যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৩৭+৩৮

0
719

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৭.

সদ্য নির্বাচিত নব এমপি গত দু’দিন ধরে নাওয়া খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে গ্রীন কেয়ার হসপিটালের আইসিইউ রুমটার সামনে স্থবির হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। আইসিইউর ভেতর ভিজিটিং আওয়ার হচ্ছে সারাদিনে কেবল এক ঘন্টা। সেই এক ঘন্টায় পরিবারের সকলেই একজন একজন করে ভিতরে প্রবেশ করে তরীকে দেখে আসে। কেবল পার্থই ভিতরে যায় না। চুপচাপ মাথা নত করে এই বেঞ্চিটাতে ঠাই বসে রয়। তার থমথমে মুখ, অসম্ভব লাল চোখ জোড়া এবং স্থির দৃষ্টি দেখে কারো সাহস হয় না আগ বাড়িয়ে তার সাথে কোনো কথা বলার।

৭০ ঘন্টা। ৪২০০ মিনিট। ২৫২০০০ সেকেন্ড। অপেক্ষা জিনিসটা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা গত ৭০ ঘন্টা ধরে হারে হারে টের পাচ্ছে পার্থ। ডক্টরের থেকে বেঁধে দেওয়া ৭২ ঘন্টার মধ্যে ইতিমধ্যে ৭০ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। অবশিষ্ট আছে কেবল আর দুই ঘন্টা। কিন্তু এখনো তরীর জ্ঞান ফেরার কোনো নাম নেই। সময় যত গড়াচ্ছে বুকের ভেতরের ব্যথাটা ততই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

পার্থর মুখোমুখি আরেকটা বেঞ্চিতে বসে আছে হুমায়ুন রশীদ। পার্থর সাথে পাঞ্জা দিয়ে এই অপেক্ষার ভাগীদার তিনিও। গত তিনদিনে তিনি টুকটাক সবার সাথে কথা বললেও কেবল পার্থর সাথেই কোনো কথা বলে নি। তার মেয়ের এহেন পরিস্থিতির পিছনে যে পার্থর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব দায়ী তা জানার পর থেকে পার্থর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না তিনি।

এই মধ্যরাতে হাসপাতালে এক প্রকার মানুষের সমাগম কিংবা ভীড় নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে কেবল আইসিইউ হতে দু একজন নার্স ব্যস্ত পায়ে আসা যাওয়া করে যাচ্ছে। সময় যখন আর এক ঘন্টা কেবল বাকি তখন আচমকা কারো ফুপিয়ে কান্নার শব্দে পার্থ মুখ তুলে তাকায়। হুমায়ুন রশীদ চাইলেও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছেন না। একমাত্র মেয়েকে হারানোর ভয়ে তিনি ফুপিয়ে বাচ্চাদের ন্যায় কান্না করছেন। পার্থ বিচলিত হয় না। উঠেও যায় না। আগের মতো নিজের জায়গায়ই বসে রয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আইসিইউ হতে একজন পুরুষ ডক্টর বেরিয়ে আসেন। করিডোরে বসে থাকা পার্থ এবং হুমায়ুন রশীদকে এক মুহুর্ত দেখে নিয়ে তিনি বলে উঠেন,

“ হুমায়ুন স্যার? “

হুমায়ুন রশীদ এবং পার্থ সাথে সাথে চোখ তুলে তাকায়। হুমায়ুন রশীদ নিজের চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“ হ্যাঁ। আমার মেয়ে? “

ডক্টর কিছুটা হাসিহাসি মুখ করে বলে,

“ সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে নি। তবে ডক্টর তরী ইজ রিস্পোন্ডিং। চিন্তা মুক্ত থাকুন এখন। “

হুমায়ুন রশীদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা পার্থ সাথে সাথে চোখ বুজে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ আলহামদুলিল্লাহ। “

অত:পর চোখ মেলে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আর কোনো রিস্ক নেই তো? “

“ চিন্তা করবেন না। সম্পূর্ণ জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত আমরা আরও কিছুক্ষণ অবজারভেশনে রাখবো। একবার জ্ঞান ফিরলেই কেবিনে শিফট করে দেওয়া হবে। “

হুমায়ুন রশীদ তাগাদা দেখিয়ে বলে,

“ আমি আমার মেয়ের কাছে যাবো। “

হুমায়ুন রশীদকে মানা করার সাধ্য কারো নেই৷ তাছাড়া তিনি নিজেও একজন ডক্টর। তাই কারো অপেক্ষা না করে তিনি হন্তদন্ত পায়ে চলে যান আইসিইউ তে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় গেটাপে তৈরি হতে। পার্থ কোনো কথা না বলে চুপচাপ করিডরেই বসে রয়।

__________

তরীর অবস্থা এখন আশংকা মুক্ত সেই খবর ইতিমধ্যে দুই বাড়িতেই পৌঁছে গেছে। কিন্তু মধ্যরাত হওয়ায় এখন কেউ আর হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হয় না। তরীকে কেবিনে দিলে একেবারে সকাল সকাল তারা দেখা করতে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু তূর্য বাসায় বসে সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে পারে না। সে পৃথাকে সাদিকা বেগমের দায়িত্বে রেখে নিজের বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায় হসপিটালের উদ্দেশ্যে। পৃথাও অবশ্য বাঁধা দেয় না। এই তিনদিন বোনের চিন্তায় তূর্য কতটা অস্থির হয়ে ছিলো তা তার অজানা নয়।

__________

ভোর ৪ টা বেজে ২৫ মিনিট। তরীকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। সাধারণত যে কোনো পেশেন্টের জ্ঞান ফিরলে সে সবার আগে নিজের আপনজনের সান্নিধ্য খুঁজে। কিন্তু তরীর বেলায় হলো উল্টো। সে জ্ঞান ফিরতেই সবার আগে কেবিনে উপস্থিত নার্সকে প্রশ্ন করে তার বাচ্চা কেমন আছে। তরী অবুঝ নয়। একজন ডক্টর হওয়ার সুবাদে সে ভালো করেই জানে এতো বড় এক্সিডেন্টের ধাক্কা সেই ছোট্ট প্রাণ কখনোই সামলাতে পারবে না। তবুও তার অবচেতন মন ভিন্ন উত্তরের আশায় এই প্রশ্নটা করে। কিন্তু নার্সের মুখে যখন সে শুনে তার বাচ্চাটা আর নেই তখন শান্ত ভঙ্গিতে জানায় কেউ যেন তাকে আর বিরক্ত না করে। সে একা থাকতে চায়।

তরীর এই কথা শুনে নার্স বেশ অবাক হয়। এরকম পেশেন্ট সে এই প্রথম দেখলো। চুপচাপ কেবিনের বাইরে এসে অপেক্ষারত তিন পুরুষকে জানায় তরী কারো সাথে দেখা করতে চায় না। তরীর এমন কথায় হুমায়ুন রশীদ ব্যথিত হয়। তার মেয়ে এতটা কষ্টে আছে অথচ তবুও সেই কষ্ট কারো সাথে ভাগ করতে রাজি না। হুমায়ুন রশীদ মাথা নত করে চুপচাপ সেখান থেকে প্রস্থান করে। তূর্যও নিজের বোনকে আর বিরক্ত করে না। সে চায় না তার আপি এই অবস্থায় উত্তেজিত হয়ে শরীর আরো খারাপ করুক।

পার্থ নার্সের কথা শুনে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বেঞ্চিতে বসে পড়ে। তার গায়ে এই মুহুর্তে একটা হালকা বাদামী রঙের শার্ট ও প্যান্ট রয়েছে। সাধারণত সবসময়ের তুলনায় বেশ ভিন্ন দেখাচ্ছে তাকে। তূর্য নীরবে পার্থর পাশে বসে শান্ত গলায় শুধায়,

“ আপি মুখে বলবে না কখনো, কিন্তু মনে মনে ঠিকই আপনার অপেক্ষা করছে ভাইয়া। “

পার্থ চোখ তুলে তূর্যর দিকে তাকায়। এর আগে তূর্য তাকে কখনো কিছু বলে সম্বোধন করে নি। এই প্রথম নিজ থাকে তাকে ভাইয়া বলে ডাকলো। তূর্যের চোখে পার্থ নিজের জন্য কোনো ঘৃণাও খুঁজে পায় না।

তূর্য একইভাবে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,

“ আপনি জানেন পৃথা সেদিন আম্মার প্রস্তাবে রাজি হয়নি কেন? কারণ ও নিজের এই প্রেগন্যান্সির জার্নিটাতে আমাকে নিজের পাশে চায়। যতই সবাই ওর সাথে থাকুক না কেন আমাকে ছাড়া ওর এই প্রেগ্ন্যাসির জার্নি কখনো কমপ্লিট হবে না। একইভাবে আপিরও এই মুহুর্তে আপনাকে পাশে প্রয়োজন। শরীরের ক্ষত না হয় ট্রিটমেন্টে সেরে যাবে, তবে মনের ক্ষত ঠিক করার দায়িত্বটুকু আপনারই। “

পার্থ চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। অত:পর শান্ত স্বরে বলে উঠে,

“ তুমি খুব বুঝতে জানো তূর্য। আমার বোনের জন্য তোমার থেকে উত্তম জীবনসঙ্গী আর কেউ হতে পারতো না। “

__________

প্রাইভেট কেবিনের শুভ্র বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে তরী। আচমকা নিজের পেটের উপরে কিছু একটার ভার অনুভব করতেই সে নিজের জ্বলতে থাকা চোখ দুটো মেলে তাকায়। মানুষটা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দু’হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে পেটের উপর মাথা রেখে বসে আছে। তরী চোখ ফিরিয়ে কেবিনের একপাশের স্বচ্ছ থাই গ্লাসের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়। ভোরের আলো এখনো ফুটে নি। বৃষ্টির দমকে এবং মেঘের আড়ালে তা লুকিয়ে রয়েছে। বাহিরের দিকে তাকাতেই তরীর চোখের সামনে ভেসে উঠে সেদিন রাতের সেই ভয়ানক চিত্র। সম্পূর্ণ স্পিডে এগিয়ে আসা একটা ট্রাক, সেই ট্রাকের সঙ্গে তার গাড়ির সংঘর্ষ, দু তিনটা ডিগবাজি খেয়ে গাড়ি উল্টো অবস্থায় রাস্তার এককোণে পড়ে থাকা, সেই নির্মম বৃষ্টি, অত:পর তরীর দু চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যাওয়া।

তরী ক্ষীণ স্বরে বাহিরের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলে উঠে,

“ ও আর নেই। “

তরী সাথে সাথে নিজের পেটের উপর থাকা চাদর ভেদ করে পার্থর তপ্ত নিঃশ্বাস এবং কয়েক বিন্দু নোনাজল টের পায়। পার্থ রুদ্ধস্বরে বলে,

“ তুমি আছো তো। আমি আছি তো। আমরা তো আছি। “

তরী নির্লিপ্ত গলায় বলে,

“ কোথায় ছিলে তুমি পার্থ? জ্ঞান হারানোর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তোমার নাম জপছিলাম। তোমার অপেক্ষায় সকল যন্ত্রণা সয়ে কাতরাচ্ছিলাম। তুমি আসো নি। “

পার্থ কিছু বলবে তার আগেই তরী আবার বলে,

“ একটা প্রশ্ন করবো শুধু। সত্যি সত্যি উত্তর দাও। “

পার্থ মাথা তুলে এবার তরীর শ্যাম রক্তশূণ্য মুখের দিকে তাকায়। তরী শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমার বাচ্চা কিসের দায়ে পৃথিবীতে আসার আগেই চলে গেলো? “

প্রশ্নটা করার সময় তরীর চোখ ছলছল করছিলো। পার্থ সেই চোখে তাকিয়ে থেকেই থমথমে গলায় জবাব দেয়,

“ তার বাবার রাজনীতি করার দায়ে। “

তরী সাথে সাথে নিজের চোখ বুজে নেয়। এতক্ষণ ধরে চোখে জমে থাকা অশ্রু এখন চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। পার্থ মাথা নত করে বলে,

“ আমাকে মাফ করে দাও। “

“ আমি একা থাকতে চাই। “

পার্থ হালকা উদ্বেগ নিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই তরী অত্যন্ত শীতল গলায় বলে,

“ আমি একা থাকতে চাইছি পার্থ মুন্তাসির। আপনার উপস্থিতি আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। “

পার্থ অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব করে। রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করে,

“ আমি তোমার যন্ত্রণার কারণ? “

তরী কোনো জবাব দেয় না। সে কেবল চোখ বুজে রাখা অবস্থায়ই নিজের মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়। এতে মাথায় কাঁচা আঘাতের জায়গায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে। তবে সেই ব্যথাটুকু তরী ঠোঁট কামড়ে সহ্য করে নেয়। পার্থ কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো বলে,

“ আর সামনে আসবো না। নিজের প্রতি অযত্ন করো না কোনো। “

পার্থ কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই তরী চোখ মেলে তাকায়। এক অবর্ননীয় যন্ত্রণা তার বুকের এফোঁড় ওফোঁড় সম্পূর্ণটা ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে চেপে রাখা কান্নাটা এই মুহুর্তে ঠেলে বেরিয়ে আসে। তরী একহাতে বেডের চাদর খামচে আর্তনাদ করে কেঁদে উঠে। জোরে আর্তনাদ করার ফলে তার সম্পূর্ণ শরীর ব্যথায় নীল হয়ে আসে। তবুও তরী থামে না। এই সকল যন্ত্রণা তার মনের যন্ত্রণার তুলনায় বেশি নয়। তরী কাঁদতে কাঁদতে অস্ফুটে বলে উঠে,

“ তোমার রাজনীতি নামক এই ঝড় আমাদের সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেলো পার্থ। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৮.

মাঝে কেটে গেলো সাতটা দিন। এই সাত দিনে দুই পরিবারের সকল মানুষ তরীকে দেখতে এলেও পার্থ ভুলেও আর তরীর সামনে আসে নি। অথচ এই সাতটা দিন মানুষটা তরীর কেবিনের বাহিরেই রাত্রি যাপন করেছে। তরী এবং পার্থর এই নীরব দূরত্ব কারো চোখ এড়ায় নি। সবাই-ই মোটামুটি নিশ্চিত যে এই দুজনের মাঝে কোনো সমস্যা চলছে। তাদের সন্দেহটাকে সম্পূর্ণ সত্যিতে রূপ দিতে তরী জানায় যে সে হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়ে নিজের বাড়ি ফিরতে চায়। তার কথা শুনে আফজাল সাহেব বলেন,

“ বেশ তো। একবার সুস্থ হও, তোমাকে সাদরে ঘরে বরণ করে নিতে আমরা অপেক্ষমাণ। “

আফজাল সাহেবের কথার পিঠে তরী বেশ শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

“ আমি যে বাড়িতে বেড়ে উঠেছি সেই বাড়িতে ফিরতে চাই আব্বা। “

আফজাল সাহেব এ নিয়ে আর কোনো টু শব্দ করে না। বাকি কেউও আপত্তি করে না। হুমায়ুন রশীদ মেয়ের জন্য নিচতলার গেস্ট রুমটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার তদারকি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তরীর পায়ের ফ্র্যাকচারটা সারতে বেশ সময় নিবে। এই অবস্থায় তরীর সিঁড়ি বেয়ে উপরের ঘরে থাকাটা মোটেও সমীচীন হবে না। মেয়ের জন্য কিভাবে কি সুবিধা হয় তাই এখন হুমায়ুন রশীদের একমাত্র চিন্তা।

সাদিকা বেগমও এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে না। এই অবস্থায় তরী এই বাড়িতে থাকলে সাদিকা বেগমের দুই মেয়ের খেয়াল রাখতেই বেশ সুবিধা হবে। এতো বড় এক্সিডেন্টের পর মেয়েটার শরীরের কি অবস্থা হয়েছে! সাদিকা বেগম তরীর আপন মা না হলেও মায়ের তুলনায় কোনো অংশে কম যত্ন করবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

__________

নিজ দলের বেশ কিছু সিনিয়র নেতা কর্মীর সঙ্গে গোল মিটিংয়ে বসেছে পার্থ। মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারী বেশ কিছু নেতা কর্মীই আকারে ইঙ্গিতে পার্থকে ছোট করে কথা বলতে ব্যস্ত। তাদের ভাষ্যমতে সিনিয়র এতো যোগ্য নেতাকর্মী থাকতে পার্টি কেন পার্থকে নমিনেশন দিলো? এ এক ঘোর অন্যায়! পার্থ সোনার থালে সাজানো অবস্থায়ই এমপি পদটা পেয়ে গিয়েছে।

পার্থ এতক্ষণ নীরব স্রোতার ন্যায় সব শুনে যাচ্ছিলো। কিন্তু এই ধরনের মন্তব্যের পর সে আর চুপ থাকতে পারে না। থমথমে গলায় বলে উঠে,

“ ভুল বললেন ইশতিয়াক ভুইয়া। সোনার থালে সাজিয়ে আমাকে এই পদ দেওয়া হলে কখনোই আমার নিজের একনিষ্ঠ কাছের কর্মীদের বিভিন্ন হামলার মুখোমুখি হতে হতো না। না আমার সন্তান বিপরীত দলের ক্ষুধার্তদের হাতে খুন হতো আর না আমার স্ত্রীকে এতো বড় একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হতো। পার্টি হতে আমার সততা আর একনিষ্ঠতা দেখেই আমাকে নমিনেশন দিয়েছে। জনগণও তা দেখেই আমাকে ভোট দিয়ে জয়ী করেছে। “

পার্থর এহেন জবাব ইশতিয়াক ভুইয়ার যুতসই মনে হয় না। তার মনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিলো এবার পার্টির তরফ থেকে নমিনেশন সে পাবে। কিন্তু পার্টি তাকে রেখে দু দিনের এই ছোকরাকে নমিনেশন দিয়ে দিলো। অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে কি এই তরুণ তার থেকে বড় নাকি? উহু! কখনোই না।

ইশতিয়াক ভুইয়া আড়চোখে পার্থকে একবার পরখ করে নেয়। পার্থর শান্ত দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকা তীক্ষ্ণতা এবং গম্ভীর মুখশ্রী তার চোখ এড়ায় না। এর আগেও বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক গোল মিটিং কিংবা সমাবেশে পার্থর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রতিবারই ইশতিয়াক ভুইয়া একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন। পার্থ বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ থাকে। কিন্তু যখন মুখ খুলে তখন তার ধারালো কথার পিঠে অন্য কেউ কথা খুঁজে পায়না। ইশতিয়াক ভুইয়ার এই পর্যবেক্ষণ মূলক দৃষ্টি পার্থ নীরবে পরোক্ষ করে নেয়।

মিটিং শেষ হতেই পার্থ পার্টি অফিস হতে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে বসে। তার পাশেই বসা রয়েছে আসিফ। পার্থ গাড়িটা স্টার্ট দেয় না। চুপচাপ ড্রাইভিং সিটে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রয়। পার্থর এরকম থমথমে মুখ দেখে আসিফ আজকাল নিজ থেকে সেধে কোনো কথা বলার সাহস পায় না। ভাবীর সেই এক্সিডেন্টের পর থেকেই পার্থকে দেখলে তার ভয় করে। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। রুবেলের মৃত্যুর সেই মুহুর্তে পার্থর হিংস্র দৃষ্টি আসিফ এখনো ভুলতে পারছে না। ওই অমানুষ গুলো তার ভাইকে কি থেকে কি বানিয়ে দিয়েছে তা ভাবতেই আসিফের শরীরে চরম ক্ষোভ এসে ভর করে।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর পার্থ চোখ বুজে রেখেই বলে উঠে,

“ বুঝলি আসিফ, ইলেকশনের আগ পর্যন্ত অন্য পার্টির মানুষরা আমাকে শত্রু হিসেবে দেখতো। কিন্তু ইলেকশনটা জিতে যাওয়ার পর থেকে এখন নিজের পার্টির লোকরাই আমাকে শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। “

আসিফ উদ্বিগ্ন গলায় বলে,

“ আপনে কি ইশতিয়াক ভুইয়ার কথা কইতাসেন ভাই? আমিও খেয়াল করসি ওই বেডায় যাওয়ার সময় আপনের দিকে কেমন শকুনের নজরে তাকাইতাসিলো। “

পার্থ ক্লান্ত গলায় বলে,

“ ইলেকশন জিতে গিয়েছি বলে সংগ্রাম শেষ হয়ে যায় নি আসিফ। আসল সংগ্রাম তো কেবল শুরু। এতদিন অন্য পার্টিকে কেবল ট্যাকেল দিতে হতো আমাদের, কিন্তু এখন নিজের পার্টির কিছু মুখোশধারী শুভাকাঙ্ক্ষীদের হতে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে হবে আমাদের। “

আসিফ মাথা নাড়ে। অত:পর নিজের হাতের ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে দুপুর প্রায় বারোটা বাজে। আসিফ সাহস করে বলে,

“ ভাই, ভাবীরে তো মনে হয় আজকে হসপিটাল থেকে ছাইড়া দিবো। ডিসচার্জ টাইম না দুপুর বারোটা বলসিলো? ভাবীর কাছে যাইবেন না? “

পার্থ চোখ মেলে তাকায়। তবে আসিফের প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না। উল্টো প্রসঙ্গ বদলে বলে,

“ তোকে বাসায় ড্রপ করে দেই চল। “

আসিফ ব্যস্ত গলায় বলে,

“ কি বলেন ভাই! আমি রিকশা নিয়া যামুগা নে। আপনে আমারে কেন ড্রপ করবেন? “

পার্থ শীতল দৃষ্টি মেলে আসিফের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে শুধায়,

“ আমি তোকে ড্রপ করতে গেলে কি তোর জাত যাবে আসিফ? “

“ নাউজুবিল্লাহ ভাই। কি বলেন এইসব! “

পার্থ আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দেয়। বাসায় ফেরার পথে আসিফ লক্ষ্য করে পার্থ চার রাস্তার সেই মেইন রোড এভোয়েড করে অন্য রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। বিষয়টা আসিফ গত কয়েক দিন ধরেই নোটিশ করছে। ভাই কি ইচ্ছা করেই ওই রাস্তায় গাড়ি চালায় না? মনের প্রশ্ন মনেই চেপে যায় আসিফ। কিছু তিক্ত স্মৃতি এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। এতে যদি ভালো থাকা যায় তবে তাতে দোষের কিছু নেই।

__________

তূর্য এবং হুমায়ুন রশীদ মিলে দুপুরের দিকে তরীকে নিয়ে নিজেদের বাসায় ফিরে। তরীর বাড়ি ফেরা নিয়ে যেনো এক উৎসব মুখোর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আফজাল সাহেব, শোভন, মধুমিতা সবাই-ই এই বাসায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। পৃথাও বেশ উদগ্রীব হয়েছিলো বড় ভাবীর অপেক্ষায়। তরী কেবিনে থাকা অবস্থায় কেবল দুইদিনই তূর্য তাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলো। এ নিয়ে পৃথা তূর্যর উপর বেশ রেগেও আছে।

গাড়ি থেকে নামতেই তূর্যের হাত ধরে বেশ ধীরে ধীরে হেটে ভিতরে প্রবেশ করে তরী। মাথার আঘাতের তুলনায় পায়ের এই ফ্র্যাকচারটা বেশি পীড়া দিচ্ছে তাকে। পায়ের উপর নূন্যতম ভরটুকু ফেলতে পারছে না সে। যদিও ডক্টর সাজেস্ট করেছিলো চাইলে হুইলচেয়ার ইউজ করতে পারে। কিন্তু তরী তাতে রাজি হয়নি। অগ্যতা তূর্যের হাতে ভর রেখেই সে সোজা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমটায় এসে বিছানায় উঠে বসে। এই কিছুক্ষণের হাঁটার ফলেই ব্যথায় তার সম্পূর্ণ শরীর নীল হয়ে গিয়েছে।

ইতিমধ্যে সবাই রুমে এসে তাকে ঘিরে ধরেছে। সকলেই বিভিন্ন ভাবে তার মন ভালো রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত। তরীর জ্ঞান ফেরার পর থেকে এখনো কেউই তার সামনে বাচ্চা নিয়ে কোনো কথা বলে নি। অযথা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার কোনো মানে হয়না।

পৃথা তরীর পাশে এসে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ ওয়েলকাম হোম ভাবী। “

পৃথার এই আকস্মিক আলিঙ্গনে তরী না চাইতেও চোখ খিচে হালকা ব্যথাতুর শব্দ করে উঠে। শরীরের কাচা ক্ষত গুলো ব্যথায় কামড়ে ধরেছে যেনো। সাথে সাথে পৃথা দূরে সড়ে অপরাধীর ন্যায় মুখ করে বলে,

“ সরি ভাবী। আমার খেয়াল ছিলো না। “

তরী কিছু বলবে তার আগেই শোভন পৃথার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

“ ছাগল একটা। দুইদিন পর এক বাচ্চার মা হবি অথচ এখনো ছাগলের মতো কাজ কারবার করস। তূর্য ভাই সামনের কুরবানি ঈদে আপনি চাইলে এই ছাগলকে হাটে তুলতে পারেন। ভালো দাম পাবেন এটাকে বিক্রি করলে। “

শোভনের কথা শুনে পৃথা, তরী এবং আফজাল সাহেব ব্যতীত সকলেই হাসে। আফজাল সাহেব ছেলেকে আড়ালে চোখ রাঙায়। নিজের বোনের শশুড়বাড়ি এসে সকলের সামনে বোনকে নিয়ে এরকম ঠাট্টা করাটা তার পছন্দ হয়না। পৃথাও রেগে ঠোঁট উল্টে বলে,

“ তোর কি ধারণা আছে যে তুই আস্ত একটা বলদ ছোট দা? ছোট ভাবী, তোমার এই জামাইকে সরি আই মিন বলদকেও চাইলে তুমি কুরবানির হাটে তুলতে পারো। “

সাদিকা বেগম বাগড়া দিয়ে বলে,

“ দুইজনকেই হাটে তুলবো। এবার খুশি? “

তরীর কাউকেই ভালো লাগছে না। সবকিছু বিরক্তিকর ঠেকছে তার কাছে। সাদিকা বেগম হয়তো তার মনের খবর বুঝতে পারেন। তাইতো সবাইকে তাড়া দিয়ে রুম থেকে বের করে দেন। তরীকে রেস্ট করতে বলে তিনি নিজেও বেরিয়ে যান।

তরী বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকা অবস্থায়ই চোখ বুজে নেয়। এতো মানুষের ভীড়ে পার্থ নেই। এ নিয়ে কি তরীর অভিমান হওয়া উচিত? মোটেও না। তরী নিজেই মানুষটাকে বলেছে যে সে তার উপস্থিতি সহ্য করতে পারছে না। তবে এখন কেন এতটা শূন্যতা অনুভব করছে সে? তরী অভিমানী গলায় আওড়ায়,

“ কি করবো আমি? তোমার উপস্থিতি আমাকে সেই তিক্ত রাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। তোমার অনুপস্থিতিও আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। আমার কাউকে ভালো লাগছে না। সব অসহ্যকর লাগছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। “

__________

মুখ গোমড়া করে ফোন চালাতে ব্যস্ত পৃথা। তূর্য পাশে বসে ল্যাপটপ চালানোর মাঝে আড়চোখে সবটাই পরখ করে। অত:পর ঠাট্টা করে বলে,

“ মুখ ফুলিয়ে রেখেছো কেনো? আর দুই তিন মাসের মধ্যে নিজ থেকেই তুমি ফুলে যাবে। “

পৃথা তূর্যর দিকে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

“ হ্যাঁ। অল ক্রেডিট গোস টু ইউ। “

পৃথার কথার ধরন দেখে তূর্য বিষম খায়। এই মেয়ের আবার কি হলো? তূর্য সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে বলে,

“ হোয়াট হ্যাপেনড পৃথা? দু দিন পরে মোটা হয়ে যাবে সেই চিন্তায় মুখ ফুলিয়ে রেখেছো নাকি অন্য কোনো কারণ? “

পৃথা এবার গরম স্বরে বলে,

“ বারবার মোটা হওয়ার কথা কেন বলছেন? মোটা কি আমি সাধে হবো? সব আপনার দোষ। আপনি বাচ্চা দিয়েছেন কেন? “

পৃথার এহেন কথায় তূর্য দ্বিতীয় দফায় বিষম খায়। অত:পর সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নেয়। মনে মনে নিজেকে শুধায়,

“ নে বেটা এখন বউয়ের মুড সুইং সামলা। “

তূর্য ল্যাপটপটা একপাশে রেখে পৃথাকে বুকে টেনে নিয়ে তার মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বলে,

“ সরি বেবি। এখন বলো রেগে আছো কেনো? “

“ বড় দা একবারও ভাবীকে দেখতে এলো না। পুরুষ মানুষ কি নির্দয়! এই অবস্থায় বড় দা’র উচিত ছিলো ভাবীর পাশে থাকা। “

“ আমরা উনাদের পরিস্থিতিতে নেই পৃথা। তাই এই ব্যাপার আমাদের কোনো মন্তব্যও করা উচিত নয়। “

পৃথা ঠোঁট উল্টে বলে,

“ তবুও! “

“ তবুও টবুও কিচ্ছু না। সারাদিন মাথায় এতো কথা ঘুরে কেনো তোমার? তোমার এই অভার থিংকিং এর যন্ত্রণায় হয়তো আমার বেবিও পেটের ভেতর শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। মাথার সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে চোখ বন্ধ করে এখুনি ঘুমাও। “

পৃথা ভেংচি কেটে বলে,

“ সব চিন্তা শুধু বেবির। “

তূর্য হেসে বলে,

“ বেবির মাম্মা বুঝে কম। নাহয় এটাও বুঝতো যে আমি তারও চিন্তা করি। “

__________

মধ্যরাতে আচমকা ভয়ংকর এক স্বপ্ন দেখে তরীর ঘুম ছুটে যায়। সম্পূর্ণ শরীর তার আতংকে ঘামছে। তরী বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেই টের পায় তার শরীর কাঁপছে। রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। সেই অন্ধকার রুমেই আচমকা এক বাচ্চার কান্না ভেসে আসে তরীর কানে। সাধারণ কোনো কান্না নয়। কোনো নবজাতক শিশুর গলা ফাটিয়ে কান্নার আওয়াজ।

তরী ভীত নয়নে অন্ধকার কক্ষটায় একবার চোখ বুলায়। কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তরী দু’হাতে কান চেপে ধরে নিজের। তার গাল বেয়ে পড়ছে অবিরাম জল। সে বিড়বিড় করতে থাকে,

“ আই এম সরি মা। মাফ করে দাও। তোমার খেয়াল রাখতে পারি নি। “

তবুও কান্নার শব্দ থামে না। তরী অন্ধকারের মাঝেই বালিশের পাশে হাতড়ে নিজের ফোনটা খুঁজে বের করে। কল লিস্টে গিয়ে সোজা একটা নাম্বার ডায়াল করে সে ফোনটা কানে চেপে ধরে। ফোনের মালিক মুহুর্তের মধ্যেই কল রিসিভ করে। তরী কান্না করতে করতে বলে,

“ আমি থাকবো না এখানে। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। “

অপরপাশ থেকে কেবল জবাবে একটাই কথা ভেসে আসে,

“ এখুনি আসছি। “

অত:পর ফোনটা কেটে যায়। তরী অন্ধকারের মধ্যেই ফোন হাতে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। পায়ে চাপ পড়তেই সম্পূর্ণ শরীর যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠে। তবে সেদিকে আপাতত তরীর খেয়াল নেই। সে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় কোনো মতে দেয়াল ধরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে রুম থেকে বের হয়। নিচতলা সম্পূর্ণটা অন্ধকারে তলিয়ে আছে। তরী জোরে শ্বাস টেনে মেইন দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

তরী মেইন দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই বাড়ির দাড়োয়ান হতভম্ব ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাড়ির মেয়ে এরকম মাঝরাতে খালি পায়ে এহেন বিধ্বস্ত অবস্থায় ঘরের বাইরে কি করছে? দাড়োয়ান চাচা বহু বছর ধরে এই বাড়িতে কর্মরত রয়েছেন। তরীর সাথে যে এমন দৃশ্য মোটেও যায় না তা তিনি ভালো করে জানেন। তাই ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে তরীকে প্রশ্ন করে,

“ কি হইসে আম্মা। কিছু লাগবো? “

তরী ভীত দৃষ্টি মেলে একবার লোকটার দিকে তাকায়। অত:পর আবার উদ্ভ্রান্তের ন্যায় মেইন গেটের বাহিরে রাস্তার দিকে ছুটে বেরিয়ে যায় সে। দাড়োয়ান আংকেল হতভম্ব চোখে সেই দৃশ্য দেখে। এই প্রথম তরীকে এমন উদ্ভট আচরণ করতে দেখছে সে। তরীর মতো ভদ্র বিচক্ষণ মেয়ের এমন আচরণ কি মেনে নেওয়া যায়? বিস্ময় কাটিয়ে উঠতেই দাড়োয়ান আংকেল তাড়াতাড়ি ফোন বের করে তূর্যর নাম্বারে কল লাগায়। প্রথম বারে কল রিসিভ না হলেও দ্বিতীয় বারের বেলায় কল রিসিভ হয়। দাড়োয়ান আংকেল চিন্তিত গলায় বলে,

“ তরী আম্মা এইমাত্র পাগলের মতো দৌড়াইতে দৌড়াইতে ঘর থেকে বাইর হইয়া গেসে বাবা। “

__________

শান্ত নীরব রাস্তায় কান্না করতে করতে দৌড়ে এগোচ্ছে তরী। এই বাসা থেকে দূরে যাওয়াই তার মূল উদ্দেশ্য। এতো দূরে যাবে যেনো সেই কান্নার আওয়াজ আর তার শুনতে না হয়। আচমকা নিস্তব্ধ রাস্তার মাঝে একটা গাড়ির হেডলাইট এসে তরীর মুখের উপর পড়ে। সাথে সাথে সে রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। গাড়িটাও দূর হতে তাকে দেখে ব্রেক কষে।

কালো গাড়িটা হতে নেমে আসে এক দীর্ঘদেহী পুরুষ। দূর হতে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মানুষটাকে চিনতে একটুও অসুবিধা হয় না তরীর। সে আবারও দৌড়ে এগিয়ে যায় পুরুষটার দিকে।

দূর হতে তরীকে দেখেই পার্থর বুক কেপে উঠে। কি এমন হয়েছে তরীর যে পার্থর আসার অপেক্ষাটুকুও করলো না? নিজেই ছুটে বেরিয়ে এসেছে! পার্থ আরেকদফা দূর হতে তরীকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে। গায়ে একটা সাদা রঙের ঢিলেঢালা কুর্তি ও পাজামা। সাথে কোনো ওড়না নেই। পার্থর দৃষ্টি স্থির হয় তরীর পায়ের দিকে গিয়ে। তরীর পায়ের সাদা ব্যান্ডেজ ভেদ করে রক্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

পার্থ আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। দৌড়ে এগিয়ে যায় তরীর দিকে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই নিজেদের মধ্যে থাকা দূরত্ব মিটিয়ে দিয়ে তরীকে জাপ্টে ধরে সে। স্ত্রীকে খালি পায়ে রাস্তায় এই অবস্থায় আর এক মুহুর্ত রাখতে চায় না পার্থ তাই তরীর কোমর জড়িয়ে ধরেই সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তরীর পা মাটি থেকে উঁচুতে চলে যায়। এই আলিঙ্গনে তরীর সমস্ত শরীর ব্যথা করে উঠে। তবুও সে দাঁত খিচে পার্থর কাধে মুখ গুজে রয়। নীরব অশ্রুতে ভিজিয়ে দেয় পার্থর ছাই রঙা টি শার্টটা।

পার্থ উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে জান? “

পার্থর প্রশ্নে তরীর কান্নার তোপ আরেকটু বেড়ে যায়। সে চোখ বুজে রেখেই এলোমেলো শব্দে কিছু বলে যা পার্থর বোধগম্য হয় না। পার্থ ফের প্রশ্ন করে,

“ তোমার পুরো শরীর কাপছে। কি হয়েছে আমাকে বলো? “

তরী এবার কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“ একটা বাচ্চা কাদছিলো ওই অন্ধকার রুমে। আমি এখানে থাকতে চাই না। নিয়ে চলো আমাকে। “

তরীর কথা শুনে পার্থ বিস্মিত হয়। বাচ্চা কাদছিলো মানে? তরীর কি হ্যালুসিয়েশন হচ্ছে? ডক্টর তো বলেছিলো ওই এক্সিডেন্ট এবং মিসক্যারেজের ফলে তরী অলরেডি ডিপ্রেশনে ভুগছে। সেই কারণেই কি এসব ইমাজিন করছে তরী? পার্থর ভাবনার মাঝেই রাস্তার অপরপাশ হতে তূর্যকে দৌড়ে আসতে দেখা যায়। দূর হতে তূর্য পার্থকে তরীর সাথে দেখে থেমে যায়। হাফ ছেড়ে নিঃশ্বাস ফেলে সে। দাড়োয়ান আংকেলের কল পেয়েই সে কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়েছে। বোনের চিন্তায় তার বুক ঢিপঢিপ করছিলো। কিন্তু পার্থর সাথে তরীকে দেখে সে স্বস্তি পায়। চোখের ইশারায় পার্থকে প্রশ্ন করে তরী ঠিক আছে নাকি। পার্থও একইভাবে চোখের ইশারায় বলে চিন্তা না করতে, তরীকে সে সাথে নিয়ে যাচ্ছে।

তূর্য আর কিছু না বলে বেস্ট অফ লাক দেখিয়ে উল্টো রাস্তায় হাঁটা শুরু করে। তরী এখনো একইভাবে কাঁদছে। পার্থ নীরবে এবার তরীকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে, সিট বেল্ট পড়িয়ে দিয়ে বলে,

“ আর ভয় পেও না। আমি আছি। “

__________

বাড়িতে ফিরেও পার্থ তরীকে কোলে তুলে বাসায় প্রবেশ করে। জমিলা খালা দরজা খুলে দিতেই পার্থ কোনো কথা না বলে সোজা সিঁড়ি ধরে উপরের দিকে হাঁটা শুরু করে। তরী পার্থর কাধ জড়িয়ে বুকে মুখ গুজে রয়। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই অপ্রত্যাশিতভাবে পার্থ শোভনের মুখোমুখি হয়। শোভন মধুকে পাজাকোলে নিয়ে ছাদ থেকে নামছিলো। এরকম একটা সময় পার্থর সামনে পড়তেই সে তাজ্জব বনে যায়। মধুমিতাও লজ্জায় নিজের দৃষ্টি নত করে রেখেছে। শোভন গলাটা সামান্য ভিজিয়ে নিয়ে বলে উঠে,

“ ওয়েলকাম ব্যাক ভাবী। “

তরী প্রতুত্তর করে না। মুখ তুলেও তাকায় না। পার্থ এই পরিস্থিতি আর দীর্ঘ না করে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে যা। “

পার্থ নিজের রুমে চলে যেতেই মধুমিতা শোভনের ঘাড় খামচে ধরে বলে,

“ আরো বউকে কোলে তুলে ঢেংঢেং করে ঘুরে বেড়াও। দাদার সামনে আমাকে এমন লজ্জায় না ফেললে তোমার চলতো না? “

শোভন ডোন্ট কেয়ার এটিটিউডে বলে উঠে,

“ এজন্যই আজ তোমার রক্ষা নেই সুন্দরী। দু চারটা বাচ্চাকাচ্চা এসে পড়লে তখন তোমাকে ফেলে ওদেরকে কোলে তুলেই ঢেংঢেং করে ঘুরবো। “

মধুমিতা মশকরা করে বলে,

“ তোমার নামে মানহানীর মামলা করবো আমি অফিসার। “

শোভন রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ আগে মানহানি তো করতে দাও। “

__________

বিছানায় নীরব ভঙ্গিতে বসে আছে তরী। পার্থ তার সামনে বসে তার পায়ের ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করতে ব্যস্ত। মানুষটা এই কাজে বেশ অপটু তা তার ব্যান্ডেজ করার স্টাইল দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবুও নিজের বেস্ট ট্রাই করে যাচ্ছে যেন তরীকে কষ্ট না দিয়ে পার্ফেক্টলি কাজটা করতে পারে।

ব্যান্ডেজ করা শেষ হতেই পার্থ চিন্তিত গলায় বলে,

“ কাল সকালেই একবার হসপিটালে যাবো। প্রোপার ড্রেসিং করাতে হবে তোমার। “

কথাটা বলেই পার্থ ফার্স্ট এইড বক্সটা হাতে নিয়ে উঠে যেতে নেয়। কিন্তু হাতে টান অনুভব করতেই সে ফিরে তাকায়। তরী তার হাত ধরে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। এতক্ষণে দুজনের দৃষ্টি মিলন হয়। তরী খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে পার্থকে। পার্থর মুখের দাঁড়ি আগের তুলনায় আরেকটু বেশি ঘন লাগছে। চেহারায় ফুটে আছে স্পষ্ট অবহেলার ছাপ। শীতল চোখ দুটোতে দৃষ্টি স্থির রেখেই তরী বলে,

“ তুমি আর আমি একই জিনিস হারিয়েছি। কষ্টের অনুপাতটাও আমাদের এক। তবুও আমি তোমাকে একা দায়ী করেছি। আমাকে মাফ করে দাও। “

কথাটুকু বলতে বলতেই তরীর চোখ বেয়ে আবার পানি পড়ে। পার্থ নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয় তরীর দিকে। অত:পর নিজের হাতের ফার্স্ট এইড বক্সটা একপাশে রেখে পুরোপুরি বিছানায় উঠে তরীর কোলে মাথা এলিয়ে দেয়। শক্ত হাতে তরীর কোমর জাপ্টে ধরে তার পেটে মুখ গুজে। আজ আর তরী তাকে ফিরিয়ে দেয় না। বরং নিজের দূর্বল হাত পার্থর মাথায় রেখে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। পার্থ রুদ্ধস্বরে বলে,

“ এইসব কিছুর পিছনে দায়ী কেবল আমিই। আমার কারণে তোমার এই অবস্থা। আমার কারণে আমাদের বাচ্চা আর নেই। সব আমার দোষ। “

কথাটুকু বলেই পার্থ ফুপিয়ে কেদে উঠে। তরী দাঁতে ঠোঁট চেপে কান্নাটুকু গিলে নিয়ে বলে,

“ ও আমাদের ভাগ্যে ছিলো না পার্থ। ও আরো ভালো এবং নিরাপদ জায়গায় আছে এখন। “

কান্নার দমকে পার্থর শরীর মৃদু কাপছে। সে একইভাবে রুদ্ধস্বরে বলে,

“ ওকে আমরা স্বপ্ন ডাকি তরী? “

তরীর নীরবে কান্নার বেগ বাড়ে। আহ স্বপ্ন! তাদের তন্দ্রায় আসা ক্ষানিকের এক স্বপ্ন। তরী মাথা নেড়ে বলে,

“ আচ্ছা। “

পার্থ এবার নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে প্রিয়তমার সান্নিধ্যে সন্তান হারানোর বেদনায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কি বেদনাদায়ক সেই কান্নার সুর! তরী নিজেও কাঁদছিলো। মানুষটা এই কয়টা দিন কিভাবে নিজের কষ্ট আড়াল করে ছিলো? ভাবতেই তরীর শরীরের পাশাপাশি মনের ব্যথাও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সে মাথাটা সামান্য নুইয়ে পার্থর মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলে,

“ কেঁদে নাও। বুকটা হালকা করো। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে