যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪১.
অপটিক্যাল ফাইবার দ্বারা যেই গতিতে তরঙ্গ চালিত হয় ঠিক একই গতিতে এমপি এবং সংসদ সদস্য পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার খবরটা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। পার্থর আওতায় থাকা পার্টির কর্মীরা ইতিমধ্যে থানার বাহিরে ভীড় জমিয়েছে। সাংবাদিকরা হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে বসে আছে। টিভি চ্যানেল গুলোতেও বর্তমানে হ্যাডলাইন জুড়ে রয়েছে এই খবর। কিন্তু পার্থকে পুলিশ ধরে নেওয়ার কারণ এখনো সবার অজানা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন পুলিশ থানা হতে বের হয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়। সকলের প্রশ্নের উত্তর হিসেবে জানানো হয় যে পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীকে রুবেল হোসেনের খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরিস্থিতি আরো উত্তেজনামূলক হয়ে পড়ে। পুলিশের এরকম ব্রিফ শুনে আসিফ গালাগালি বাদ দিয়ে শান্ত হয়ে পড়ে। মুহুর্তেই সে ভীড় ঠেলে নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে শোভনকে ফোন করে। কিছুক্ষণ রিং বাজতেই শোভন কল রিসিভ করে জানায় সে থানায় আসছে। আসিফ বলে থানায় প্রবেশের আগে যেন তার সাথে একবার দেখা করে শোভন।
পার্থর প্রতি এমন আরোপে পার্টিও বেশ আশ্চর্য হয়ে পড়েছে। যেহেতু বিষয়টা পার্টির রেপুটেশনের সাথে জড়িত তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সঠিক তথ্য প্রমাণসহ যদি পার্থ দোষী সাব্যস্ত হয় তবে ওর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধূলিসাৎ করার আগে তারা একবারও ভাববে না।
উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আরেকটু ঘি ঢালার জন্য এবং টিভি চ্যানেল গুলো আরেকটু টিআরপির আশায় পুলিশের সেই এক লাইন ব্রিফিংয়ের সাথে ভুংচুং মিশিয়ে নতুন নতুন মুখরোচক কিসসা রটানো শুরু করেছে। একটা সম্মান তৈরী করতে মানুষের সম্পূর্ণ জীবন পাড় হয়ে যায় অথচ সেই সম্মানে দাগ লাগাটা কেবল ক্ষানিকের বিষয়।
__________
কিছুক্ষণ আগেও বেশ আমেজে মেতে থাকা চৌধুরী নিবাসে যেন মুহুর্তেই শকুনের নজর লেগেছে। সাদিকা বেগম নিজ চোখে বড় ছেলেকে এই পরিস্থিতিতে পড়তে দেখে শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন নি। কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে বেশ নাজুক অবস্থা হয়ে গিয়েছে উনার। অপরদিকে আফজাল সাহেবও এতক্ষণ উপরে উপরে নিজেকে শক্ত দেখালেও পার্থকে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই উনার শরীর অসাড় হয়ে আসে। স্বভাবত বিপি হাই হওয়ার বদলে উল্টো লো হয়ে যায় উনার। মধুমিতা শশুর এবং শাশুড়িকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। জমিলা খালা থাকায় কিছুটা রক্ষা হয়েছে তার। তূর্য এবং শোভন দুজনেই বেরিয়েছে পার্থর পিছু পিছু।
বাকি রইলো হুমায়ুন রশীদ তো তিনি নিজের মেয়ে এবং পুত্রবধূর চিন্তায় তটস্থ। মেয়ে তো ঘরের দরজা দিয়ে বসে আছে, অপরদিকে পৃথাও স্ট্রেস নিচ্ছে। হুমায়ুন রশীদ যেনো নদীর মাঝে পড়ে গিয়েছেন। এক কূলে দরজার অপরপাশে তার মেয়ে ঠিক আছে কিনা এই চিন্তা তাকে দংশন করছে, তো অপর কূলে তার পুত্রবধূ এই অবস্থায় মোটেও শান্ত থাকছে না। হুমায়ুন রশীদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তা করে তার মেয়ে ঠিকই নিজেকে সামলে নিবে, তার থেকে ভালো আপাতত এই মুহুর্তে পৃথার দিকে খেয়াল রাখা।
__________
থানায় প্রবেশের আগেই শোভন সবার আড়ালে নিরিবিলি এক স্থানে আসিফের সাথে দেখা করতে যায়। শোভন আসতেই আসিফ হতভম্ব গলায় বলে,
“ শোভন ভাই? রুবেলের ওই কাহিনী কি আপনে পুলিশের কাছে ফাস করসেন? “
মুহুর্তেই একটা বিকট ধমকে আসিফের কান তব্দা লেগে যায়। শোভন আগুন ভরা স্বরে বলে,
“ আমাকে তোমার পাগল মনে হয় আসিফ? আমার যদি দাদাকে পুলিশেই দেওয়ার হতো তাহলে আমি একমাস অপেক্ষা করতাম কেন? “
শোভনের গলা শুনে আসিফ ভয়ে একটা ঢোক গিলে। পর মুহুর্তেই সে বলে উঠে,
“ ওইদিন তো ওইখানে শুধুমাত্র আমরা তিনজন এই ঘটনার সাক্ষী ছিলাম। আমরা কেউই যদি এই ঘটনা ফাঁস না কইরা থাকি তাহলে অন্য কেউ কিভাবে জানবো? আমরা ছাড়া অন্য কেউও ওইখানে ছিলো নাকি? “
শোভনের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ দেখা যায়। আপাতত সে মনে মনে আসিফ, শামীম দু’জনকেই সন্দেহের তালিকায় ফেলে রেখেছে। পাশাপাশি আসিফের ধারণাটাও সে মস্তিষ্কে তুলে রেখেছে। এমনও হতে পারে অন্য কেউ সেই ঘটনার সাক্ষী ছিলো। কিন্তু যদি এমন হয় তবে সে একমাস কেন অপেক্ষা করলো এই তথ্য ফাঁস করতে? শোভন গভীর ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলে,
“ আমি ভিতরে যাই। কথা বলে পরিস্থিতি বুঝে আসি। “
কথাটুকু বলেই শোভন আর অপেক্ষা না করে সেখান থেকে প্রস্থান করে।
__________
অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে বিছানার এককোণে নীরবে বসে আছে তরী। তার পাশেই ফোনে লাইভ নিউজ চলছে। সাংবাদিকদের বলা প্রতিটা কথা তীক্ষ্ণ ভাবে তার কানে বারি খাচ্ছে। নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সে। রুবেল হোসেনের মৃত্যুতে পার্থকে দায়ী করাটা তার মোটেও অস্বাভাবিক লাগছে না। তরীর ওই এক্সিডেন্টের পিছনে যে রুবেলের হাত ছিলো তা কারো অজানা নয়। আর সেই এক্সিডেন্টের জের ধরে যে পার্থ রুবেলকে মারতে পারে তাও অবাক করার মতো কিছু নয়। তরী বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
“ আরেকবার তোমার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আমাদের স্বাভাবিক জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। “
ফের তরী বিছানার হেড সাইডে মাথা এলিয়ে দেয়। মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরন মনে হচ্ছে এক এক করে ছিড়ে যাচ্ছে। পার্থর চিন্তা কোনোভাবেই মাথা থেকে দূর হচ্ছে না। জেলে ওর সাথে কি কি হতে পারে ভেবেই তরী শিউরে উঠছে। মস্তিষ্কের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তরী বেড সাইড কেবিনেটের উপর থাকা একটা শো পিস হাতড়ে সামনের দেয়াল বরাবর ঢিল মারে। নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“ আমি যত সব সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, তুমি ততই সব এলোমেলো কেনো করে দিচ্ছো? নিজের রাগের উপর কেন সামান্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলে না? তোমার রাজনীতি, তোমার রাগ বারবার কেন আমাদের জীবনে এতো ঝড় বয়ে আনে? “
__________
শেষ রাতে শোভন বাড়ি ফিরে আসে। আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগম তখন নিজেদের রুমে রেস্ট নিচ্ছেন। পৃথাকেও বহু কষ্টে তূর্য ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছে। আপাতত লিভিং রুমে উপস্থিত রয়েছে কেবল হুমায়ুন রশীদ, তূর্য ও মধুমিতা। শোভন বাড়ি ফিরতেই তিনজন তাকে ঘিরে ধরে। সর্ব প্রথম হুমায়ুন রশীদ শোভনকে প্রশ্ন করে,
“ পার্থর উপর যেই অভিযোগ লাগানো হচ্ছে তার সত্যতা কতদূর? “
শোভন নিজের ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে ক্ষানিকক্ষণ চোখ বুজে রয়। মুহুর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠে শৈশবের কিছু স্মৃতিমাখা চিত্র। শোভনের করা কত শত ভুল যে পার্থ নিজের উপর তুলে নিতো তা অগণিত। মায়ের কতো মার থেকে যে দাদা তাকে বাঁচাতো সেজন্য শোভন কখনো দাদাকে একবার ধন্যবাদও বলে নি। তবে আজ অকপটে একটা মিথ্যা বলে সেই হিসাবটা মিটিয়ে দেয় শোভন। ক্লান্ত গলায় শুধায়,
“ সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। “
মধুমিতা স্বামীর জন্য এক গ্লাস পানি এনে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ দাদার কি অবস্থা? তোমার দেখা হয়েছে উনার সাথে? ছাড়ানোর কোনো উপায় নেই? আব্বা, আম্মা আর ভাবীর অবস্থা ভয়ানক। উনাদের কি বলবো? “
শোভন পানির গ্লাসটা হাতে নিলেও আর সামান্যতম পানি মুখে না তুলেই জবাব দেয়,
“ অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু দেখা করার কোনো সুযোগ দেয় নি। সব পুলিশ কেমন একগুঁয়ে আচরণ করছে। তার উপর ভাইয়ার নামে চার দিনের রিমান্ড জারি করে দিয়েছে। আগামী চার দিনে দেখা করার আর কোনো সুযোগ নেই। “
মধুমিতা ব্যস্ত গলায় বলে,
“ তুমিও তো পুলিশ। তোমাকে কেন দেখা করার অনুমতি দেয় নি? “
শোভন এবার শান্ত গলায় বলে উঠে,
“ আমার নিজের চাকরি সংকটে পড়ে গিয়েছে মধু। সবাই এতোদিন জানতো রুবেল হোসেন পুলিশের ইনকাউন্টারে আমার গান দ্বারা নিহত হয়েছে। আজ আচমকাই সবাই এক নতুন তথ্য পেলো। সব দিক থেকে আমি বাঁধা পড়ে যাচ্ছি। “
মধুমিতা আহত দৃষ্টি মেলে শোভনের দিকে তাকিয়ে রয়। হুমায়ুন রশীদও নীরব থাকে। তূর্য এই মুহুর্তে বলার মতো কথা খুঁজে পায় না। সে নিজের তরফ থেকে কেবল ভুয়া নিউজ প্রচার হতে যতদুর রোধ করা সম্ভব তা চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর বাহিরে তার আর কিছু করার নেই।
এরকম থমথমে পরিবেশে জমিলা খালা কাচুমাচু করে সেখানে উপস্থিত হয়ে বলে উঠে,
“ সেহেরির সময় হইয়া গেসে। আপনেরা সেহরি করবেন না? “
কেউ কোনো জবাব দেয় না। মধুমিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,
“ আংকেল, তূর্য ভাইয়া প্লিজ চলুন আপনারা। “
হুমায়ুন রশীদ কোনো কথা বলে না। তার মেয়ে কি অবস্থায় আছে কে জানে! এই অবস্থায় উনার গলা দিয়ে এক লোকমাও ভাত নামবে না। মধুমিতা আবার কিছু বলতে নিবে তখনই পিছন থেকে একটা থমথমে নারী স্বর বলে উঠে,
“ শোভন, পাপা, তূর্য চুপচাপ উঠে খেয়ে নাও তোমরা। “
মুহুর্তেই সবাই চমকে তাকায় পিছনে। তরীকে দেখেই হুমায়ুন রশীদের বুক মুচড়ে উঠে। তার মেয়ের চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে এতক্ষণ কান্নাকাটি করেছে। তরী আর তাদের জবাবের অপেক্ষায় থাকে না। জমিলা খালাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
“ খালা টেবিলে খাবার নিয়ে আসুন। “
জমিলা খালা আচ্ছা বলে চলে যেতেই তরী মধুমিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“ আব্বা আম্মা কি করছেন? “
“ দুজনেই রুমে জেগে আছেন। “
তরী এবার একহাতে নিজের চুলগুলোকে হাত খোপা করে নিতে নিতে বলে,
“ তুমি সবাইকে নিয়ে খেতে বসো। আমি আব্বা আম্মার খাবার নিয়ে যাচ্ছি। “
বলেই তরী রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। এরপর আর কেউ কোনো কথা বলে না। সবাই নীরবে উঠে যায় সেহেরি করতে।
__________
সদা শক্ত চিত্তে ঘুরে বেড়ানো চৌধুরী নিবাসের প্রধান খুঁটি আফজাল সাহেব কেবল কিছু ঘন্টার ব্যবধানেই বেশ নরম হয়ে পড়েছেন। শরীরে কিংবা মনে কোনো ধরনের জোর অনুভব করছেন না তিনি। উনার একপাশেই বিছানায় শুয়ে নীরবে ফুপিয়ে কাঁদতে ব্যস্ত সাদিকা বেগম। আর তাদের সামনে খাবারের প্লেট হাতে বসে রয়েছে তরী। সে বেশ শান্ত গলায় বলে উঠে,
“ দয়া করে খেয়ে নিন আপনারা। এসব করে নিজেরা অসুস্থ হয়ে পড়বেন না। “
আফজাল সাহেব মৃদু গলায় বলে,
“ তোমার আম্মাকে জোর করে একটু খাইয়ে দাও। আমার খিদে নেই মা। “
“ খিদে মিটানোর জন্য খেতে হবে না আব্বা। আমার আবদারটুকু রাখতেই নাহয় খেয়ে নিন। “
কথাটুকু বলেই তরী সাদিকা বেগমের পায়ের পাতা মৃদু হাতে ছুঁয়ে বলে,
“ আম্মা প্লিজ উঠুন। “
সাদিকা বেগম চাপা স্বরে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে,
“ আমার ছেলেকে কেউ বাসায় নিয়ে আসো। শোভনরে! তোর দাদাকে বাসায় নিয়ে আয় রে বাবা। আমার ছেলে ওইখানে থাকতে পারবে না। “
সাদিকা বেগমের আর্তনাদ শুনেও তরী দমে যায় না। সে বেশ জোর খাটিয়েই দু’জনকে কিছুটা খাইয়ে দিয়ে নিজে দেখে ওষুধ খাওয়ায়। অত:পর বের হওয়ার আগে সে দুজনের সামনে বসে বলে উঠে,
“ আপনাদের ছেলের চিন্তা করে নিজেরা ভেঙে পড়বেন না প্লিজ। চিন্তার ভারটা দয়া করে আমার উপর ছেড়ে দিয়ে আপনারা শক্ত থাকুন। “
__________
শোভন নামেমাত্র দুয়েক লোকমা মুখে তুলে সেহেরিটা কেবল সেরেছে। এই মুহুর্তে সে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। আজান পড়তে এখনো বিশ-পঁচিশ মিনিট বাকি। সে শান্ত মস্তিষ্কে কিছু একটা ভাবতে ব্যস্ত। তখনই পিছন হতে একটা নারী কণ্ঠ শুনে সে চমকে ফিরে তাকায়। তরী বেশ শান্ত ভঙ্গিতে তার থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,
“ ওকে কি ওখানে অন্তত সেহরির খাবারটুকু দিবে? “
শোভন নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
“ আপনি অভুক্ত না থেকে খেয়ে নিন ভাবী। “
তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শোভনের তার প্রশ্নে নিরুত্তর রয়ে বলা অন্য কথাটার মানে সে ভালোই বুঝতে পারছে। তাই সে আর কোনো ভনিতা না করে বলে,
“ আমি তোমার দাদার সাথে দেখা করতে চাই শোভন। যেকোনো মূল্যে। তুমি ব্যবস্থা করে দিতে পারবে? “
শোভন আঁতকে উঠে বলে,
“ দাদা মানা করে গিয়েছে যেনো আপনাকে কোনো ভাবেই থানায় যেতে না দেই। আর আপনার জন্যও সেটা শোচনীয় জায়গা নয়। “
“ তুমি তোমার দাদার এতো বড় ভক্ত তা আমার আগে জানা ছিলো না। “
তরীর দৃঢ় স্বরের চাপে শোভন পিষ্ট হয়। আসলেই তো। সে তো আগে কখনো ভাইয়ের নেওটা ছিলো না। ইদানীং তার কি হয়েছে? নিজের মনের ভাবনাগুলোকে একপাশে রেখে শোভন বলে উঠে,
“ শুধু মাত্র দাদা আদেশ দিয়েছে বলে আমি মানা করছি না। বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করুন। “
“ তুমি ব্যবস্থা করতে না চাইলে স্পষ্ট জানাও শোভন। আমি নিজের মতো করে অন্য ব্যবস্থা করে নিবো। “
শোভন আরেকবার আঁতকে উঠে বলে,
“ প্লিজ ভাবী এসব বলবেন না। আমার সিচুয়েশনটা বুঝুন। “
“ আমি সবার সিচুয়েশনই খুব ভালো করে বুঝছি শোভন। কিন্তু কেউ আমার সিচুয়েশন বুঝতে চাইছো না। আমার জন্য পরিস্থিতিটা আর জটিল করে তুলো না। আই নিড টু সি হিম। “
শোভন হাল ছেড়ে বলে,
“ আগামী চারদিনের মধ্যে দেখা করানো সম্ভব না ভাবী। দাদাকে রিমান্ডে নেওয়া হবে আগামীকাল। “
রিমান্ডের কথা শুনতেই তরীর খোলসে আবৃত রূপে ভাটা পড়ে। রিমান্ডে প্রশ্ন করার নাম করে কি ধরনের পাষবিক নির্যাতন করা হয় সেই সম্পর্কে একবার শুনেছিলো তরী। সেই বিবরণ অনুযায়ীই কি পার্থর উপর নির্যাতন চলবে? তরীর সম্পূর্ণ শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে। কিন্তু সে এই মুহুর্তে শোভনের সামনে কান্না করতে চায় না। তাই দ্রুত হেঁটে সেখান থেকে প্রস্থান করে।
তরীর যাওয়ার পানের দিকে তাকিয়ে থেকে শোভন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তখনই নীরবতা ভেঙে তার ফোনটা শব্দ তুলে বেজে উঠলো। শোভন ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই অপরপ্রান্ত হতে কিছু কথা ভেসে এলো। সেই কথার পিঠে শোভন জ্বলে উঠা গলায় বলে উঠে,
“ তুমি কি নিশ্চিত তথ্য দিচ্ছো? “
পরপর ওইপাশ থেকে আরো দু চারটে কথা ভেসে আসে। শোভন কেবল দ্রুত গলায় বলে উঠে,
“ আমি আসছি। ওকে দ্রুত খুঁজে বের করে আমার পাঠানো ঠিকানা অনুযায়ী নিয়ে আসো। একটা কাক পক্ষী যেনো টের না পায়। “
__________
নির্দিষ্ট ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছাতেই শোভন দেখতে পায় চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা অবস্থায় একজনকে। তার পাশেই নীরবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন। শোভন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের রাগ কিছুটা সামলে নেয়। অত:পর সেই বাঁধা মানুষটার সামনাসামনি গিয়ে তার দিয়ে কিছুটা ঝুঁকে প্রশ্ন করে,
“ কেনো করলে এমন? “
চলবে…
যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪২.
শক্ত পোক্ত রোলারের আঘাত গায়ে পড়তেই পার্থ দাঁত ও চোখ খিচে ব্যথাটা সহ্য করে নেয়। গত চারদিন ধরে রিমান্ডে আছে সে। আজ শেষ দিন। তবুও এই দানবীয় পুলিশদের থামাথামির কোনো নাম নেই। তাদের এই অত্যাচারের কারণ যে শুধুমাত্র পার্থর মুখ বন্ধ রাখা নয় তা সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। সুযোগ পেয়ে তার শত্রুরা ভিতরের কিছু সংখ্যক পুলিশকে কিনে নিয়েছে। আদেশ একটাই যেন পার্থ মুন্তাসির মরণের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত নিজের জেলে কাটানো এই দিনগুলোর অভিজ্ঞতা না ভুলতে পারে।
আসলেই পার্থ এই দিনগুলো কখনো স্মৃতির পাতা থেকে মুছতে সক্ষম হবে না। এইযে তার দু’হাত বেঁধে তাকে বেধড়ক ভাবে মারতে মারতে সম্পূর্ণ শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছে এই স্মৃতি কি আদৌ ভুলে যাওয়া সম্ভব? উঁহু।
একজন পুলিশ আরেকদফা পার্থর শরীরে আঘাত করে প্রশ্ন করে,
“ তুই কি মুখ খুলবি না? “
পার্থ মুখ খুলে না। রিমান্ডে আসার আগে তার উকিল খুব স্বল্প সময়ের জন্য তার সাথে দেখা করেছিলো। তখন তিনি পার্থকে বলে, রিমান্ডে যাই হয়ে যাক না কেন পার্থ যেন হ্যাঁ না কোনো জবাব না দেয়। এই সময়ের মধ্যে তিনি নিজের মতো করে কেসটা সাজিয়ে নিবেন। পার্থ ভুলেও হ্যাঁ জবাব দিলে তাকে এই জেল থেকে ছাড়ানোর সাধ্যি কারো নেই।
পার্থ উকিলের কথা মেনে নেয়। যদিও রুবেলের মতো জানোয়ারকে মেরেছে এই কথা স্বীকার করতে তার কোনো ভয় নেই। কিন্তু আজীবন এই জেলে বন্দী জীবন পাড় করাও তার দ্বারা সম্ভব নয়। আব্বা, আম্মা, তরী এই তিনটা গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ভালো থাকার জন্য হলেও তার এখান থেকে বের হতে হবে। মানুষগুলো নিশ্চয়ই তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে রয়েছে? মুহুর্তেই পার্থর চোখের সামনে ভেসে উঠে তরীর প্রতিচ্ছবি। তীব্র যন্ত্রণা গায়ে নিয়েও পার্থ চোখ বুজে মৃদু হাসে। এই দৃশ্য দেখে একজন পুলিশ বলে উঠে,
“ মাইর খাইতে খাইতে পাগল হইয়া গেলো নাকি? “
অপর পুলিশ আরো রাগে ফেটে পড়ে এবার পার্থর বা পায়ের হাঁটু বরাবর জোরে রোলার দ্বারা আঘাত করে। পার্থ এবার চোখ মেলে সামনের পুলিশের দিকে তাকায়। তীব্র ব্যথা নিয়েও সে চোখ দ্বারা বুঝিয়ে দেয় যে এসব কিছুই তার মুখ খোলাতে পারবে না। ব্যর্থ পুলিশ এবার রাগ হয়ে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায়। অপরজনও তার পিছু পিছু বেরিয়ে যায়। পার্থ ফের চোখ বুজে নেয়। মনে মনে আওড়ায়,
“ দেশে লুটপাট চালানো কালো সম্পত্তির অধিকারী খুনীদের কি কখনো এভাবে অতিথি আপ্যায়ন করা হবে না আদৌ? “
__________
গায়ে হালকা ঘিয়ে রঙের একটা থ্রি-পিস এবং তার সাথে বিশাল শাল জড়ানো নারীটা একজন পুলিশ কর্মকর্তার পিছু পিছু হাঁটছে। দিনের বেলা হওয়া সত্ত্বেও জেলের ভিতরের এই জায়গাটা মৃদু আলো এবং ব্যাপক আধারের সমান্বয়ে ছেঁয়ে আছে। আরো কয়েক কদম হেঁটে এগুতেই পুলিশ অফিসারটা থেমে গেলো। তাকে অনুসরণ করে সেই নারীর কদম জোড়াও থেমে গেলো। অফিসার পিছু ফিরে বেশ ভদ্র ও বিনয়ী ভঙ্গিতে বললো,
“ এই বাম দিকের লাস্ট সেলটার সামনে গেলেই দেখতে পারবেন। কিন্তু সময় বেশিক্ষণ দেওয়া যাবে না। আমারও চাকরির চিন্তা আছে। আশা করি বিষয়টার তাৎপর্য বুঝবেন ম্যাডাম। “
সেই নারী কোনো প্রতুত্তর করলো না। কেবল নীরবে মাথা নেড়ে বাম দিকের দেখিয়ে দেওয়া পথ অনুসরণ করলো। ধীরে সুস্থে বাইশ কদম এগিয়ে যেতেই সে পৌঁছে যায় কাঙ্ক্ষিত সেলটার সামনে। তার পা জোড়া আপনা আপনি গতিহীন হয়ে পড়ে। নীরবে দাঁড়িয়ে নিষ্প্রভ দৃষ্টি মেলে সেলের ভিতরের দিকে তাকিয়ে রয়।
দূর হতে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই মাথা তুলে তাকায় পার্থ। শিকের অপর পাশে থাকা নারীর অর্ধ মুখশ্রী মাস্কের আড়ালে ঢাকা। কিন্তু তাকে চিনতে মোটেও অসুবিধা হয়না পার্থর। সে সম্বিত হারিয়ে তড়াক উঠে দাঁড়াতে নিলেই পায়ের তীক্ষ্ণ ব্যথায় চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলে। অত:পর ফের চোখ মেলে যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে এগিয়ে যায় সামনে। লোহার শিকের কাছাকাছি আসতেই সে বেশ থমথমে গলায় বলে উঠে,
“ শোভনকে মানা করেছিলাম যেন তোমাকে থানার দর্শন না করায়। ও সোজা তোমাকে জেলের দর্শন করার ব্যবস্থা করে দিলো। “
কি তেজ সেই কণ্ঠে। কে বলবে এই মানুষ গত চারদিন রিমান্ডে ছিলো? সেই তেজী স্বরে বলা বাক্য দুটিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তরী নীরবে দুই পা এগিয়ে লোহার শিকের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। তাদের মাঝে কেবল এক কদমের দূরত্ব এই মুহুর্তে। কিন্তু এই লোহার শিক যেন সেই এক কদমের দূরত্ব ঘোচানোর পথে সুউচ্চ বেড়ির ন্যায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তরী শিকের ফাঁক গলে নিজের একহাতে ছুঁয়ে দেয় পার্থর গাল। সাথে সাথে পার্থ চোখ বুজে নেয়। গাল গড়িয়ে সেই হাতের ছোঁয়া গিয়ে পৌঁছে পার্থর ডান চোখ হতে এক আঙ্গুল সমান দূরের জায়গাটিতে। মুহুর্তেই ক্ষত স্থান তীব্র ব্যথায় বিষিয়ে উঠে। পার্থ তবুও তরীর সামনে শক্ত থাকতে দাঁত খিচে সেই যন্ত্রণাটা সয়ে নেয়। কিন্তু তরী আর শক্ত থাকতে পারে না। গত ক’টা দিন ধরে এই শক্ত খোলসে আবৃত থেকে সে হাপিয়ে উঠেছে। মাস্কের ভিতর সে ঠোঁট কামড়ে কান্নার স্বর আটকে রাখার চেষ্টা করে। মুহুর্তেই ধপ করে শিকের কাছ ঘেঁষে নিচে বসে পড়ে সে। দু হাতে মুখ ঢেকে নিজের কান্না আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
পার্থ চোখ মেলে দেখে তরী নিচে বসে আছে। তার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস। পার্থ নিজেও ধীরে তরীর মুখোমুখি হয়ে বসে। কিছু বলতে নিবে তার আগেই তরী রুদ্ধস্বরে বলে উঠে,
“ আর কারো সামনে আমি নিজের আবেগ প্রকাশ করি নি। আপনার সামনেই কেবল করছি। বাঁধা দিবেন না দয়া করে। সম্ভব হলে আমার এই আবেগের যথার্থ মূল্যায়ন করুন। “
এতোদিন পর স্বীয় স্ত্রীর মুখে আপনি সম্বোধন শুনে পার্থ নীরব বনে যায়। একসময় তরী সবসময় তাকে আপনি বলে সম্বোধন করলেও, সময়ের পরিক্রমায় এখন কেবল অভিমান কিংবা রাগ হলেই তরী আপনি টার্মটা ব্যবহার করে। কিছু মুহুর্তের ব্যবধানেই তরী নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে সোজা হয়ে তাকায় পার্থর পানে। দৃষ্টি মিলন হতেই তরী বলে,
“ আরো একবার আপনার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আমাদের সুখে ভাটা দিয়ে গেলো। “
পার্থ নীরবতা ভেঙে বলে,
“ আমি তোমাকে সত্যিকার অর্থেই সুখী রাখতে চাই তরী। “
তরী বেদনাদায়ক হাসি দিয়ে বলে,
“ আপনি আমাকে বলেছিলেন সিচুয়েশন সেফ এন্ড সিকিউরড হতেই আমাদের স্বপ্নের ভাই কিংবা বোনকে আমরা পৃথিবীতে আনবো। কিন্তু তা কখনো সম্ভব না। ইউ নো হোয়াই? কারণ আপনি যতদিন রাজনীতিতে জড়িত ততদিন আমাদের লাইফে সেফ এন্ড সিকিউরড টার্মটা কখনোই আসবে না। আপনার রাজনীতি আপনারসহ আপনার পুরো পরিবারের নিরাপত্তায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকম অবস্থায় আপনার মামির বলা কথাটাই এখন আমার সত্যি মনে হচ্ছে। আপনি রাজনীতিতে জড়িত থাকায় আমাদের এক সন্তান হারানোর দুঃখ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আপনি যদি রাজনীতিতে আজীবন জড়িত থাকেন তাহলে হয়তো আসলেই আমার বাচ্চা কখনোই পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না। “
পার্থ ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,
“ কি বলতে চাইছো? “
তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি পার্থ। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে আমার। এই অনিশ্চয়তাপূর্ণ জীবন থেকে আমাকে মুক্তি দিন। রাজনীতিটা ছেড়ে দিন। আমরা ভালো থাকবো। “
তরীর কথার পিঠে পার্থ একটাও টু শব্দ করে না। তরী অধৈর্য্য গলায় বলে,
“ আব্বা আম্মার কথা ভাবুন একবার। এই বয়সে উনাদের এই চিন্তাটা না দিলেই কি নয়? আপনাকে এই অবস্থায় দেখে আমার কেমন লাগছে তা কি আপনি বুঝতে পারছেন না? এই জ্বলজ্যান্ত মানুষগুলোর অনুভূতির মূল্যায়ন কি আপনি তাদের কষ্ট দিয়ে করবেন? “
পার্থ এবারও নীরব রয়। তরী ফের হাত বাড়িয়ে পার্থর গাল ছুঁয়ে লোহার শিকে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে নেয়। রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ সত্যি বলছি আমরা ভালো থাকবো। ভালো থেকে দেখিয়ে দিবো। আমার এই আবদারটা মেনে নিন। “
তরীর কণ্ঠে মিশ্রিত তীব্র আকুলতা পার্থর হৃদয় দ্বারে তুফান হয়ে হানা দেয়। তবে সেই তুফানের প্রকোপ পার্থর হৃদয়ের তুখোড় দ্বার পেরিয়ে আর চৌকাঠে প্রবেশ করতে পারে না। সে তরীর কপাল বরাবর শিকের অপর পাশ হতে নিজের কপাল ঠেকায়। নিজের গালে থাকা তরীর হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে তাতে চুমু খায়। এতদিন পর পার্থর স্পর্শ পেয়ে তরীর নয়ন যুগল ফের ভরে আসে। রাগ অভিমানের পাল্লা ভুলে গিয়ে সে নরম সুরে অভিযোগ তুলে,
“ আমি ভালো নেই পার্থ। ওই ঘরটাতে তোমাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এসব ছেড়ে দয়া করে ফিরে আসো। তোমার ঘর, তোমার পরিবার, তোমার তরী সবাই তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। “
পার্থ এবার শান্ত স্বরে শুধায়,
“ আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তরী। প্রতিজ্ঞা ভেঙে বেইমানি করা আমার স্বভাবে নেই। হোক সেইটা রাজনীতির ক্ষেত্রে অথবা সম্পর্কের ক্ষেত্রে। “
পার্থর এহেন কথা শুনে তরী সাথে সাথে দূরে সড়ে যায়। এক মুহুর্ত পার্থকে দেখে নিয়ে নিজের চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। অপরদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেই পিছন থেকে পার্থর স্বর ভেসে আসে,
“ ডাক্তার, এতদূর এসেছেন অন্তত মুখদর্শনের সুযোগ দিন এই অধমকে। “
তরী নরম হয় না। পার্থ কি তার আবদার রেখেছে যে সে পার্থর আবদার মানবে? কখনোই না। তরী দুই হাতে গায়ের শাল দৃঢ় ভঙ্গিতে আঁকড়ে ধরে পিছু না ফিরেই সেখান থেকে প্রস্থান করে। পার্থ নীরবে সেই পানে চেয়ে হাসে। অত:পর অস্ফুটে বলে উঠে,
“ বড় নিষ্ঠুর আপনি ডাক্তার। প্রাণ পিপাসায় তৃষ্ণার্ত মরিজকে চিকিৎসা না দিয়ে উল্টো তার সামান্য ওষুধের আবদারও নাকোচ করলেন। “
__________
বিশ্বাসঘাতকতা কখনো দূরের মানুষ করে না। বরং খুব কাছের মানুষই আজীবন নীরবে পিঠে ছুড়ি চালায়। ইশতিয়াক ভুইয়ার লোক পার্থর উপর নজর রাখছে জানতে পেরে আসিফ পার্থর কথায় নিজের বিশ্বস্ত দু’জন লোককে ইশতিয়াক ভুইয়ার উপর নজর রাখতে পাঠায়। তাদের মধ্যে একজন দূর্ভাগ্যবশত ধরা খেয়ে যায়। সেই একজনকে ইশতিয়াক ভুইয়ার সামনে পেশ করা হলে ইশতিয়াক ভুইয়া তাকে বেশ লোভনীয় কিছু প্রস্তাব দেয়। তার মধ্যে একটা প্রস্তাব ছিলো যে তাকে বড় পদ দেওয়া হবে। বিনিময়ে তাকে পার্থর ব্যাপারে যেকোনো এমন তথ্য দিতে হবে যা দ্বারা পার্থর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করা যাবে।
কথায় বলে লোভ হলো মানুষের স্বভাবের একটা বৈশিষ্ট্য মাত্র। কিন্তু এই লোভ সংবরণ করার চাবিকাঠিও মানুষের হাতেই থাকে। কেউ যদি নিজ হতে নিজের লোভের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারে তবে অন্য কেউ তাকে সেই পথ থেকে ফেরাতে পারবে না। কথাটা একদম যথার্থ। ইশতিয়াক ভুইয়ার এমন প্রস্তাবে নিজের লোভ সামলাতে না পেরে সেই ব্যক্তি পার্থর ব্যাপারে একটা সিক্রেট ফাঁস করে দেয়। এমনকি নিজে পার্থর বিপক্ষে সাক্ষীও দেয় পুলিশের কাছে।
এই সম্পূর্ণ ব্যাপারে সবথেকে দুঃখজনক বিষয় হলো মানুষটা আর কেউ নয় বরং শামীম। পার্থর খুব কাছের, খুব বিশ্বস্ত মানুষ। আর এই সত্যিটা জানার পর থেকেই আসিফ খুব চটে আছে। সে ঘুণাক্ষরেও একবারের জন্য শামীমকে সন্দেহ করে নি। কিভাবে করবে? তার মতো শামীমও এতো বছর ধরে পার্থর ভালো খারাপ সময়ে তার পাশে ছিলো। এই যুগে বিশ্বস্ততা কি এতোই সস্তা যে কেবল সামান্য এক পদের লোভে এত বছরের একনিষ্ঠতা ভুলে যেতেও মানুষ সময় নেয় না? কে জানে!
শামীমের ভাগ্য ভালো যে শোভন তাকে ছেড়ে দিয়েছে। নাহলে রাগচটা আসিফ পারলে শামীমকে সোজা খুন করে ফেলতো। আসিফের মাথায় এখন কেবল একটাই চিন্তা কি করে পার্থকে জেল থেকে বের করে আনা যায়। ইতিমধ্যে পার্থর শুনানির তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আর দু’দিন পরেই তার কেসের শুনানি হবে। শোভন আর পার্থর উকিল মিলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যেন সেদিনই পার্থকে ছাড়াতে পারে। কিন্তু আদৌ তা সম্ভব হবে তো?
আচমকা আসিফের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সে সাথে সাথে শোভনের নাম্বারে কল দেয়। শোভন কল রিসিভ করতেই আসিফ বলে,
“ ভাই উকিলের সাথে কি দেখা করা যাইবো? ভাইরে নির্দোষ প্রমাণ করার একটা পথ খুঁইজা পাইসি। “
__________
রুম জুড়ে পায়চারি করতে করতে ফোনকলে ব্যস্ত তূর্য। অফিসে জরুরি বিষয়ে ফোন আলাপের মাঝেও আড়চোখে পৃথাকে দেখছে সে। গোলগাল ফর্সা মুখটায় ছেঁয়ে আছে এক আকাশ পরিমাণ আধার। নীরবে বসে সে তূর্যর হ্যান্ড লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত। আগামীকাল তূর্যর ফ্লাইট আছে নিউজিল্যান্ডে। স্পোর্টস নিউজ কাভারের জন্য তার অফিস থেকে চার জনকে নির্ধারণ করা হয় নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক অবনতির ফলে হাসপাতালে ভর্তি। তাই তার জায়গায় প্রক্সিতে তূর্যকে যাওয়ার অফার করা হয়। তূর্য সেই অফার নাকোচ করে না। বস তাকে ভরসা করে একটা দায়িত্ব দিয়েছে সেটা মানা করে দিলে একটা বাজে ইম্প্রেশন ক্রিয়েট হতো তার। আর তাছাড়া বসের গুড বুকসে থাকার মানে হলো প্রমোশনের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাওয়া। কোন মানুষই বা নিজের শখের চাকরিতে পদোন্নতি পাওয়ার চান্স হাত ছাড়া করবে?
ফোনে কথা বলতে বলতেই তূর্য বারান্দায় চলে যায়। পৃথা মুখ কালো করে বসে রয়। এভাবেই বড় দা’র চিন্তায় সে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। এসবের মাঝে তূর্যও আগামীকাল চলে যাবে। অথচ আজ পৃথাকে একটু সময়ও দিচ্ছে না। লোকটা কি তার প্রতি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলছে? এসব উদ্ভট ভাবনার ফলে অষ্টাদশীর মন আকাশে মেঘ জমে। তখনই হঠাৎ তার ফোন শব্দ তুলে বেজে উঠে। পৃথা চমকে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। অত:পর তার ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। ফোনের স্ক্রিনে গোটা ইংরেজিতে ভেসে উঠেছে মিস্টার এক্স ওয়াই জেট নামটি। তূর্য বারান্দা থেকে তাকে কল করছে কেন? পৃথা ফোন হাতে নিয়েই গলা ছেড়ে ডাকে,
“ তূর্য? বারান্দা থেকে কল দিচ্ছেন কেন? “
কোনো জবাব আসে না। থাই গ্লাসের সামনের পর্দা দুটো টানা থাকায় তূর্যকে দেখাও যাচ্ছে না। পৃথা ভ্রু কুচকে রেখেই ফোন রিসিভ করে কানে দেয়। সে কিছু বলার আগেই অপরপাশ থেকে তূর্য গভীর স্বরে বলে উঠে,
“ চলো আবার ফিরে যাই ফোনালাপের সেই সময়ে, যখন তুমি আমার জীবনে এসেছিলে মিস এ বি সি হয়ে। “
তূর্যর ভরাট গলায় বলা এমন অদ্ভূত কবিতা পৃথার ভারী পছন্দ হয়। সে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ কি হয়েছে বলুন তো? হঠাৎ কবিগুরু সাজতে চাইছেন? “
“ এই সাময়িক বিচ্ছেদ আমাকে বানিয়ে দিয়েছে কবি, যদি থাকতো আমার কোনো ছোট ভাই তবে ডাকতো তোমায় ভাবি। “
পৃথা এবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে সে বলে,
“ নাইস ট্রাই। রেটিং ফাইফ আউট অফ টেন। “
পৃথার হাসির পিঠে তূর্য আর হাসে না। সে একই স্বরে বলে,
“ রেটিং দিয়ে ভেঙো না আমার মন,
আমি চলে গেলে পাশে রবে ক’জন? “
পৃথা ততক্ষণে ফোন কানে ধরে রেখেই ধীর পায়ে বারান্দায় পৌঁছে যায়। বারান্দায় প্রবেশ করতেই দেখে তূর্য অপরপাশে রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। একহাত নিজের ট্রাউজারের পকেটে গুজে অপর হাতে ফোন কানে ধরে পৃথার দিকে তাকিয়ে আছে। পৃথা ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে আসতেই তূর্য কান থেকে ফোন নামিয়ে পৃথাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে। নরম স্বরে বলে,
“ হ্যাপি বার্থডে ওয়াইফি। “
তূর্যর বুকে লেপ্টে থাকা অবস্থায়ও পৃথা কানে ফোন গুজে রেখেছে। তূর্যর কোমল উইশ পেতেই পৃথার এতক্ষণের মন খারাপটা সুতো কাঁটা ঘুড়ির ন্যায় উড়ে চলে গেলো। মুখ তুলে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে,
“ আপনার মনে ছিলো? “
“ অবশ্যই। পাপাও জানে। ইতিমধ্যে নিচে আমাদের জন্য ওয়েট করছে কেক নিয়ে। “
পৃথা ফোন নামিয়ে বলে উঠে,
“ তাহলে অপেক্ষা করছেন কেন? চলুন। “
বলেই পৃথা যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু তূর্য তাকে আবার টেনে নিজের সামনে এনে দাঁড় করায়। পৃথার ঘাড়ে পড়ে থাকা রেশমী চুলগুলোকে খুব যত্নে দু’হাতে তার কানের পিছনে গুজে দিয়ে বলে,
“ আপাতত পাঁচ মিনিট আমার জন্য বরাদ্দ থাকুক। “
পৃথা লজ্জা আড়াল করে তাড়া দেখিয়ে বলে,
“ কি বলবেন চটজলদি বলুন। “
তূর্য পৃথার কোমর জড়িয়ে ধরে বলে,
“ পরের বছর থেকে রাত বারোটায় তোমাকে উইশ করার সুযোগ আর পাবো না। প্লিজ তাড়া দেখিও না আজ। “
পৃথা চোখ কুচকে প্রশ্ন করে,
“ মানে? “
“ মানে তখন আর এভাবে তোমাকে একা পাওয়া হবে না। বেবিও থাকবে সাথে। তখন অন্যভাবে উইশ করবো। “
পৃথা মুখ টিপে হেসে বলে,
“ বেবি তো এখনো আমাদের মাঝে আছে। “
তূর্য হাসে। কোমর থেকে একটা হাত সরিয়ে তা পৃথার পেটের উপর রাখতেই পৃথা প্রশ্ন করে,
“ কি করছেন? “
তূর্য খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে গভীর স্বরে বলে,
“ এখন ও আর দেখবে না। “
পৃথা প্রশ্ন করতে চায় কি। কিন্তু সেই সুযোগ আর পায় না। নিজের অধরে অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়া টের পেতেই শরীর জুড়ে শিরশিরে অনুভূতি বয়ে যায়। তূর্য নিজের ঠোঁট জোড়া পৃথার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“ আগামী একমাসের জন্য সত্যিকার অর্থে তোমার ফোনালাপের স্বামী হতে যাচ্ছি। উইশ মি লাক। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]