যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৪৯

0
669

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৯.

উঁচু দেয়াল টপকে তূর্য সবার অগোচরে রেস্টুরেন্টের পিছন দিয়ে বেরিয়ে আসে। আশেপাশে একবার তাকিয়ে সে সাথে সাথে ফোনে সেভ করে রাখা থানার নাম্বারে কল লাগায়। এক দু দফা কল বাজতেই অপরপাশ থেকে কল রিসিভ হয়। তূর্য ব্যস্ত গলায় রেস্টুরেন্টের এড্রেস জানিয়ে পুলিশদের দ্রুত পৌঁছানোর কথা বলে। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখতেই আচমকা রেস্টুরেন্টের ভিতর হতে তীক্ষ্ণ ফায়ারিং এর শব্দ ভেসে আসে। তূর্য হতবুদ্ধি হয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। সেই তীক্ষ্ণ শব্দে রাস্তার কিছুসংখ্যক পথচারীরা ভয়ে আতংকিত হয়ে পড়ে। গাছের ডাল পালায় বসে থাকা পাখিরাও ভীত হয়ে শব্দ তুলে ডানা জাপ্টে উঁড়ে যায়।

তূর্য এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে যেভাবে বেরিয়ে এসেছিলো সেভাবেই দেয়াল টপকে আবার রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে। খুব সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায় রেস্টুরেন্টের পেছনে এক ঝোপঝাড়ের আড়ালে। একতলা রেস্টুরেন্টের চার দেয়ালের মধ্যে দুটি দেয়ালই সম্পূর্ণ কাঁচের। বাকি দুটো ইট পাথরের তৈরী। ঝোপের আড়ালে সতর্ক ভঙ্গিতে লুকিয়ে থাকা তূর্য কাঁচ ভেদ করে ভিতরের দিকে তাকাতেই আতংকিত হলো। পাঁচটে যুবকের একটি দল রেস্টুরেন্টে উপস্থিত সকল মানুষের দিকে বড়ো বড়ো রাইফেল গান তাক করে রেখেছে। আরেকজন যুবক রাইফেল হাতে সকলকে শাসিয়ে ফ্লোরে এককোণে বসার তাগাদা দিচ্ছে। উপস্থিত মানুষ সকলেই ভীত। তারা সেই রাইফেলের ইশারাই মেনে চলছে। দু চারটে বাচ্চাও রয়েছে ভিতরে। তাদের মধ্যে একটা বাচ্চা শব্দ করে কান্না করে উঠতেই একজন রাইফেল ধারী অমানুষ বাচ্চাটাকে হিংস্র গলায় ধমকে তার দিকে রাইফেল তাক করলো। সাথে সাথে বাচ্চাটার মা নিজের মেয়ের মুখ চেপে ধরে নিজের কোলে মিশিয়ে নিলো।

দৃশ্যটা দেখতেই তূর্যর বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠে। ভিতরে কি চলছে এবং সেই যুবক দলের পরিচয় কি হতে পারে তা সে ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছে। তূর্য সতর্ক দৃষ্টি মেলে আরেকবার রেস্টুরেন্টের ভিতরটা দেখে নেয়। কিন্তু শোভনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শোভন কোথায়?

তূর্য আর কিছু ভাবতে পারে না। পিছন থেকে দু জোড়া পায়ের পদচারণের ধ্বনি ভেসে আসে। তূর্য নিজের নিঃশ্বাস আটকে আরেকটু আড়াল হয়ে বসে। দুটো যুবক রাইফেল হাতে চারিদিক ঘুরে দেখছে। এই দুটো যুবক রেস্টুরেন্টের ভিতরের ছয়টি যুবক হতে আলাদা বেশভূষা ধারণ করেছে। ভিতরের যুবকগুলোর মুখশ্রী উন্মুক্ত হলেও এই দুই যুবক নিজেদের মুখের অর্ধাংশ কাপড় দ্বারা ঢেকে রেখেছে। তারা সচেতন দৃষ্টি মেলে চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছে।

তূর্য অপেক্ষা না করে অতি সাবধানে নিজের ফোন বের করে আগে ফোনের ভলিউম কমায়। অত:পর নিজের চ্যানেলের একজনকে ম্যাসেজ করে এখানে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে জানায়। প্রমাণস্বরূপ আড়াল হতে সে কিছু ভিডিও ক্লিপও ধারণ করে সেন্ড করে।

মুহুর্তেই চ্যানেল ২৪ এর মুখ্য হেডলাইন হয়ে যায়, ‘ এই মাত্র পাওয়া খবর – বনানীর সনামধন্য এক রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা। ’ নিউজে টেলিকাস্ট করা হয় তূর্যের পাঠানো ভিডিও ক্লিপটা। তূর্য সুযোগ বুঝে সাথে সাথে নিজের স্থান পরিবর্তন করে ফেলে। ঝোপঝাড়ের আড়াল হতে বেরিয়ে তুলনামূলক আরো নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেয়। মনে মনে দোয়া করছে শোভন যেন ঠিক থাকে। তাদের দু’জনেরই সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু সেজন্য আগে তাকে শোভনকে খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটা বাহিরে বসে থেকে কখনো সম্ভব না। তূর্য চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আশেপাশে নজর বুলিয়ে প্রস্তুত হয় সবার আড়ালে রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশের জন্য।

__________

আসরের আজান পড়েছে অনেকক্ষণ হলো। নামাজ সেড়ে বাড়ির সকলে এই মুহুর্তে লিভিং রুমে বসে গল্প করছে। তরী তারিণীকে কোলে নিয়ে বসে তার সাথে খেলতে ব্যস্ত। আফজাল সাহেব ও হুমায়ুন রশীদও বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় মগ্ন। সাদিকা বেগম নিজের মেয়ে এবং ছোট পুত্রবধূর সাথে গল্প করছেন। এমন সময়ই তড়িঘড়ি করে লিভিং রুমে প্রবেশ করে পার্থ। একহাতে কানে সে ফোন চেপে ধরে রেখেছে। কপাল এবং চোখে ফুটে আছে চিন্তার ছাপ। কারো সাথে কোনো কথা না বলে সে সোজা রিমোট দিয়ে টিভি অন করে নিউজ ২৪ চ্যানেল দেয়। মুহুর্তেই টিভি হতে সংবাদ পাঠিকার পাঠ করা নিউজ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

“ আজ বিকেলে পাওয়া খবর, বনানীর এভার ভিউ রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়েছে জঙ্গি বাহিনী। বিকাল ৪ টা বেজে ৪৫ মিনিটে আচমকা গান ফায়ারিং এর শব্দে কেঁপে উঠে স্থানীয়রা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। আমাদের নিউজ ২৪ চ্যানেলের ক্রাইম বিষয়ক সাংবাদিক তূর্য রশীদ সেই রেস্টুরেন্টের ভেতরের পরিস্থিতির একটা ভিডিও ক্লিপ দ্বারা আমাদের এই জঙ্গি হামলা পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত করেন। “

এতটুকু শুনতেই পৃথা আর্তনাদ করে উঠে। আকস্মিক এরকম একটা ভয়ানক খবরে শিউরে উঠে উপস্থিত সকলে। কেউ কিছু বলবে তার আগেই মধুমিতা ভয়ার্ত গলায় বলে উঠে,

“ শোভন! শোভন আর তূর্য ভাইয়া ওই রেস্টুরেন্টে আছে। “

মুহুর্তেই এক লণ্ডভণ্ড করা ঘূর্ণিঝড় এলোমেলো করে দিয়ে গেলো একঝাঁক হাস্যজ্বল মুখ। পার্থ অপেক্ষা না করে সাথে সাথে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। হুমায়ুন রশীদ এবং আফজাল সাহেবও উঠে তার সাথে আসতে নিলে পার্থ চিন্তিত গলায় বলে,

“ আপনারা বাসায় থাকুন। আমি যাচ্ছি। দোয়া করুন সবাই। আল্লাহ ভরসা কিছু হবে না। “

বলেই পার্থ বেরিয়ে যেতে নিলে তার হাতে টান অনুভব করে। পিছু ফিরে দেখে তরী করুণ দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

“ আমার দুই ভাইকে সহি সালামতে নিয়ে ফিরবে। অপেক্ষায় থাকবো। “

সবসময় জনগণকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেড়ানো পার্থ তরীকে আশ্বাস দেওয়ার জন্য শব্দ খুঁজে পেলো না। খুব মৃদু গলায় বললো,

“ আমি ফেরার আগ পর্যন্ত সবার খেয়াল রেখো। “

এই সামান্য একটা বাক্যের ভার যে কতটুকু তা তরী টের পেলো পার্থ বেরিয়ে যাওয়ার পর। আফজাল সাহেব এবং হুমায়ুন রশীদ উপরে নিজেদের শক্ত দেখালেও তাদের ভেতর কি চলছে তা আন্দাজ করার সাধ্যি কারো নেই। পৃথা ইতিমধ্যে শব্দ করে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। তার কান্নার শব্দে তারিণীও গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে কান্না করে যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাটা কি খিদেয় কান্না করছে না নিজের মায়ের কষ্ট এবং বাবার অনুপস্থিতি টের পেয়ে কান্না করছে তা বুঝা যাচ্ছে না। সাদিকা বেগম মেয়েকে ছেড়ে নাতনির কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।

তরী অসহায় চোখে চারিদিকে সবাইকে দেখে নিয়ে শেষে মধুর দিকে তাকায়। রুমের এককোণে সোফায় নীরবে বসে থাকা মধু বারবার ফোনে কারো নাম্বারে কল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে। তরীর নিজেকে অসহায় লাগছে। সে কার খেয়াল রাখবে? কিভাবে রাখবে? এই পরিস্থিতিতে সে কি-ই বা বলে এই মানুষগুলোকে ভরসা জোগাবে? তার নিজেরও ভেতরটা গুমরে উঠছে। তার ছোট ভাই কেমন আছে? কি করছে? ঠিকঠাক বাড়ি ফিরতে পারবে তো?

তরীর ভাবনার মাঝেই জমিলা খালা চিৎকার করে উঠলো,

“ ও ছোডো বউ! আল্লাহ! ছোডো বউর কি হইসে? “

জমিলা খালার চিৎকার শুনে এবং সোফায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা মধুমিতাকে দেখে তরীর টনক নড়লো। সে দ্রুত মধুমিতার কাছে এগিয়ে গেলো। আফজাল সাহেব চিন্তিত গলায় বলেন,

“ আম্মু? মধুমিতাকে হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে? গাড়ি বের করবো? “

তরী উত্তর দেয়,

“ না আব্বা। লাগবে না। জমিলা খালা প্লিজ এক গ্লাস পানি নিয়ে আসেন। “

জমিলা খালা তড়িৎ গতিতে পানি নিয়ে এসে হাজির হতেই তরী কিছু পানি নিয়ে মধুর মুখে হালকা করে ছিটিয়ে দেয়। দু তিনবার আলতো করে তার গালে চাপড় মেরে তার নাম ধরে ডাকে। অতি দুশ্চিন্তায় চেতনা হারানো মধু পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। সাথে সাথে তার চোখ গলে পড়ে কয়েক বিন্দু অশ্রু। মধু দূর্বল গলায় বলে,

“ শোভনকে ফিরতে বলুন ভাবী। ওর বাচ্চা পৃথিবীতে আসার আগেই যেনো এতিম না হয়ে যায়। “

মধুর কথার অর্থ বুঝতে পেরেই সকলে বিস্মিত হলো। এতক্ষণ শক্ত হাতে নাতনিকে সামলানো সাদিকা বেগমও এই মুহুর্তে ভেঙে পড়লেন। কান্না জর্জরিত গলায় বললেন,

“ পার্থর আব্বা ছেলে দুইটারে ফিরিয়ে আনেন। নাতি নাতনিদের মাথার উপর থেকে যেনো বাপের ছায়া দূর না হয়। “

__________

ঘাড়ের নিচের অংশে রাইফেল দ্বারা আঘাত করতেই তূর্য হাঁটু ভেঙে আর্তনাদ করে বসে পড়লো। তার অবস্থা দেখে ভয়ে গুটিসুটি মেরে চুপ করে রইলো সকল জিম্মিরা। আঘাত করার সাথে সাথেই তূর্যর ঘাড় বেয়ে তরল রক্ত পড়তে শুরু হলো। একজন জঙ্গি তূর্যকে আরেকবার আঘাত করে বলে উঠে,

“ জানোয়ারের বাচ্চা আমাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারবি ভাবসিলি? আমাদের ভিডিও করে নিউজ টেলিকাস্ট করস? “

বলেই তূর্যর চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে সামান্য মুখ উঁচু করে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,

“ তোর কি মনে হয় আমরা এসবে ভয় পাই? আমাদের কোনো মৃত্যু ভয় নাই। “

সেই জঙ্গির কথা শেষ হতে না হতেই তূর্য তার মুখ বরাবর থুথু ছুড়ে মারে। তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,

“ কি উদ্দেশ্যে সবাইকে জিম্মি করেছিস? “

সেই জঙ্গি রাগে কিছু বলবে তার আগেই বাহির হতে আরেকজন জঙ্গি এসে চেঁচিয়ে বলে,

“ পুলিশ ভিতরে আসার চেষ্টা করছে। “

কথাটুকু শেষ হতেই সেই যুবক দল হতে দুজন রাইফেল হাতে বেরিয়ে যায়। কিছু মুহুর্তের ব্যবধানেই ছন্দপতন হয় বাহির থেকে ভেসে আসা গুলি এবং গ্রেনেডের শব্দে। এই সুযোগেই জিম্মিদের মধ্যে হতে একজন পুরুষ ঝাপিয়ে পড়ে একজন রাইফেল ধারী যুবকের উপর। শুরু হয় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি। সেই ধস্তাধস্তির ইতি ঘটে রাইফেল হতে ছোঁড়া বুলেটের শব্দে। মুহুর্তেই সেই জিম্মি পুরুষ লুটিয়ে পড়ে ফ্লোরে। তার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা রক্তে মাখামাখি হয়ে যায় সমস্ত ফ্লোর। ক্ষোভে ফেটে পড়া সেই জঙ্গি একটা গুলি করেই ক্ষান্ত হয় নি। আরো বেশ কয়েকটা গুলি ছুড়ে সেই লোকের নিথর দেহে। চোখের পলকেই একজন জিম্মি মৃত্যু বরণ করেন।

চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনার ভয়াবহতায় সকল জিম্মিরা আর্তনাদ করে উঠলো। রাইফেল ধারী যুবকরা আবার রাইফেল তাক করে সকলকে শাসিয়ে বললো,

“ যার মুখ থেকে একটা শব্দ হবে তাকে খুন করে ফেলবো। “

সাথে সাথে সকলে চুপ বনে গেলো। তূর্য চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখছে। ঘাড়ের আঘাতপ্রাপ্ত যেই জায়গা হতে রক্ত বের হচ্ছে সেই জায়গায় প্রচুর যন্ত্রণা অনুভব করছে। হঠাৎ সে দেখতে পায় ওয়াশরুম হতে একজন জঙ্গি বেরিয়ে আসছে। তার হাতে থাকা রাইফেলটা তাক করা সামনে হেঁটে আসা আরেক ব্যক্তির দিকে। সেই ব্যক্তি এগিয়ে আসতে আসতে তূর্যর দিকে আহত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়। অত:পর চোখ ফিরিয়ে এক বন্দুকধারী জঙ্গিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ শান্ত আরেফিন। গত এক বছর ধরে তুমি নিখোঁজ ছিলে। তোমার পরিবার হন্য হয়ে তোমাকে খুঁজছে। আমি জানিনা গত এক বছর তুমি কোথায় ছিলে কিংবা কার আদেশে এসব করছো। কিন্তু তুমি যা করছো তা ভুল। নিরপরাধ মানুষদের যেতে দাও। “

শোভনের থমথমে গলায় বলা কথায় শান্তর মাঝে কোনো ভাবান্তর হলো না। সে কিছুক্ষণ চুপ রইলো। অত:পর কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ধীর গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমার পরিবার কেমন আছে? “

শোভন মৃদু হাসে। এই আটজন জঙ্গির মধ্যে চারজনেই হলো তার মিসিং এইট কেসের নিখোঁজ যুবকেরা। শান্ত আরেফিন, রফিকুল আসাদ রাফি, তামিম রহমান, মাহদী তাওসিফ। বাকি চারজনকে সে চিনেনা। এই চারজনের মধ্যে শান্ত নামক ছেলেটার মধ্যেই সে তেমন একটা হিংস্রতা লক্ষ্য করে নি। তাই ইচ্ছে করে তাকে উদ্দেশ্য করেই সে এই প্রস্তাবটা রেখেছে। শান্তর প্রশ্নের জবাবে সে বলে,

“ তোমার অপেক্ষায় আছে। ঠিক যেমন এই জিম্মিদের পরিবার তাদের অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে একইভাবে তোমার পরিবারও তোমার অপেক্ষায় আছে। সবাইকে যেতে দাও। এসবের পিছনে কে দায়ী আমাকে জানাও। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে তোমার পরিবারের সাথে দেখা করিয়ে দিবো। “

শান্তর দৃষ্টি এলোমেলো হয়। পরিবারের সাথে দেখা করার প্রস্তাবে মন কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়ে। সেই সময়ই পিছন থেকে মাহদী বলে উঠে,

“ এই অফিসার তোকে ভোলানোর চেষ্টা করছে শান্ত। আমাদের কোনো পরিবার নেই, কোনো পিছুটান নেই। “

শান্তর দৃষ্টি বদলে যায় মুহুর্তে। সে শোভনের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। শোভন আশাহত হয়। তাকে ঘাড় ধরে তূর্যর পাশে হাঁটু ভেঙে বসানো হয়। শোভন ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আপনাকে ফিরে আসতে নিষেধ করেছিলাম ভাই৷ কেন ফিরে আসলেন? “

তূর্য ধীর গলায় বলে,

“ আজকে যদি আমরা ফিরি তাহলে একসাথে ফিরবো শোভন। নাহয় একসাথে শহীদের মর্যাদা লাভ করবো। “

__________

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। রেস্টুরেন্টের ভিতরের পরিস্থিতি সকলের অজানা। এক দল পুলিশ বাহিনী ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। উল্টো তিনজন পুলিশ জঙ্গিদের সাথে গোলাগুলিতে নিহত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাসাধ্য চেষ্টা করছে অন্তত কোনো চুক্তির বিনিময়ে হলেও যেনো জিম্মিদের উদ্ধার করা যায়। কিন্তু জঙ্গি বাহিনীরা যেনো কোনো চুক্তি করতে রাজি নয়। না কাউকে ছাড়তে আগ্রহী। ইতিমধ্যে এই হামলার খবর ছড়িয়ে পড়েছে দেশী, বিদেশী গণমাধ্যমে। সকলের কেবল একটাই প্রশ্ন। এই হামলার পিছনে আসল মাস্টারমাইন্ড কে?

বনানী এলাকার সড়ক গুলোতে সকল প্রকার চলাচল ইতিমধ্যে নিষেধ করা হয়েছে। পার্থ নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে বনানীতে সেই রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে পারে নি। তবে উদ্ধার অভিযান পরিকল্পনাকারী বাহিনীর সাথে সে যোগাযোগ করেছে। সতর্ক করে বলেছে যেকোনো মূল্যে যেনো অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরী এবং জার্নালিস্ট তূর্য রশীদকে যেনো সুস্থভাবে উদ্ধার করা হয়। পাশাপাশি সকল জিম্মিদেরও যেনো উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের এই অভিযান ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর হাতে সমর্পণ করা হয়েছে। ঘটনা স্থলে পৌঁছেছে সেনাবাহিনীর এক বিশেষ দল। সেই দলের মেজরের নেতৃত্বে শুরু হয় উদ্ধার অপারেশন। রাত ৯ টা ১০ বাজে সেনাবাহিনীর দল পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট ঘেরাও করে নেয়।

__________

সেনাবাহিনীর উপস্থিতি টের পেতেই জঙ্গিরা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। মুহুর্তেই রেস্টুরেন্টের ভেতর রণক্ষেত্র শুরু হয়। জঙ্গিরা এলোমেলো ভাবে সকল জিম্মিদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। পরিস্থিতি বিগড়ে যেতেই শোভন সুযোগ নেয়। খুব কৌশলে একজন জঙ্গিকে আহত করে তার রাইফেল তুলে নেয়। তূর্যও পরিস্থিতি দেখে নিজেকে বাঁচানোর জন্য একটা সোফার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। সেখান থেকে সে দেখতে পায় গুলিবর্ষণে এক নিহত মহিলার বুকের উপর একটা চার বছরের বাচ্চা মেয়ে পড়ে কান্না করছে। জঙ্গিদের একজন সেই বাচ্চার দিকে রাইফেল তাক করতেই তূর্য দ্রুত গতিতে সোফার আড়াল থেকে বেরিয়ে বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে যায়। সেই জঙ্গি গুলি ছোঁড়ার আগ মুহুর্তেই শোভন পিছন থেকে তার পিঠে শুট করে। সেই সুযোগ তূর্যও বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে সাথে সাথে সেখান থেকে সড়ে যায়। গুলিবর্ষণের তীক্ষ্ণ শব্দ চিড়ে শোভন চিৎকার করে বলে উঠে,

“ ভাইয়া আপনি বাচ্চাটাকে নিয়ে বেরিয়ে যান। আমি আসছি। “

তূর্য শোভনের কথা শুনেও তাকে ছেড়ে যেতে মন সায় দেয় না। তবে কোলে থাকা বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে তার মায়া লাগে। এই মুহুর্তে এখানে এক মুহুর্তেরও জীবনের নিশ্চয়তা নেই। বাচ্চাটাকে বাঁচানোর চিন্তাও তার মাথায় ঘুরছে। সে ছলছল চোখে একপলক শোভনের দিকে তাকিয়ে থেকে সাথে সাথে ওয়াশরুমের দিকে দৌড়ে চলে যায়।

শোভন তূর্যকে যেতে দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সাথে সাথে সে একটা পিলারের পিছনে আড়াল হয়ে ফের জঙ্গিদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়া শুরু করে। এসবের মাঝে সে সুযোগ বুঝে একপাশের বিশাল গ্লাসেও কয়েকবার শুট করে গ্লাস ভেঙে দেয় যেনো জিম্মিরা সেখান দিয়ে পালাতে পারে। তার এই বুদ্ধি কাজে দেয়। বেশ কিছু জিম্মিই সুযোগ বুঝে ভাঙা কাঁচের দেয়ালের একপাশ দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আর মাত্র দুজন জঙ্গি জীবিত আছে। তাদের মধ্যে একজন হলো শান্ত। সেনাবাহিনীও ইতিমধ্যে এগিয়ে এসেছে। সেনাবাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখে তাদের মধ্যে একজন জঙ্গি দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে দৌঁড়ে যায়।

শান্তকে ওয়াশরুমের দিকে যেতে দেখেই শোভনের বুক কেঁপে উঠে। তূর্য না ওয়াশরুমের দিকে গিয়েছে? শান্তকে বাঁধা দেওয়ার জন্য শোভন শুট করতে নেয়। কিন্তু সাথে সাথে সে উপলব্ধি করে রাইফেলে আর কোনো বুলেট নেই। তাই সে বাধ্য হয়ে রাইফেল হাত থেকে ফেলেই শান্তর পিছু ছুটে। ঠিক সেই মুহুর্তে পিছন হতে আরেকজন জঙ্গি শোভনের পিঠে শুট করে। শোভনের পা থেমে যায়। সে টালমাটাল পায়ে পিছনে ফিরতেই সেই জঙ্গি আবার তার বুকে শুট করে। ঠিক সেই মুহুর্তে সেনাবাহিনী ভিতরে প্রবেশ করে সেই জঙ্গিকে শুট করে। শরীরে দুটি বুলেটের অস্তিত্ব নিয়ে শোভন অসাড় দেহ নিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠে অসংখ্য স্মৃতি। চোখজোড়া বুজে ফেলার আগেই অস্ফুটে বলে উঠে,

“ এখন কি আপনি আমার প্রতি গর্ববোধ করবেন আব্বা? “

__________

ওয়াশরুমের উপরে এককোণে ছোট একটা কঁচের জানালা ছিলো। একটা ছোট বাচ্চা চাইলে অনায়াসেই সেদিক দিয়ে বের হতে পারবে। তূর্য কোলের বাচ্চা মেয়েটার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে,

“ দোয়া করছি এই দিনটা যেনো তোমার স্মৃতির পাতা থেকে যেনো মুছে যায়। “

বাচ্চাটা ইতিমধ্যে কান্না থামিয়ে তূর্যর দিকে ফোলা ফোলা চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। তূর্য আর অপেক্ষা না করে খুব সাবধানতার সহিত বাচ্চাটাকে সেই জানালা দিয়ে বের করে দেয় এবং ভেতর থেকে জানালাটা আটকে দেয়ালে পিঠ হেলান দিয়ে চোখ বুজে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। ঠিক সেই মুহুর্তে ওয়াশরুমের দরজাটা শব্দ তুলে খুলে যায়। শান্ত হিংস্র চোখে একপলক তূর্যকে দেখে। অত:পর কিছু বুঝে উঠার আগেই তূর্যর দিকে রাইফেল তাক করে শুট করা শুরু করে। রাইফেলে অবশিষ্ট শেষ চারটা বুলেটের মধ্যে তিনটা বুলেট তূর্যর বুকে চালাতেই সে অবশিষ্ট শেষ একটা বুলেট নিজের মাথায় তাক করে। আজ রাতে আর যাই হোক সে অন্য কারো হাতে মরতে রাজি না। এই ভাবনা নিয়েই শেষ বুলেটটা নিজের মাথায় শুট করে সে।

ওয়াশরুমের সিঙ্কের পাশের দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়ে তূর্য। বুকটা যেনো ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। প্রাণপ্রদীপ নিভু নিভু প্রায়। সাদা পাঞ্জাবিটা ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ রক্তে লাল রঙ ধারণ করেছে। তূর্য কাঁপা কাঁপা হাতে প্যান্টের পকেট হতে নিজের ফোনটা বের করে। কল লিস্ট হতে মিস এ বি সি লেখা নাম্বারটা ডায়াল করে ফোন কানে চেপে ধরতেই চোখ বুজে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নেয়।
অল্প মুহুর্তেই অপর পাশ হতে ফোনটা রিসিভ হয়। ভেসে আসে পৃথার কান্না মিশ্রিত স্বর,

“ তূর্য? ঠিক আছেন আপনি? ছোট দা? ছোট দা ঠিক আছে? “

পৃথা একদমে আরো অসংখ্য প্রশ্ন করে যেতে থাকে। তূর্য চোখ বুজে রেখেই মৃদু হাসে। মরণ যন্ত্রণা কমে গেলো নাকি হঠাৎ করে? পৃথার লাগাতার প্রশ্নের ভীড়েই তূর্য রুদ্ধস্বরে বলে উঠে,

“ বলো তো মেয়ে। তুমি প্রেমিকা হতে চাও নাকি স্ত্রী? “

পৃথার প্রশ্নের ঝুলি থেমে যায়। তার মনে পড়ে যায় তাদের প্রথম দিনের ফোনালাপ। এই মুহুর্তে এই রুমে সে আর তারিণী একা। সবাই চেতনা হারানো মধুমিতাকে নিয়ে ব্যস্ত নিচে। পৃথা হিচকি তুলে কাঁদছে। কান্নার দমকে তার শরীর কেঁপে উঠছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা তারিণীও কাদছে। পৃথা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলে উঠে,

“ স্ত্রী। সম্পূর্ণ অধিকার সমেত স্ত্রী। “

পৃথার বলা কথাটা তূর্যর কানে পৌঁছালো নাকি বুঝা গেলো না। তার কানে চেপে ধরা ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়। চোখ বুজে আসে শান্ত ভঙ্গিতে। নিথর দেহের উপরের অংশ হেলে পড়ে একদিকে। রক্তে মাখামাখি অবস্থায় পড়ে থাকা ফোনের অপরপাশ হতে ভেসে আসছে তারিণীর কান্নার স্বর এবং পৃথার চিৎকার,

“ আমি আপনার স্ত্রী হতে চাই তূর্য। শুধু আপনার স্ত্রী। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে