যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৭.
বছর ঘুরে আবার এসেছে শীতকাল। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে ঢাকা শহর। ফাইনাল এক্সাম দিয়ে সবেমাত্র ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে মধুমিতা। সাথে সাথে তার চোখে পড়লো একজন হাওয়াই মিঠাই ওয়ালাকে। মধু মনে মনে বেশ খুশি হলো। এতক্ষণ ধরে তার মিষ্টি কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। মনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে মধুমিতা একটা গোলাপি রঙা হাওয়াই মিঠাই কিনে নিলো। অত:পর টিএসসি চত্ত্বরের একপাশে বসে সে রাস্তার দিকে দৃষ্টিপাত করে হাওয়াই মিঠাই খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
এরকমই কোনো এক শীতের বিকেলে তার আর শোভনের প্রথম দেখা হয়েছিলো। ঠিক তার ভার্সিটির সামনেই। কিছুদিন যেতেই মধু লক্ষ্য করে শোভন নামক এই ছেলেটাকে প্রায়শই তার ভার্সিটি এরিয়া তে দেখা যায়। প্রথম প্রথম মধুমিতা দেখেও না দেখার ভান করে হলে ফিরে যেতো। কিন্তু একদিন সে সাহস নিয়ে শোভনের মুখোমুখি হয়। কপট রাগ দেখিয়ে প্রশ্ন করে,
“ কি চাই? “
শোভনের অকপটে জবাব,
“ তোমাকে চাই। নিজের ঘরের বউ হিসেবে। “
লোকটার এমন লাগামহীন কথায় মধু সেদিন বিরক্ত হয়। রাগ নিয়ে বলে,
“ এই ছেলে? কি মনে করো নিজেকে? কোন সিনেমা দেখে এসে এসব ফিল্মি ডায়লগ ছাড়ছো? “
“ আমি বড় হয়েছি কেবল একজনের সিনেমা দেখেই। দেব দা। শিরায় শিরায় রক্ত, আমি দে দা’র ভক্ত। “
শেষের লাইনটা বলে শোভন বিস্তর হাসে। মধুমিতার গা জ্বলে যায় সেই হাসি দেখে। সে শাসিয়ে বলে,
“ আর কখনো যেনো আমার আশেপাশে না দেখি। নাহলে গুন্ডা ভাড়া করে ধরে পেটাবো। আর তবুও দূর না হলে পুলিশে কেস করবো। “
“ এনিটাইম ম্যাডাম। আমি থানায় ডায়েরি খুলে বসে থাকবো আপনার অভিযোগ তুলে নিতে। “
মধুমিতা বিরক্ত হয়। এই লোককে হুমকি ধামকি দিয়ে লাভ নেই বুঝতে পারে। তাই সে নীরবে চলে যেতে উদ্যত হয়। শোভন সেদিন তাকে পিছু ডেকে বলেছিলো,
“ এইযে মিস মধু। আপনাকে কিছু বলার ছিলো। “
মধু ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে কি? শোভন হাসতে হাসতে দু লাইন গেয়ে উঠে,
“ ও মধু, ও মধু,
আই লাভ ইউ,
আই লাভ ইউ। “
মধু বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে পড়ে। অত:পর ফুসে উঠে বলে,
“ আপনি কি এইমাত্র আমাকে টিজ করলেন? “
“ মোটেও না। আমি শুধু দেব দা’র সিনেমার একটা গানের দুটো চরণ গেলাম। “
পুরনো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মধুমিতা আপনমনে হেসে উঠে। তাদের সাদামাটা প্রেমের সাক্ষী এই টিএসসিকে হঠাৎ করেই তার খুব ভালো লাগছে। টিএসসির বাতাসে হাজারো প্রেমের কাহিনীর মাঝে মিশে আছে তাদের সাদামাটা প্রেমের ঘ্রাণও।
__________
হসপিটাল থেকে বেরয়েই ধানমন্ডির একটা শপিং মলের বেবি শপে এসেছে তরী। উদ্দেশ্য নিজের ভাজতির জন্য সুন্দর কিছু জামা এবং খেলনা কেনা। যদিও আম্মা ইতিমধ্যে নিজের নাতনির জন্য অসংখ্য জামা এবং নিমা বানিয়েছেন। তবুও তরীর ইচ্ছা সে নিজেও পছন্দ করে তার ভাজতিকে কিছু জামা এবং খেলনা উপহার দিবে। বেবি শপে ঘুরতে ঘুরতে তরী আচমকা দেয়ালের পাশে থাকা এক আয়নার দিকে তাকায়। সাথে সাথে সে তড়িৎ গতিতে পিছনে ফিরে তাকিয়ে সামান্য গলা উঁচু করে ডাকে,
“ ছোট? “
তরীর গলা শুনে আশেপাশের কিছু মানুষ ক্ষানিকের জন্য তার দিকে তাকায়। অত:পর যে যার কাজে ফের মন দেয়। তূর্যও ফিরে তাকায়। বোনের সাথে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়ে সে অবাকও হয় এবং খুশিও। তরী এগিয়ে যেতেই প্রশ্ন করে,
“ তুই এখানে কি করিস আপি? “
তরী নিজের ভাইয়ের দু’হাতে থাকা কতগুলো মেয়ে বাচ্চার জামা দেখে বলে,
“ তুই যেই কাজে এসেছিস আমিও সেই কাজেই এসেছি। “
তরীর কথার মানে বুঝতে পেরে তূর্য হাসে। তরী প্রশ্ন করে,
“ একা এসেছিস? “
“ হ্যাঁ। অফিস থেকে বের হয়ে সোজা এখানে আসলাম। পৃথার পায়ে পানি জমার কারণে ওকে আপাতত বাসা থেকে বের হতে দেই না। তাই ও বাসায় বসে অনলাইন শপিং করে আর আমি স্ব শরীরে এসে। “
তরী হেসে বলে,
“ তোরা দুইটাই পাগল। আমাদেরও সুযোগ দে কিছু কেনার। “
তূর্য আর তরী গল্প করতে করতে আরো কিছু শপিং করে বেরিয়ে একটা কফিশপে বসে। কফি অর্ডার দিয়েই তরী বলে,
“ দেখ আমি কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি, বেবি আমাকে ফুপ্পি ডাকবে। যদি পার্থর পাল্লায় পড়ে ওকে মামী ডাক শিখিয়েছিস তাহলে তোকে আর পার্থকে আমি তুলে আছাড় মারবো। “
“ বাপরে! তুই এটা নিয়ে আবার ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করেছিস নাকি? “
“ আলবাত করেছি। অসভ্য লোক বলছিলো ও মামা হলে আমি মামী হবো। আমিও বলে দিয়েছি আমি ফুপ্পি হলে উনি ফুফা হবে। ব্যস! এই নিয়ে ওর সাথে আমার খুব সিরিয়াস ঝগড়া হয়েছে। “
তূর্য হেসে বলে,
“ শিট। তারমানে তোদের বেবি আসলে এরকম ঝগড়া আমার আর পৃথারও ফেস করতে হবে। “
তরী চোখ টিপে বলে,
“ চাপ নিস না। আমার বাচ্চা তোকে মামাই ডাকবে। আফটার অল আমার একমাত্র ভাই তুই। “
তূর্য হেসে একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“ একবছরে আমাদের জীবন কতো বদলে গেলো না আপি? গতবছরও আমার জীবনে প্রায়োরিটি লিস্টে শুধু কাজ আর ফ্যামিলি ছিলো। আর এখন বছর ঘুরতে না ঘুরতে আমার ফ্যামিলিতে এবং প্রায়োরিটি লিস্টে দুজন নতুন মানুষ যোগ হয়ে গেলো। টু বি অনেস্ট আমি ছোট থাকতে জেলাস ফিল করতাম যে পাপা হয়তো তোকে বেশি আদর করে। কিন্তু এখন নিজে ফিল করতে পারছি। মেয়ের বাবা হওয়া ইজ সাচ এ ব্লেসিং। আই এম অলরেডি এটাচড টু হার। তুই দেখিস আমার মেয়েও তার পাপার প্রিন্সেস হবে। “
তরী মুগ্ধ চোখে নিজের ভাইকে দেখতে ব্যস্ত। তূর্যর চোখে মুখে ফুটে আছে খুশির রেখা। তরী টেবিলের উপর থাকা ভাইয়ের একহাতের উপর নিজের হাত রেখে বলে উঠে,
“ ইউ উইল বি এ গুড ফাদার আই নো। আমাদের ছোট্ট মা অলরেডি তার পাপার প্রিন্সেস। “
__________
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বুকে ফের ফিরেছে পার্থ এবং তরী। গতবার শাশুড়ির কথায় বাধ্য হয়ে আসলেও এবার তরী স্ব ইচ্ছায় ঘুরতে এসেছে। আচমকা সমুদ্র তাকে খুব টানছিলো। মনের টানকে নাকি কখনো ফিরিয়ে দিতে নেই। তরী পার্থর কাছে প্রস্তাব রাখে সমুদ্রে ঘুরে আসার প্রসঙ্গে। পার্থ নাকোচ না করলেও বলেছিলো ব্যস্ততা মিটলেই সে তরীকে নিয়ে যাবে সমুদ্রে। পার্থর সেই ব্যস্ততা মিটতে লেগে গেলো একটা মাস। এক মাস পর হলেও দ্বীপে এসে তরী খুশিতে উৎফুল্ল হয়। বহু কষ্টে সে তিনদিনের ছুটি ম্যানেজ করেছে হসপিটাল থেকে। কর্ম জীবনের ব্যস্ততা থেকে মাঝেমধ্যে ছোট খাটো ব্রেক মস্তিষ্ক এবং বদনে সজীবতা এনে দেয়।
সেই একই বাংলোতে এসে তরী মনটা দূর্দান্ত রকমের ভালো হয়ে যায়। সে মনে মনে এই বাংলোটাতেই আসতে চাইছিলো। কিন্তু মুখ ফুটে আর পার্থকে বলা হয়নি। ভাগ্যিস পার্থ অন্য কোথাও তাকে নিয়ে যায় নি।
বাংলোতে প্রথম দিন তাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। একে তো জার্নির ক্লান্তি ভাব তার উপর রাতের বেলা তাই তারা আর বেরোয় নি। খেয়েদেয়ে সোজা ঘুমিয়ে শরীর সতেজ করে। পরের দিন দুপুরে সি ফুড দিয়ে লাঞ্চ করে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়েই দু’জন বেরিয়ে পড়ে দ্বীপ ঘুরে দেখতে। বাসায় সবসময় তরী থ্রি পিস পড়ে থাকলেও এখানে আসার সময় লাগেজে করে শুধু শাড়িই নিয়ে এসেছে। আজকে সে হালকা ধূসর এবং লাল রঙের মিশ্রিত একটা শাড়ি পড়েছে। আয়োজন করে বেশ সেজেছেও।
কিন্তু যার জন্য এতো আয়োজন তার কোনো পাত্তাই নেই। পার্থ আপনমনে সমুদ্রের তীরে পা ভিজিয়ে হেঁটে চলেছে। তার দৃষ্টি স্থির এই অপার্থিব সুন্দর প্রকৃতির দিকে। দূরে বালির উপর হেঁটে চলা তরীর মন খারাপ হয়। সে হাঁটা ছেড়ে বালির উপর নিজের জুতো জোড়া খুলে তার পাশে পা ভেঙে বসে পড়ে। অত:পর দূর হতে পার্থকে দেখতে থাকে। হালকা গোলাপি রঙের শার্ট এবং সাদা রঙের প্যান্ট পরিহিত সেই পুরুষ আপনমনে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূরে চলে যায়। তরী যে তার পাশ হতে কখন সড়ে গেলো যেনো টেরও পেলো না।
তরী নিজের মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। এই শীতকালে দূর দূর পর্যন্ত দ্বীপের বুকে বৃষ্টি নামার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবুও যদি প্রকৃতি নিয়ম বদলে বর্ষণ ঘটাতো তবে কেমন হতো? পার্থ কি তবে এই মুহুর্তে দৌড়ে এসে তরীর হাত ধরে বাংলোর দিকে ছুট লাগাতো সেদিনের মতো? পুরো দ্বীপ জুড়ে কি ইলেক্ট্রিসিটি নিশ্চল হয়ে পড়তো? আসতো কি সেই ঝড়ো বেপরোয়া রাত?
তরীর কান মুহুর্তেই গরম হয়ে উঠলো। মনে মনে নিজেকে শুধালো,
“ দিন দিন খুব নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছিস তরী। “
পরমুহূর্তেই তার মস্তিষ্ক বলে উঠে,
“ কিসের নির্লজ্জ টির্লজ্জ? কোনো পরপুরুষ নিয়ে তো আর ভাবছিস না। যাকে নিয়ে ভাবছিস সে তোর নিজেরই স্বামী। এই লোককে তুই চোখ দিয়ে গিলে খেলেও কোনো পাপ নেই। “
তরীর ভাবনার মাঝেই পার্থ আচমকা তার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। দৌড়ে আসার ফলে বার কয়েক হাফ ছাড়লো। অত:পর বলে,
“ হাত দাও তো তরী। “
আচমকা পার্থ এভাবে সামনে এসে পড়ায় তরী হকচকিয়ে উঠে। কিছুক্ষণ পার্থর দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“ কি? “
পার্থ নিজেই তরীর একহাত টেনে ধরে। অত:পর তার হাতের তালুতে কিছু একটা দেয়। তরী প্রথমে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও পরে নিজের হাতের তালুতে থাকা তিনটা ছোট শুভ্র ঝিনুককে দেখে খুশি হয়। হাসিমুখে বলে,
“ এতক্ষণ ঝিনুক কুড়াচ্ছিলে? “
পার্থ হাসি চেপে বলে,
“ উহু। নিজেকে সংবরণও করছিলাম। অতি সুন্দর বউয়ের দিকে তাকিয়ে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে চাইছিলাম না। “
পার্থর চাপা হাসি দেখে তরীর শ্যাম বর্ণের মুখশ্রী লজ্জায় লাল হয়। সে তড়িৎ অপর হাতে নিজের জুতো জোড়া তুলে উঠে দাঁড়িয়ে মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,
“ মিথ্যুক। “
তরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই সে নিজেকে শূন্যে অনুভব করে। দুই হাতে পার্থর ঘাড় জড়িয়ে ধরে বলে,
“ কি করছো? “
পার্থ তরীকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে বাংলোর পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রাণখোলা হাসি নিয়ে গেয়ে উঠে,
“ সারদি কি রাতো মে,
হাম সোয়ে রাহে এক চাদার মে,
হাম দোনো তানহা হো,
না কোয়ি ভি রাহে ইস ঘার মে। “
এই দফায় আর তরী লজ্জা পায় না। বরং মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে পার্থর দিকে। তার মুগ্ধতার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে পার্থর গুনগুনিয়ে গাওয়া গানের চরণ।
__________
শীত ঋতু বিদায় নিয়েছে সবে ক’দিন হলো। কোনো এক শুক্রবার সন্ধ্যার ঘটনা। পৃথার লেবার পেইন উঠে। খিচুনিযুক্ত ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ ধারণ করে। তূর্য ঘাবড়ে যায়। ডেলিভারি ডেট তো পরের মাসে দিয়েছে ডক্টর। এই আগাম পেইনের মানে কি? দিশাহারা তূর্য দ্রুত নিজের পাপাকে ডেকে পৃথাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সম্পূর্ণ রাস্তা জুড়ে আগলে রাখে পৃথাকে নিজের বুকে। হুমায়ুন রশীদ গাড়ির লুকিং গ্লাসে ছেলের চিন্তিত মুখশ্রী এবং পুত্রবধূর কান্না দেখে সাবধানের সহিত গাড়ির স্পিড বাড়ায়। পৃথা কান্না জর্জরিত স্বরে বারবার বলে যাচ্ছিলো,
“ আমার আব্বা আম্মাকে কল করুন প্লিজ। আমি মনে হয় আর বাঁচবো না। “
পৃথার যন্ত্রণায় জড়িত কণ্ঠ শুনে তূর্য অসহায় অনুভব করে। ঘাবড়ানো পৃথাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
“ কিছু হবে না তোমাদের। দুজনেই সুস্থ থাকবে ইনশাআল্লাহ। “
ওটির ভেতর নিয়ে যাওয়া হয়েছে পৃথাকে। ডক্টর জানিয়েছে তার নরমাল ডেলিভারির লেবার পেইন উঠেছে তাই তারা নরমালেই চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে সবাই হসপিটালে এসে পৌঁছেছে। তরী ভাগ্যক্রমে আগে থেকেই হসপিটালে উপস্থিত ছিলো। ও তাই পারমিশন নিয়ে ওটির ভেতর নিজেও সামিল থাকছে পৃথার পাশে। তূর্য অশান্ত ভঙ্গিতে ওটির সামনে করিডর জুড়ে পায়চারি করছে। বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে উঠছে। সময়ের আগে তার মেয়ের আগমন ঘটার কারণ কি? তূর্য তো পৃথার ব্যাপারে সব নিজ দায়িত্বে হ্যান্ডেল করেছে। তার দ্বারা কি কোথাও ভুল হয়েছে? পৃথা ঠিক থাকবে তো?
তূর্যর ভয়ে ধুকপুক করা হৃদয়টা শান্ত হয় ওটির দরজা খুলে তরীকে বেরিয়ে আসতে দেখে। তরীর কোলে হালকা গোলাপি রঙের টাওয়ালে মোড়ানো একটা ফুটফুটে শিশু। তরী ভাইয়ের দিকে আগে এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাকে এগিয়ে দেয়। তূর্য আগে রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করে,
“ পৃথা? “
তরী হেসে শুধায়,
“ আলহামদুলিল্লাহ। ঠিক আছে। “
তূর্যর বুকের ওপর থেকে যেনো বিশাল পাথর সড়ে গেলো। সে মেয়েকে কোলে নিতে গিয়েও থেমে যায়। হুমায়ুন রশীদের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলে,
“ পাপা ও অনেক ছোট। আমার হাত গড়িয়ে পড়ে গেলে? “
ছেলের এমন কথা শুনে হুমায়ুন রশীদ হাসেন। হাসে বাকিরাও। পার্থ তূর্যর পিঠ চাপড়ে বলে,
“ বুকে আগলে নাও মেয়েকে। কিছু হবে না। “
তূর্য কম্পিত হাতে মেয়েকে তুলে নেয় কোলে। মেয়ে তার ছোট ছোট চোখ মেলে নিজের পাপাকে দেখতে ব্যস্ত। তূর্যর মনে হয় তার মেয়ে তাকে বলছে,
“ হ্যালো পাপা। অগ্রীম এসে চমকে দিলাম তো? “
নিজের মনের উদ্ভট ভাবনার উপর তূর্য নিঃশব্দে হাসে। আফজাল সাহেব মেয়ের জামাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
“ বাচ্চার কানের কাছে আজান দাও বাবা। “
__________
হসপিটাল হতে চারদিনের মাথায় বাড়ি ফিরেছে পৃথা। তার বাবার বাড়ির সবাইও আজ এই বাসায় উপস্থিত। সবাই ব্যস্ত তারিণীকে ঘিরে। হুমায়ুন রশীদ এবং তূর্য মিলে ঠিক করেছে তিনদিন পর পবিত্র শুক্রবারে তারিণীর আকিকার অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। সেই বিষয়ে আলোচনা চলছে লিভিং রুম জুড়ে। পৃথা বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ নিচে সবার সাথে বসে ছিলো। তূর্য তাকে বসিয়ে রেখে উপরে রুমে কি যেনো করতে গিয়েছে।
পৃথা যখন নীরবে সাদিকা বেগমের পাশে বসে বিভিন্ন আদেশ বাক্য শুনতে ব্যস্ত তখনই তূর্য উপর থেকে নেমে এলো। শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে শুধায়,
“ আমি পৃথা আর তারিণীকে রুমে নিয়ে যাই আম্মা? “
সাদিকা বেগম ব্যস্ত গলায় নাতনিকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“ হ্যাঁ বাবা। চলো। “
তূর্য সামান্য ইতস্ত অনুভব করে। মাথা নিচু করে বলে,
“ আমি দুজনকেই সামলে নিতে পারবো আম্মা। “
সাদিকা বেগম সেকেন্ড খানিক চুপ থাকে। অত:পর হেসে তারিণীকে তূর্যর কোলে দিয়ে বলে,
“ আচ্ছা সমস্যা নেই। “
তূর্য হেসে একহাতে তারিণীকে কোলে নিয়ে এবং অন্যহাতে পৃথার হাত ধরে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই সে তাকিয়ে দেখে আশেপাশে কেউ আছে নাকি। কেউ নেই বুঝতেই তারিণীকে পৃথার কোলে দিয়ে দু’জনকে একসাথে কোলে তুলে নেয়। পৃথা ঘাবড়ে উঠে। শক্ত করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মিনমিনে গলায় শুধায়,
“ পড়ে যাবো। প্লিজ নামান। “
তূর্য সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে বলে,
“ পড়তে দিলে তো পড়বে! “
রুমের দরজা আগে থেকেই খোলা ছিলো। তূর্য দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার মেয়ে অত:পর স্ত্রীর পানে তাকিয়ে হেসে বলে,
“ ওয়েলকাম টু আওয়ার ফেইরিল্যান্ড। “
চলবে…
যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৮.
মধ্যরাতে মেয়েকে কোলে নিয়ে রুম জুড়ে পায়চারি করছে তূর্য। গত এক ঘন্টা ধরে মেয়ের গলা ফাটানো কান্না থেমে সবেমাত্র তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়েছে। মেয়েকে চোখ বুজতে দেখেই তূর্য একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। খুব সাবধানে তারিণীকে বেবি কটে শুইয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পিছনে ফিরে তাকায় পৃথার দিকে। পৃথা জেগেই ছিলো। তূর্য নীরবে পৃথার পাশে এসে বসতেই পৃথা ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“ আপনি তারিণীর অভ্যাস খারাপ করছেন। মহারাণীর ডিমান্ড দেখেছেন? দু’দিনেই বাপের নেওটা হয়ে গিয়েছে। বাপের কোল ছাড়া অন্য কারো কোলে ঘুমাতে রাজি না ও। “
“ তো? আমার মেয়ে মন চাইলে হাজারটা ডিমান্ড করবে। পূরণের জন্য ওর পাপা এখনো বেঁচে আছে। “
পৃথা মুখ কুচকে বলে,
“ যখন আপনি থাকবেন না তখন আপনার মেয়েকে সামলাতে আমার কাঠখড় পোহাতে হবে। “
তূর্য প্রশ্ন করে,
“ আমি আবার কোথায় যাবো? “
“ দিনের অর্ধেক সময় যে অফিসে পাড় করেন ভুলে গিয়েছেন? পাপাও হসপিটাল থাকে। বাসায় আমরা মা মেয়ে একা থাকবো। আমাকে একদম জ্বালিয়ে মারবে। “
তূর্য নিঃশব্দে প্রাণখোলা হেসে হিসহিসিয়ে শুধায়,
“ তুমিও তো আমাকে বহু জ্বালাও পৃথা। আমার মেয়ে নাহয় তার কিছুটা শোধ তুললো। সইতে পারবে না? “
পৃথা ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তূর্যর হাসি দেখতে দেখতে অস্ফুটে জবাব দেয়,
“ সব পারবো। “
পৃথার দৃষ্টি তূর্যর চোখ এড়ায় না। সেই ঘোর লাগা দৃষ্টি সে উপেক্ষাও করে না। এগিয়ে গিয়ে নিজের কোমল অধর ছোঁয়ায় পৃথার ললাটে। ললাট হতে ধীরে ধীরে গালে অত:পর পৃথার অধরে এসে থামে তা। পৃথার হৃদয় অচিনপুরে ছটফট অনুভূত হয়। মনের কোণে উঁড়ে বেড়ায় রঙ বেরঙের ভালোবাসার প্রজাপতি। সেই উড়ন্ত প্রজাপতির ফাঁক গলে পৃথা তূর্যর শার্টের কলার টেনে আরেকটু নিজের দিকে নিয়ে আসে। তূর্য পৃথার নরম শরীর টেনে নিজের আয়ত্তে নিয়ে অতি সঙ্গোপনে পৃথার ঘাড়ে চিবুক ছুঁইয়ে নরম স্বরে বলে,
“ মেয়েকে ঘুম পাড়িয়েছি। এখন মেয়ের মায়ের পালা। “
__________
সকাল সকাল পশু কুরবানির মাধ্যমে তারিণীর আকিকার প্রাথমিক কাজটুকু সেড়ে ফেলা হয়েছে। সম্পূর্ণ নাম রাখা হয়েছে তারিণী রশীদ। আপাতত ছাদে বড়সড় হাড়িতে বাবুর্চির রান্না বান্না চলছে। বাড়ির পুরুষরা ছাদে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে ব্যস্ত। পুরুষরা জুম্মার নামাজটা মসজিদ হতে সেড়ে আসতেই খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হয়।
পৃথার রুমে তারিণীকে কোলে নিয়ে বসে আছে তরী। আপনমনে ভাইজির সঙ্গে বলে যাচ্ছে ডিজনিল্যান্ড প্রসঙ্গে অনেক কথা। রুমে আরো উপস্থিত রয়েছে পৃথা এবং মধুমিতা। তারা তরীর আর তারিণীর আলোচ্য বিষয় গভীর মনে উপভোগ করে চলেছে। তরী আচমকা পৃথার দিকে ফিরে বলে,
“ বাই দ্যা ওয়ে পৃথা খুব শীঘ্রই তোমার প্রমোশন হতে চলেছে। “
পৃথা আগ্রহী গলায় বলে,
“ কিসের প্রমোশন বড় ভাবী? “
মধুমিতা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে তরীকে বলে,
“ ভাবী প্লিজ। “
পৃথা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়। তরী হেসে বলে,
“ পৃথার কাছে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই মধুমিতা। পৃথা যে খুব সম্ভাব্য ফুপ্পি হতে চলেছে এটা খুব চমৎকার একটা সংবাদ। “
পৃথা অবাক হয়। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে মধুমিতার দিকে তাকায়। অত:পর উল্লাসে ফেটে পড়ে চেঁচিয়ে উঠে,
“ সত্যি ছোট ভাবী? “
পৃথার চিৎকারের জোরে তারিণী ভীত হয়। কিছুক্ষণ টলমল চোখে চেয়ে থেকেই অত:পর গলা ফাটিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। তূর্য, শোভন, পার্থ হয়তো এদিকেই ছিলো। মেয়ের কান্না শুনতেই তূর্য দরজা নক করে তড়িঘড়ি রুমে প্রবেশ করে। তার পিছন পিছন প্রবেশ করে তারিণীর দুই মামাও। তূর্য মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পৃথার দিকে এক পলক ফিরে প্রশ্ন করে,
“ কান্না করছে কেনো? “
পৃথা কিঞ্চিৎ ভয় নিয়ে জবাব দেয়,
“ আমি একটু জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। ভয় পেয়ে হয়তো কাঁদছে। “
তূর্য রাগ হয় না। শান্ত গলায় বলে,
“ সমস্যা নেই। এখনি চুপ হয়ে যাবে। “
শোভন পাশ থেকে পৃথার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
“ এই ভূতনি। আর কখনো তোর পেত্নি মার্কা গলা নিয়ে আমার ভাগনির সামনে চিল্লালে তোকে একদম গাছে উল্টো লটকিয়ে রাখবো। “
পৃথা ফুসে উঠে বলে,
“ আমার মেয়ের সামনে আমাকে আজেবাজে নামে ডাকবি না ছোট দা। “
“ একশো বার ডাকবো। কি করবি? “
“ তাহলে আমিও তোকে তোর বাচ্চার সামনে মামতো ভূত ডাকবো। “
শোভন হেসে বলে,
“ আমার বাচ্চা কই পেলি? “
পৃথা নাক ফুলিয়ে বলে,
“ ছোট ভাবী প্রেগন্যান্ট। খুব শীঘ্রই বাপ হচ্ছিস। “
পৃথার কথা শুনে পার্থ এবং তূর্য চমকালেও শোভন স্বাভাবিক থাকে। জবাবে বলে,
“ এখনো কনফার্ম না। একটু পর হসপিটাল গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসবো। “
তারিণী ইতিমধ্যে কান্না থামিয়েছে। তূর্য শোভন ও মধুমিতার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“ এডভান্স কংগ্রেচুলেশন। “
পার্থ তরীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে শুধায়,
“ বাপ হওয়ার বয়সে মামা, চাচা হয়ে যাচ্ছি ডাক্তার। আপনার কি মনে হয় না, আপনার ভাই এবং আমার ভাইকেও মামা, চাচা ডাক শোনার ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত আমাদের? “
তরী নিজের একটা কনুই দিয়ে পার্থর পেটে গুতা মেরে বলে,
“ চুপ থাকো তো। “
শোভন হাতঘড়ি দেখে বলে,
“ আমি বের হই তাহলে। হসপিটাল থেকে রিপোর্ট নিয়ে সোজা ফিরবো। “
তূর্য তারিণীকে পৃথার কোলে এনে দিয়ে বলে উঠে,
“ দাঁড়াও। একসাথে যাই তাহলে। আমারও ওদিকে একটু কাজ আছে। “
শোভন মাথা নেড়ে বলে,
“ আমি তাহলে নিচে গিয়ে ওয়েট করছি ভাইয়া। আপনি আসুন। “
বলেই শোভন আর মধুমিতা বেরিয়ে যায়। তাদের পিছুপিছু পার্থ আর তরীও বেরিয়ে যায়। পৃথা তারিণীকে সহ উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,
“ আপনি কোথায় যাচ্ছেন? “
“ এই একটু কাজ আছে। চিন্তা করো না। শোভনের সাথেই ব্যাক করবো। “
বলতে বলতে তূর্য আয়নার সামনে গিয়ে হেয়ার ব্রাশ দিয়ে চুল সামান্য ব্রাশ করে নেয়। অত:পর নিজের ওয়ালেট এবং ফোন প্যান্টের পকেটে নিয়ে পৃথার দিকে এগিয়ে এসে কোলে থাকা মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে পৃথার কপালে চুমু খায়। হেসে বলে,
“ যাই। “
কথাটা বলে তূর্য সড়ে যেতে নিয়েও পারে না। তারিণী নিজের হাতের ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে তার পাঞ্জাবির বুকের একপাশ খামচে ধরে রেখেছে। তূর্য মৃদু হেসে বলে,
“ মা? পাপা তাড়াতাড়ি চলে আসবো। যেতে দাও। “
তারিণী তূর্যর পাঞ্জাবি ছাড়ে না। এতক্ষণ কেঁদে চোখ মুখ লাল করে রেখেছে সে। সেই টলমল করা ফোলা চোখ নিয়ে নিজের পাপার দিকে তাকিয়ে রয়। তূর্য নিজের হাতের সাহায্যে সাবধানে মেয়ের বাঁধন ছাড়ায়। অত:পর মেয়ের হাতের পিঠে চুমু খেয়ে পৃথার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ সাবধানে থেকো। আর তারিণীর খেয়াল রেখো। “
তূর্যর কথা পৃথার কাছে অদ্ভুত লাগে। সে চোখ ছোট করে বলে,
“ এভাবে বলছেন কেন? “
পৃথার প্রশ্নের পিঠে তূর্য জবাব খুঁজে পায় না। এই কথাটা সে কেনো বললো সে নিজেও জানে না। তাই আর কিছু না বলে হালকা হেসে বেড়িয়ে যায়।
__________
লিভিং রুম পেরিয়ে বাড়ির মেইন গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে শোভন ও মধুমিতা। শোভন মধুমিতার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ অস্থিরতা কমাও তো মধু। রিপোর্ট যাই আসুক আই হ্যাভ নো প্রবলেম। “
শোভনের কথায় মধু শান্ত হয় না। তার মনের অস্থিরতা বাড়ছে বৈকি কমছে না। এই অস্থিরতা কি শুধুমাত্র রিপোর্ট কি হতে পারে সেই বিষয়ের চিন্তা হতেই কাজ করছে? নাকি অন্যকিছু? শোভন মধুমিতার মুড ঠিক করার জন্য হেসে মৃদু গলায় গুনগুনিয়ে উঠে,
“ ও মধু ও মধু
আই লাভ ইউ
আই লাভ ইউ। “
সেই পরিচিত গান শুনতেই মধু হেসে দেয়। শোভন বলে,
“ ফিরে এসে যেনো এই হাসিমুখটাই দেখি। “
বলেই শোভন উল্টো ঘুরে বেড়িয়ে যেতে নিলে আচমকা তার কদম নড়বড়ে হয়ে উঠে। পড়ে যেতে নিয়েও একটা শক্ত হাতের সাহায্যে সামলে নেয় নিজেকে। আফজাল সাহেব সামান্য ধমকে বলে উঠে,
“ সাবধানে হাঁটো। “
শোভন মাথা নেড়ে আচ্ছা বলেই বেড়িয়ে যায়।
__________
একটা রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে তূর্য ও শোভন। তূর্য কফির মগে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ্য করে শোভনের চেহারার স্পষ্ট খুশির ঝলক। শোভন বারবার রিপোর্ট ফাইলটা দেখছে আর আপনমনে হাসছে। তূর্য বলে,
“ বাড়িতে ফেরার পথে কিন্তু মিষ্টি নিতে ভুলো না শোভন। “
শোভন হেসে বলে,
“ শুধু মিষ্টি বলছেন ভাই? আমি পারলে পুরো মিষ্টির দোকান তুলে নিয়ে যাই। “
তূর্য ফোনের স্ক্রিনে সময়টা দেখে নিয়ে বলে উঠে,
“ আর বিশ মিনিট বসি আমরা। জুয়েলারি শপটা খুললেই ওখান থেকে তোমার বোন আর ভাগ্নির গিফট পিক করে বাসায় রওনা হবো আমরা। “
শোভন বলে,
“ আমি ভাবছি মধুর জন্যও ওখান থেকে একটা কিছু গিফট নিয়ে নিবো। ও আমাকে এতো বড় গিফট দিচ্ছে, আমারও ওকে কিছু গিফট দেওয়া উচিত। “
“ শিওর। “
মধুমিতার অস্থিরতা এখন শোভনের উপর এসে ভর করেছে। তার ইচ্ছে করছে চিল্লিয়ে সবাইকে এই গুড নিউজটা জানাতে। বাসায় ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্য্য কাজ করছে না তার মধ্যে। সবাইকে জানাতে না পারলেও অন্তত মধুকে তো এখনই জানিয়ে দেওয়া যায়। তাই না? এতে মধুর টেনশনও কমে যাবে।
যেই ভাবনা সেই কাজ। শোভন নিজের ফোনটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“ ভাইয়া আমি এক মিনিট একটা ইমপোর্ট্যান্ট কল এটেন্ড করে আসছি। “
তূর্য বুঝতে পারে শোভনের গুরুত্বপূর্ণ কল কার উদ্দেশ্যে হতে পারে। সে হেসে মাথা নাড়ে। শোভন ফোন নিয়ে রেস্টুরেন্টের আউটডোর এরিয়ায় এসে দাঁড়ায়। ডায়াল করে মধুর নাম্বার। কিছুক্ষণের মধ্যেই কল রিসিভ হতে শোভন উৎফুল্ল গলায় বলে,
“ আমরা প্যারেন্টস হবো মধু। রিপোর্ট পজেটিভ। “
ফোনের অপর পাশ হতে মধু কিছু বলে। শোভন হাসিমুখে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে থাকে। আচমকা বেখেয়ালি বসত একজনের সাথে ধাক্কা লেগে তার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। শোভন সাথে সাথে সরি বলে ফোন তুলে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার পাশ কেটে সেই আগুন্তকও ভিতরে প্রবেশ করে। সাথে সাথে শোভনের টনক নড়ে উঠে। সে দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁচের দরজা ভেদ করে রেস্টুরেন্টের ইনডোর এরিয়ার দিকে তাকায়। এইমাত্র যেই ছেলেটার সাথে তার ধাক্কা লেগেছে তাকে বিচক্ষণ ভঙ্গিতে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে। ছেলেটা তার চোখের সামনে দিয়েই সবগুলো টেবিল ক্রস করে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। শোভন আবারও সতর্ক দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকায়। সাথে সাথে তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। দ্রুত ভিতরে প্রবেশ করে আগে নিজেদের টেবিলের কাছে যায়। তূর্যর কাছে গিয়ে তাড়া দিয়ে বলে,
“ ভাই লিভ দিজ প্লেস রাইট নাও। সামনের মেইন এন্টারেন্স দিয়ে বের হবেন না। সবার অগোচরে তাড়াতাড়ি রেস্টুরেন্টের পিছন দিয়ে বেরিয়ে যান এন্ড কল দ্যা কপস। “
শোভনের আকস্মিক এতগুলো কথা শুনে তূর্য ঘাবড়ে যায়। চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করে,
“ কি হয়েছে শোভন? “
“ ভাই সময় নষ্ট করবেন না। যান প্লিজ। যাই হয়ে যাক না কেনো ভিতরে ফিরে আসবেন না। এট এনি কস্ট দ্রুত পুলিশ ফোর্সকে এখানে আসতে ইনফর্ম করুন। “
বলেই শোভন তূর্যকে টেনে তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের করার চেষ্টা করে। তূর্য বুঝে উঠতে পারছে না শোভন এমন কেন করছে। কিন্তু খুব সাংঘাতিক কোনো বিষয় ঘটতে চলেছে তা সে আঁচ করতে পারছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে সে শোভনের কাধে হাত রেখে বলে,
“ টেক কেয়ার। আমাদের জন্য বাসায় সবাই অপেক্ষা করছে ভুলে যেও না। “
শোভন মাথা নাড়ে। তূর্য আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায় দ্রুত। শোভন এক পলক তূর্যর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। অত:পর নিজের প্যান্টের পিছন হতে খুব সাবধানে একটা রিভলবার বের করে সবার আড়ালে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]