যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৯.
সকাল সকাল তরীর চলে যাওয়ার খবর শুনে হুমায়ুন রশীদ বেশ অবাক হলেন। তার মেয়ের কি কোনো ভাবে যত্ন আত্মী কম হয়েছে যে মেয়েটা মাঝ রাতে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো? হুমায়ুন রশীদের চিন্তা তূর্য বুঝতে পারে। তাই বলে উঠে,
“ আপির এই মুহুর্তে পার্থ ভাইয়ার সঙ্গের সবথেকে বেশি প্রয়োজন। এই বাসায় এসেও হয়তো সেই অভাবই অনুভব করছিলো। সেটা বুঝতে পেরেই ভাইয়ার কাছে চলে গিয়েছে। ভালোই হয়েছে। এই মুহুর্তে দু’জন একসাথে থাকলেই দ্রুত এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারবে। “
তূর্যর কথার পিঠে হুমায়ুন রশীদ আর কিছু বলে না। যদিও মনে মনে সে পার্থর প্রতি ক্ষুদ্ধ। কিন্তু তা সবার সামনে অযথা প্রকাশ করার মানে হয় না। যেখানে তার মেয়ে নিজেই সেই ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিলো সেখানে হুমায়ুন রশীদের রাগ দিয়েই বা কি আসে যায়? উনার কেবল একটাই চাওয়া, যে উনার মেয়ে যেনো ভালো থাকে। তার মেয়ে যদি পার্থ নামক মানুষটার কাছে ভালো থাকা খুঁজে পায় তাহলে সেটাই নাহয় হোক।
নাস্তার টেবিলে তূর্যের কথা শুনে সাদিকা বেগম চিন্তিত হয়ে পড়ে। মধুমিতার তো প্রায়ই দিনের বেলা ক্লাস থাকে। আফজাল সাহেব, শোভন এবং পার্থও দিনের বেলা বাহিরে থাকে। ঘরে থাকে শুধু জমিলা। জমিলা ঠিকঠাক খেয়াল রাখতে পারবে তো তরীর?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সাদিকা বেগম রুমের ভেতর গিয়ে জমিলাকে ফোন দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে জমিলা খালা ফোন রিসিভ করে বলে উঠে,
“ আসসালামু আলাইকুম খালাম্মা। “
“ ওয়ালাইকুম আস সালাম জমিলা। কেমন আছো? “
“ আলহামদুলিল্লাহ খালাম্মা। মেলা ভালো আছি। আপনে কেমন আছেন? পৃথার শরীরডা কেমন? “
“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। শুনো জমিলা, গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ফোন দিয়েছি। তরী এখন কি করছে? “
“ পার্থ আব্বায় তো বড় বউরে নিয়া হসপিটালে গেসে ডাক্তার দেখাইতে সক্কাল সক্কাল। “
“ আচ্ছা। জমিলা যেহেতু এখন আমিও ওখানে নেই আর বাসার সবাইও সারাদিন ব্যস্ত থাকে তাই তুমি তরীর দিকে একটু ভালো করে খেয়াল রেখো। বাসায় কেউ না থাকলে একটু পর পর ওর কাছে গিয়ে দেখে আসবে। কখন কি প্রয়োজন হয়। “
“ আচ্ছা খালাম্মা, আপনে চিন্তা কইরেন না। “
“ আর শুনো শিং মাছ আনিয়ে তরীর জন্য সুন্দর করে শিং মাছ ভুনা করো। সাথে গরুর কলিজা ভুনাও করো। মেয়েটার শরীরে একেবারেই রক্ত নেই। আর আমি পার্থকে বিটরুট কিনে বাসায় নিয়ে যেতে বলবো। ওই বিটরুট ফলের মতো টুকরো টুকরো করে কেটে গরম পানিতে দিয়ে ভালো করে জাল দিবে। সাথে সামান্য লবণও দিও। একবার জাল এসে পড়লে পরে চায়ের মতো ছেঁকে শুধু পানিটা একটু ঠান্ডা করে তরীকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় খেতে দিবে। বুঝতে পেরেছো? “
এতো এতো নির্দেশ শুনে জমিলা খালার মাথা ঘুরাচ্ছিলো। তিনি আচ্ছা বলে ফোনটা রেখেই বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
“ বড় বউয়ের চান্দের লাহান একখান কপাল। “
__________
সকাল সকাল তরীকে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে পায়ে ভালো করে ড্রেসিং করিয়ে তাকে বাসায় ড্রপ করে দেয় পার্থ। অত:পর নিজে বেরিয়ে পড়ে নিজের কাজে। ফ্যাক্টরিতে কিছু কাজ মিটিয়ে সে পৌঁছে যায় হাজারীবাগে। হাজারীবাগে এক এলাকায় রাস্তার অবস্থা বেশ বিপর্যস্ত। বর্ষাকাল হওয়ায় সেই পথে চলাচল খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এলাকা ঘুরে নিজের দলীয় কর্মীদের সঙ্গে সবটা একবার পর্যবেক্ষন করে নেয় পার্থ। নিজের পরিকল্পনার খাতায় তুলে নেয় আরেকটি নতুন প্রকল্প। অবিলম্বে এই রাস্তা ঠিক করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেয় এলাকার জনগণকে।
অত:পর গাড়িতে করে এলাকা ছাড়তেই আসিফ গাড়ি চালাতে চালাতে বলে উঠে,
“ ভাই একটা খবর জানানোর ছিলো আপনারে। “
পার্থ মনযোগ ফোনের স্ক্রিনের দিকে স্থির। সে তরীকে ম্যাসেজ দিয়ে তার খবর নিতে ব্যস্ত। সেই ব্যস্ততার মধ্যেই পার্থ হালকা স্বরে বলে,
“ কি খবর? “
“ ভাই এলাকার লোক যখন আপনারে ঘিরা ধরসিলো আর আপনে সবার লগে কথা কইতে ব্যস্ত ছিলেন তখন আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করসি। “
পার্থ এবার ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আসিফের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকায়। আসিফ নিজ হতেই বলতে থাকে,
“ আমি দূরে এক দোকানের চিপা থেকে ইশতিয়াক ভুইয়ার এক লোকরে আপনার উপর নজর রাখতে দেখসি। “
পার্থর ভ্রু দ্বয় কুচকে আসে। সে প্রশ্ন করে,
“ তুই আগে কেনো বলিস নি আমাকে? “
“ ভাই আপনে তখন ব্যস্ত আছিলেন। আর আমি শিওর হইয়া একবার দেইখ্যা সাথে সাথে নিজেও ওইদিকে আর তাকাই নাই। যদি বুইঝা যায় যে আমরা দেইখ্যা ফেলসি তাইলে আরো সতর্ক হইয়া যাইতো। “
পার্থ কপাল কুচকে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়। ইশতিয়াক ভুইয়ার উদ্দেশ্য কি? নিজের পার্টির সদস্যর সাথেই কি শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে নাকি লোকটা? শত্রুতা শব্দটা মাথায় আসতেই পার্থর শরীর শিউরে উঠে। তার শত্রুতার হিসাব সবসময় তার কাছের মানুষদের পরিশোধ করতে হয়। ইশতিয়াক ভুইয়াকে এই সুযোগ কোনো ভাবেই দেওয়া যাবে না। পার্থর খুব সতর্ক হয়ে কদম ফেলতে হবে এখন থেকে। রাজনীতির মঞ্চে লাইমলাইটে এসে পড়ায় সবার দৃষ্টি এই মুহুর্তে তার উপর।
পার্থ শান্ত গলায় বলে,
“ আমাদের সবথেকে বিশ্বস্ত দু জন মানুষকে ইশতিয়াক ভুইয়ার উপর নজর রাখার দায়িত্ব দে আসিফ। উনার মতলব ভালো ঠেকছে না। নমিনেশন না পাওয়ার শোকে খুব সাংঘাতিক কিছু ঘটানোর পরিকল্পনা করছেন তিনি। “
__________
সবেমাত্র ভার্সিটি থেকে ফিরেছে মধুমিতা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ঢুকেই অভ্যাসবশত সবার আগে ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। জমিলা খালা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে মধুমিতার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“ ছোট বউ ভাত বাইরা দিমু? “
“ না খালা। আগে গিয়ে গোসল করে আসি। ভাবী আর তুমি খেয়েছো? “
“ হ। বড় বউয়ের খাবার আমি রুমে নিয়া গেসিলাম। নিজে সামনে বইসা ছিলাম খাবার শেষ করার আগ পর্যন্ত। “
মধুমিতা মিষ্টি হেসে বলে,
“ ওয়েল ডান। “
অত:পর মধুমিতা উপরে নিজের রুমে চলে যায় আগে গোসল সেরে নিতে। তখনই বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠে। জমিলা খালা গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই পার্থর দুই মামী আর শর্মী সুরসুর করে ঘরে প্রবেশ করে। এই অসময়ে বিনা নোটিশে উনাদের আগমনে জমিলা খালা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তবুও বিনয়ী ভঙ্গিতে উনাদের বলে লিভিং রুমে বসতে। পার্থর ছোট মামী বলে উঠে,
“ এতো ব্যস্ত হইতে হবে না। আমরা বড় বউরে দেখতে আসছি। বড় বউ নিজের রুমে আছে? “
বলতে বলতে উনারা উপরের দিকে এগিয়ে যায়। জমিলা খালা উনাদের বাঁধা দিতে পারে না।
__________
নিজের রুমে শুয়ে ফোনে কিছু একটা করছিলো তরী। তখনই আচমকা তার বেডরুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে পার্থর এক জোড়া মামী ও শর্মী। তাদের আকস্মিক আগমনে তরী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বিছানার একপাশে থাকা ওড়নাটা নিয়ে উঠে বসতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। একা উঠে বসতে গিয়ে মৃদু হিমশিম খেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে তরী তাদের উদ্দেশ্যে সালাম দেয়। পার্থর মামীরা বিছানার কোণে বসে আয়েশী ভঙ্গিতে। অত:পর বড় মামী বলে উঠে,
“ থাক ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা আরো তোমাকে দেখতে এসেছি। তা শরীর কেমন এখন তোমার? “
তরী আড়চোখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে পার্থর পারফিউম হাতে দাঁড়ানো শর্মীকে দেখে নিয়ে জবাব দেয়,
“ আলহামদুলিল্লাহ। “
ছোট মামী কিছুটা অতিরিক্ত মায়া দেখিয়ে বলে,
“ আহারে! কি একটা অবস্থা! এক্সিডেন্ট তো করসো সাথে বাচ্চাটাও গেলো। এই কারণেই বলে পোয়াতি অবস্থায় মেয়ে মানুষের এতো বাইরে ঘুরে বেড়ানো উচিত না। “
ছোট মামীর কথাগুলো যেন তরীর কাঁচা আঘাতে মরিচ গুঁড়োর মতে লেপ্টে যায়। এই মুহুর্তে তার এই ব্যাপারে এই দুই মহিলার সাথে কোনো রকমের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। শর্মী মনে হয় দূর হতে বুঝতে পারে তরীর মনের অবস্থা। সে তরীকে জ্বলানোর জন্য বলে উঠে,
“ একে তো বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। তার উপর বাচ্চাটাও থাকলো না। তোমাকে বিয়ে করে পার্থ ভাইয়ের কপালে মনে হয় আর বাচ্চার সুখটা রইলো না। “
মধুমিতা মামীদের আগমনের খবর পেতেই গোসলে না গিয়ে দ্রুত জামা বদলে তরীর রুমে ছুটে আসে। দরজার কাছাকাছি আসতেই সে শর্মীর এরকম কথা শুনে বেশ বিরক্ত বোধ করে। সাথে সাথে ভাবে এই মেয়েকে দু চারটে কড়া কথা শুনাবে। কিন্তু তার আগেই তরী বেশ হাসিমুখে জবাব দেয়,
“ তোমার জ্ঞানের সীমা খুব অল্প শর্মী। প্রথমত আমার বয়স সাতাশ। দ্বিতীয়ত ত্রিশ হয়ে গেলেই যে কেউ কনসিভ করতে পারে না এটা একটা ভুল ধারণা কেবল। তাই ইনশাআল্লাহ আল্লাহ চাইলে তোমার পার্থ ভাই অবশ্যই সন্তানের সুখ পাবে। আর তৃতীয়ত তোমার জ্ঞানের পাশাপাশি ভদ্রতার সীমাও খুব অল্প। তাইতো একজন বিবাহিত পুরুষের রুমে এসে তার অনুমতি ব্যতীত তার জিনিস ধরে ঘাটাঘাটি করছো। “
তরীর কথা দ্বারা নিঃশব্দে শর্মীর গালে একটা অপমানের সিল লেগে যায়। সাথে সাথে তার চোখ মুখ কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়। ক্ষুদ্ধ হয় দুই মামীও। বিশেষ করে ছোট মামী। উনি সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠেন,
“ এতো তেজ? আমার মেয়ের এখন তোমার থেকে জ্ঞান আর ভদ্রতা শিখতে হবে? নিজের ভাইয়ের রুমে এসে কিছু একটা ধরেছে দেখে তুমি ওকে এভাবে কথা শুনালে? “
তরী উদ্বিগ্ন হয় না। সে বেশ শান্ত গলায় জবাব দেয়,
“ পার্থ শুধু এখন আপনার মেয়ের ফুফাতো ভাই নয় বরং কারো স্বামীও। সেটা ভুলে যাবেন না মামী। “
ছোট মামী তেজী স্বরে বলে,
“ এতো দেমাগ তোমার? শুধু শুধু এখানে মানবতা দেখিয়ে খোঁজ নিতে এসেছি আমি। এরকম মেয়েদের পেটে বাচ্চা কখনো টিকেও না। আজ একটা গেছে, আগামীতে যে কয়টা আসবে সেগুলোও যাবে। “
শেষের কথাটা তরীর বুকে বিঁধে। তার চোখ ছলছল করে উঠে। মধুমিতা বেশ রাগ হয়। এই কারণে তার আন্টি সমাজ একটুও পছন্দ নয়। এরা সারাক্ষণ অন্যের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে ব্যস্ত থাকে। আর যখন মাথা ঘামিয়েও শান্তি পায় না তখন তারা নিজেদের অভিশাপ ঝারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মধুমিতা বেশ রাগ নিয়ে বলে,
“ তা নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে মামি। আপনারা চাইলে এখন আসতে পারেন। “
মধুমিতার কথায় দুই মামীর রাগ আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ছোট মামী শর্মীর হাত ধরে টেনে সোজা বেরিয়ে যায়। বড় মামীও বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে,
“ খুঁজে খুঁজে দুই আদব-কায়দাহীন মেয়েকেই এই দুই ভাই পেলো বিয়ে করার জন্য। ছি! “
মামীরা বেরিয়ে যেতেই মধুমিতা তরীর কাছে এসে বলে,
“ উনাদের কথা গায়ে মাখবেন না ভাবী। আমার বিয়ের সময়ও উনারা আমার বাবার ফাইন্যান্সিয়াল অবস্থা নিয়ে প্রচুর আজেবাজে কমেন্টস করেছে। আমি নাকি এতো বড় ফ্যামিলি দেখে শোভনকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছি। “
তরী কিছু বলে না। উনাদের স্বভাব কেমন সেই সম্পর্কে তরীরও ইতিমধ্যে ভালো ধারণা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এরকম একটা সেনসিটিভ ইস্যু নিয়ে এরকম একটা বদদোয়ায় সে মনে মনে আঘাত পেয়েছে বেশ।
__________
ইশতিয়াক ভুইয়া আপন বাসায় সোফায় বসে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনায় ব্যস্ত। উনার সামনে বসে আছে উনারই লোক আশিক। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো পার্থ। আশিক বলে উঠে,
“ পার্থ মুন্তাসির তো তোড়জোড় করে উন্নয়ন কর্মসূচী নিয়ে ব্যস্ত। কিছুদিন বাদেই সংসদ সদস্য হিসেবে শপথও গ্রহণ করে ফেলবে। তখন তো ও ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। “
ইশতিয়াক ভুইয়া চায়ের কাপে একটা বিস্কুট অর্ধেক ডুবিয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলো। চায়ের কাপ হতে বিস্কুটটা তুলে মুখে দিতে নিবে তখনই বিস্কুটটার অর্ধেক অংশ নরম হয়ে ফের চায়ের কাপেই পড়ে যায়। এতে ইশতিয়াক ভুইয়া বেশ বিরক্ত হয়। এই সম্পূর্ণ দৃশ্যটা এতক্ষণ ধরে অবলোকন করছিলো আশিক। ইশতিয়াক ভুইয়া হাতের কাপটা টি টেবিলের উপর রেখে বলে উঠে,
“ বুঝলে আশিক বিস্কুটের ওই অংশটুকু কেন ভেঙে পড়লো? “
এহেন প্রশ্নের মানে খুঁজে পায়না আশিক। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্যে নেতা চা বিস্কুট নিয়ে তাকে প্রশ্ন কেন করছে? আশিকের আর কষ্ট করে কিছু বলতে হয়না। ইশতিয়াক ভুইয়া নিজেই বলে উঠে,
“ কারণ এটাকে অধিক সময় ধরে চায়ে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিলো। “
আশিক বিরক্ত হয়। মনে মনে আওড়ায় অন্তিক মাহমুদের ভিডিও হতে শোনা দুইটা বিখ্যাত লাইন,
“ তাই নাকি? আমি তো জানতামই না। তুমি কেম্নে জানলে? “
মনে মনে এটা বললেও আশিক মুখে কোনো শব্দ করে না। ইশতিয়াক ভুইয়া আবারও নিজ থেকেই বলে উঠে,
“ পার্থ মুন্তাসিরের অবস্থাও এখন এই বিস্কুটের মতো। মাত্রাতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। ওর এই সব কাজ যে কেবল পার্টির চোখে নিজেকে ভালো প্রমাণ করার জন্য তা আমি বেশ ভালো করে বুঝতে পারছি। কিন্তু ওর পরিণাম হবে এই বিস্কুটের ন্যায়। শীঘ্রই ঝরে পড়বে। “
আশিক সামান্য কৌতূহলি গলায় প্রশ্ন করে,
“ কি করার চিন্তা করছেন আপনি? রুবেল হোসেনের মতো পার্থ মুন্তাসিরের আপনজনের ক্ষতি করার ভয় দেখাবেন? “
ইশতিয়াক ভুইয়া বেশ শব্দ করে হাসে এই কথা শুনে। ফের আফসোসের সুরে বলে,
“ রুবেল বলদামি করেছে দেখে কি আমিও ওর পথে হাঁটবো নাকি? পার্থ মুন্তাসিরের কাছের মানুষের ক্ষতি করে আমার কি লাভ? তবে পার্থ মুন্তাসিরের ক্ষতি করে আমার লাভ আছে। খুব পাখনা গজিয়েছে না ওর? আমার অধিকার মেরে খায়। ও রাজনীতিতে এসেছে কয়দিন হলো? আমি পুরো জীবন এই রাজনীতির পিছনে খেটে গিয়েছি আর এই দুইদিনের ছেলে কিনা আমার জায়গায় এমপি আর সংসদ সদস্য হবে? আমি ওকে দেখে নিবো ও রাজনীতি কিভাবে করে। “
শেষের কথাটুকু বলতেই ইশতিয়াক ভুইয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।
__________
আফজাল সাহেব বিকেল বেলায় বাড়ি ফিরতেই পার্থর মামীদের আগমনের কথা জানতে পারে। জমিলা খালা উনাকে এ-ও জানায় যে মামীরা বেশ রাগ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। সম্পূর্ণ ঘটনা বিস্তারিত জানার জন্য আফজাল সাহেব তরী এবং মধুমিতার সাথে কথা বলে। দুজনই তাকে যতটুকু যা ঘটেছে ঠিক ততটুকুই বলে। এক লাইনও বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে বলে না। সব শুনে আফজাল সাহেব বেশ রাগ হোন। তার বাড়ির সদস্যদের ব্যাপারে বাহিরের মানুষের এতো মাথা ব্যথা তার কোনো কালেই পছন্দ ছিলো না। আর সেখানে কিনা উনারা এসে তার ঘরের পুত্রবধূদের আজেবাজে কথা শুনিয়ে যাবে তা উনি কিভাবে মেনে নিবেন? তাই নিজের শশুড়কে কল করে সম্পূর্ণ ঘটনা জানায় তিনি। পাশাপাশি এ-ও বলেন,
“ আপনার ঘরের পুত্রবধূরা যেন আর কখনো আমার বাড়ির পুত্রবধূদের এসব আজেবাজে কথা না বলতে পারে আব্বা। এই দায়িত্বটা আপনার রইলো। “
রাতে যখন পার্থ আর শোভন বাড়ি ফিরে তখন তারাও এই বিষয় নিয়ে বেশ রাগ হয়। কিন্তু যখন শুনে যে আফজাল সাহেব ইতিমধ্যে এই বিষয় নিয়ে নানাজানের সাথে কথা বলেছে তখন তারা কিছুটা শান্ত হয়।
পার্থ বাসায় ফেরার পর থেকেই লক্ষ্য করে তরী বেশ মনমরা হয়ে আছে। এর কারণ কি তা ও ভালোই বুঝতে পারে। কিন্তু আপাতত এই বিষয়ে কোনো কথা বলে না। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে পার্থ বসে তরীর পায়ে ওষুধ লাগাচ্ছিলো। এই পা আর মাথার আঘাত নিয়ে যে মেয়েটা কতটা কষ্ট পাচ্ছে তা গতরাতেই দেখেছে পার্থ। যেহেতু তরীর ঘুমের মধ্যে অনেক নড়াচড়া করার অভ্যাস। কিন্তু এই ব্যান্ডেজ আর আঘাতের ফলে সে চাইলেও পাশ ফিরে কিংবা আরাম করে ঘুমাতে পারছে না। সারা রাত একটু পর পর উঠে বসেছিলো সে।
পার্থর ভাবনার মাঝেই তরী আচমকা বলে উঠে,
“ তোমার কি আমার বয়স খুব বেশি মনে হয় পার্থ? “
তরীর এমন প্রশ্ন শুনে পার্থ অবাক হয়। এই ধরনের প্রশ্নের মানে কি? তরী কি নিজের প্রতি কনফিডেন্স হারাচ্ছে? হতেই পারে! তরীর বর্তমাম মানসিক অবস্থার সাপেক্ষে এটা স্বাভাবিক বিষয়।
পার্থ শান্ত গলায় বলে,
“ তুমি আমার কাছে পারফেকশনের ডেফিনেশন। তোমার ব্যাপারে কোনো কিছুই আমার কম বেশি মনে হয়না। ইউ আর বেলেন্সড। “
তরীর মনের খুতখুত ভাবটা রয়েই যায়। পার্থ চুপচাপ উঠে মেডিসিন রেখে এসে তরীর পায়ের নিচে একটা বালিশ রেখে দেয়। অত:পর তরীর সামনে বসে তার কপালের ব্যান্ডেজের উপর দিয়েই আলতো করে চুমু খেয়ে বলে,
“ আমাকে সময় দাও। সব আরেকটু গুছিয়ে নেই। তুমিও সুস্থ হও। সিচুয়েশন যখন আরেকটু সেফ আর সিকিউরড হবে তখন আমরা স্বপ্নর ভাই কিংবা বোনকে আনবো। ওকে? “
পার্থর কথা শুনে তরীর চোখ ছলছল করে উঠে আবার। ইদানীং তার কি হয়েছে কে জানে। হুটহাট খুব কান্না পায়। এরকম ছিচে কাদুনী তো তরী আগে ছিলো না। পার্থ বুঝতে পারে এসব কথায় কাজ হবে না। তরীর মস্তিষ্ক অন্যদিকে ঘুরাতে সে শান্ত গলায় বলে উঠে,
“ তোমার কি মনে হয় তরী, আমি তোমাকে শুধুমাত্র ওই রাতের ওই ঘটনার সাক্ষী হওয়ার ফলস্বরূপ জোর করে বিয়ে করেছি? “
এবার তরীর চোখে কৌতূহল দেখা যায়। সে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ তা নয়তো কি? “
পার্থ তরীর দিকে তাকিয়ে শীতল হাসে।
চলবে…
যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪০.
“ তোমার মনে আছে সাত মাস আগে আমাদের পার্টির কলাবাগান এরিয়ার ওদিকে একটা বিশাল সমাবেশ হয়েছিলো? “
পার্থর প্রশ্ন শুনে তরীর ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। যদিও কোনো কিছু মনে রাখার ক্ষেত্রে তার মেমোরি খুব শার্প। কিন্তু রাজনীতি বিষয়ক কোনো তথ্যের প্রতি তার কখনো তেমন কোনো আগ্রহ ছিলো না। তাই এই ব্যাপারে সে চাইলেও কিছু মনে করতে পারছে না। পার্থ বুঝতে পারে তরীর মনে পড়ছে না। তাই সে নিজ উদ্যেগে ফের বলে উঠে,
“ সেই সমাবেশে বোমা হামলা হয়েছিলো। পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ ছিলো। আহতের সংখ্যাও প্রায় শ খানেক ছিলো। “
আচমকা তরীর চোখ জোড়ায় মৃূদু বিস্ময় ফুটে উঠে। সে কিছুটা উচ্চস্বরে প্রশ্ন করে,
“ ওটা তোমাদের সমাবেশ ছিলো? “
পার্থ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। তরী অবাক গলায় বলে,
“ কোন দলের সমাবেশ ছিলো এতো কিছু আমি খেয়াল করি নি তখন। আমি আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে ওদিকে গিয়েছিলাম। ফেরার পথেই এই সিচুয়েশনের মাঝে ফেসে যাই। “
“ ওখানে তুমি একজন আহত যুবককে সাহায্য করেছিলে। মনে আছে? সেই যুবকের মাথা ফেটে গিয়েছিলো। তুমি নিজের গাড়িতে করে তাকে হসপিটাল নিয়ে গিয়েছিলে। “
তরী এবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ তুমি কিভাবে জানো? “
পার্থ এবার বেশ শীতল গলায় বলে,
“ ওই যুবককে তোমার গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে একজন তোমাকে সাহায্য করেছিলো। সেই একজনটা আমি ছিলাম। “
তরী অবাক হয়ে পার্থকে দেখতে থাকে। সেদিন সেই যুবককে তার গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এক আগুন্তক সাহায্য করেছিলো। সেই আগুন্তকের তেমন একটা বর্ণনা তরীর মনে নেই। কেবল এইটুকু তার মনে পড়ে যে সেই আগুন্তক একটা মাস্ক পরিহিত ছিলো। তরী এবার পার্থর হাত চেপে ধরে প্রশ্ন করে,
“ ওই মাস্ক পড়া লোকটা তুমি ছিলে? “
পার্থ মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। তরী কিছুক্ষণ অবাক নয়নে পার্থর দিকে তাকিয়ে থাকে। অত:পর সন্দিহান গলায় বলে উঠে,
“ তুমি কথা ঘুরাচ্ছো কেন? আমাকে বিয়ে করার কারণ নিয়ে কথা হচ্ছিলো। “
পার্থ এবার সোজা হয়ে সামান্য গলা ঝেড়ে বলে উঠে,
“ এটাই তোমাকে বিয়ে করার কারণ। “
“ মানে? “
“ মানে আমার তোমাকে প্রথম দেখায় ভালো লেগেছিলো। যেই ছেলেকে তুমি সাহায্য করেছিলে ও আমারই দলের একজন ছিলো। ওর নাম ফুয়াদ। সেই প্রথম সাক্ষাতের পর আমি আবার তোমাকে হসপিটালের ইমার্জেন্সি এরিয়ায় দেখি। “
পার্থর বলা প্রথম কথাটুকু শুনে তরী আরেক দফা বিস্মিত হয়। সে প্রশ্ন করে,
“ সিয়ামকে যখন হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছিলো তখনকার কথা বলছো? “
পার্থ মাথা নেড়ে বলে উঠে,
“ না। ফুয়াদ আহত অবস্থায় যখন হসপিটালে ভর্তি ছিলো তখন আমি ওকে দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিনও অবশ্য আমি মাস্ক পরিহিত ছিলাম। ইমারজেন্সি ইউনিটের সামনে দিয়ে লিফটের দিকে এগোনোর সময় আচমকা দেখি মেইন এন্ট্রেস হতে অনেক চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছে। আমি আগ্রহী হয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পাই স্ট্রেচারে করে একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে দৌড়ে তুমি হসপিটালে প্রবেশ করছো। তোমাকে দেখেই আমি থেমে যাই। তুমি আমার চোখের সামনে দিয়েই ইমারজেন্সি ইউনিটে প্রবেশ করো। বাচ্চাটার কি সমস্যা ছিলো আমার জানা নেই। আমি কেবল তোমাকে দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। স্বচ্ছ কাঁচের অপরপাশ হতে আমি দেখছিলাম তোমাকে সেই বাচ্চার জীবন বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করতে। আশেপাশে আরো কয়েক নার্স এবং ডাক্তার ছিলো। সকলের চোখে মুখেই আতংক ছিলো। কেবল তোমার চোখে আমি দৃঢ়তা খুঁজে পাই। সব চেষ্টা শেষে সবার চোখে যখন নিরাশা দেখতে পাই সেই মুহুর্তে তুমি বাচ্চাটার গায়ের ফ্রক কেঁটে ডিফিব্রিলেশন দেওয়া শুরু করো। আল্লাহর রহমতে বাচ্চাটা বেঁচে যায়। “
পার্থর মুখে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে তরী নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। পার্থ তাকে এতো আগে থেকে নোটিশ করেছে? কই তরী তো কখনো পার্থকে আগে নোটিশ করে নি! পার্থ আবার বলে উঠে,
“ আই নো তুমি হয়তো ভাবছো এসবের সাথে তোমাকে বিয়ে করার সম্পর্ক কোথায়? এর উত্তর হলো সেই সময়টায় আমি নিজের লাইফের খুব ক্রুশাল একটা পিরিয়ড পার করছিলাম। সামনে ইলেকশন ছিলো অথচ আমি মনে জোর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। রাজনীতির প্রতি পদে পদে আমি হতাশার দেখা পাচ্ছিলাম। রাজনীতি করার সাহসও হারিয়ে ফেলছিলাম প্রায়। বারবার মনে হচ্ছিলো এই করাপ্টেড সিস্টেমের মাঝে আমি কখনোই টিকতে পারবো না। কিন্তু দ্যাট ডে ইউ ইন্সপায়ার্ড মি সামহাও। আই ফেল্ট দ্যাট আই শুড অলসো ট্রাই। সেদিন আরেকটা জিনিসও মনে হয়েছিলো আমার। যে এই মেয়েটাকে সারাজীবনের প্রেরণা হিসেবে নিজের পাশে পেলেও হয়তো মন্দ হয়না। কিন্তু তোমার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি রাজনীতির প্রতি তোমার তীব্র বিতৃষ্ণা। এরকম একটা মেয়ের জন্য বিয়ের সমন্ধ পাঠালেও যে সে দরজা থেকেই আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে তা-ও আমার বুঝা হয়ে গিয়েছিল। তাই নিজের সেই আশায় বালি চাপা দিয়ে দেই আমি। “
কথাটুকু বলে এক দন্ড দম নেয় পার্থ। অত:পর আবার বলতে শুরু করে,
“ যেদিন রাতে আমি তোমাকে ওই কনস্ট্রাকটেড বিল্ডিংয়ে দেখি সেদিন আমার মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। বারবার মনে হচ্ছিলো তুমি আগে থেকেই রাজনীতি করার ফলে আমাকে অপছন্দ করো। আর সেদিন রাতে স্ব চক্ষে ওই দৃশ্য দেখার পর হয়তো আমাকে আরো অপছন্দ করতে শুরু করে দিয়েছো। কিছু ভাবতে না পেরে আমি তোমার মুখে রুমাল চেপে ধরে তোমাকে অজ্ঞান করে ফেলি। যতক্ষণ তোমার জ্ঞান ছিলো না ততক্ষণ আমি কিভাবে এই সিচুয়েশন সামলাবো সেই চিন্তায় বিভোর ছিলাম। আচমকা আমার মনে হয় এটাই ভালো সুযোগ। তূর্যকে ব্লেকমেইল করে আমি ওই ফুটেজ গুলোও ডিলিট করিয়ে ফেলি আর তোমার সাথে আমার বিয়েটাও হয়ে যায়। বাট তরী ট্রাস্ট মি ওইদিন ওই ছেলেগুলোকে মারার পিছনে আমার কাছে কারণ ছিলো। ওরা নির্দোষ ছিলো না। “
তরী এতক্ষণ শান্ত ভঙ্গিতে সব শুনছিলো। এই পর্যায়ে সে বলে উঠে,
“ আমি জানি ওরা নির্দোষ ছিলো না। “
পার্থ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
“ তুমি কিভাবে জানো? “
তরীর সোজা হয়ে বসে থেকে পিঠ ব্যথা করছিলো। সে পিছনে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বলে,
“ তোমার কি মনে হয় আমি কিছু না জেনেই তোমাকে মেনে নিয়েছি? “
পার্থ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়। এই প্রশ্ন তার মনের মধ্যেও ছিলো যে তরী তাকে হঠাৎ কেন মেনে নিলো। কিন্তু কখনো এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়নি। তরী এবার পার্থর এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠে,
“ আমি নিজের মন আর মস্তিষ্ক দুটো দিয়ে বিচার করেই তোমাকে মেনে নিয়েছিলাম পার্থ। এটা সত্যি ওই মুহুর্তে হয়তো আমি তোমাকে ভালোবাসতাম না। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই অনুভূতিতেও বাঁধা পড়ে যাই আমি। “
পার্থ মৃদু হেসে বলে,
“ এই বিশ্বাস নিয়েই আমি তোমাকে বিয়ে করি। “
কথাটুকু বলেই পার্থ তরীর একগালে হাত রেখে বলে,
“ আমি যেই তরীকে ভালোবেসেছি সে সবার সামনে নিজের দৃঢ়তা বজায় রাখে সবসময়। কারো অপ্রয়োজনীয় কথায় নিজে ভেঙে পড়বে না। তোমার ব্যাপারে অন্য কারো মন্তব্যের কোনো দাম নেই আমার কাছে। তুমি কি, তুমি কেমন সব জেনেই আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। তাই অন্যের মূল্যহীন কথায় ইনসিকিউরড ফিল করা বন্ধ করো। আবেগ এতো সস্তা না তরী। অন্যের কথায় আবেগী না হয়ে সেই আবেগটা আমার জন্য তুলে রাখো। কথা দিচ্ছি যথাযথ তোমার আবেগের মূল্যায়ন করবো। “
__________
ক্যালেন্ডারের আরেকটি পাতা উল্টে গেলো। মাঝে চলে গেলো আরেকটি মাস। তরী ইতিমধ্যে আগের তুলনায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে গিয়েছে। কেবল বাম পা টা এখনো সম্পূর্ণ সেড়ে উঠে নি। ডক্টরের কথা অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি চলছে এখনো। আরো একমাসের মধ্যে আশা করা যায় এই জখমটাও সম্পূর্ণ সেড়ে যাবে। যদিও সে এখনই আবার হসপিটালে ফিরে যেতে চাচ্ছিলো কিন্তু হুমায়ুন রশীদ বলে দিয়েছেন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েই নিজের কাজে ফিরে যেতে। তাই আপাতত তরীর বেশিরভাগ সময় বাসায়ই পাড় হয়ে যায়। সাদিকা বেগমও ইতিমধ্যে নিজের সংসারে ফিরে এসেছে। পৃথার জন্য তিনি অনেক খুঁজে একজন বিশ্বস্ত বাঁধা বুয়া ঠিক করে দিয়েছেন। তাই আপাতত মেয়েকে নিয়ে তিনি মোটামুটি চিন্তা মুক্তই আছেন।
আজকে বছরের প্রথম রোজা। সেই উপলক্ষে আফজাল সাহেব ইচ্ছা পোষণ করেছে যে তিনি নিজের সম্পূর্ণ পরিবার নিয়ে প্রথম ইফতারটা এক সঙ্গে করতে চান। উনার ইচ্ছা মোতাবেকই প্রস্তুতি চলছে। আফজাল সাহেব নিজে হুমায়ুন রশীদকে ফোন করে তূর্য এবং পৃথাকে সহ ইফতারের দাওয়াত দিয়েছেন। হুমায়ুন রশীদও সেই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন নি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন যে তিনি সময়মতো পৌঁছে যাবে।
দুপুর বেলা থেকেই চৌধুরী নিবাসের বধূরা ইফতারের প্রস্তুতিতে মেতে আছে। আফজাল সাহেব একবার বলেছিলেন যে তিনি খাবার বাহির থেকে কিনে আনবে। কিন্তু সাদিকা বেগম সেই ব্যাপারে বাঁধ সাধে। উনার মতে বাহির থেকে ইফতার কিনে আনলে তাতে রমজানের আমেজ পাওয়া যাবে না। তরী আর মধুমিতাও শাশুড়ীর সাথে একমত। তাই দুপুর থেকে শাশুড়ি এবং পুত্র বধূরা মিলে বিভিন্ন ডিশ রেডি করছে। তরীর যেন বেশি দৌড়াদৌড়ি না করতে হয় সেজন্য সাদিকা বেগম তাকে টেবিলে বসে চপিং এর দায়িত্বটা দিয়েছে। মধুমিতা খুব মন দিয়ে বিভিন্ন ডেজার্ট আইটেম এবং শরবত বানাতে ব্যস্ত। ভাজাপোড়ার কাজ গুলো সাদিকা বেগম এবং জমিলা খালা করছেন।
বিকেলের দিকে হুমায়ুন রশীদ এবং পৃথা চৌধুরী নিবাসে এসে পৌঁছায়। তূর্য অফিস থেকে ডিরেক্ট আসবে বলে জানিয়েছে। পৃথা বাদে বাড়ির সকলেই রোজা। তাই পৃথা রান্নাঘরে গিয়ে ঘুরেফিরে সব খাবারই টেস্ট করে দেখছে। সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে পার্থ, শোভন, তূর্য তিনজনই বাড়ি ফিরে।
মাগরিবের আজান পড়তেই সকলে একসাথে দোয়া পড়ে খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার খুলে। অনেকদিন পর চৌধুরী নিবাসের ডাইনিং টেবিলে শোনা যায় তিন ভাই বোনের খুনসুটির গুঞ্জন। তাদের সাথে যোগ দেয় তাদের স্ত্রী ও স্বামীও। বেশ আনন্দে সম্পূর্ণ সন্ধ্যাটা পাড় করে তারা।
ইফতার শেষে সকলেই লিভিং রুমে যে যার মতো গল্পে মশগুল ছিলো। তরী সুযোগ বুঝে সবার আড়ালে হুমায়ুন রশীদকে ডেকে বলে,
“ পাপা তোমার সাথে কথা ছিলো। “
হুমায়ুন রশীদ মেয়ের গুরুত্বপূর্ণ কথা শোনার জন্য নীরবে লিভিং রুম থেকে প্রস্থান করে তরীর পিছু পিছু তরীর রুমে যায়। সিটিং এরিয়ার একটা সোফায় বসে হুমায়ুন রশীদ। তার মুখোমুখি বসে আছে তরী। তরী কোনো ভনিতা না করেই বলে,
“ তুমি পার্থর উপর রেগে আছো তা আমি জানি পাপা। কিন্তু ওই ঘটনার অলরেডি একমাসের উপর সময় পার হয়ে গিয়েছে। এখন কি এই রাগটা বাদ দেওয়া যায় না? “
হুমায়ুন রশীদ ভ্রু সরু করে বলে,
“ কে বললো আমি রেগে আছি? রেগে থাকলে কি আমি এই বাড়ি আসতাম নাকি? “
“ তাহলে তুমি সবার সাথে কথা বললেও পার্থর সাথে কথা বলছো না কেন? ওকে ইগনোর কেন করছো? “
মেয়ের প্রশ্নের পিঠে হুমায়ুন রশীদ নীরব বনে যায়। তরী এবার কিছুটা ব্যকুল গলায় বলে উঠে,
“ পাপা ওই এক্সিডেন্টে ওর কি দোষ বলো? তুমি অযথা ওর উপর রেগে আছো। ওই এক্সিডেন্টে আল্লাহর রহমতে তুমি কিছু হারাও নি কিন্তু পার্থ হারিয়েছে পাপা। তোমার মেয়ের শরীরের ক্ষত সেরে যাবে কিন্তু পার্থর ক্ষতিটা অপূরণীয়। তোমার এই পরিস্থিতিতে ওকে বুঝার চেষ্টা করা উচিত ছিলো পাপা। প্লিজ এই রাগ পুষে রেখো না। ওকে এই গিল্ট ট্র্যাপ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দাও। পার্থ এখনো নিজেকে দায়ী মনে করছে এই সবকিছুর পিছনে। প্রতি রাতে ও আমার আড়ালে আমাদের বেবির আল্ট্রাসাউন্ডের ছবি দেখে রাত পার করে। ওর উপর অলরেডি অনেক প্রেশার পাপা। এই মেন্টাল প্রেশারটুকু থেকে ওকে মুক্তি দিতে আমাকে হেল্প করো। “
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে তরী থামে। হুমায়ুন রশীদ এতক্ষণ শান্ত মস্তিষ্কে মেয়ের কথা শুনছিলো। এই পর্যায়ে তিনি প্রশ্ন করে,
“ পার্থ তোমার খুব খেয়াল রাখে, তাইনা? “
তরী মৃদু হেসে বলে,
“ তার প্রমাণ তোমার সামনেই। “
হুমায়ুন রশীদ নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মেয়ে যে কতটা যত্নে আছে তা নিয়ে উনার সন্দেহ নেই। কেবল উনি এটাই ভেবে পায়না যেই মেয়ের রাজনীতির প্রতি এতো বিরূপ ধারণা ছিলো সেই মেয়ে কিভাবে এক রাজনীতিবীদকে এতটা ভালোবেসে ফেললো? তবে কি পার্থ রাজনীতি সম্পর্কে তরীর ধারণা বদলে দিয়েছে নাকি সবটাই বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কের জোর?
হুমায়ুন রশীদ গলা সামান্য ঝেড়ে বলে উঠে,
“ আচ্ছা… “
হুমায়ুন রশীদের কথা অপূর্ণ রয়ে যায়। আচমকা বাসার বাহির থেকে ভেসে আসে তীক্ষ্ণ সাইরেনের শব্দ। তরী এবং হুমায়ুন রশীদের আলাপন থেমে যায়। দুজনেই ভ্রু কুচকে একে অপরের দিকে তাকায়। মুহুর্তেই নিচ থেকে ভেসে আসে জমিলা খালার অদ্ভুৎ আর্তনাদের শব্দ। তরীর বুক ধক করে উঠে। সে সাথে সাথে উঠে নিজের রুমের বারান্দার দিকে ছুটে। হুমায়ুন রশীদ দ্রুত পায়ে নিচে চলে যায়। বারান্দা হতে তরী যেই দৃশ্য দেখতে পায় তাতে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। উল্টো ফিরে আবার রুম পেরিয়ে সে দ্রুত পায়ে দৌড়ে নিচে আসতে নেয়। সিঁড়ির এখানে দু বার পড়তে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সে। কিছুক্ষণ আগের আড্ডায় মশগুল লিভিং রুমটা নীরব ভঙ্গিতে শূন্য হয়ে রয়েছে। টি টেবিলের উপর রয়ে গিয়েছে পার্থর অর্ধেক খাওয়া কফির মগটা। সেসব কিছুর দিকে ফিরে না তাকিয়েই তরী ঘরের বাইরে ছুটে যায়।
আফজাল সাহেব, শোভন এবং পার্থর সাথে একদল ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ ফোর্সের তুলকালাম তর্কাতর্কি হচ্ছে। দূর হতে এই দৃশ্য দেখে তরীর মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে। তার পা জোড়া আর সামনে এগোনোর সাহস পায় না। সে ঠাই দাঁড়িয়ে রয় দরজার বাহিরটায়। মধুমিতা আর পৃথা সাদিকা বেগমকে সামলাতে ব্যস্ত। আতংকিত সাদিকা বেগম ইতিমধ্যে কান্না জুড়ে দিয়েছেন। আফজাল সাহেব বার দুয়েক স্ত্রীকে কঠিন ধমক দিয়ে চুপ হতে বলে। কিন্তু অস্থির মায়ের মন শান্ত হয় না সেই ধমকে।
তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে পুলিশ বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি আশংকাজনক দেখে পার্থ ব্যকুল দৃষ্টি মেলে ঘরের দরজার পানে তাকায়। সাথে সাথে তরীর সাথে তার দৃষ্টি মিলন হয়। তরীর আতংক মিশ্রিত চোখ পার্থর দিকেই স্থির ছিলো। পার্থ তাকাতেই সেই ছলছল চোখ হতে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়ে। পার্থ সাথে সাথে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। বেশ শান্ত শীতল গলায় বলে,
“ আব্বা, শোভন আর কোনো কথা হবে না। আমি যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ। “
কথাটুকু বলেই পার্থ নিজেকে পুলিশের আন্ডারে সমর্পণ করে দেয়। দূর হতে পার্থকে হ্যান্ডকাফ পড়ানোর দৃশ্যটা দেখেই তরীর শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। সে দেয়ালে পিঠ দিয়ে ধপ করে নিচে বসে পড়ে। হুমায়ুন রশীদ দৌড়ে এসে নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে তার দৃষ্টি আড়াল করে ফেলে যেন এই দৃশ্যর সাক্ষী তার মেয়ের না হতে হয়।
পার্থকে পুলিশের গাড়িতে টেনে তোলার আগে পার্থ শোভনের উদ্দেশ্যে নীরব আদেশ দেয়,
“ যা-ই হয়ে যাক না কেন, তোর ভাবী যেন থানায় না আসে। “
শোভন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রয়। পার্থ অপেক্ষা না করে সাথে সাথে আফজাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রভ গলায় বলে,
“ আম্মার খেয়াল রাখবেন আব্বা। আমার জন্য নিজের বিপিটাও বাড়াবেন না দয়া করে। আর তরীকে আপনার আমানতে রেখে যাচ্ছি। “
ব্যস! সঙ্গে সঙ্গেই পার্থকে গাড়িতে তুলে ফেলা হয়। গাড়ি ছাড়বে এমন মুহুর্তে ভীড় ঠেলে তরীকে দৌড়ে আসতে দেখে পার্থ। মুহুর্তেই তার চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে উঠে। কিন্তু তরী গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই গাড়ি ছেড়ে দেয়। আফজাল সাহেবও তরীকে একহাত ধরে আটকে ফেলে। তরী পার্থর দিকে তাকিয়ে থেকেই অশ্রুসিক্ত গলায় বলে উঠে,
“ ওরা পার্থকে ছাড়বে না আব্বা। ওরা ছাড়বে না ওকে। “
দূর হতে তরীকে এই অবস্থায় দেখে পার্থর বুক পুড়ে যাচ্ছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। এই বিচ্ছেদের স্থায়িত্ব কত সময়ের তা তার জানা নেই। কিন্তু এই সময়কাল জুড়ে যে তরী ভালো থাকবে না তা তার ভালো করেই জানা আছে। পার্থ অস্ফুটে বলে উঠে,
“ ঘুরেফিরে বারবার আমি-ই কেনো তোমার খারাপ থাকার কারণ হচ্ছি, বলো তো তরী? “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]