যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৫.
আঁধার আসমানে ভেসে আছে এক ধবধবে অর্ধ আকৃতির চিকন চাঁদ। সেই চাঁদের আশেপাশে জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্রপুঞ্জিরা। একত্রে মিলে জানান দিচ্ছে আজ চাঁদ রাত অর্থাৎ আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর।
চৌধুরী নিবাসের পুরুষেরা এক সঙ্গে বসে লিভিং রুমে খবর দেখতে ব্যস্ত। সাদিকা বেগম এবং জমিলা খালা মিলে আগামীকাল যা যা রান্না করবেন তা আজ রাতেই গুছিয়ে রাখছেন। মধুমিতা ব্যস্ত বাহারি রকমের ডেজার্ট আইটেম বানাতে। রান্নাবান্নার ক্ষেত্রে এই কাজটা করতে মেয়েটা খুব উপভোগ করে। বিয়ে করে এই বাড়ির বউ হয়ে আসার পর থেকে সবসময় যে কোনো উপলক্ষেই ডেজার্ট বানানোর দায়িত্বটা সে অলিখিত ভাবে নিজের কাধে তুলে নিয়েছে।
পার্থ খবর দেখার মাঝে একবার আড়চোখে চারিদিকে চোখ বুলায়। তরীকে কোথাও দেখছে না সে। কোথায় গেলো? এতক্ষণ তো রান্নাঘরে আম্মার সাথেই ছিলো। ভাবতে ভাবতেই পার্থ উঠে উপরের দিকে হাঁটা ধরে।
নিজের রুমে নীরবে প্রবেশ করতেই দেখে বিছানায় বসা তরীকে। হালকা সোনালী রঙের একটা অরগাঞ্জা থ্রি পিস পড়ে আছে সে। মাথার চুলগুলো একটা ক্লাচার দিয়ে খোপা করে রাখা। হাতে থাকা মেহেদীর কোন দিয়ে বাম হাতের তালুতে কিছু একটা আঁকিবুঁকি করার চেষ্টা চালাতে ব্যস্ত সে।
পার্থ এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,
“ মেহেদি দিতে জানেন ম্যাডাম? “
তরী অসহায় মুখে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ এর থেকে সহজ তো আমার বায়োলজি প্র্যাক্টিকালের ড্রইং ছিলো। “
“ আগে কখনো ঈদে মেহেদী লাগাও নি? “
“ মাঝে মধ্যে সময় পেলে মেহেদি আর্টিস্ট বাসায় কল করে নিতাম। এসে সুন্দর করে ডিজাইন করে দিয়ে যেতো। “
“ তাহলে আজ ডাকো নি কেনো? “
“ খেয়াল ছিলো না। “
পার্থ তরীর পাশে বসে বলে,
“ সবসময় যে ডিজাইনই করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। চাইলে হাতের মাঝে গোল করে একটা বৃত্ত আর আঙুল ভরে মেহেদি লাগালেই পারো। ওটা আরো বেশি সুন্দর লাগবে। “
তরীর বুদ্ধিটা বেশ পছন্দ হয়। সে একটা টিস্যু নিয়ে হাতের এলোমেলো মেহেদীর ডিজাইন মুছে পার্থর কথা মতো লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পার্থ তার পাশে বসে একহাতে ফোন চালাতে চালাতে অপরহাতে তরীর ক্লাচার টেনে খোপা খুলে দেয়। সাথে সাথে তরী বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করে,
“ সমস্যা কি? “
পার্থ ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই নিজের একহাতে তরীর চুলের গোছা পেঁচিয়ে ধরে বলে,
“ আমি তোমাকে বিরক্ত করবো না, তুমিও এখন আর আমাকে বিরক্ত করো না তো। “
তরী ফুসে উঠে সামনে ফিরে ফের হাতে মেহেদী লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই লোকের সাথে বেশি তর্ক করাও জ্বালা। সর্বদা বেশ শান্ত সেজে ঘুরে বেড়ানো এই অতিশয় ভদ্রলোক যে কতটা নির্লজ্জ তা তরী ছাড়া আর কেউ জানেনা। তাই আপাতত নিজের কাজে মনযোগ দেওয়াই উত্তম মনে করে সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেডরুমের দরজায় নকের শব্দ হয়। পার্থ তরীর চুল ছেড়ে দিয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। রুমে প্রবেশ করে শোভন ও মধুমিতা। মধুমিতার হাতে একটা ট্রে তে সবেমাত্র রান্না করা চার বাটি ফিরনি। তরী হাসিমুখে বলে,
“ গরম গরম খাবে নাকি? “
“ হ্যাঁ ভাবী। ছাদে চলুন। চাঁদ রাতে চাঁদ দেখতে দেখতে গল্পও করা হয়ে যাবে। “
তরীর কাছে প্রস্তাবটা ভালো লাগে। তার একহাতে মেহেদী দেওয়াও শেষ। অপর হাতে আরেকটা মেহেদীর কোন আর কিছু টিস্যু নিয়ে সে বিছানা থেকে নেমে বলে,
“ চলো। “
মধুমিতা পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ দাদা আপনিও চলুন। চারজনের জন্যই ফিরনি নিয়েছি আমি। “
পার্থ মৃদু হেসে বলে,
“ তোমরা যাও। আমার একটু কলে কথা বলতে হবে। “
তরী একহাতে পার্থর ফোন টেনে নিয়ে বলে,
“ ফ্যামিলি টাইমের মাঝে নিজের ফোনকে একটু বিরতি দাও তো। “
শোভন ভাবীর সাথে সুর মিলিয়ে বলে,
“ চল না। তোর ফোন আর ফোনকল কোথাও পালিয়ে যাবে না। কিন্তু দুই দিনের জীবনে এই সুযোগ দ্বিতীয় বার না-ও আসতে পারে। “
শোভনের কথা শুনে তিনজনই তার দিকে সরু চোখে তাকায়। তিনজনের দৃষ্টি দেখে শোভন অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সে গলা ঝেড়ে বলে,
“ আমি তো কথার কথা বললাম। “
পার্থ আলতো হাতে নিজের ঘাড়ের একপাশ ম্যাসাজ করতে করতে বলে উঠে,
“ ওকে। নো ফোনকল। অনলি ফ্যামিলি টাইম নাও। “
__________
মুষুলধারে বৃষ্টির শব্দ নিস্তব্ধ রাতের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলেছে। সেই সুন্দর রাতে আরেকটা সুন্দর দৃশ্য হলো একজন যুবক বসে খুব মনযোগ দিয়ে নিজের স্ত্রীর হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। সেই রমণীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে আপনমনে চরম বিরক্তি নিয়ে বলে চলেছে,
“ লোকে আপনাকে দুইদিনের মধ্যে বউ পাগল উপাধি দিবে তূর্য। ভাববে আমি আপনাকে জাদু টোনা করে বিয়ে করেছি। “
তূর্য সামান্য গম্ভীর স্বরে বলে,
“ তোমাকে কে বলেছিলো রান্নাঘরে গিয়ে মাতাব্বরি করতে? আয়না খালা তো আছেই। “
পৃথা অবাক গলায় বলে,
“ তো? উনি আছে দেখে কি আমি যেতে পারবো না নাকি? কালকে ঈদ অথচ ঘরের বউয়ের রান্না করা কোনো খাবার না খেয়ে তুমি আর পাপা কালকে নামাজ পড়তে যাবে এটা কেমন দেখায়? “
“ আর এখন যে রান্নায় হাত লাগাতে গিয়ে মাছ মাংসের গন্ধে বমি করেছো এটা খুব ভালো হয়েছে তাইনা? “
পৃথা মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে ফিরে তাকায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তূর্য তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
“ হয়ে গিয়েছে। “
পৃথা আগ্রহ নিয়ে নিজের হাতের তালুর দিকে তাকাতেই দেখে একপাশে একটা চাঁদ আর তার পাশেই মেহেদী দিয়ে ইংরেজি লেটারে টি পি টি লেখা। পৃথা চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,
“ একটা টি ফর তূর্য এবং পি ফর পৃথা নাহয় বুঝলাম। আরেকটা টি কার জন্য? “
তূর্য এবার বেশ আগ্রহী গলায় বলে,
“ আমাদের বেবির নাম। “
“ আপনি ঠিক করে ফেলেছেন? “
“ ফাইনাল ডিসিশন তোমার। তোমার পছন্দ হলে রাখবো। “
কথাটা বলেই তূর্য ফের আগ্রহী গলায় বলে,
“ আমার মনে হয় ইট ইজ এ বেবি গার্ল। “
“ আপনি কিভাবে বুঝলেন? “
“ শি ইজ এটাচড টু মি। মেয়ে বেবিরা না বাবাদের সাথে খুব এটাচড হয়? “
পৃথা ভাবুক গলায় বলে,
“ ইউ আর রাইট। এখন থেকেই কি জেদ রে বাবা! আপনি কিছুদিনের জন্য দূরে গিয়েছেন ও একদম খাবার দাবারের বিরুদ্ধে অনশণ জারি করে বসেছে। “
তূর্য নিঃশব্দে হাসে। পৃথা ফের আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ নাম কি ভেবেছেন বলুন না। “
“ তারিণী। “
পৃথা খুশিতে আটখানা হয়ে পড়ে। নামটা কি সুন্দর! তার বেশ পছন্দ হয়েছে। সে তূর্যর দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে আওড়ায়,
“ তারিণীর পাপা। “
‘ তারিণীর পাপা ‘ কথাটা শুনতেই তূর্যের বুকের ভেতর প্রগাঢ় আবেগের সমারোহ ঘটে। সেই আবেগকে পশ্রয় দিয়েই ও পৃথার পেটের কাছে মাথা নিয়ে সেখানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“ মা? আমাকে শুনতে পাচ্ছো? তাড়াতাড়ি এসে পড়ো। পাপা ইজ ওয়েটিং ফর ইউ। লাভ ইউ। “
পৃথা হাসিমুখে বসে দেখতে থাকে সেই দৃশ্য। একটা ছোট্ট মেয়ে বাচ্চা কোলে তূর্যকে কেমন লাগবে ভাবতেই আবেগের আন্দোলনে কেঁপে উঠে সে।
__________
ঈদের দিন বিকেলে পরিবারের সাথে দেখা করতে চৌধুরী নিবাসে এসেছে পৃথা। সাথে তূর্য আর হুমায়ুন রশীদও রয়েছে। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে শোভনের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেই শোভন ঠাট্টা করে বলে,
“ এই ভূতনি। তোর এই অবস্থা কেন? আমার ভাগিনা কিংবা ভাগ্নিকেও কি নিজের মতো পাতলু বানাতে চাস নাকি? “
পৃথা ঠোঁট উল্টে বলে,
“ আমি এখন এক বাচ্চার মা। প্রমোশন হয়েছে। সম্মান দিয়ে কথা বল আমাকে। আমার সাথে ফাইজলামি করলে বেবির কাছেও ঘেঁষতে দিবো না তোকে। “
“ তোর পারমিশনের অপেক্ষা কে করবে? “
পার্থ পাশ থেকে বলে উঠে,
“ তোর দিন শেষ পৃথা। এখন আমাদের সব আদর লুটে নেওয়ার জন্য জুনিয়র আছে। দুই মামা মিলে ওকে আদরে একদম বাঁদড় বানিয়ে ছাড়বো। তখন টের পাবি ছোটবেলায় তুই কেমন বাঁদড় ছিলি। “
পৃথা ভয়ে আঁতকে উঠে। তার বাচ্চা তার মতো দস্যি হলে সে পাগলই হয়ে যাবে। তার থেকে ভালো যদি তূর্যর মতো ঠান্ডা চুপচাপ হয়। তার ভয়ার্ত মুখ দেখে পার্থ আর শোভন চোখাচোখি করে একসাথে হেসে উঠে। দুইপাশ থেকে দুজন বোনের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,
“ বেক্কল! মজা নিচ্ছিলাম। “
ভাইদের আস্কারা পেতেই পৃথা আহ্লাদে ভেসে যায়। মুখ ফুলিয়ে বলে,
“ ছোট দা, তোর আইনের কোনো ধারা তে এই নীতি লেখা নেই যে একটা প্রেগন্যান্ট মহিলাকে রাগানো দণ্ডনীয় অপরাধ? “
পৃথার অযৌক্তিক বোকা কথা শুনে পার্থ ও শোভন আরেকদফা হাসে। দূর হতে মধুমিতা এই দৃশ্য দেখে বলে,
“ ইশ! আমারও যদি ভাইবোন থাকতো! “
তরী আর তূর্য মধুমিতার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কথাটা তাদের কর্ণগোচর হয় না। তরী হেসে মধুমিতাকে টেনে একহাতে জড়িয়ে ধরে অপরহাতে তূর্যর হাত জড়িয়ে ধরে বলে,
“ আমরা আছি না? “
মধুমিতার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে আবার চোখ তুলে তূর্যর দিকে তাকায়। তূর্য হেসে বলে,
“ দুই বোন থাকলে কিন্তু মন্দ হয় না। “
চলবে…
যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৬.
শরতের শেষের সময়। প্রকৃতিতে বিরাজমান ঠান্ডা আবহাওয়ার ফলে মৃদু গায়ে কাপন ধরছে। অন্ধকার রাতে কাথা গায়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে তরী। হাত পায়ের ভঙ্গি স্বভাবত কিছুটা এলোমেলো। বিছানার অর্ধেকের বেশি অংশ তার দখলে। বিছানার অপর দিকে একপাশ ফিরে স্থির ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে পার্থ। সামান্য এদিক ওদিক হলেই সে ডিরেক্ট নিচে পড়ে যাবে অবস্থা।
নিস্তব্ধ রাতের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে আচমকা একটা ফোন বেজে উঠে। কিছুক্ষণ বাজতেই রিংটোনের শব্দে পার্থ কপাল কুচকে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। মাঝ রাতে ঘুম ভাঙায় যেন সে খুব বিরক্ত। একবার পাশ ফিরে তরীকে দেখে নিয়ে হাতড়ে নিজের ফোনটা তুলে নেয়। রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই একটা পুরুষ স্বর বিদ্যুৎ গতিতে বলে উঠে,
“ আসসালামু আলাইকুম ভাই। মাঝরাতে ডিস্টার্ব করার জন্য সো সরি। কিন্তু এটার জন্য আপনে পরে আমার ক্লাস নিয়েন। এখন তাড়াতাড়ি আমার টেক্সট করা এড্রেসে ভাবীরে নিয়া আইস্যা পড়েন। আল্লাহ হাফেজ। “
ব্যস! এইটুকু কথা বলেই ফোনটা কেটে দিলো অপরপাশ থেকে। পার্থ হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এইমাত্র কি ঘটলো যেন তার বোধগম্য হচ্ছে না। ফোনে টুং করে ম্যাসেজের শব্দ হতেই সে আবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। ম্যাসেজে লেখা এড্রেসটা দেখতেই সে আরেক দফা বিস্মিত হলো। মধ্যরাতে এসব নাটকের মানে কি? পাগল নাকি?
পার্থ তড়িৎ উঠে দাঁড়ালো। নিজের গায়ের টি শার্ট আর ট্রাউজার বদলে একটা শার্ট আর জিন্স পড়ে নিলো। অত:পর বিছানার কাছে গিয়ে তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ আলতো গলায় ডাকলো। পর মুহুর্তেই তার মনে পড়লো নিজের স্ত্রীর কুম্ভকর্ণের ন্যায় ঘুমানোর অভ্যাসের কথা। সাথে সাথেই পার্থ এবার কিছুটা জোরে জোরে ডাকা শুরু করলো।
তরী ঘুমের মধ্যেই নিজের মাথার উপর একটা বালিশ চেপে ধরে বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বলে উঠে,
“ ছাগলের মতো চিল্লিও না প্লিজ। সারাদিন পাগলের মতো দৌড়াতে হয়েছে আমার হসপিটালে। একটু ঘুমাতে দাও। “
পার্থ তরীকে ঠেলে তোলার চেষ্টা করতে করতে বলে উঠে,
“ প্লিজ জান উঠো। ইমারজেন্সি। “
তরী এরকম কান্ডে খুব রাগ হয়। সে নিজের ঘুমন্ত চোখ জোড়া মেলে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পার্থর দিকে। ক্ষিপ্ত গলায় বলে,
“ আমি তোমাকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলবো পার্থ মুন্তাসির। মাঝরাতে তুমি আমার প্রিয় ঘুম ভাঙিয়ে জান জান করতে এসেছো? কি এমন ইমারজেন্সি? ডোনাল্ড ট্রাম্প হার্ট অ্যাটাক করেছে নাকি লাদেন স্ট্রোক করেছে? “
বউয়ের গরম কথার টোপের মাঝে পড়ে পার্থ অসহায় অনুভব করে। মনে মনে সেই কল করা পুরুষকে রামছাগল বলে গালি দিতেও ভুলে না সে। অত:পর বেশ নরম গলায় তরীকে সব খুলে বলে। সব শুনে তরী ঘুমন্ত শরীর টেনে উঠে বসে। তার শরীর বিছানা ছাড়তে না চাইলেও মস্তিষ্ক বলছে তার পার্থর সাথে গিয়ে বিষয়টা দেখা উচিত। অবশেষে মস্তিষ্ককে সায় দিয়ে সে জামা বদলাতে চলে যায়। এই ফাঁকে পার্থও নিজের ফোন, ওয়ালেট আর গাড়ির চাবিটা নিয়ে নেয়। সবশেষে আলমারির এক গোপন জায়গা হতে সুরক্ষিত রিভলবারটা বের করে আড়ালে পকেটে ভরে সে। অত:পর বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
“ আবার নতুন কি আকাম করেছে আল্লাহ জানে। “
__________
কাজি অফিসের সম্মুখে এসে থামা গাড়িটা হতে ব্যস্ত পায়ে নেমে এলো পার্থ ও তরী। তাড়াহুড়ো করে ভিতরে প্রবেশ করতেই কাজির রুমের বাহিরে একটা বেঞ্চির দু মাথায় বসে থাকতে দেখলো এক জোড়া যুবক ও যুবতীকে। পার্থ ও তরীকে দেখতে পেয়েই সেই যুবক উঠে এসে বলে,
“ ভাই – ভাবী আমি জানতাম আপনারা আইবেন। “
পার্থ রাগী গলায় প্রশ্ন করে,
“ এই রাত বিরাতে কাজি অফিসে কি আকাম করতে এসেছিস তুই? “
আসিফের ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। সে বেশ বিজ্ঞের ন্যায় বলে উঠে,
“ আকাম? সিরিয়াসলি ভাই? আমি জীবনে কোনো আকাম করসি? আমার করা সব কাজই হইসে সুকাম। দেশ আর জাতির জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়া পুরুষ আজকে নিজের জন্য একটা সুকাম করতে কাজি অফিসে আসছে। ওইযে বেঞ্চে ওই মাইয়াডারে দেখতাসেন না? ওর নাম সুচিত্রা। আমরা দুইজন দুইজনরে ভালোবাসি। বিয়া করমু। “
তরী প্রশ্ন করে,
“ ভালোবাসো, বিয়ে করবে ভালো কথা। বাসায় না জানিয়ে কাজি অফিসে কেনো এসেছো? “
আসিফ মাথা চুলকে বলে,
“ আসলে ভাবী আমার ছোডোবেলার থেকেই নায়িকা সুচিত্রারে সেই লাগতো। উত্তম কুমারের সামনে কি মিষ্টি মিষ্টি নরম নরম কথা কইতো। দেখলেই পরাণডা জুড়ায় যাইতো। ভাগ্যক্রমে বাস্তব জীবনেও এক সুচিত্রার প্রেমে পড়লাম। কিন্তু এই সুচিত্রা নরম কম গরম কথা বেশি কয়। অবশ্য ওর কোনো দোষও নাই। বাপের মতো হইসে এক্কেবারে। হালায় আস্তা এক হিটলার। “
শেষ লাইনটা বলেই আসিফ জিভ কাটে। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে দেখে বধূ বেশে বসে থাকা সুচিত্রা তার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে আছে। আসিফ ভীতস্বরে বলে,
“ সরি বেবি। ভুলে মুখ দিয়া সত্যি কথা বাইর হইয়া গেসে। “
সুচিত্রা ফের রাগ নিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আসিফ হাফ ছেড়ে সামনে ফিরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“ সুচিত্রার বাপ মানে আমার শশুর আমগোর প্রেম মাইন্না নেয় নাই। আমি রাজনীতিতে জড়িত হুইনাই বেডায় নাক ছিটকাইসে। বেডারে এতো বুঝাইলাম যে উনার মাইয়্যার লাইগ্যা আমার তে উত্তম জামাই জগৎ খুঁইজ্জাও পাইতো না। বেডায় আমার কথা কানে তুললো না। ধইরা বাইন্ধা এক দামড়া বিসিএস ক্যাডারের লগে ওর বিয়া দিতে নিসিল। হেন তে ওরে ভাগায় আনসি। আপনিই কন ভাই সুচিত্রার লগে আমার মতো উত্তম পুরুষ রাইখ্যা কি ওই রসকষহীন ব্যাডারে মানাইতো? আমি ঠিক করসি না? “
আসিফের বিশাল গল্পের সারমর্ম শুনে পার্থ ও তরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়। আচমকা তরী শব্দ করে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে সে একপাশের দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। কোনো মতে হাসি থামিয়ে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ তুমিই ট্রেন্ড সেট করেছো। এখন সামলাও ঠ্যালা। “
পার্থ আসিফের দিকে ফিরে প্রশ্ন করে,
“ এখন এই বিষয়ে আমরা কি করতে পারি? “
আসিফ দাঁত বের করে হেসে বলে,
“ জীবনের এতো বড় একটা কাম কি আমি আপনেরে ছাড়া করতে পারি ভাই? আপনে আর ভাবী বিয়াতে খালি সাক্ষী দিয়েন। আর আমার বাসায় গিয়ে আব্বার সামনে আমার হইয়া একটু ওকালতি কইরেন। তাইলেই চলবো। “
আসিফের প্ল্যান শুনে পার্থ রাগী চোখে তাকাতেই আসিফ নিষ্পাপ মুখভঙ্গি করে বলে উঠে,
“ প্লিজ ভাই। আমি বিয়া কইরা বউ নিয়া বাড়িত গেলে আব্বায় আমার দিকে জুতা খুইল্যা মারবো। আপনে গিয়া একটু বুঝায় কইলে আব্বারে একটু ঠান্ডা করন যাইবো। “
তরী পাশ থেকে প্রশ্ন করে,
“ আর সুচিত্রার ফ্যামিলি? “
“ চিন্তা কইরেন না ভাবী৷ আমার বাসায় আগে সব সামলায়া পরে ওর বাপের কাছে গিয়া মাফ চাইয়া নিমু। তবুও রাগ না ভাঙলে পরের বছর একটা নাতি গিফট কইরা দিমু নে হিটলাররে। শশুর খুশি হইয়্যা রাগ ভুইল্যা সব মাইন্না নিবো। “
তরী হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ে। কথায় আছে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। পার্থর মতো নির্লজ্জ লোকের হাওয়া শেষমেশ আসিফেরও লাগলো। এরকম বাচ্চাকাচ্চার কথা কেউ পাব্লিক্যালি বলে নাকি? পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ এক শর্তে আমরা এখন বিয়েতে সাক্ষী হবো। “
আসিফ প্রশ্ন করে,
“ কি শর্ত ভাই? “
“ রাজনীতির পাশাপাশি চাকরির ব্যবস্থা কর একটা। ঢাকার সব অফিসে নিজের সিভি জমা দিবি। ফাইন্যান্সিয়ালি সিকিউরিটির গ্যারান্টি ছাড়া কোনো বাপ তোকে মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। “
আসিফ রাজি হয়। অত:পর বিনা বাধায় পার্থ এবং তরীর উপস্থিতিতে তার আর সুচিত্রার বিয়েটা হয়ে যায়।
__________
নতুন বছরের আগমন ঘটেছে বেশ ক’দিন হলো। দেশ জুড়ে বিরাজ করছে হাড় কাঁপানো শীতল আবহাওয়া। নিজের বড়সড় পেটটা নিয়ে চলাফেরা করতে বেশ ঝামেলা হয় পৃথার। অসুবিধা হয় রাতে ঘুমোতেও। সাত মাসের পেট নিয়ে আরাম করে পাশ ফিরে ঘুমোনো বেশ কষ্টসাধ্যকর বটে। ইদানীং আবার তার পায়েও পানি জমেছে। একদিকে শীতের যন্ত্রণা তো অপরদিকে রাতে এই আরামে ঘুমোতে না পারার যন্ত্রণা। এসব যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে সে প্রায়ই মাঝরাতে একা ফুঁপিয়ে কাঁদে।
তূর্য তখন তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অসহায় ভঙ্গিতে শুনে যায় পৃথার সকল অভিযোগ। বেশ কষ্ট করে সারারাত জেগে পৃথার পায়ে তেল মালিশ করে। কখনো পৃথা আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে যায় তো কখনো ক্লান্ত হয়ে। তূর্যর তখন বেশ মন খারাপ হয়। পৃথার শারীরিক কষ্টের একভাগও অংশীদার না হতে পেরে নিজেকে বেশ অসহায় মনে হয়। মনে মনে ঠিক করে সে আর বাচ্চা কাচ্চা নিবে না। একটা মেয়ে নিয়ে বেশ হাসিখুশি জীবন পাড় করে দিতে পারবে তারা। পৃথার তিনমাসের সময় তূর্য নিজের আন্দাজে মেয়ের নাম ঠিক করলেও এখন সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে তাদের মেয়ে হবে। সোনোগ্রাফির রিপোর্ট পেয়ে এই বিষয়ে কনফার্ম হওয়ার পর থেকেই পৃথা দিন রাত তার কানের কাছে ‘তারিণীর পাপা’ বলে সম্বোধন করে কিচিরমিচির করে। তূর্য অবশ্য এই ডাকটা খুব উপভোগ করে। হৃদয় শীতল হয়ে আসে।
জানুয়ারির কোনো এক রাতের ঘটনা। পৃথা উদাসীন ভঙ্গিতে বারান্দায় থাকা দুই সিটের বেঁতের সোফার একপাশে বসে আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আঁধারে নিমজ্জিত আকাশটার দিকে। আকাশ জুড়ে ছেয়ে আছে কালো মেঘের ভেলা। সেই মেঘগুচ্ছের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ ও নক্ষত্রপুঞ্জিরাও। আচমকা তূর্য এসে একটা শাল তার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে তার পাশের খালি জায়গাটায় বসতে বসতে বলে,
“ এই কনকনে শীতে না তোমাকে বারান্দায় আসতে মানা করেছিলাম? খুব অবাধ্য হয়ে গিয়েছো। ইদানীং কোনো কথা মানছো না। “
পৃথা ঘাড় ঘুরিয়ে বারান্দার এককোণে জ্বালানো লাইটের টিমটিমে আলোয় স্বামীর স্নিগ্ধ, চিন্তাভরা মুখটা দেখে। তার চোখ গিয়ে আটকায় তূর্যর থুতনির কাঁটা দাগটার দিকে। পাপার মুখে সে শুনেছে তূর্য ছোটবেলায় একবার স্কুল মাঠে পড়ে ব্যথা পেয়েছিলো। সেই দূর্ঘটনার চিহ্ন হিসেবে এই দাগটা রয়ে গিয়েছে। তূর্যর দিকে তাকিয়ে থেকেই পৃথা একটা ছোট নিঃশ্বাস ছাড়ে।
পৃথাকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে তূর্য ভ্রু উঁচিয়ে চোখের ইশারায় প্রশ্ন করে কি? পৃথা কিছু না বলে তূর্যর ডানহাতটা জড়িয়ে ধরে তার কাধে মাথা এলিয়ে দেয়। তূর্য ছোট গলায় ডাকে,
“ পৃথা? “
“ হু। “
“ কি হয়েছে? মন খারাপ? “
পৃথা শান্ত গলায় বলে,
“ এক জীবনে আমি অনেক কিছু পেয়ে গিয়েছি তারিণীর পাপা। হুটহাট ভয় লাগে। মানুষের জীবনে নাকি সব চাওয়া পূরণ হয় না। অথচ আমি না চাইতেই সব পেয়ে যাওয়াতে ভয়টা আরো বেশি ঘিরে ধরছে আমাকে। “
তূর্য এবার নিঃশব্দে হেসে বলে,
“ তোমার তো খুশি হওয়া উচিত। অযথাই ভয় পাচ্ছো। “
পৃথা এবার তূর্যের হাতটা আরেকটু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে। মনের এককোণ হতে দলা বাঁধা কান্না ঠেলেঠুলে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। পৃথা বেশিক্ষণ সেটাকে চাপিয়ে রাখতেও পারে না। তার চোখ ফেঁটে গড়িয়ে পড়ে অবাধ্য নোনা জলরাশি। রুদ্ধস্বরে বলে,
“ হঠাৎ করে এই এক জীবনকে খুব ছোট মনে হচ্ছে আমার। আমাদের সংসার কি কোনোভাবে একশো বছরের হতে পারে না? এই অল্প কয়েকদিনের জীবনে আপনাকে পেয়ে আমার মন ভরবে না। আমি খুব লোভী হয়ে গিয়েছি তারিণীর পাপা। আপনার প্রতি আমার লোভ চক্রাকার হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে কেবল দিনকে দিন। “
পৃথার এই অল্প কিছু কথা তূর্যর বুকে কাঁপন ধরালো। এই অসম্ভব ভালোবাসতে জানা মেয়েটাকে সেও প্রচন্ডরকমের ভালোবাসে। তূর্য পৃথার পিঠের পিছন দিয়ে হাত নিয়ে তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। মাথা নামিয়ে পৃথার জ্বলজ্বল করা নাকফুলে সজ্জিত নাকটায় চুমু খায়। গভীর কণ্ঠে বলে,
“ আমি যে তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা হয়তো কখনো মুখ ফুটে আয়োজন করে তোমাকে বলা হয়নি পৃথা। কিন্তু তুমি জেনে রেখো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা অনন্তকালের। অনন্ত মানে জানো তো? “
তূর্যের কথা শুনে পৃথা এবার ফুঁপিয়ে উঠলো। মনের হাজারো জমানো কথা চাপা পড়লো তার কান্না এবং রাতের আধারের ভীড়ে। এতো তাড়া কিসের? এখনো যে খুব সময় আছে।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]