্থ আচমকা হাতের কোল ড্রিংকসের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে পৃথাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
“ এই ভূতনি! অনেকদিন একসাথে গান গাওয়া হয় না। গাইবি? “
পৃথা নিজের অতি মনযোগী দৃষ্টি তূর্যর থেকে ফিরিয়ে পার্থর দিকে তাকায়। ফুসে উঠে বলে,
“ বড় দা! স্টপ কলিং মি দ্যাট। “
শোভন টিপ্পনী কেটে বলে,
“ এহ! তোরে ভূতনি ডাকবো না তাইলে পেত্নী ডাকবো? “
পৃথা চাপা রাগ নিয়ে বলে উঠে,
“ ছোট দা! “
শোভন ও পার্থ প্রাণখোলা হাসি দিয়ে কান ধরে বলে,
“ সরি। চল এখন গান শুরু কর। “
পৃথা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“ কি গান? “
পার্থ গানের নাম বলতেই পৃথা রাজি হয়ে যায়। শোভন বাকি তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ এইযে নন সিংগারের দল। আপনারাও জয়েন করবেন কিন্তু। “
তরী হেসে শুধায়,
“ শিওর দেবরজি। “
ভিন্ন তিন জোড়া। ভিন্ন তাদের গল্প। ভিন্ন তাদের অনুভূতির প্রগাঢ়তা। ভিন্ন তাদের কাছে ভালোবাসার মানে। কারো কাছে ভালোবাসার মানে স্ত্রীর সব পরিস্থিতিতে বুঝতে পারার ক্ষমতা। কারো কাছে ভালোবাসার মানে অষ্টাদশীর অভিমান। কারো কাছে ভালোবাসার মানে প্রেমিকার হাস্যজ্বল মুখশ্রী। সঠিক মানুষের প্রেমের হাওয়া ছুঁয়েছে সকলকেই। সেই হাওয়ায় মত্ত হয়ে প্রকৃতি তাদের উপহার দিয়েছে এক সুন্দর পরিণয়।
নিস্তব্ধ রাত মুখরিত হয় ছয় কণ্ঠের মিলনায়তনে,
“ যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
উড়ে গেলো মন পায়রা গুলো
তাও কেনো দেখেও দেখো নি,
আজ ছুঁয়ে বলো আমাকে তুমি
আনলে কেন এমন সুনামি
দাও মন আমাকে এখুনি।
ও রাত বিরাতে
কোনো মতে ঘুম পাড়াই নিজেকে,
দিন দুপুরে
মাঝ পুকুরে রোজ ডুবায় নিজেকে।
এসেছি তোমাকে জানাতে
এসেছি তোমাকে মানাতে,
ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। “
সমাপ্ত
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]