যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৫.
রাত পেরিয়ে নতুন ভোরের আগমন ঘটছে ধীরে ধীরে। এই ভোরের আগমন হওয়ার কথা ছিলো কোনো এক সুখকর বার্তা নিয়ে। কিন্তু তা আর হলো না। এই ভোর বড় অলুক্ষণে। এই অনবরত বর্ষণ খুব অলুক্ষণে। গতরাতে যে ব্যক্তি বিজয়ীর বেশে জনগণের সামনে বক্তব্য পেশ করেছিলো, আজ সেই একই ব্যক্তি একজন হেরে যাওয়া ব্যক্তির ন্যায় মেঝেতে মাথা নত করে বসে আছে। তার আশেপাশে কারো অস্তিত্বই সে অনুভব করতে পারছে না। সব মলিন লাগছে।
দূর হতে বেঞ্চিতে বসা আফজাল সাহেব ছেলের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। চোখের সামনে ছেলের এই অবস্থা তার সহ্য হচ্ছে না। উনার পাশে বসে থাকা মধুমিতা আশ্বাস দেওয়ার সুরে বলে উঠে,
“ আল্লাহ সহায় হবেন আব্বা। আপনি শক্ত থাকুন। আম্মাও পৃথাকে একা রেখে আসতে পারছে না। শোভনও এখানে উপস্থিত নেই। আপনি ভেঙে পড়লে দাদা, হুমায়ুন আংকেল আর তূর্য ভাইয়াকে কে সাহস জোগাবে বলুন? “
পুত্র বধূর কথা শুনে আফজাল সাহেব চোখ তুলে তার সামনের বেঞ্চিতে বসে থাকা হুমায়ুন রশীদ এবং তূর্যের দিকে তাকায়। হুমায়ুন রশীদের বেশ বিধ্বস্ত অবস্থা। তূর্যও গত মধ্যরাত হতে এখানে উপস্থিত। সবার সামনে না কাদলেও ছেলেটা যে আড়ালে নিজের একমাত্র বোনের জন্য অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে তা তার চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
আফজাল সাহেব আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের ছেলের দিকে তাকায়।
__________
গতরাতে পার্টি অফিসে বসে সকলের অভিনন্দন বার্তার জবাব দিতে ব্যস্ত পার্থর কাছে আচমকা জহিরের কল আসে। ফোনের স্ক্রিনে আচমকা জহিরের নাম দেখতেই পার্থর বুক ধক করে উঠে। সে ফোন রিসিভ করে কিছু বলবে তার আগেই অপরপাশ থেকে জহিরের চিৎকার ভেসে আসে,
“ ভাই, ভাবীর এক্সিডেন্ট হইসে। গ্রীন কেয়ার হসপিটালে নিয়ে যাইতেসি আমি। আপনি আসেন। “
ব্যস! এই তিনটি বাক্যই পার্থর পৃথিবী দুমড়ে মুচড়ে দেয়। সে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় দৌড়ে পার্টি অফিস থেকে বের হয়। তার সাথে থাকা শামীম,আসিফ সহ বেশ কয়েকজন তার এই অবস্থা দেখে নিজে ড্রাইভ করে তাকে হসপিটালে নিয়ে আসে। হসপিটালে এসে এক্সিডেন্টের বর্ণনা শোনার পরই পার্থ ধপ করে এই ওটির রুমের সামনে বসে পড়ে। এরপর থেকে কারো সাথে কোনো বাক্য বিনিময় করে নি সে। অনুভূতিহীন পাথরের মূর্তির ন্যায় একইভাবে বসে আছে।
দীর্ঘ চার ঘন্টার অপেক্ষার পর ওটির বাহিরের রুমের দরজা খুলে। বেরিয়ে আসে একজন সার্জিক্যাল এপ্রোন পরিহিত মহিলা ডক্টর। তার পিছনে রয়েছেন একজন নার্স। পার্থ যেন কিছুটা শক্তি ফিরে পায়। ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে উঠে দাঁড়িয়ে ডক্টরের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না তার। সামান্য ছোট একটা প্রশ্ন করার সাহসটুকুও খুঁজে পাচ্ছে না সে। এগিয়ে আসে বাকিরাও। হুমায়ুন সাহেব বেশ আশা নিয়ে দুঃসাহসিক প্রশ্নটা করে বসে,
“ আমার মেয়েটা ঠিক আছে তো ডক্টর? “
ডক্টর ফারহানা নিরাশ গলায় প্রশ্ন করে,
“ আপনারা কি জানেন না? “
মধুমিতা ডক্টরের প্রশ্ন শুনে মনে মনে কিছু একটা আন্দাজ করে। গতরাত হতে সে এই বিষয়টা নিয়ে কারো সামনে মুখ খুলে নি। যেই ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয় সেই ব্যাপারে আশংকা করে সবার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার পক্ষে সে ছিল না। মধুমিতার ভাবনার মাঝেই হুমায়ুন রশীদ বলেন,
“ কি জানি না? আমার মেয়ে কেমন আছে? “
ডক্টর ফারহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ এক্সিডেন্টের শিকার আপনার মেয়ে একা হয় নি। তার গর্ভে থাকা দুই মাসের আরেকটা প্রাণও এই এক্সিডেন্টের শিকার। কিন্তু নাজুক প্রাণটা এতো বড় ধাক্কা সামলাতে পারে নি। বাচ্চাটা আর নেই। “
মুহুর্তেই কান্নার তীব্রতা হু হু করে বেড়ে যায়। আফজাল সাহেবের মতো কঠিন একজন মানুষও নিজের কান্না দমিয়ে রাখতে পারে না। মধুমিতাও শব্দ করে কেদে উঠে।
পার্থর সম্পূর্ণ শরীর নিস্তেজ লাগছে। সে দুই পা পিছিয়ে যেতেই করিডোরের দেয়ালে গিয়ে তার পিঠ ঠেকে। তার তরী প্রেগন্যান্ট ছিলো? তার বাচ্চাটাকে ওরা বাঁচতে দিলো না? বাচ্চাটার কি দোষ ছিলো? তার তরী আর তার বাচ্চা তো নিষ্পাপ ছিলো। প্রশ্নগুলো পার্থর মস্তিষ্কে বেশ এলোমেলো ভঙ্গিতে উঁকি দেয়।
ডক্টর ফারহানা আবার হুমায়ুন রশীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“ ডক্টর তরী কাল আমার কাছে এসেছিলো প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাতে। আমার সামনে বসেই উনি বিকেলে নিজের রিপোর্ট দেখেছিলেন। খুশিতে আমার চেম্বারে বসে বেশ কিছুক্ষণ কেদেও ছিলেন। বারবার বলছিলেন আমি যেনো আপনাকে এই বিষয়ে না জানাই। উনি সবার আগে নিজের হাজবেন্ডকে এই গুড নিউজটা দিতে চায়। “
ডক্টর ফারহানার এক একটা কথা পার্থর কানে তীক্ষ্ণ ভাবে বারি খাচ্ছে। উনার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ পার্থর বুকে গিয়ে বিঁধছে। তূর্য ঢোক গিলে নিজের কান্নাটুকু দমিয়ে রেখে প্রশ্ন করে,
“ আমার আপি? হাও ইজ শি? আপি ঠিক আছে তো? “
“ আমাদের যতদূর যা করার ছিলো সবটা করেছি। উনার ইঞ্জুরি গুলো খুব সিরিয়াস। গাড়ি কয়েকবার ডিগবাজি খাওয়াতে মাথায় বেশ সিরিয়াস ইঞ্জুরি হয়েছে। ডান পায়েও হয়তো বেকায়দায় আঘাত পেয়েছে বেশ। ফ্র্যাকচার হয়ে গিয়েছে। পুরো শরীরে আরো অসংখ্য ইঞ্জুরি রয়েছে। উনাকে এখন আইসিইউতে শিফট করা হবে। আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে যেনো জ্ঞান ফিরে আসে সেই দোয়া করেন। নাহয় আমাদের আর কিছু করার নেই। “
আফজাল সাহেব, মধুমিতা ও তূর্য আবার বেঞ্চিতে বসে পড়ে। হুমায়ুন রশীদ ডক্টর ফারহানার সাথে তরীর ব্যাপারে কথা বলার জন্য তার কেবিনে চলে যায়। পার্থ দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পরাস্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। তখনই আবার ওটির দরজা খুলে যায়। দরজার ভেতর থেকে একটা চাকা চালিত হসপিটাল বেড বেরিয়ে আসে। তিনজন ওয়ার্ড বয় এবং একজন নার্স সেই বেড নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বেডে শুয়ে থাকা মানবীর বুক পর্যন্ত একটা শুভ্র চাদর দ্বারা ঢাকা। সম্পূর্ণ মাথার অর্ধেকটাই ব্যান্ডেজ করা। আঘাত প্রাপ্ত একহাতে ক্যানেলাসহ আরো বিভিন্ন নাম না জিনিস লাগানো। বেডটা চোখের আড়াল হওয়ার আগেই পার্থ এক পলক সেই মানবীর মুখশ্রীর দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির করে। গাড়ির ভাঙা কাঁচের সাথে লেগে তরীর ডান গালের বড় গভীর কাঁটাটা পার্থর চোখে বিঁধে। সে এলোমেলো কদম ফেলে বেডটার দিকে এগিয়ে যেতে নিলে আসিফ ও শামীম এসে তাকে পিছন থেকে জাপ্টে ধরে। আসিফ বলে,
“ ভাই যাইয়েন না। সহ্য করতে পারবেন না। “
পার্থ তাদের বাধা মানে না। ছোটার জন্য ছটফট করতে থাকে। কিন্তু ক্লান্ত শরীরে জোর না থাকায় পরাজিত হয়ে থেমে যায় সে। তার অসম্ভব লাল চোখ জোড়ায় জমে থাকা পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই হাতের উলটো পিঠের সাহায্যে তা মুছে নেয় সে। অত:পর বড় বড় কদম ফেলে লিফটের দিকে এগিয়ে যায়। আফজাল সাহেব ক্লান্ত গলায় আসিফ ও শামীমকে বলে,
“ ওকে একা ছেড়ো না। সাথে যাও। “
আসিফ আর শামীমও পার্থর পিছু পিছু চলে যায়।
__________
শান্ত শিষ্ট থানাটা সদ্য নির্বাচিত এমপির আগমনে গরম হয়ে যায়। সকলেই এগিয়ে আসে পার্থর দিকে তাকে বিভিন্ন শুভেচ্ছা বার্তা জানানোর জন্য। কিন্তু পার্থ সকলকে উপেক্ষা করে সোজা একটা রুমে প্রবেশ করে।
টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কনসটেবেলের সাথে কথা বলছিলো শোভন। আচমকা নিজের বড় ভাইয়ের আগমনে সে অবাক হয়। গতরাতে ভাবীর এক্সিডেন্টের খবরটা পাওয়ার পর সে সোজা এক্সিডেন্ট স্পটটা তে চলে যায়। এই কেসটা নিয়েই ইনভেস্টিগেশনে ব্যস্ত সে। তাই পার্থর সাথে আর তার দেখা হয় নি। কিন্তু এই মুহুর্তে নিজের ভাইকে এরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে তার বেশ খারাপ লাগে। কিন্তু সেটা সে প্রকাশ করতে পারে না। চুপচাপ কনসটেবলকে চোখের ইশারায় বলে বেরিয়ে যেতে।
পার্থ এগিয়ে এসে শোভনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠে,
“ এই এক্সিডেন্টের সাথে রুবেল হোসেন জড়িত। ওকে বাসা থেকে তুলে আন। বাকিটা আমি দেখবো। “
শোভন ভাইকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে,
“ তুই ঠান্ডা হয়ে বস দাদা। “
পার্থ শান্ত হয় না। বরং আক্রোশে ফেটে পড়ে। চিৎকার করে উঠে,
“ আমার সন্তানের হত্যাকারীকে যদি তুই আমার হাতে না তুলে দিতে পারিস তাহলে আমি নিজে তাকে খুঁজে বের করবো। কিন্তু কোনো ভাবেই ও আমার থেকে রেহাই পাবে না। “
শোভন বিস্মিত হয়। অবাক সুরে প্রশ্ন করে,
“ তোর সন্তান মানে? “
“ আমার তরী প্রেগন্যান্ট ছিলো। ওই কুলাঙ্গার আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে। আমার বউ ওর কারণে ক্রিটিকাল অবস্থায় আইসিইউতে পড়ে আছে। আমার ভেতরে যেই আগুন ও জ্বালিয়েছে সেই আগুন নিভানোর আগ পর্যন্ত আমি শান্ত হবো না। জানোয়ারের বাচ্চাকে আমি খুন করে ফেলবো। “
শেষের কথাটুকু বেশ হিংস্র ভঙ্গিতে বলে পার্থ। শোভন পার্থকে জোর করে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে তার সামনে একটা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ আমি জানি রুবেল এর সাথে জড়িত। প্রমাণ পেয়েছি। “
পার্থ পানির গ্লাসটাকে উপেক্ষা করে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। শোভন হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে শান্ত গলায় বলে,
“ যেই রোডে ভাবীর এক্সিডেন্ট হয়েছে তার কিছু দূরেই একটা খাদে সেই ট্রাকটাকে খুঁজে পাই আমরা। ট্রাকের ভেতর ড্রাইভারের সিটে আমরা রুবেলের লোক সুজনের ডেড বডি খুঁজে পাই। রুবেলের আদেশ মতেই হয়তো সুজন এই কাজটা করেছে। ভাগ্য খারাপ যে এক্সিডেন্ট স্পটে কোনো সিসিটিভি ছিলো না। তাহলে প্রমাণটা আরো পাকাপোক্ত হতো। কিন্তু তুই চিন্তা করিস না। আমি অলরেডি আমার লোক পাঠিয়েছি রুবেলকে ধরে আনার জন্য। “
সুজনের নাম শুনতেই পার্থ স্তব্ধ হয়ে যায়। তার সাহায্য করার প্রতিদান ছেলেটাকে নিজের জীবন দিয়ে চুকাতে হলো? রুবেল কি টের পেয়ে গিয়েছিলো যে সুজন তার হয়ে রুবেলের বিরুদ্ধে কাজ করছে?
__________
চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে রুবেল হোসেন। তার সম্পূর্ণ শরীর হতে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। রডের আঘাতে করা তার আর্তনাদ কাপিয়ে তুলছে সম্পূর্ণ আন্ডার কন্সট্রাক্টশন বিল্ডিংটা। দূর হতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এই নৃশংস দৃশ্য দেখছে শোভন, আসিফ ও শামীম।
পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে অমানবিক ভাবে একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছে পার্থ। তার সম্পূর্ণ শরীর ঘেমে একাকার। ঘর্মাক্ত পাঞ্জাবিটা গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। থেকে থেকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। নিঃশ্বাস নেওয়ার দমকে তার বুক পিঠ কিছুক্ষণ পর পর ফুলে উঠছে। তবুও থামার কোনো নাম নেই। রড দিয়ে লাগাতার আঘাত করতে করতে পার্থ চেঁচিয়ে বলে উঠে,
“ শু*রের বাচ্চা, তোর শত্রুতা আমার সাথে। তোর প্রতিশোধ নেওয়ার হলে তুই আমার উপর নিতি। এই দ্বন্দ্বের ভেতর তুই আমার বউকে কেন টেনে আনলি? “
পার্থর কথা শুনে রুবেল আর্তনাদ থামিয়ে এবার গা কাপিয়ে হেসে উঠে। গা জ্বালানো সুরে বলে উঠে,
“ খুব বাড় বেড়েছিলো না তোর? তোকে আমি সতর্ক করেছিলাম আমার পিছনে না লেগে নিজের বউয়ের দিকে খেয়াল রাখতে। কিন্তু তুই আমার কথা শুনোস নাই। ওই সুজন কুত্তার বাচ্চার সাথে মিলে আমার পিছে হাত ধুয়ে পড়েছিলি। কি ভেবেছিলি? আমি জানতে পারবো না? মন তো চাচ্ছিলো তোর বউকে তুলে এনে গ্যাং রেপ করাই। যাতে কখনো আর মাথা উঁচু করে সমাজে দাঁড়াতে না পারোস। কিন্তু আমি তোর বউকে সহজ মৃত্যু ভিক্ষা দিয়েছি। তোর উচিত আমার কাছে শুকরিয়া আদায় করা। “
রুবেলের কথা যেনো পার্থর বুকের জ্বলন্ত আগুনে পেট্রোলের ন্যায় কাজ করে। বন্য জন্তুর ন্যায় ফুসে উঠে সে। সাথে সাথে হাতের রডটা ঢিল মেরে দূরে ফেলে দিয়ে চেয়ার সহ রুবেলকে এক লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়। অত:পর রুবেলের উপর বসে সে বেসামাল ভঙ্গিতে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে থাকে। হিংস্র স্বরে বলে উঠে,
“ জানোয়ারের বাচ্চা তোকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না আজকে। তুই মরার আগে আমাকে শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দে। আমার বাচ্চাকে কেন মারলি তুই? আমার বাচ্চার কি দোষ ছিলো? কেন মারলি? “
প্রশ্নটুকু করে পার্থ জবাবের অপেক্ষা করে না। বরং একহাতে রুবেলের চুল মুঠি করে ধরে মেঝেতে তার মাথা জোরে জোরে ঠুকতে শুরু করে। রুবেলের মাথা ফেটে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়। এই পর্যায়ে ব্যথাটা অসহনীয় ঠেকে তার কাছে। এতক্ষণের পৈশাচিক রূপ থেকে বেরিয়ে আচমকা আর্তনাদ করে উঠে,
“ ছেড়ে দে পার্থ মুন্তাসির। “
এই আর্তনাদ পার্থর কলিজা শান্ত করতে পারে না। সে এই আকুতি আরো শুনতে চায়। তাই লাগাতার এলোপাথাড়ি মারতে থাকে রুবেলকে। মুখে হিংস্র গলায় শুধায়,
“ তোকে ছাড়বো? তুই ছেড়েছিলি? আমার তরীকে? আমার বাচ্চাকে? তুই ওদের ছাড় দিয়েছিস? তোকে ছাড় দিলে আমার বাচ্চার আত্মাও কখনো শান্তি পাবে না। তোকে ছাড় দিলে আমার তরীর সাথে অন্যায় হবে। ছাড়বো না তোকে আমি। একটুও ছাড় পাবি না। “
কথাটুকু বলতে বলতে পার্থর দু’হাত থেমে যায়। সে ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। দু দন্ড জোরে নিঃশ্বাস নেয়। এক মুহুর্তের জন্য আঘাত থেকে মুক্তি পেয়ে রুবেল একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে নেয়। কিন্তু তার আগেই সে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে। পার্থ তার গোপন অঙ্গে পরপর কয়েকটা জোরে লাথি মারে। এই পর্যায়ে শোভন দৌড়ে এসে ভাইকে দূরে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে বলে,
“ মরে যাবে দাদা। ছেড়ে দে। বাকি শাস্তিটুকু আইনের জন্য তোলা রাখ। “
শোভন একা ভাইকে আটকাতে পারছিলো না। পার্থর উপর যেনো দশটা জ্বিনের অলৌকিক শক্তি এসে ভর করেছে। সে হিংস্র স্বরে ফুসছে। আসিফ ও শামীমও এগিয়ে এসে শোভনের সাথে মিলে পার্থকে জাপ্টে ধরে পিছিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু তারা সকলেই পার্থকে আটকে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। শোভন পার্থকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“ ভাবী অপেক্ষা করছে দাদা। এখানে আর সময় নষ্ট করিস না। তোর এই মুহুর্তে ভাবীর পাশে থাকা উচিত। “
শোভনের কথাটুকু যেন টনিকের মতো কাজ করে। হিংস্র পার্থ মুহুর্তেই শান্ত হয়ে যায়। তাকে শান্ত হতে দেখে শোভন, আসিফ আর শামীম তাকে ছেড়ে দেয়। পার্থ নিষ্প্রভ দৃষ্টি মেলে শোভনের দিকে তাকায়। শোভন আবার কোমল স্বরে বলে,
“ ভাবীর কাছে যা দাদা। “
পার্থ কোনো জবাব দেয় না। সে এক দৃষ্টিতে শোভনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আচমকা গান শুটের বিকট শব্দে শোভন, আসিফ ও শামীম কেপে উঠে। বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তারা কিছুটা দূরে মেঝেতে পড়ে থাকা রুবেলের দিকে তাকায়। অত:পর তাকায় রুবেলের দিকে রিভলবার তাক করে দাঁড়িয়ে থাকা পার্থর দিকে। পার্থ এখনো শোভনের দিকে তাকিয়ে আছে। শোভন বিস্ময় নিয়ে নিজের পকেট হাতড়ে নিজের রিভলবারটা খুঁজে। পার্থ তার অজান্তেই তার রিভলবার নিয়ে নিয়েছে বুঝতেই সে আরেক দফা অবাক হয়ে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকায়। পার্থ সাথে সাথে আরো কয়েকবার শুট করে। লোডেড রিভলবারের সবগুলো গুলি রুবেলের দেহে প্রবেশ করিয়ে তবেই সে ক্ষান্ত হয়। এখন তাকে দেখতে বেশ শান্ত লাগছে। চেহারার ভঙ্গিমা এমন যেন এইমাত্র সে কিছুই করে নি। রিভলবারটা এবার শোভনের হাতে দিয়ে পার্থ অতি শীতল গলায় বলে,
“ এখন আমি গিয়ে তরীর সামনে দাঁড়াতে পারবো। “
চলবে…
যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৬.
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আইসিউ রুমটা বেশ নীরব এবং নিস্তব্ধ হয়ে আছে। এই নীরব রুমটাতেই বেডসাইড মনিটরের বিপ বিপ আওয়াজটা বেশ তীক্ষ্ণ ঠেকছে। শুভ্র বেডটার পাশে একটা টুলে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে আছে পার্থ। তার গায়ে নীল রঙের একটা এপ্রোন। মাথায় রয়েছে সার্জিক্যাল হেয়ার ক্যাপ। মুখের মাস্কটা অবশ্য নামিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে সে। এসব না পড়ে আইসিইউতে প্রবেশ করা যায় না। পাছে আবার পেশেন্টের কোনো ধরনের ইনফেকশন হয় কি-না!
স্ত্রী’র নিষ্প্রাণ মুখশ্রীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পার্থ। এই গভীর ঘুমের মেয়েটা কি এই মনিটরের তীক্ষ্ণ শব্দে বিরক্ত বোধ করছে না? এতো নিশ্চিন্তে কিভাবে ঘুমিয়ে আছে সে?
পার্থর দৃষ্টি তরীর মুখ থেকে নেমে তার পেটের দিকে স্থির হয়। তরীর বামহাতটা খুব সন্তর্পণে পেটের উপর রাখা। সেই হাতের তর্জনী আঙুলে লাগানো পালস অক্সিমিটারটায় স্পষ্ট হয়ে আছে দুটি সংখ্যা। ৭৪ এবং ৫০।
পার্থ নিজের মৃদু কম্পিত হাতটা বাড়িয়ে আলতো করে তরীর সেই হাত ছুঁয়ে দেয়। অত:পর বেশ কোমল ভঙ্গিতে নিজের হাতটা তরীর পেটের উপর রাখে। ঠিক এইখানটাতেই তার বাচ্চাটা ছিলো। এরকমটাও কখনো হয়? নিজের সন্তানের অস্তিত্ব সম্পর্কে জেনে কি কোনো বাবা এতটা ভেঙে পড়তে পারে? হয়তো পারে! পার্থ সেই হতভাগাদের একজন। ভেঙে পড়বেই না বা কেন? নিজের সন্তানের অস্তিত্ব অনুভব করার আগেই তার সন্তানের অস্তিত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে।
পার্থ পেটের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে কোমল স্বরে বলে,
“ বাবাকে ক্ষমা করে দিও। বাবা তোমার আর মা’র খেয়াল রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। “
কথাটুকু বলতে বলতে পার্থর চোখ জোড়া অশ্রুতে টইটুম্বুর হয়ে উঠে। সে আবার বলে উঠে,
“ পরপারে তোমার সাথে দেখা হবে বাবা। চিন্তা করো না। বাবা ঠিকই তোমাকে খুঁজে নিবো। তোমাকে কোলে তুলে অনেক আদরও করবো। কিন্তু তোমার মা কে এখন নিজের কাছে ডেকে নিও না। এতো বড় শাস্তি দিও না বাবাকে। “
পার্থ সাথে সাথে মাথা নত করে ফেলে। তার গলা ধরে আসছে। মনে হচ্ছে কেউ বুকের ভেতর বিষযুক্ত ছুড়ি চালিয়ে জখম করে দিচ্ছে। পার্থ এবার উঠে তরীর মাথার কাছটায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুটা ঝুঁকে তরীর কপালের ব্যান্ডেজ কাপড়ের উপরেই নিজের ঠোঁট জোড়া ছোঁয়ায়। এতটা আলতো ভাবে ছোঁয় যেন এতটুকু ছোঁয়াতেও তরী ব্যথা পাবে। কপাল থেকে মুখ সরিয়ে কানের কাছে এসে থামে পার্থ। নিজের তপ্ত নিঃশ্বাসটুকু ফেলে গভীর স্বরে শুধায়,
“ কোথাও যেতে দিচ্ছি না তোমাকে। “
__________
পুরো দেশে সকল টিভি চ্যানেলে খবর হয়ে গেলো পুলিশের সাথে ক্রস ফায়ারে রুবেল হোসেন নিহত হয়েছে। এরকম একটা নিউজ যেনো পুরো দেশে উত্তেজনামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেয়। মৃত্যুর একদিন পূর্বেই রুবেল হোসেন পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর বিপক্ষে ইলেকশন হেরেছে। সেদিন রাতেই আবার ঢাকার কোনো এক মহা সড়কে পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর স্ত্রীর এক্সিডেন্ট হলো। পুলিশ ইনভেস্টিগেশনে সেই এক্সিডেন্টের পিছনে দায়ীর নাম হিসেবে আসে রুবেল হোসেনের নাম। তার পর দিনই আবার পুলিশ ইনকাউন্টারে রুবেল হোসেনের মৃত্যু। সম্পূর্ণ ঘটনাটা আসলেই বেশ চাঞ্চল্যকর এবং উত্তেজনামূলকই বটে।
থানায় নিজের রুমে বসে ডগডগ করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নেয় শোভন। সারাদিন তার উপর দিয়ে বেশ ঝামেলা গিয়েছে। বিষয়টাকে কোনো মতে ক্রস ফায়ার বলে চালিয়ে দিতেও তার হাজার জায়গায় দৌঁড়াতে হয়েছে। দুপুর থেকে সে পার্থর উপর বেশ চটে ছিলো। একজন পুলিশের পকেট থেকে তার রিভলবার নিয়ে আসামীকে শুট করার দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে পার্থ বেশ সাবলীল ভঙ্গিতেই সেখান থেকে প্রস্থান করে। শোভন যে নিজের চাকরি সংকটে ফেলে অপরাধীকে জেলে না নিয়ে পার্থর কাছে নিয়ে এসেছে সেই ব্যাপারে যেনো কোনো কৃতজ্ঞতা বোধই নেই পার্থর। তখন থেকেই শোভন রাগে গিজগিজ করছিলো।
নিজের আপন ভাই দেখে কি সে পার্থকে যেতে দিবে নাকি? কাউকে সামনে না পেয়ে সেখানে উপস্থিত আসিফ ও শামীমের উপর বেশ রাগ ঝাড়ে সে। আসিফ ও শামীম সুরসুর করে সেখান থেকে প্রস্থান করে সোজা হসপিটাল চলে আসে পার্থর পিছুপিছু। শোভন কেমন ধরনের মানুষ তা তাদের বেশ ভালোই জানা আছে। এরকম একটা অবস্থায় তারা কোনো মতেই পার্থকে নতুন কোনো বিপদে পড়তে দিবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
শোভন যেন পার্থর বিরুদ্ধে কোনো লিগ্যাল একশন না নিতে পারে সেজন্য তারা সবথেকে বড় ট্রাম্প কার্ডের শরণাপন্ন হয়। মধুমিতাকে আড়ালে নিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা তারা খুলে বলে। সাথে এটাও বলে শোভন যেনো পার্থর বিপক্ষে কোনো একশন না নেয় সেই ব্যাপারে যেনো মধুমিতা শোভনকে বুঝায়। সবটা শুনে মধুমিতা অপেক্ষা না করে থানায় যায় শোভনের সাথে দেখা করতে।
শোভনকে বুঝানোর জন্য বাধ্য হয়ে মধুমিতা রাগ হয়ে বলে,
“ যদি আজকে ভাবীর জায়গায় আমি থাকতাম আর আমরা নিজেদের বাচ্চা হারাতাম তখন তুমি কি করতে? অপরাধীকে সামনে পেয়ে ছেড়ে দিতে? নিজের সন্তানের হত্যাকারীকে খুন করতে না? “
শোভন সাথে সাথে থমকে গিয়েছিলো। আর একটাও শব্দ উচ্চারণ করে নি। মধুমিতা যাওয়ার আগে বলেছিলো,
“ নিজেকে একবার দাদার জায়গায় রেখে সিচুয়েশনটা ভেবে দেখো। তুমি খুব ভালো একজন পুলিশ অফিসার। আমি সেজন্য তোমাকে যথেষ্ট রেসপেক্ট করি। কিন্তু এখন নিজের পুলিশের দায়িত্বটা একটু একপাশে রেখে ভাই হওয়ার দায়িত্বটুকু পালন করো। “
ব্যস! এইটুকু বলে যে মধু গিয়েছে সারাদিন আর একবারও কল করে নি। তবে মধুর কথায় বেশ কাজ হয়েছে। শোভন পার্থকে বাঁচিয়ে সম্পূর্ণ বিষয়টা ধামাচাপা দিয়ে দেয়। নিজেকে পার্থর জায়গায় এবং মধুকে তরীর জায়গায় কল্পনা করতেও তার গা শিউরে উঠে। তার দাদার জায়গায় সে হলেও এই একই কাজ করতো। হয়ত আরও বেশি কিছু করতো।
শোভনের ভাবনার মাঝেই একজন পুলিশ এসে তার রুমের দরজায় নক করে। শোভন অনুমতি দিতেই তিনি ভিতরে প্রবেশ করে। কাচুমাচু করে প্রশ্ন করে,
“ স্যার, ওই মিসিং এইট কেসটা আপনি আসলেই ক্লোজ করতে চাচ্ছেন? “
শোভন ক্লান্ত গলায় বলে,
“ হ্যাঁ। “
শোভনের রুমে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের পোশাক পরিধেয় লোকটার যেনো এই কথাটা বিশ্বাস হয় না। শোভন স্যার যেভাবে হাত ধুয়ে এই কেসের পিছনে পড়েছিলো সবাই ভেবেছিলো শোভন নিশ্চয়ই এই রহস্যের জোট খুলবে। অথচ হঠাৎ করেই কথা নেই বার্তা নেই শোভন স্যার আদেশ দিলো সকল ইনভেস্টিগেশন থামিয়ে এই কেস ক্লোজ করে দিতে। বড় অদ্ভুত ঘটনা!
__________
তূর্য সবেমাত্র হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। পাপাকে হাজার বার বলেছে বাসায় এসে রেস্ট করতে। কিন্তু হুমায়ুন সাহেব মেয়েকে হসপিটালে রেখে বাসায় ফিরতে নারাজ। হসপিটালে এখন কেবল পার্থ এবং হুমায়ুন রশীদই উপস্থিত আছে। বাকি সকলকে হুমায়ুন রশীদ বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।
কলিংবেল বাজিয়ে দরজার সামনে অপেক্ষা করছিলো তূর্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে যায়। সাদিকা বেগমকে দেখে তূর্য ক্লান্ত স্বরে সালাম জানায়। সাদিকা বেগম নরম স্বরে প্রশ্ন করে,
“ তরীর কি অবস্থা বাবা? জ্ঞান ফিরেছে? “
যদিও সাদিকা বেগম সারাদিন একটু পরপর হসপিটালে কল করে খোঁজ নিয়েছেন তরীর তবুও এখন ভালো কোনো উত্তরের আশায় নিজেকে প্রশ্ন করা থেকে সংবরণ করতে পারেন না। কিন্তু তূর্য উনার আশায় পানি ঢেলে জবাব দেয়,
“ না আম্মা। “
সাদিকা বেগম বেশ আশাহত হয়। মেয়েকে সামলানোর জন্য উনি চাইলেও মন খুলে তরী কিংবা তার সন্তানের জন্য একটু কাদতেও পারেন নি সারাদিন। আহারে! না জানি মেয়েটা কতটা কষ্টে আছেন। সাদিকা বেগমের চিন্তার মধ্যেই তূর্য নিজের হাতের টিফিন ক্যারির ব্যাগটা সাদিকা বেগমের হাতে তুলে দিয়ে প্রশ্ন করে,
“ পৃথা খেয়েছে আম্মা? “
“ হ্যাঁ। সারাদিন তরীর জন্য কান্নাকাটি করেছে। এরকম অবস্থায় এভাবে কান্নাকাটি করলে চলে বলো? কতবার বুঝালাম যে কান্না না করে ভাবীর জন্য দোয়া করতে। কিন্তু ও আমার কথা কানে তুললে তো। “
তূর্য আর কোনো কথা না বলে উপরের দিকে চলে যায়। সাদিকা বেগম টিফিন ক্যারির বক্স গুলো খুলে দেখে। যাক! অন্তত সবাই একটু খাবার তো মুখে তুলেছে। এই অবস্থায় বাসা থেকে সাদিকা বেগম যতটুকু সম্ভব হচ্ছে সাপোর্ট দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এতে তার মন ভরছে না। কাল একবার মধুকে পৃথার কাছে রেখে নিজে হসপিটালে গিয়ে তরীকে কাছ থেকে না দেখলে উনার মন শান্ত হবে না।
রুমে প্রবেশ করতেই তূর্য দেখে পৃথা দরজার দিকে পিঠ করে একপাশ ফিরে শুয়ে আছে। তূর্য চুপচাপ নিজের টাওয়াল আর টিশার্ট ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। সারাদিন হসপিটালে ছিলো। কত ধরনের জীবাণু শরীরে লেগে আছে হয়তো। এই অবস্থায় পৃথার কাছে কখনোই যাবে না সে। তাই ভালো করে একটা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে সে।
পৃথা তখনো অপরদিকে ফিরে শুয়ে ছিলো। তূর্য নীরবে বিছানায় উঠে পৃথার পিছনে হেলান দিয়ে বসে। নরম সুরে ডাকে,
“ পৃথা? “
পৃথা জেগেই ছিলো। তূর্যের কণ্ঠ শুনতেই তার খানিকের বিরতি পাওয়া কান্নাটা আবার ফিরে আসে। সে সাথে সাথে পিছনে ফিরে তূর্যকে জাপ্টে ধরে কেঁদে দেয়। তূর্য একইভাবে নরম গলায় বলে,
“ এরকম করে না সোনা। বেবি কিন্তু কষ্ট পাচ্ছে। “
পৃথা হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“ ভাবী ঠিক হয়ে যাবে তো? আমার দাদা আর ভাবীর জন্য অনেক কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চাটার কথা ভাবতেই আমার অনেক কান্না পাচ্ছে তূর্য। “
খারাপ তূর্যরও লাগছে। কিন্তু তা প্রকাশ করার সাধ্যি তার নেই। সে ভেঙে পড়লে সবাইকে সামলাবে কে এই পরিস্থিতিতে? তূর্য বলে,
“ দোয়া করো পৃথা। আমার আপি সুস্থ হয়ে গেলেই সব আগের মতো হয়ে যাবে আবার। “
পৃথার কান্নার দমক কিছুটা কমে আসে। সারাদিনে তার মনে এক ধরনের ভয় সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। তূর্য পৃথাকে টেনে বুকে আগলে নেয়। সাথে সাথে পৃথার বুকের ভয়টা কিছু শব্দের আকারে প্রকাশ পায়।
“ আমাদের বেবিকে ঠিকঠাক ভাবে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারবো তো তূর্য? “
তূর্য পৃথাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে,
“ হুশ। এসব বলতে হয়না। ইনশাআল্লাহ বেবি ঠিকঠাক ভাবেই আসবে আমাদের কোলে। “
পৃথা মুখটা আরেকটু ছোট করে বলে,
“ আমি শুনেছি ডেলিভারির টাইমে অনেকসময় বেবি কিংবা মা যেকোনো একজনকে চুজ করতে হয়। এরকম সিচুয়েশ যদি কখনো আসে আপনি প্লিজ আমাদের বেবিকে চুজ করবেন। আমি মানসিকভাবে এতো শক্ত নই। আমি ভাবীর মতো এরকম কষ্ট ফেস করতে চাই না। “
তূর্যর কোমল কণ্ঠস্বর মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়। সে জোরে পৃথাকে একটা ধমক দিয়ে বলে,
“ এরকম ফালতু কথাবার্তা আমার সামনে আর কখনো বললে একদম কানের নিচে একটা দিবো। “
পৃথা সাথে সাথে চুপ হয়ে যায়। তূর্যের ধমক শুনে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছে সে। তূর্য কণ্ঠে কাঠিন্য বজায় রেখেই আবার বলে উঠে,
“ চুপচাপ ঘুমাও। তোমার এসব অহেতুক চিন্তার কারণে আমার বেবির কোনো ক্ষতি হলে তোমাকে মাথায় তুলে একটা আছাড় মারবো। “
তূর্যের এরকম কঠিন কঠিন কথা শুনে অষ্টাদশীর মন অভিমানে ভরে উঠে। সে সাথে সাথে তূর্যের বুক থেকে দূরে সরে যেতে চাইলে তূর্য আরো দৃঢ়ভাবে তাকে জড়িয়ে রেখে গম্ভীর স্বরে শুধায়,
“ সমস্যা কি? “
পৃথা আর সরে যাওয়ার চেষ্টা করে না। কোনো জবাবও দেয় না। অভিমানী অষ্টাদশী মনে অভিমান জমিয়ে রেখেই চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ে।
__________
কালো চাঁদরে মোড়ানো আকাশ থেকে থেকে শব্দ তুলে বজ্রপাতের জানান দিচ্ছে। সম্পূর্ণ চৌধুরী নিবাস আজ বেশ নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধ পার্থ এবং তরীর ব্যক্তিগত রুমটাও। যেই রুমটায় এখন আনন্দের গুঞ্জন ভেসে বেড়ানোর কথা ছিলো, ভাগ্যের জোরে সেই রুমটা এখন ছেয়ে আছে আঁধারে জোড়ানো শোকের সাগরে।
সেই আধারে তলিয়ে থাকা রুমটায় ধীর পায়ে প্রবেশ করে পার্থ। সিটিং এরিয়ার দরজাটা নীরবে লক করে এগিয়ে যায় বেডরুমের দিকে। বেডরুমের দরজা দিয়ে রুমে প্রবেশ করেই সে আগে হাত বাড়িয়ে সুইচ বোর্ড হতে একটা সুইচ অন করে দেয়। মুহুর্তেই অন্ধকার রুমটা আলোর ছোঁয়া পায়। বেডরুমের দরজাটাও ভেতর থেকে লক করে সামনে এগোতে নিলেই পার্থর চোখ স্থির হয়ে বিছানার এককোণে। দু চারটে জিপলক ব্যাগ সেখানে রাখা আছে।
জিপলক ব্যাগ গুলোকে দূর থেকে দেখতেই পার্থর বুক দুমড়ে মুচড়ে যায়। ধীর পায়ে সে এগিয়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে একটা জিপলক ব্যাগ তুলে নেয়। ব্যাগের ভেতর রয়েছে তরীর রক্তাক্ত গোলাপি রঙের কামিজটা। সেটা খুলে দেখার আর সাহস হয় না তার। পার্থ সেই ব্যাগটা রেখে অন্য একটা ব্যাগ হাতে তুলে নেয়। এটার ভেতর তরীর ভাঙা ফোনটা আর একটা মেডিক্যাল ফাইল। জিপলকের মুখটা খুলে ভিতর থেকে কেবল মেডিক্যাল ফাইলটা বের করে হাতে নেয় পার্থ। ফাইলটা খুলতেই তার চোখ গিয়ে আটকায় আল্ট্রাসাউন্ডের সেই ছোট্ট চিত্রটায়।
এই নিস্তব্ধ রুমে এখন পার্থ ব্যতীত আর কেউ নেই। চাইলেও প্রবেশ করতে পারবে না। তাই পার্থর রক্তাক্ত রঙ ধারণ করা চোখ জোড়া ঠিকরে অশ্রু বেরিয়ে আসতেও এখন কোনো বাঁধা নেই। পার্থ আলতো করে আল্ট্রাসাউন্ডের ছবিটাতে একটা চুমু খায়। সাথে সাথে তার চোখ বেয়ে টলটল করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
পার্থ সন্তর্পণে ফাইলটাকে আলমারির নিজের তাকে যত্নের সাথে তুলে রাখে। অত:পর ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দু হাত দিয়ে দেয়ালে ঠেক দিয়ে নীরব ভঙ্গিতে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রয়। শাওয়ারের পানিতে তার গায়ের পাঞ্জাবিটা ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে যায়। পার্থ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না।
আচমকা সে অনুভব করে তার বুকের দু পাশে এক জোড়া হাত ধীরে ধীরে তাকে আঁকড়ে ধরছে। পার্থ চোখ বুজে থাকা অবস্থায়ই সেই ছোঁয়াটুকু অনুভব করে। পার্থর পিঠে একটা মাথা এসে ঠেকতেই পার্থ অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে বলে উঠে,
“ মাফ করে দাও জান। “
পিছন থেকে একটা শান্ত নারী কণ্ঠ ভেসে আসে,
“ তোমার তো দোষ নেই। তুমি কেন মাফ চাইছো? “
পার্থ অশ্রু মিশ্রিত গলায় বলে,
“ সব দোষ আমার। আমার শত্রুতার দাম তোমাকে দিতে হচ্ছে। আমার শত্রুতায় আমাদের সন্তান বলিদান হয়েছে। মাফ করে দাও আমাকে। কোনো কথা রাখতে পারি নি আমি। “
কথাটুকু বলতে বলতে পার্থ হিংস্র হয়ে চোখ মেলে তাকায়। বাথরুমের একপাশে থাকা কাচের আয়নার দিকে এগিয়ে গিয়ে উন্মাদের ন্যায় একহাতে সেই আয়নায় এলোপাথাড়ি ঘুষি দিতে শুরু করে। ততক্ষণ থামে না যতক্ষণ না নিজের হাত সম্পূর্ণ ক্ষত বিক্ষত হয়ে আসে।
দেয়াল জুড়ে বিশাল আয়নাটার একটা অংশও যখন আর চূর্ণ বিচূর্ণ হতে অবশিষ্ট থাকে না তখন পার্থ ধপ করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে। বুকের উথাল-পাথাল ঝড় তীব্র আর্তনাদ ও অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসে। সর্বদা ঠান্ডা মস্তিষ্ক নিয়ে চলা পার্থর এই বিধ্বস্ত রূপ দেখলে যে কেউই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যেতো। কিন্তু তার এই কান্না বা চিৎকার দেখার জন্য কেউ নেই।
ব্যস্ত ঢাকা শহরের দু কোণে দুই পিতা এভাবেই অশ্রু বিসর্জন দিয়ে পাড় করে দেয় একটা নির্ঘুম রাত। একজন পিতা যখন নিজের সন্তানের সংকটাপন্ন জীবনের জন্য সুস্থতা কামনা করে নীরবে অশ্রু ফেলতে ব্যস্ত তখন অন্য এক পিতা নিজের অনাগত সন্তানকে হারিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে ব্যস্ত। দুজনের ব্যথা দুই ধরনের হওয়া সত্ত্বেও যেনো একই সূত্রে গাঁথা।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]