যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৩.
বিছানার এককোণে বালিশ জড়িয়ে উবুড় হয়ে শুয়ে থাকা নারী চোখ মেলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ল্যাম্পের পানে। হাতে থাকা ল্যাম্পের ওয়্যার কানেকশনের সুইচটা পর্যায়ক্রমে অন এবং অফ করছে সে। তার অটল দৃষ্টি কোণে জমে আছে বিন্দু বিন্দু পানি। আজ দুপুরে পার্থকে দেখে আসার পর থেকেই নিজেকে বেশ এলোমেলো লাগছে। সদা পরিপাটি থাকা মানুষটা এতো নোংরা এবং বিচ্ছিরি একটা জায়গায় কিভাবে থাকছে? পার্থর দৃশ্যমান আঘাত গুলোও তার দৃষ্টি এড়ায় নি। তরীর ইচ্ছে করছিলো শিক ভেঙে সেলে প্রবেশ করে পার্থর প্রতিটা জখমে মলম লাগাতে। কিন্তু চাইলেই কি সব আর পারা যায়? উহু।
রাজনীতির পিছনে নিজের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে তবুও রাজনীতি ছাড়তে রাজি না। এতো জেদ? একবার বাড়ি ফিরুক সব জেদ দূর করে ছাড়বে তরী। এসব ছাইপাঁশের পিছনে আর পার্থকে নিজের জীবন নষ্ট করতে দিবে না সে। যথেষ্ট হয়েছে। পার্থকে বুঝতে হবে যে রাজনীতির নোংরা মাঠে পরিচ্ছন্ন উপায়ে টিকে থাকার কোনো অবকাশ নেই।
আপাতত তরীর মনে কেবল একটাই আশা। শোভন এবং পার্থর শুভাকাঙ্ক্ষীদের চেষ্টা যেনো সফল হয়। ওই নরক তূল্য জায়গাটা থেকে যেনো মানুষটাকে বের করে আনতে পারে তারা।
__________
কোর্ট রুমে বসে আছে দুই পক্ষীয় মানুষজন। তাদেরই একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে শোভন। পার্থর পক্ষ হতে কেবল সে আর দলের কয়েকজন ছেলে পেলে এখানে উপস্থিত আছে। পার্থ কড়া করে জানিয়ে দিয়েছিলো সে তার কোনো ফ্যামিলি মেম্বারকে কোর্টে দেখতে চায় না। শোভন সেই কথা রেখেছে। যদিও আপাতত যেই কয়জন উপস্থিত আছে তারাই যথেষ্ট।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিচারপতি এসে উপস্থিত হন। তিনি আদেশ দিতেই পার্থকে নিয়ে প্রবেশ করে দুজন পুলিশ। দূর হতে পার্থকে দেখেই শোভনের কঠোর রূপ নরম হয়ে আসে। পার্থর চেহারা দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তার উপর কি অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছে রিমান্ডের নাম করে। নিজের দাদার হাতে সেই হ্যান্ডকাফটাকেও বিষের মতো লাগছে শোভনের। আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তারপর দাদাকে মুক্ত করে ঘরে নিয়ে ফিরবে সে। তার দাদার মুক্তির পাশাপাশি এই শুনানির উপর তার চাকরিও নির্ভর করছে।
পার্থ নীরবে কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াতেই তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে সবার আগে তার পক্ষের উকিলের পিছনে বসে থাকা আসিফের দিকে। আসিফের চোখ ছলছল করছিলো। পার্থ অবাক হয়। সে কি ভুল দেখছে? তার রাগচটা স্বভাবের এই ছোট ভাইটা এতো আবেগী কবে থেকে হয়ে গেলো? পার্থকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে মুহুর্তেই আসিফ দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসি দেয়। চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দেয়, ‘ চিন্তা করবেন না ভাই। আমরা আছি। ‘
পার্থর ব্যথায় জর্জরিত চিত্ত প্রশান্তি অনুভব করে। তখনই তার চোখ গিয়ে আটকায় বিপরীত পক্ষের উকিলের পিছনে বসে থাকা শামীমের দিকে। সাথে সাথে তার ভ্রু কুচকে আসে। শামীম ওই পাশে বসে আছে কেন? পার্থ আগ্রহী চোখে নিজের পাশের সাড়িতে লক্ষ্য করে। শেষের বেঞ্চিটাতে তো এখনো বসার জায়গা আছে। তাহলে শামীম সেখানে না বসে ওই পাশে কি করছে?
পার্থর গভীর ভাবনায় ভাটা পড়ে বিচারকার্য শুরুর মধ্য দিয়ে। পার্থর পক্ষের উকিল রওশন জাহান সর্ব প্রথম বিচারপতির সামনে প্রশ্ন রাখে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই কেন তার মক্কেলকে রিমান্ডে নিয়ে এরকম টর্চার করা হলো?
রিমান্ডে পার্থর উপর পাষবিক আচরণ চালানো একজন পুলিশকে বিপরীত কাঠগড়ায় ডেকে এই প্রশ্ন করতেই সে জানায় পার্থ কিছু স্বীকার না করায় এবং তার নির্লিপ্ত ব্যবহারের ফলে সে বাধ্য হয়েছে আঘাত করতে। সেই পুলিশের এরকম কচি খুকি সাজার নাটক দেখে শোভন এবং আসিফের শরীর জ্বলে যাচ্ছে যেনো। আসিফের মন চাচ্ছে উঠে গিয়ে এই ঘুষখোর জানোয়ারকে ঘুষি মারতে মারতে রক্তাক্ত করে তরী ভাবীর হসপিটালে এডমিট করিয়ে বিনা চিকিৎসায় মারতে।
রওশন জাহানের প্রশ্নের মধ্যে বাগড়া দিয়ে বিপরীত পক্ষের উকিল হারুনুর কালাম নিজে কিছু বলার অনুমতি চায়। বিচারপতি হতে অনুমতি মিলতেই সে বলে উঠে,
“ আমি এই কেসের সাক্ষীকে আদালতে পেশ করতে চাই অনুমতি থাকলে। “
অনুমতি পেতেই হারুনুর কালাম পিছনে ফিরে বেঞ্চির দিকে তাকায়। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে পার্থও সেদিকে তাকায়। মুহুর্তেই তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে। স্তব্ধ দৃষ্টি মেলে সে দেখতে থাকে শামীমের তার বিপরীত কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ানোর দৃশ্য। শামীম দৃঢ় গলায় বলে উঠে,
“ পার্থ মুন্তাসির আমার সামনেই রুবেল হোসেনকে গুলি করে খুন করে। উনি একজন আসামী। উনার কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। “
রিমান্ডে পাড় করা সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোতেও হয়তো পার্থ এতটা আহত হয় নি যতটা এই মুহুর্তে নিজের প্রতিপক্ষের সাক্ষীকে দেখে সে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার কাঁটা ঘা গুলোতে কেউ লবণ মরিচ মাখিয়ে দিয়েছে। তার রাশভারী চিত্ত বিশ্বাসঘাতকতার আঘাতে জর্জরিত অনুভব করছে।
হারুনুর কালাম ফের শামীমের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,
“ ওই ঘটনার সময় কি সেখানে আরো কেউ উপস্থিত ছিলো? “
শামীম ভাবলেশহীন গলায় জবাব দেয়,
“ অফিসার শোভন আর আসিফও এই ঘটনার সাক্ষী। “
রওশন জাহান অবজেকশন জানিয়ে আসিফকে কাঠগড়ায় ডাকার অনুমতি চায়। অনুমতি পেতেই শামীমের জায়গায় আসিফ এসে কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। রওশন জাহান প্রশ্ন করে,
“ শামীম যা বলে গিয়েছে তার সত্যতা কতটুকু? “
আসিফ মুখে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,
“ ওর কথায় সত্যতা খোঁজা, আর দিনে আকাশে চাঁদ খোঁজা একই। এই হালায় তো দিনে একশো কথা কইলে তার মধ্যে নব্বইটাই মিছা হয়। আমারে বিশ্বাস না করলে এই হালার যত এক্স গার্লফ্রেন্ড আছে আপনে ওগোরে ডাইক্কা জিগান। সবগুলার লগে হালার ব্রেকাপ হইসে এইডার কাইষ্ঠা স্বভাবের কারণে। “
রওশন জাহান সামান্য গলা ঝেড়ে আসিফকে সামান্য চোখ রাঙায় উল্টোপালটা সম্বোধন করা হতে নিজেকে সংবরণ করতে। আসিফ সেই দৃষ্টি দেখে নিজেকে সামলে নেয়। আসলে নিজের রাগ সামলাতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। সে পারলে শামীমকে গালির ডিকশনারি খুলে বসে সেখান থেকে এ টু জেট সব গালি দিতো। রওশন জাহান ফের প্রশ্ন করে,
“ শামীম এইমাত্র বলে গেলো যে সেদিন রুবেল হোসেনের মৃত্যুর সময় সেখানে আপনি এবং অফিসার শোভনও উপস্থিত ছিলো। এটা কি সত্যি? “
“ পুরাই ডাহা মিছা কথা বলসে ও। ওইদিন ওই মুহুর্তে ভাই আমার বাসায় ছিলো। ভাবীর অবস্থা দেইখ্যা উনি খুব ভাইঙ্গা পড়সিলো। আমি তাই হসপিটাল থেকে উনারে সোজা নিজের বাসায় নিয়া গেসিলাম। দুপুরে উনি আমগোর বাসায় আসিলো। বিশ্বাস না হইলে আমার আম্মারেও আপনে জিগাইতে পারেন। আম্মায় দুপুরে ভাইয়ে আইবো দেইখ্যা খুব আয়োজন কইরা রান্না বান্না করসিল। এমনকি দুপুরে খাওয়ার সময় মুরগীর দুইডা রানই ভাইয়ের প্লেটে তুইল্যা দিসিলো। কিন্তু ভাইয়ে তখন অতি শোকে পাথর হইয়্যা ছিলো। উনার গলা দিয়া খাবার নামে নাই। ওইদিন আমার ওই মুরগির রান দুইডার থেকেও বেশি ভাইয়ের লাইগ্যা খারাপ লাগসিলো। “
রওশন জাহান মনে মনে বিরক্ত হয়। ছেলেটার বুদ্ধি দেখে উনি ভেবেছিলেন ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান। কিন্তু এই ছেলের দেখি প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কথা বলার অভ্যাস আছে। রওশন জাহান তাড়াতাড়ি মূল কথায় গিয়ে প্রশ্ন করে,
“ তার মানে শামীমের বলা করা সকল অভিযোগ মিথ্যা তাইতো? “
“ অবশ্যই। “
“ কিন্তু আমার জানামতে তো শামীম পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর লোক। তাহলে তিনি কেন এই মিথ্যা অভিযোগ করবেন? এতে উনার কি লাভ? আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে? “
আসিফ দৃঢ় গলায় বলে,
“ প্রমাণ আছে। “
আসিফের এতো কনফিডেন্সের সাথে বলা কথাটা শামীমকে নার্ভাস করে তুলে। প্রমাণ আছে মানে? কি প্রমাণ? শোভন এগিয়ে এসে একটা পেন ড্রাইভ এগিয়ে দেয়। সেই পেন ড্রাইভের ফাইল ল্যাপটপে ওপেন করতেই দেখা যায়, শোভন শামীমকে প্রশ্ন করছে এমনটা সে কেনো করলো? সেই প্রশ্নের পিঠে শামীম বেশ হাসিমুখেই জবাব দেয়,
“ আমি কি বলদ নাকি যে আজীবন পার্থ ভাইয়ের ছাঁয়াতলে থাকবো? ইশতিয়াক ভুইয়া নিজ থেকে আমাকে দশ লাখ টাকা আর পার্টিতে পদ অফার করেছে। সেই অফার ফিরিয়ে দেওয়ার মতো বোকামি আমি কিভাবে করি? তাই পার্থ ভাইয়ের বিপক্ষে গিয়ে থানায় সাক্ষী দিয়েছি। “
ব্যস! এতটুকু ক্লিপ। শামীমের শরীরে তিরতির করে ঘামছে। কি এক বোকামি করে ফেললো সে। কথার মাঝে তো কোথাও সে এটা মেনশন করে নি যে সে পার্থর সিক্রেট ফাঁস করেছে। আসিফটা এতো শেয়ানা! শামীমের আড়ালে তার কথা রেকর্ড করে রেখেছে।
রওশন জাহান মুখে জয়ের হাসি নিয়ে বিচারপতির উদ্দেশ্যে বলে,
“ এই ভিডিও হতে স্পষ্ট প্রমাণিত যে শামীম টাকার এবং পদের লোভে ইশতিয়াক ভুইয়ার কথায় আমার মক্কেল পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীকে মিথ্যা বানোয়াট একটা কেসে ফাঁসিয়েছে। “
শামীম পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠে,
“ আমার অভিযোগ মিথ্যা নয়। “
বিচারপতি বেশ গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,
“ আপনি নিজ মুখে স্বীকার করেছেন যে আপনি ইশতিয়াক ভুইয়ার সাথে হাত মিলিয়ে পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন। “
শামীম আর কিছু বলতে পারে না। তার আগেই বিচারপতি নিজের রায় শোনায়। মিথ্যা বানোয়াট কেস এবং মানহানীর দায়ে শামীম এবং ইশতিয়াক ভুইয়ার বিপক্ষ শাস্তি ঘোষণা করা হয়।
পার্থর হাতের হ্যান্ডকাফ খুলে দেওয়া হচ্ছে। পার্থর সেদিকে খেয়াল নেই। সে নীরবে তাকিয়ে আছে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শামীমের দিকে। শামীম রাগে ফোস ফোস করছে। আসিফ তার পাশ পেরিয়ে আসার সময় এক মুহুর্তের জন্য দাঁড়িয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়ায়। অত:পর শামীমের চোখে চোখ রেখে বলে,
“ ইউ স্টুপিড মেল, নাও গো টু হেল। ফট! “
বলেই আসিফ পার্থর কাছে এগিয়ে এসে বত্রিশ দাঁত বের করে হেসে বলে,
“ ভাই! মিষ্টির আশেপাশে নোংরা মাছি ঘুরঘুর করবোই। ওইগুলোর দিকে তাকাইয়েন না। আমার মতো মৌমাছি আপনার পাশে থাকতে মাছিদের কোনো বেল নাই। “
শোভন তাড়া দেখিয়ে বলে,
“ এইখানে অপেক্ষা করা আর ঠিক হবে না। আসিফ তুমি দলের ছেলেদের নিয়ে সামনের দিক সামলাও। আমি দাদাকে নিয়ে আড়ালে বের হয়ে বাসায় চলে যাই। সাংবাদিকদের সামনে পড়লে এরা সহজে ছাড়বে না আর। “
“ ঠিক বলসেন ভাই। “
__________
পার্থ জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে এই খবর পেতেই যেনো সাদিকা বেগম অলৌকিক ভাবে সুস্থ হয়ে গেলো। মধুমিতা ভার্সিটিতে থাকায় তিনি জমিলা খালাকে নিয়ে নিজেই রান্নার তোড়জোড় শুরু করলেন। তার ছেলেটা এই কয়দিন ওই আজাবের ভিতর কি খেয়েছে না খেয়েছে আল্লাহ জানে। আজ ইফতারের সময় ছেলেকে নিজ হাতে রান্না করা ভালো মন্দ না খাওয়ালে তিনি শান্তি পাবে না একটুও। তাই তিনি পুরান ঢাকার স্টাইলে কাচ্চি রান্না করছেন। পাশাপাশি শোভনকে ফোন করে বলেছে যেনো পার্থর দলের ছেলেদেরও ইফতারে বাসায় আসতে বলে।
আফজাল সাহেবও ছেলের অপেক্ষায় বেশ অস্থির হয়ে আছে। বারবার দরজার সামনে পায়চারি করছে। বড় দা’র মুক্তির খবর পেয়ে পৃথাও ছুটে এসেছে চৌধুরী নিবাসে। সবার চোখেই এক সমুদ্র অপেক্ষা।
কেবল তরীই বেশ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে রয়েছে। এসবের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সেদিকে অবশ্য কারো খেয়ালও নেই।
অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটে। বাড়ির দুই ছেলে স্ব শরীরে বাড়িতে প্রবেশ করে। সাদিকা বেগম দৌড়ে গিয়ে বড় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। এতক্ষণ তীব্র উত্তেজনা নিয়ে পায়চারি করা আফজাল সাহেব বড় ছেলেকে দেখতেই উনার বুক ধক করে উঠে। এই কয়েকটা দিনেই তার ছেলের কি অবস্থা করে দিয়েছে জানোয়াররা? আফজাল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত কান্ড ঘটায়। হুট করে তিনি শোভনকে জড়িয়ে ধরে।
আকস্মিক নিজের আব্বার আলিঙ্গনে শোভন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কিছু কারণে তার আব্বার সাথে তার সম্পর্কটা খুব একটা স্বাভাবিক নয়। এই কারণে এই জড়িয়ে ধরাটা তার কাছে খুব অপ্রত্যাশিতই বটে। আফজাল সাহেব ধরে আসা গলায় কিছু বলতে চায়। কিন্তু কথা উনার গলায় আটকে রয়। তাই তিনি নীরবে শোভনকে ছেড়ে আবার পার্থকে জড়িয়ে ধরে। শোভন শান্ত দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখে। মনে মনে বলে,
“ ভাইকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার পুরস্কার সরূপ এই আলিঙ্গন ছিলো আমি জানি। এছাড়া আপনি কখনোই আমাকে নিয়ে গর্ব করবেন না। কখনোই আমার প্রতি গর্ব করে আমাকে জড়িয়ে ধরবেন না আপনি আব্বা। “
__________
আম্মা, আব্বা, পৃথা, জমিলা খালা সবাই নিচে থাকলেও পার্থর দৃষ্টি আরেকজনকে খুঁজতে ব্যস্ত। সেই কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে পৃথা নীরবে ভাইয়ের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,
“ বড় ভাবী উপরে রুমে আছে বড় দা। “
পার্থ আর অপেক্ষা করে না। রেস্ট নেওয়ার কথা বলে সোজা উপরে নিজের রুমে চলে যায়। সিটিং এরিয়ার দরজা লক করে বেডরুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় বেডের উপর তরী পা ঝুলিয়ে নীরব ভঙ্গিতে বসে আছে। তার পাশে রয়েছে একটা ফার্স্ট এইড বক্স। পার্থ এক দন্ড দাঁড়িয়ে থেকে বেড রুমের দরজা লক করে দেয়। অত:পর গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্সের অপর পাশে বসে।
তরী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পার্থর দিকে ফিরে তাকায়। এক পলক পার্থর বুকের এবং পিঠের তাজা আঘাত গুলো দেখেই উঠে ফার্স্ট এইড বক্স হাতে নেয়। পার্থর তাজা জখমে ওষুধ লাগায় সচেতন হাতে। ওষুধ লাগাতেই পার্থর কাঁটা ক্ষতগুলো জ্বলে উঠে। তবুও সে মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও করে না।
প্রয়োজনীয় মেডিসিন লাগানো শেষ হতেই তরী হাত ধোয়ার জন্য উল্টো ফিরে ওয়াশরুমের দিকে যেতে নেয়। কিন্তু সাথে সাথে নিজের ডান হাতের কব্জিতে টান অনুভব করে। তরী ফিরে তাকায় না। পার্থ নরম সুরে বলে উঠে,
“ এখনো কিছু আঘাতে মলম লাগানো বাকি তরী। “
তরী প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়। পার্থ তার হাতের কব্জি ধরে রাখা অবস্থায়ই উঠে দাঁড়ায়। তরীর চোখে চোখ রেখে বলে,
“ বিশ্বাসঘাতকতার আঘাতে সৃষ্ট জখমে মলম লাগানো বাকি। “
আরো এককদম এগিয়ে গিয়ে তরীর হাত নিজের উন্মুক্ত বক্ষস্থলের বাম পাশে রেখে দূর্বল গলায় বলে,
“ এই কয়েকদিনের বিচ্ছেদের যন্ত্রণা এখনো আমাকে কাতড়াচ্ছে। আর সহ্য হচ্ছে না। সারিয়ে তুলো তরী। “
তরীর চক্ষুকোণের শেষ প্রান্ত জলে চিকচিক করে উঠে। পার্থর দূর্বল গলার আবদারে তার অন্তঃপুরের গুমোট ভাব উবে গিয়ে তীব্র অনুরাগ হানা দেয়। কঠিন চিত্তের খোলস ছেড়ে কোমল রূপ বেরিয়ে আসে। নিজেদের মাঝের দূরত্ব মিটিয়ে পার্থর ক্ষত বিক্ষত দেহে আশ্রয় খুঁজে নেয়।
শূন্য বুকটাতে তরীর মাথা ঠেকতেই পার্থ তাকে দু’হাতের কারাগৃহে আগলে নেয়। তরী কান্না মিশ্রিত সুরে বলে,
“ যে জিনিসটা আমি নিজে পারবো না কখনো করতে সেই একই জিনিসের আবদার করেছি আমি তোমার থেকে। অভিমান দেখিয়ে তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে এসেছিলাম। সরি ফর দ্যাট। “
“ একশো বার অভিমান দেখাবে। অধিকার আছে তোমার। সরি বলতে হবে না। “
তরী ফের বলে উঠে,
“ ছাড়তে হবে না তোমার রাজনীতি। শুধু নিজে সেফ থাকো। আর কিছু চাই না। “
পার্থ থমথমে স্বরে বলে উঠে,
“ এই শিক্ষাটার খুব দরকার ছিলো আমার। রাগ আর বিশ্বাসের ফলাফল নিজ চোখে দেখে নিয়েছি। এই ভুল জীবনে আর দ্বিতীয়বার হবে না। “
তরী চোখ তুলে তাকায় পার্থর মুখশ্রীর দিকে। মুখ থেকে ধীরে ধীরে পার্থর অধর যুগলের দিকে দৃষ্টি স্থির করে। সেই দৃষ্টি দেখে পার্থ আহত হেসে বলে,
“ খবরদার। নোংরা, জীবাণুযুক্ত ঠোঁটে চুমু খাবে না। “
তরী সেই বারণ মানলো না। পার্থর ঘাড় আগলে ধরে এক সমুদ্র শীতল ছোঁয়ার পরশ আঁকে পার্থর ওষ্ঠযুগলে। অধর সন্ধি হতে ক্ষানিকের বিরতি নিয়ে বলে,
“ জীবাণু দূর করার জন্য সেনিটাইজড করে দিচ্ছি। “
চলবে…
যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৪.
সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ হলো। ফেইরি লাইটের সোনালী টিমটিমে আলোয় রুমটা আচ্ছাদিত হয়ে আছে। এককালে সর্বদা সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে থাকা তূর্যের রুমটা তার অনুপস্থিতিতেও এখন বেশ গোছানো থাকে। সেই গুছিয়ে রাখার পিছনে অবদানকারী রমণী পরিপাটি বিছানার এককোণে শুয়ে আছে ফোন কানে গুজে। বাংলাদেশ সময় এখন সন্ধ্যা সাতটা হলেও নিউজিল্যান্ডে এখন রাত দুটো বাজে। ফোনের এপাশ হতে রমণী একরাশ অভিমান নিয়ে বলে উঠে,
“ আমাদের প্রথম রমজানের মাস ছিলো তূর্য। প্রথম চাঁদ রাত, প্রথম ঈদ। আপনার অনুপস্থিতি আমার আর সহ্য হচ্ছে না। “
“ পনেরো দিন চলে গিয়েছে। আর পনেরোটা দিন অপেক্ষা করো। ফিরে আসবো তো শীঘ্রই। “
তূর্যর ফিরতে আরো পনেরো দিন বাকি ভাবতেও পৃথার দমবন্ধকর অনুভূতি হয়। সে বেশ নরম গলায় বলে উঠে,
“ আমি খুব অধৈর্য্য কিশোরীর ন্যায় আচরণ করছি। তাই না? বিয়ে হয়েছে, এক বাচ্চার মা হতে চলেছি তবুও নিজের এইরকম স্বভাব দূর করতে না পেরে আমি নিজের প্রতিই খুব বিরক্ত। “
ফোনের অপর পাশ হতে তূর্য স্লান হেসে বলে,
“ আমি তো তোমার প্রতি বিরক্ত অনুভব করি না পৃথা। “
শরতের সময় এখন। বর্ষার শুরুর দিকে পৃথা একটা বেলি ফুলের চারা কিনে বারান্দায় লাগিয়েছে। কিছুদিন হয়ে তাতে ফুল এসেছে। বারান্দার থাই দরজা খোলা থাকায় শিরশিরে বাতাসের সাথে সেই সুবাস ভেসে আসছে। সেটার সুবাসে মৌ মৌ করছে সম্পূর্ণ রুম।
ফোনের অপরপাশ হতে তূর্য ক্ষানিকক্ষণ চুপ থেকে প্রশ্ন করে,
“ বেবি কি করে? “
পৃথা মন খারাপ নিয়ে জবাব দেয়,
“ জানি না। আমি মা হয়েও ওর ব্যাপারে কিছু বুঝতে পারি না। আপনি ওর প্রয়োজন অপ্রয়োজন আমার থেকেও ভালো বুঝেন। “
তূর্য শান্ত গলায় বলে,
“ আমি তোমাকেও বুঝি পৃথা। “
পৃথা আর কিছু বলে না। আচমকা সে ফোন কেটে দেয়। তার টানা টানা অভিমানী চোখ জোড়া থেকে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু হয়। তূর্যকে ছাড়া তার খুব শূন্য লাগছে। এই শূন্যতা কেবল তূর্যই মেটাতে পারবে। কবে আসবে তূর্য?
__________
সন্ধ্যায় ইফতারি সেড়ে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে বেরিয়েছিল শোভন। এতোদিন পর বিদেশ ফেরত বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ায় গল্প আড্ডায় কখন যে রাত নেমে আসে সেদিকে তার খেয়াল ছিলো না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দশটার উপর বেজে যায়। দশটার দিকেই তাদের বাড়ির সবাই যে যার রুমে ঘুমাতে চলে যায়। তাই শোভনও বাহির থেকে ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে আসে।
নিজের রুমে প্রবেশ করতেই দেখে মধুমিতা বেশ আয়োজন করে গোলাপি রঙের একটা তাঁতের শাড়ি পড়ে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছে। শোভন গায়ের ঘর্মাক্ত শার্টটা খুলতে খুলতে বলে উঠে,
“ এতো আয়োজন কিসের? “
মধুমিতা বইয়ে মুখ গুজে রেখে জবাব দেয়,
“ নিজের জন্য সকল আয়োজন। “
শোভন আর কোনো পাল্টা কথা বলে না। চুপচাপ গিয়ে বিছানার এককোণে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গাটায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে। একহাত কপালের উপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টায় মগ্ন হয়। শোভনের এই কাজে মধুমিতা বেশ রাগ হয়। এই ডিউটিওয়ালা কি এই মাত্র তার মতো সুন্দরী বউকে ইগনোর করে ঘুম বেছে নিলো? এর শোধ মধুমিতা তুলেই ছাড়বে। দেখে নিবে এই ডিউটিওয়ালা শান্তিতে ঘুমায় কিভাবে।
মধুমিতা চুপচাপ বিছানা ছেড়ে নেমে রুমের যত লাইট আছে সব জ্বেলে দেয়। বিছানার কাছে এসে ল্যাম্পের লাইটও শব্দ তুলে জ্বেলে দেয়। অত:পর বড় বড় পা ফেলে বিছানায় গিয়ে একপাশ ফিরে চোখ বুজে শুয়ে রয়। লাইট অন থাকলে যে শোভনের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে তা তার অজানা নয়। তাই ইচ্ছে করেই এই কাজটা করেছে সে।
বেশ কিছুক্ষণ সময় পেরোয়। মধুমিতা হঠাৎ টের পায় শোভন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সাথে সাথে মধুমিতা শক্ত করে নিজের চোখ বুজে ঘুমানোর অভিনয় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শোভন সব লাইট বন্ধ করে ফের বিছানায় এসে শুতেই মধুমিতা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। মনে মনে ঠিক করে সে আবার নেমে সব লাইট অন করে দিবে। ঠিক সেই মুহুর্তেই পিছন থেকে ঠান্ডা একজোড়া হাত তাকে নিজের কাছে টেনে পিছন থেকে আঁকড়ে ধরে। তার কাধে নিজের নাক ঘষে বলে উঠে,
“ একজনের জন্য করা আয়োজনকে নিজের নামে বলে চালিয়ে দেওয়া একটা দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধে আপনার জরিমানা দায়ের করা হলো। “
মধুমিতা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
“ কি জরিমানা? “
“ সুন্দরী বলে জরিমানার পরিমাণ কমিয়ে দিলাম। কেবল একশো মধুময় চুমুতেই চলবে। “
__________
সন্ধ্যায় ডাইনিং টেবিলে পার্থ আর শোভন মুখোমুখি বসে আছে। টেবিলে বসে আছে আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগমও। মাগরিবের আজান হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। আফজাল সাহেব বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ইফতারি খেলেও সাদিকা বেগম মুখ টিপে হাসছে। এমনকি জমিলা খালাও বাদ যাচ্ছে না। শোভন এবং পার্থ একে অপরের দিকে আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে। তাদের স্বীয় স্ত্রী দ্বয় আজ রান্নাঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না। কেবল খেজুর খেয়ে রোজা খুলেই কাজের অযুহাত দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গিয়েছে। এর কারণও তারা বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে। অপরাধ করে তাদের ফাঁসিয়ে দিয়ে অপরাধীরা ঠিকই এখন নিজেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
পার্থ এবং শোভন দুজনেই খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের শার্টের কলার টেনে গলার একপাশে রক্ত জমে যাওয়া কালচে দাগটা ঢাকতে ব্যস্ত। আজ সারাদিন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘরের বাইরে থাকলেও এই মুহুর্তে আর তাদের পালানোর কোনো জায়গা নেই। আফজাল সাহেব যত দ্রুত সম্ভব খাবার সেড়ে সেখান থেকে কেটে পড়লেন। নিজের রুমে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি গলা ছেড়ে স্ত্রীকে তলব করেন। স্বামীর ডাক শুনতেই সাদিকা বেগম হাসতে হাসতে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। ডাইনিং রুমে এখন পার্থ আর শোভন ব্যতীত আর কেউ নেই।
পার্থ তরীর বানানো কাবাবের শেষ অংশটুকু মুখে পুড়ে বেশ বিরক্ত মুখে বলে উঠে,
“ বাসায় হঠাৎ ছাড়পোকা খুব বেড়েছে মনে হচ্ছে। এদের কামড়ের জ্বালায় আর টেকা যাচ্ছে না। এশার নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার পথে ছাড়পোকার ওষুধ কিনে আনতে হবে। “
শোভনও খাওয়া শেষ করে পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে না এমন একটা ভাব করে ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিরক্ত মিশ্রিত সুরে বলে উঠে,
“ তেলাপোকার পরিমাণও খুব বেড়েছে। আমিও বাসায় ফেরার সময় তেলাপোকা মারার ওষুধ কিনে আনবো। “
তাদের কথার মাঝেই রান্নাঘরের দরজা হতে হাসির শব্দ ভেসে আসে। পার্থ আর শোভন হতভম্ব ভঙ্গিতে সেদিকে তাকাতেই দেখে তরী এবং মধুমিতা খাবারের বাটি হাতে লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে দাঁড়ানো জমিলা খালাই শব্দ করে হাসছে। পার্থ আর শোভন মনে মনে ভাবে জমিলা খালা কি তাদের বলা কথা শুনে ফেললো নাকি? দুজনেই আরেকদফা লজ্জায় পড়ে যায়। পার্থ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“ তরী, আমি বাহিরে যাচ্ছি। বাসায় ফিরতে রাত হবে। কেউ জেগে আমার অপেক্ষা করো না। “
শোভনও তাড়া দেখিয়ে বলে উঠে,
“ মধু, এসে দরজা লাগাও। আমিও বাহিরে যাচ্ছি। “
কথা শেষ করতেই দুই ভাই তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে দুই দিকে হাঁটা ধরে। আজকে আর কারো মুখোমুখি পড়তে চায় না তারা। মাঝরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তবেই বাড়ি ফিরবে বলে ঠিক করে তারা।
___________
দেখতে দেখতে সাতাশটা রোজা চলে গেলো। ঘড়িতে ক’টা বাজে জানা নেই পৃথার। অন্ধকার রুমটা জ্যোৎস্নার মেলায় মৃদু আলোকিত। বারান্দার খোলা থাই দরজা হয়ে ঝিরঝিরে বাতাসের সঙ্গে মৃদু ঠান্ডাভাব বয়ে আসছে। আম্মা থাকলে নিশ্চিত এখন পৃথাকে বড় করে একটা ধমক দিতো এই রাতের দিকে দরজা খোলা রাখার অপরাধে। আম্মার ভাষ্যমতে গর্ভাবস্থায় নাকি সহজেই মেয়েদের খারাপ বাতাস লেগে যায়। এ নিয়ে পৃথাকে বেশ নিষেধাজ্ঞার তালিকাও তিনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পৃথা সেসবের প্রতি খুবই উদাসীন। এসব ধরাবাঁধা নিয়ম মেনে চলার অভ্যাস তার নেই কখনো।
বিছানার হেডসাইডে পিঠ হেলান দিয়ে বসে আছে সে। শাড়ির আঁচলটা বিছানা গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে আছে অবহেলায়। উদাসী দৃষ্টি বয়ে অভিমানের অশ্রু ঝড়ছে। চরম অভিমান নিয়ে সেদিন ফোন কেটে দেওয়ার পর থেকে সে আর তূর্যর কোনো ফোনকল রিসিভ করে নি। সিন করেনি কোনো ম্যাসেজও। তূর্য নামক মানুষটার উপর তার জমে রয়েছে চরম অভিমান। এই লোকটা পৃথার মিষ্টতাও চুরি করে সাথে নিয়ে দূর দেশে চলে গিয়েছে। পৃথার সব কিছুই এখন তিক্ত মনে হয়।
তার পাশাপাশি তার বাচ্চাটাও হয়তো নিজের বাবার অনুপস্থিতি হারে হারে টের পাচ্ছে। সেজন্যই হয়তো খাবার দাবারের প্রতি জারি করেছে নীরব বিদ্রোহ। গত ক’দিন ধরে পৃথা যাই মুখে দিচ্ছে তা-ই গলা দিয়ে আর নামছে না। বমি হয়ে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে বারবার। হুমায়ুন রশীদ আর আম্মার ঠিক করা আয়না খালা এ নিয়ে বেশ চিন্তিত।
আচমকা কলিংবেলের শব্দটা সম্পূর্ণ বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে তীক্ষ্ণ স্বরে বেজে উঠে। এই সময়ে আবার কে এলো? প্রশ্নটা মনে উঁকি দিলেও পৃথা উঠে গিয়ে দেখার শক্তি খুঁজে পায় না। পাপা আর আয়না খালা নিচে আছে। উনারাই নাহয় দেখে নিবে ভেবে পৃথা নিজের ক্লান্ত চোখ জোড়া বুজে নেয়।
পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মাথায় রুমের দরজার নব ঘুরানোর শব্দ কানে পৌঁছাতেই পৃথা চোখ মেলে পাশ ফিরে তাকায়। মুহুর্তেই তার বিস্মিত, স্তম্ভিত চোখ জোড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু ফোটা জল। তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে নামতে নিলেই শাড়ির আঁচলের সাথে পা পেঁচিয়ে পড়তে নেয়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে একটা বলিষ্ঠ বুকে তার জায়গা হয়। স্তম্ভিত পৃথা সেখান থেকে সড়ে যাওয়ার আর সাহস পেলো না। যদি এটা স্বপ্ন হয়? এই ভয়ে তার শরীর কাঁপিয়ে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে একটা শীতল স্বর বলে উঠে,
“ তোমাকে রেখে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবো না আমি। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]