যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৩.
সকাল সকাল সাদিকা বেগমের অদ্ভুত আবদার শুনে খাবার গলায় আটকে তূর্যের কাশি উঠে যায়। সাথে সাথে পৃথা তার দিকে একটা পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। খাবার টেবিলে উপস্থিত আফজাল সাহেব কিছুটা রাগী সুরে বলে উঠে,
“ আহ পার্থর আম্মা। খাওয়ার মাঝখানে ছেলেটাকে বিরক্ত করছো কেন? “
সাদিকা বেগম কিছুটা চিন্তিত গলায় বলে,
“ আমি তো ভেবে চিন্তেই এই কথা বলছি। ভাইসাব আর তূর্য বাবা তো সারাদিন বাইরেই থাকে। এই অবস্থায় পৃথার একা থাকাটা ঠিক হবে? একা ঘরে যদি আল্লাহ না করুক মেয়েটার কিছু হয়ে যায়? এইখানে থাকলে তো সারাক্ষণ কেউ না কেউ ওর সাথে থাকবে। চিন্তা কিছুটা কম হবে। “
কথাটুকু বলেই সাদিকা বেগম তরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ আম্মু তুমি তো ডাক্তার। ভালো বুঝো। তুমি বলো আমি ঠিক বলসি না? “
তরী আড়চোখে খাবার টেবিলে বসে থাকা নিজের ভাই এবং ননদের দিকে তাকায়। দুজনের চেহারাই চুপসে যাওয়া বেলুনের ন্যায় দেখাচ্ছে। তরী কিছু বলবে তার আগেই পৃথা বলে উঠে,
“ আমার ওই বাসায় কোনো সমস্যা হবে না আম্মা। “
স্ত্রীর কথা শুনে এবার তূর্য সাহস পায়। এতক্ষণ সে এটা ভেবেই চুপ ছিলো যে পৃথা যদি থাকতে চায়। কিন্তু যেহেতু পৃথা নিজেই থাকতে চাইছে না তাই তূর্য সাহস করে বলে,
“ আমি পৃথার সম্পূর্ণ খেয়াল রাখবো আম্মা। ওর কোনো অসুবিধা হবে না। “
সাদিকা বেগম সন্তুষ্ট হয় না এই কথায়। পার্থ, শোভন ও মধুমিতা খাবার টেবিলে আপাতত নীরব ভূমিকা পালন করছে। এটা সত্য যে তূর্য লাইফের এই ইম্পোরট্যান্ট সময়টা পৃথাকে ছাড়া কাটাতে চায় না। কিন্তু সাদিকা বেগমের চিন্তাটাও যে অযথা নয় তা-ও সে ভালো করে জানে। কারণ কাজের কারণে তার আর হুমায়ুন রশীদের সারাদিন বাহিরে থাকতে হয়। দিনের এই সময়টুকু পৃৃথাকে অন্য কারো ভরসায় রেখে গিয়েও সে শান্তি পাবে না। তাই কিছুটা বিনয়ের সুরে সে আবদার করে,
“ আম্মা, আপনার কোনো সমস্যা না থাকলে আপনি আমাদের সাথে চলুন। “
সাদিকা বেগম প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকায়। আফজাল সাহেব বলেন,
“ মেয়ের কাছে থাকাটা এখন তোমার বেশি জরুরি পার্থর আম্মা। সংসার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। দুইজন বউমা ঘরে আছে এখন। তারা ঠিকই মিলেমিশে সংসার সামলাতে পারবে। ভুল বলেছি আম্মাজানেরা? “
শেষের প্রশ্নটা ছেলের বউদের দিকে তাকিয়ে করেন আফজাল সাহেব। তরী এবং মধুমিতা একই সাথে বলে উঠে,
“ আমরা পারবো আব্বা। “
অত:পর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি বিনিময় করে। সাদিকা বেগম যেনো এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হন। তূর্য এবং পৃথাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এতক্ষণ একে অপরের থেকে দূরে থাকার কথা ভেবেই তাদের নিঃশ্বাস আটকে ছিলো।
__________
ক্যালেন্ডারে কাটা পড়লো আরও একটা মাস। গ্রীষ্মের তপ্ততা পেরিয়ে প্রকৃতি বরণ করে নিয়েছে বর্ষার মৃদু উগ্রতাকে। সময় ঘনিয়ে এসেছে নির্বাচনের। আজ বাদে কালকেই হবে জাতীয় নির্বাচন। এই একমাস পার্থ একপ্রকার দৌড়ের উপর ছিলো। ব্যস্ত ছিলো শোভনও। চৌধুরী নিবাসের দুই পুত্রবধূও যেনো শাশুড়ির অনুপস্থিতিতে সংসারের হাল আরো শক্ত হাতে আগলে ধরেছে।
সকাল থেকেই গা গুলিয়ে বারবার বমি পাচ্ছে তরীর। বিরক্ত হয়ে সে হসপিটালে কল করে একটা দিনের জন্য লিভ নেয়। সকালে মুখে দেওয়া সামান্য নাস্তাটুকুও বেশিক্ষণ পেটে টিকে নি। ক্লান্ত চিত্তে সে বিছানায় শুয়ে আছে। তখনই রুমের দরজায় নকের শব্দ হয়। তরী চোখ মেলে প্রশ্ন করে,
“ কে? “
“ আমি ভাবী। “
মধুমিতার গলা শুনেই তরী দূর্বল শরীর নিয়ে উঠে বসে বলে,
“ এসো মধুমিতা। “
মধুমিতা হাসিমুখে রুমে প্রবেশ করে বিছানার একপাশে বসে। অত:পর তরীর চেহারা দেখে প্রশ্ন করে,
“ অসুস্থ লাগছে ভাবী? “
“ আর বলো না। সকাল থেকে বমি হচ্ছে শুধু। শরীর একদম ছেড়ে দিয়েছে। “
মধুমিতা চিন্তিত গলায় বলে,
“ তুমিতো বাহিরের কিছুও খাও নি। তাহলে এমন হচ্ছে কেনো? “
“ কি জানি। “
মধুমিতা কিছুক্ষণ চুপচাপ কিছু একটা ভাবে। অত:পর উল্লাস নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ এনি গুড নিউজ ভাবী? “
মধুমিতার প্রশ্ন শুনে তরীর দূর্বল মস্তিষ্ক মুহুর্তেই দপ করে জ্বলে উঠে। সে এক দন্ড মধুমিতার দিকে তাকিয়ে থেকে তড়িৎ গতিতে নিজের ফোনটা হাতে নেয়। ক্যালেন্ডার চেক করে কিছু একটা হিসাব করতেই তারও সন্দেহ হয়। অত:পর মধুমিতার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ আমি শিওর না। “
মধুমিতা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলে,
“ দাদা জানে ভাবী আপনি যে অসুস্থ? “
“ এই না। একদমই না। ও এখন এভাবেই এতো টেনশন মাথায় নিয়ে ঘুরছে। আগে নিজে শিওর হই তারপর ওকে জানাবো আমি। “
“ তাহলে ভাবী আজকে চলুন হসপিটাল যাই। “
“ আজ না মধুমিতা। আজ হসপিটাল থেকে লিভ নিয়েছি। বাসায় একটু রেস্ট করি। কাল একেবারে হসপিটাল গিয়ে ডক্টর দেখিয়ে নিবো। “
মধুমিতা খুশি খুশি মুখ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“ আপনি রেস্ট করুন ভাবী। আমি লেবুর শরবত করে নিয়ে আসছি। খেলে বমি বমি ভাবটা কম লাগবে। “
“ শুধু শুধু কষ্ট করো না। “
“ ভাবী, আমার জ্বর আসার পর আপনি কি আমার খেয়াল রাখেন নি? আমাকেও সুযোগ দিন। “
তরী হেসে বলে,
“ আচ্ছা যাও। কিন্তু চিনি কম দিও। “
“ ওকে। “
বলে মধুমিতা বেরিয়ে যায়। তরী ক্লান্ত শরীরের মধ্যে সম্ভাব্য আশংকা যেনো কিছুটা শীতলতা এনে দিয়েছে। কাল পর্যন্ত তো সে ফুপ্পি হওয়ার আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছিলো। কিন্তু নিজে মা হওয়ার সম্ভাবনা ভাবতেই তার অন্যরকম অনূভুতি হচ্ছে। আগামীকালটা আসতে আর কতো দেরি? কখন সে নিজে নিশ্চিত হতে পারবে? তার ধারণা যদি সত্যি হয় তাহলে পার্থকে কিভাবে জানাবে সে? এসব ভাবতে ভাবতেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।
__________
নির্বাচনের আগের দিনের প্রস্তুতির পাট চুকিয়ে সবেমাত্র পার্টি অফিসে পা রেখেছে পার্থ। তখনই তার ফোনটা একটা কল আসে। কলটা রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে কিছু কথা ভেসে আসে। পার্থ জবাবে কেবল আসছি বলে রেখে দেয়। আসিফ তার সাথেই ছিলো। সে বলে উঠে,
“ ভাই আমিও আসি? “
“ না। তুই এদিকটা সামলা। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বো। “
কথাটুকু বলেই পার্থ ব্যস্ত পায়ে আবার বেরিয়ে যায়। সম্পূর্ণ রাস্তায় বেশ নিশ্চিন্তে ড্রাইভ করে সে পৌঁছে যায় একটা নিরিবিলি সুনসান জায়গায়। গাড়িটা রাস্তার একপাশে থামিয়ে নামতেই তার মুখোমুখি হয় একজন পুরুষ। পার্থকে দেখেই সে হেসে বলে উঠে,
“ কালকের দিনটার শুধু অপেক্ষা এখন। তারপর আপনিই হবেন এই আসনের নতুন এমপি। “
পার্থ হেসে বলে,
“ তোমার সাহায্যর জন্যই গত এক মাসে রুবেল হোসেইনের সকল ফাঁদ এড়িয়ে গিয়ে আজ এইখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। সেজন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সুজন। সেদিন সমাবেশেও তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছিলে। আল্লাহ তোমার উছিলায় সেদিন আমাকে এতো বড় একটা বিপদ থেকে রক্ষা করলো। “
সুজন হেসে শুধায়,
“ ওর মতো কুলাঙ্গারের উপর আমি থুথু মারি ভাই। হালায় পুরাডা জীবন আমারে দিয়া কামলা খাডাইসে আবার জনসম্মুখে অপমানও করসে। সবসময় মাইনসের ক্ষতি করার ধান্দায় থাকতো। এমন কুলাঙ্গারের রাজনীতি ছাইড়া আমার কোনো আফসোস নাই। “
কথাটুকু বলে সুজন আবার বলে উঠে,
“ জনগণ আপনার মতো একজন নেতা ডিজার্ভ করে ভাই। রুবেলের মতো কুলাঙ্গাররা ক্ষমতা পাইলে খালি নিজের পকেটই ভারী করা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জনগণের দিকে ফিরে তাকানোর সময় নাই। “
পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“ কালকের নির্বাচনের রেজাল্টের উপর অনেক কিছু ডিপেন্ড করছে সুজন। লেট’স প্রে যেনো রুবেল আর কোনো ব্লেন্ডার করার সুযোগ না পায়। “
“ আপনি চিন্তা করবেন না ভাই। আমার নজর আছে ওর উপর চব্বিশ ঘণ্টা। উল্টাপাল্টা কিছু মনে হইলেই আপনাকে কল দিয়ে জানায় দিবো। “
দূরে আড়াল হতে এক জোড়া চোখ এই দৃশ্যটার সাক্ষী হয় খুব সন্তর্পণে। তার মুখে ফুটে উঠে হিংস্রতার ছাপ। অস্ফুটে একটা বিশ্রী গালি দেয় সে।
__________
এবার মেডিকেলে চান্স হওয়া সত্ত্বেও পৃথা আর ভর্তি হয়নি। তার দুই পরিবারের মানুষের সিদ্ধান্তই এটা। কিছুদিন পর তার শরীর ভারী হয়ে আসবে। তার উপর রয়েছে শারীরিক দূর্বলতা। এরকম একটা অবস্থায় তার এতটা প্রেশার নেওয়ার পক্ষে কেউই নেই। আল্লাহ চাইলে নেক্সট ইয়ার নাহয় সে আরেকবার ট্রাই করবে। ততদিনে তার বেবিও পৃথিবীতে এসে পড়বে।
আজকাল পৃথার জেদ যেনো কয়েকগুণ বেড়েছে। খাবার নিয়ে প্রচুর অনিহা দেখানো পৃথা হুটহাট মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বলে তার খিদে পেয়েছে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। মধ্যরাতে আচমকা পৃথার ডাকে তূর্যের ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসতেই পৃথা বলে,
“ ঘুম আসছে না আমার। “
তূর্যের ঘুম ততক্ষণে পুরোপুরি উবে গিয়েছে। সে প্রশ্ন করে,
“ খিদে পেয়েছে? “
সাথে সাথে পৃথার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সে আদুরে মুখে তাকিয়ে থেকে বলে,
“ কাবাব খেতে ইচ্ছে করছে। “
তূর্য সাথে সাথে ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরে চলে যায়। সে পৃথার জন্য বেশ কিছু কাবাব আর চিকেন নাগেটস বানিয়ে ফ্রোজেন করে রেখেছিলো। যাতে যখনই খেতে ইচ্ছে করবে তখনই যেন সাথে সাথে ভেজে দিতে পারে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তূর্য একটা প্লেটে কিছু কাবাব আর একটা পানির গ্লাস নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। পৃথার সামনে সেই প্লেট এবং গ্লাস রেখে বসতেই পৃথা খেতে ব্যস্ত হয়ে পরে। আচমকা তার খেয়াল হয় তূর্যের দিকে। তূর্য বসে বসে ঘুমে ঢুলছে। সাথে সাথে পৃথার খুব মায়া লাগে। মানুষটা সারাদিন অফিস করে এসে আবার বাসায় তার দিকে খেয়াল রাখে। রাতে যেই কয়েক ঘন্টা একটু ঘুমানোর সুযোগ পায় সেটাও পৃথার কারণে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারে না।
এই কথাটুকু মনে পড়তেই পৃথার খারাপ লাগে। অপরাধবোধও কাজ করে। আবেগপ্রবণ হয়ে সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। সাথে সাথে তূর্যের তন্দ্রাভাব কেটে যায়। সে হুড়মুড়িয়ে নিজের পাশে বসে থাকা পৃথার দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় শুধায়,
“ এই পৃথা? কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? পাপাকে ডাকবো? আম্মাকে আসতে বলবো? “
কথাটুকু বলতে বলতেই তূর্য উঠে যেতে নেয় রুম থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে। সাথে সাথে পৃথা তার হাত টেনে ধরে। তূর্য আর এগোয় না। পৃথার পাশে বসে চিন্তিত গলায় এটা সেটা প্রশ্ন করতে থাকে। পৃথা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“ আ’ম সরি তূর্য। আমি আপনাকে অনেক বিরক্ত করছি না? আমার কারণে আপনি ঠিকঠাক ঘুমোতে পারেন না। “
পৃথা কি কারণে কান্না করছে বুঝতে পেরেই তূর্য কিছুটা শান্ত হয়। তার চেহারা থেকে চিন্তা ভাবটা উড়ে গিয়ে হাসি ফুটে উঠে। সে পৃথার চোখ মুছে দিয়ে বলে,
“ তুমি যে আমার বাচ্চার জন্য এতো শারীরিক কষ্ট সহ্য করছো তার একভাগও তো আমার সহ্য করতে হচ্ছে না। অন্তত এইটুকুর ভাগীদার আমাকে হতে দাও। “
এইটুকু বলেই তূর্য আবার হেসে বলে উঠে,
“ আর তাছাড়াও তূর্য ইজ নাও টুয়েন্টি ফর আওয়ারস এভেইলেবেল ফর হিজ বোথ বেবিস। “
পৃথার কান্না থেমে যায়। সে নিজের চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,
“ বোথ বেবিস? দুটো বেবি কই পেলেন? “
তূর্য নিজের একটা আঙুল দ্বারা পৃথার পেটের দিকে ইশারা করে বলে,
“ একজন হচ্ছে এই বেবি। “
অত:পর আবার তার আঙুল দ্বারা পৃথার দিকে ইশারা করে বলে,
“ আরেকজন হচ্ছে এই বেবি। “
তূর্যের কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরেই পৃথা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। তূর্য মুগ্ধ চোখে সেই লজ্জা ভরা দৃষ্টি দেখতে দেখতে মনে মনে ভাবে ভাগ্যিস সে কখনো কোনো প্রেম করে নি। তাইতো নিজের সকল অনুভূতি এই মানবীর জন্য উজাড় করে দিতে পারছে আজ।
__________
রাতের আধারে অনেকটা চোরের মতোই ঘরের থেকে বেরিয়ে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে যায় শোভন। কিছুক্ষণ আগে পাওয়া ফোনকলটা রিসিভ করার পর থেকেই উত্তেজনায় তার হাত পা কাপছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে কল করা ব্যক্তিটার সাক্ষাৎ পাওয়া গেলো। লম্বা চওড়া সেই পুরুষের প্রথম দর্শনেই শোভন লোকটার কঠোর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আন্দাজ করে ফেললো। লোকটার বয়স হয়তো আনুমানিক ২৬ কিংবা ২৭। শোভন হাত বাড়িয়ে দিতেই লোকটা বেশ সু কৌশলে তার সাথে হাত মিলিয়ে কুশল বিনিময় করলো। অত:পর নিজের গভীর গলায় বলে উঠে,
“ আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরী। “
“ সৌভাগ্য তো আমার যে আপনার সাথে দেখা করার সুযোগ পেলাম। “
“ দেশের স্বার্থে আজ আমাদের এই সাক্ষাৎ অফিসার শোভন। আপনার মতো নিঃস্বার্থে দেশকে ভালোবাসা একজন দেশপ্রেমিকের সাহায্যের প্রয়োজন আমার। “
“ অবশ্যই বলুন। কিভাবে সাহায্য করতে পারি? “
“ আপনার মিসিং এইট নামক কেসটা নিয়ে কথা বলতে এসেছি আমি। “
শোভন অবাক হয়। এই আটটা মিসিং কেস এবং সেই ম্যানহোলে পাওয়া লাশের কেস নিয়ে সবাই যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছে তখন শোভন এগুলোর মধ্যে কানেকশন খুঁজে বের করে আলাদা এক কেসের নাম দেয় এটাকে। কিন্তু তা খুব গোপনে। সেই খবর এই ভদ্রলোক পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছে গেলো? অবশ্য এই ভদ্রলোকের প্রফেশন অনুযায়ী এই খবর জানা তার জন্য কোনো অসম্ভব বিষয় নয়।
শোভন আগ্রহী স্বর মিশিয়ে প্রশ্ন করে,
“ এই কেসের প্রতি আপনি আগ্রহের কারণ কি জানতে পারি আমি? কারণ এই পর্যন্ত এই কেস নিয়ে আমি আমার উপরমহলের অনেকের কাছে গিয়েছি। কিন্তু উনারা কেউ এই কেসের ইনভেস্টিগেশনের প্রতি আগ্রহী না। “
লোকটা নিঃশব্দে মেপে মৃদু হাসে। যেনো এর থেকে বেশি হাসি তার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না। অত:পর বলে উঠে,
“ আপনি যে কেসগুলোর মধ্যে কানেকশন খুঁজে বের করেছেন সেটা জেনেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি বেশ বিচক্ষণ। যা আর কারো চোখে ধরা পড়ে নি তা আপনার দৃষ্টি এড়াতে পারে নি। তাই আপনাকে আমি বেশ স্বল্প শব্দে কিছু কথা বলবো। আশা করছি সেই কথাগুলো শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন এই কেসের প্রতি আমার আগ্রহের কারণ। “
শোভন আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রয়। লোকটা আপন ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“ এই কেসের মিসিং ছেলেগুলো সব প্রাইভেট ভার্সিটির স্টুডেন্ট। ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাটাস সবার বেশ ভালো পর্যায়ের। সবাই ব্যক্তিগত জীবনে সম্পূর্ণ নির্ভেজাল টাইপ মানুষ। এই ধরনের ছেলেগুলো হুট করে উধাও হয়ে যাওয়ার মানে বুঝতে পারছেন আপনি? কোন ধরনের চক্রের এর পিছনে হাত থাকতে পারে আপনি আন্দাজ করতে পারছেন? “
শোভন এক দন্ড খুব মনযোগ নিয়ে কথাটুকু শুনে। আচমকাই তার মস্তিষ্কে গেঁথে থাকা সকল রহস্যের জট খুলে যায়। বিস্ফোরিত গলায় প্রশ্ন করে,
“ আর ইউ শিওর? “
“ শিওর না হলে আমি এই মুহুর্তে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। এই কেসটা খুব কনফিডেন্সিয়াল অফিসার শোভন। এন্ড উই মাস্ট কিপ এভ্রিথিং রিলেটেড টু দিজ কনফিডেন্সিয়াল। “
শোভন আর সেই আগুন্তকঃ ভদ্রলোকের কথাপোকথন দীর্ঘস্থায়ী হয় আরো বেশ কিছুক্ষণ। কথা শেষে বিদায় বেলায় সেই আগুন্তকঃ শোভনের সাথে হাত মিলাতেই শোভন বলে উঠে,
“ খুব বড় একটা কেসের পিছনে পড়েছেন আপনি। সামলে চলবেন। আশা করছি দ্রুতই এই কেসের মূল কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন। সেই চক্র এদেশের জন্য আতঙ্কে রূপ নেওয়ার আগে আপনি যেনো তাদের আতঙ্কের কারণ হতে পারেন। “
“ মে আওয়ার কান্ট্রি লিভ লং। “
কথাটুকু বলেই সেই লোকটা প্রস্থান করে। শোভন মুগ্ধ চোখে সেই লোকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। দেশের প্রতি এই মানুষটার ভক্তি দেখেই সে মূলত এতো মুগ্ধ। এই মানুষটার সাথে তার আর কখনো দেখা হবে নাকি তা নিয়ে সে নিশ্চিত নয়। কিন্তু এই মানুষটা যেনো তার উদ্দেশ্যে সফল হয় সেই দোয়া সে সবসময় করবে।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]
যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৪.
সারাদিনের ক্লান্তি গায়ে মেখে পার্থ যখন বাসায় ফিরে তখন প্রায় মধ্যরাত। ব্যস্ততার টানাপোড়েনে আজ সারাদিন তরীকে কলও করা হয় নি তার এক মুহুর্তের জন্য। ডাক্তার নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে? এসব ব্যাপারে তো মহারাণী খুব পাংচুয়াল। পার্থ নীরবে বাড়িতে প্রবেশ করতেই তার চোখ আটকে যায় ডাইনিং টেবিলের দিকে। সারাদিনের ক্লান্তি মুহুর্তেই প্রশান্তিতে বদলে যায়।
সে ছোট ছোট কদম ফেলে ধীর গতিতে টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। অত:পর নিঃশব্দে একটা চেয়ার টেনে সে বসে পড়ে। তার সামনে বরাবর চেয়ারেই তরী বসে আছে। টেবিলের উপর রাখা তার একহাতের উপর মাথা এলিয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আরেকহাত সোজা করে টেবিলের উপর রাখা। পার্থ নিষ্পলক সেই ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টেবিলের একপাশে রাখা খাবার প্লেট এবং গ্লাস দেখে পার্থ নিশ্চিত হয় যে তার স্ত্রী তার ফেরার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাজনীতির উছিলায় বিয়ের আগেও অনেক সময়ই পার্থর রাতে বাড়ি ফিরতে দেরি হতো। সাদিকা বেগম প্রথম প্রথম রাত জেগে ছেলের জন্য অপেক্ষা করতো। কিন্তু পার্থ স্পষ্ট ভাষায় মানা করে দেয় তার জন্য কাউকে রাত জাগতে। এরপর থেকে সাদিকা বেগম নিজে অপেক্ষা না করলেও জমিলা খালাকে কড়া নির্দেশনা দিয়ে রাখতেন যেনো পার্থ বাড়ি ফিরলে তাকে খালি পেটে না ঘুমাতে দেয়। জমিলা খালাও সেই আদেশ পালন করতেন। কিন্তু তখন পার্থর কখনোই আলাদা কোনো অনুভূতি কাজ করে নি। তবে আজ করছে। তরীর তার জন্য করা অপেক্ষাতেও সে সুখ খুঁজে পাচ্ছে। পার্থ কি কখনো ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলো যে তার পছন্দসই নারী একদিন তারই স্ত্রী রূপে তার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে রইবে?
ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে পার্থ। আরেক দন্ড দেখে নেয় তরীকে। কতক্ষণ ধরে এভাবে ঘুমাচ্ছে? ঘাড় ব্যথা করছে না? পার্থ চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে তরীর পাশে দাঁড়ায়। তরীকে চেয়ার থেকে তুলতে নিলেই তরী নড়েচড়ে উঠে। কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় আবার চোখ বুজে ফেলে সে। পার্থ তরীকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে এক দন্ড সেই ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে নেয়। অত:পর মুখ নামিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
__________
নির্বাচন শব্দটা শুনতে যত সাধারণ মনে হয় এর অর্থ ততটাই ভারী। এই একটা জিনিসকে কেন্দ্র করে ঘুরে আরো অনেক গুলো বিষয়। একটা দেশের উন্নয়ন, জনগণের আশা, প্রার্থীদের জয় পরাজয় সব এই শব্দটার সাথে সংশ্লিষ্ট।
খুব সকাল থেকেই নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নির্ধারিত স্কুল কেন্দ্রগুলোকে ঘিরে আছে বিভিন্ন চ্যানেলের সাংবাদিকরা। টিভিতে চলছে নির্বাচনের লাইভ টেলিকাস্ট। পার্থর এরিয়ার কেন্দ্রগুলোতে তার ছেলেদের রয়েছে কঠোর পাহারা। কোথাও কোনো অনৈতিকতা করার সুযোগ দিবে না যেনো তারা। জিতুক কিংবা হারুক তা গুরুত্বপূর্ণ না। একটা সুষ্ঠু নির্বাচন বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে। পুলিশের টহলে সেই নিরাপত্তা আরো দ্বিগুণ রূপ ধারণ করেছে। স্কুল মাঠ গুলোতে রয়েছে ভোটারদের লম্বা লাইন।
পার্থ খুব ভোর বেলায়ই গোসল সেরে গায়ে একখান শুভ্র পাঞ্জাবি জড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তরী তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই আসার আগে তার সাথে কথাও হয় নি। আকাশটা আজ সকাল থেকে খুব পরিষ্কার। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে আগামী এক দু’দিনের মধ্যে নাকি ভারী বর্ষণের আশংকা করছে তারা। কিন্তু আবহাওয়া অধিদপ্তরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সকাল পনে নয়টার দিকেই সূর্যের দেখা মিললো।
প্রকৃতি যতটাই উজ্জ্বল থাকুক না কেন পার্থর বুকের ভেতর ডিংডিং করে চিন্তার ঘন্টা বেজে চলেছে। এই চিন্তার কারণ তার অজানা। সে তো একটু পর পরই ভোট কেন্দ্র গুলোর ভেতরকার অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে। সব তো ঠিকঠাকই আছে। তবে এই চিন্তা এই ভয় কিসের জন্য?
ভোর বেলায় তরীকে রেখে আসার সময় তরী ঘুমের ঘোরে আষ্টেপৃষ্টে তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো। পার্থ নিজেকে সেই বাধন থেকে মুক্ত করে উঠে বিছানা ছেড়ে নামতে নিলেই তরী ঘুমের ঘোরে আবার তার হাত জড়িয়ে ধরে। যেনো কোনো ভাবেই তাকে যেতে দিবে না আজ। পার্থ সেই সকল বাঁধা পেরিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে আজ।
আরেকটা খটকা লাগার বিষয় হচ্ছে রুবেল গতকাল থেকে খুব শান্ত আছে। কোনো রকমের মাথা ব্যাথা যেনো নেই তার। এরকম কেন হচ্ছে? রুবেলের তো এতটা শান্ত থাকার কথা না। আর কিছু ভাবার সুযোগ পায় না পার্থ। তার আগেই তাকে ঘিরে ধরে বেশ কিছু সাংবাদিক। পার্থ স্বল্প কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়ে প্রশ্ন উত্তরের পাটটা চুকিয়ে ফেলে। সাথে সাথে পার্থর সাথে থাকা তার দলের কিছু ছেলে তাকে সেই ভীড় ঠেলে বের করে এনে একটা নীরব জায়গায় পৌঁছে দেয়। এইদিকটা বেশ নিরিবিলি। লোক সমাগম নেই বললেই চলে। স্কুলের পিছনের এই খোলা মাঠটার একপাশেই পার্থর গাড়ি পার্ক করা। পার্থ শামীমের হাতে নিজের গাড়ির চাবিটা দিয়ে বলে,
“ শামীম আমার সাথে চল। “
শামীম বাকি সকলকে কেন্দ্রের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে পার্থর সাথে এসে গাড়িতে উঠে বসে। অত:পর প্রশ্ন করে,
“ কোথায় যাবেন ভাই? “
পার্থ পিছনের সিটে বসে নিজের পিঠ এলিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বলে,
“ সেগুনবাগিচার জমির ওদিকটায় চল। “
__________
চৌধুরী নিবাসে আজ সকাল থেকেই সবাই টিভির সামনে বসে। আফজাল সাহেব, মধুমিতা, জমিলা খালা সবাই টিভির দিকে তাকিয়ে। ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। আফজাল সাহেবের থেকে থেকে ছেলের চিন্তায় বিপি হাই হয়ে যাচ্ছে। মধুমিতা শশুড়কে কখনো ওষুধ এনে দিচ্ছে তো কখনো পানি। তবুও আফজাল সাহেবের চিন্তার সিকি ভাগও কমছে না। তার ছেলের রাজনীতির প্রতি ঝোকে তিনিই সর্বপ্রথম সমর্থন জানিয়েছিলেন। তার সমর্থনেই ছেলের সাহস এবং মনোবল আরো জোড়দার হয়। তীব্র সংগ্রামের পর ছেলের জয়ই কেবল উনার কাম্য।
__________
নিজের কেবিনে বসে উসখুস করছে তরী। একদিকে পার্থর জন্য চিন্তা তো অপরদিকে টেস্টের রিপোর্টের জন্য চিন্তা হচ্ছে তার। কিন্তু আপাতত পার্থর জন্য তার চিন্তাটাই মুখ্য। সকালে মানুষটাকে সে ঠিক করে বিদায়ও দিতে পারে নি। মরার মতো পরে ঘুমোচ্ছিলো। পার্থ রাতেও কিছু খায় নি সকালেও কিছু খেয়ে যায় নি। সেই মানুষটার চিন্তায় তরীও গতরাত থেকে না খাওয়া। রাতে ভেবেছিলো পার্থ বাড়ি ফিরলে একসাথে খাবে। কিন্তু কখন যে চোখ লেগে আসে সে টেরই পায় নি। সকালে যখন জমিলা খালার কাছে শুনলো পার্থ নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়েছে তখন তারও মুখে আর খাবার উঠে নি। তাড়াতাড়ি শশুড়ের চোখ ফাকি দিয়ে হসপিটাল এসে পড়ে। বাসায় থাকলে আফজাল সাহেব কখনোই তাকে নাস্তা না করে বের হওয়ার অনুমতি দিতো না।
তরীর আকাশ কুসুম চিন্তার মাঝেই তার ফোনে একটা ছোট ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজটা ওপেন করতেই তার চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
“ আই নিড ইউ বাই মাই সাইড জান।
মিট মি এট সেগুনবাগিচা। “
ছোট্ট দুই লাইনের ম্যাসেজ এবং তার সাথে এটাচড গুগল ম্যাপে লোকেশনের লিংকের এটাচমেন্টটা তরীর মন ফুরফুরে করে দেয়। সে সাথে সাথে গায়ের এপ্রোন খুলে রেখে নিজের মাথার খোপাটা খুলে হাতের সাহায্যে চুল সামান্য ঠিক করে নেয়। অত:পর নিজের পার্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।
__________
নীল রঙা গাড়িটা ব্রেক করে তরী তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামে। তার মুখোমুখি কালো গাড়িটার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে শামীম। তরীকে দেখেই সে সালাম দিয়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে,
“ ভাই গাড়ির ভেতর আছে ভাবী। “
তরী হেসে নিজের হাতের দুটো ব্যাগ হতে শামিমের হাতে একটা ছোট ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলে তুমি আমার গাড়িতে বসে লাঞ্চটা করে নাও। শামীম বিস্মিত হয়ে যায়। তরী বলে,
“ চিন্তায় যে তোমাদের কারো গলা দিয়ে আজ খাবার নামবে না আমি জানি। কিন্তু না খেলে আমি রাগ হবো। তাই কোনো কথা না বলে গিয়ে লাঞ্চ করে নাও। “
শামীম আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। তার আগেই তরী দৌঁড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। তরী গাড়ির দরজা বন্ধ করেই পার্থর বুকে হামলে পড়ে। পার্থ নিজের প্রশস্ত বুকে স্ত্রীকে জড়িয়ে নিতেই তরী বলে,
“ খুব চিন্তায় ছিলাম। “
পার্থও একই ভঙ্গিতে বলে,
“ খুব অস্থির ছিলাম। “
পার্থর কথা শুনে তরী হেসে চোখ বুজে। অত:পর পার্থর বুক থেকে মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। এসি তো চলমান। তবুও পার্থর কপাল চুইয়ে ঘাম পড়ছে। তরী নিজের গোলাপি রঙা ওড়নার আঁচল দিয়ে সেই ঘামটুকু মুছে দিতেই পার্থ হেসে বলে,
“ তোমার মধ্যে গিন্নি টাইপ ব্যাপার এসে পড়েছে। “
তরী লজ্জা পায়। পার্থ ভালো করেই জানে এই ধরনের টিপিক্যাল কথা শুনলে সাধারণত তরী রাগ হয়। অথচ আজ তার উল্টো হতে দেখে সে বেশ অবাক হয়। তরী নিজের সাথে আনা আরেকটা ব্যাগ হতে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট ও পানির বোতল বের করে। অত:পর গাড়ির জানালা খুলে নিজের হাত ধুয়ে নিয়ে পার্থর সামনে লোকমা তুলে বলে,
“ মাথা চক্কর খেয়ে পড়ে আমার হসপিটালে এডমিট হতে না চাইলে চুপচাপ খেয়ে নাও। গত রাত থেকে না খেয়ে দেবদাস সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছো। এসব আমার একদম পছন্দ না। “
তরীর এই হালকা শাসন পার্থ উপভোগ করে। সে বিনাবাক্য ব্যয়ে লোকমাটুকু মুখে নিয়ে নেয়। অত:পর তরীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ আমি দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি সেটা অপরাধ। আর আপনি যে পারু সেজে স্বামীর সাথে তাল মিলিয়ে অভুক্ত রয়েছেন সেটা কি অপরাধ নয় তরী রশীদ? “
তরী অবাক হয়। পার্থ কি বাসায় তার পিছনে স্পাই লাগিয়ে রেখেছে নাকি? অবশ্য সেই স্পাইটা যে কে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তরীর। জমিলা খালা যে পার্থর কত বড় নেওটা তা তার বেশ জানা আছে। পার্থ মৃদু ধমকে বলে,
“ আর পার্বতী সেজে ঘুরে বেড়াতে হবে না। তুমিও খেয়ে নাও। “
তরী এবার পালাক্রমে পার্থর পাশাপাশি নিজের মুখেও খাবার তুলে নেয়। খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই তরী হাত ধুয়ে বসতেই পার্থ তার ওড়নার আঁচল টেনে নিয়ে নিজের ভেজা মুখ মুছে নেয়। তা দেখে তরী হেসে বলে,
“ তুমিও কিন্তু টিপিক্যাল হাজবেন্ড হয়ে যাচ্ছো। “
পার্থ হেসে নিজের হাতঘড়ি দেখে বলে,
“ হসপিটালে যাবে নাকি বাসায় ফিরবে? “
“ হসপিটাল যেতে হবে। একঘন্টার ব্রেক নিয়ে এসেছি আমি। “
তরী নিজের পার্স হাতে নিয়ে অপরদিকে ফিরে দরজা খুলতে উদ্যত হলেই সাথে সাথে নিজের পেটের কাছে পার্থর বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া অনুভব করে। তরী সাথে সাথে আবেশে চোখ বুজে ফেলে। আপনাআপনিই তার হাত চলে যায় পার্থর হাতের উপরের পিঠে। মনে মনে ভাবে যদি টেস্টের রিপোর্ট পজেটিভ আসে? তার মানে এখন ঠিক এই জায়গাটায় আরেকটা প্রাণও রয়েছে। যাকে নিজের অজান্তেই পার্থ ছুঁয়ে দিচ্ছে। তরীর ভাবনার মাঝেই পার্থ তার কাধে নিজের থুতনি ঠেকিয়ে বলে,
“ সকাল থেকে এক অজানা আতংক আর অস্থিরতা অনুভব করছিলাম। তোমার খানিকের সান্নিধ্যে তা কিছুটা কম অনুভব করছি এখন। “
তরী মৃদু হাসে। অত:পর নরম সুরে ডাকে,
“ পার্থ? “
“ হ্যাঁ, জান। “
তরী আর কিছু বলতে পারে না। তার ইচ্ছে করছে চিল্লিয়ে পার্থকে জানাতে যে হয়তো তুমি বাবা হতে চলেছো। কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে সে কিছু বলতে চায় না। তাই কথাটা চেপে গিয়ে সে বলে,
“ নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন তুমি প্লিজ রাতে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরো। “
“ কিছু বলবে? “
“ না, এমনি। “
তরী চলে যায়। পার্থ আবার এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। আজ সকাল থেকে তার সাথে হচ্ছেটা কি? এরকম অদ্ভুত অনুভূতি কেনো হচ্ছে না? এতটা অস্থির কেনো লাগছে? নির্বাচনের জন্য নাকি অন্য কিছু?
__________
ভোট প্রক্রিয়া শেষ হয়ে এখন গণনাকার্য চলছে। সারাদিনের উজ্জ্বল আবহাওয়া হঠাৎ করেই গুমোট রূপ ধারণ করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কথাটা যেনো সত্যি হতে চলেছে। যেকোনো মুহুর্তে আকাশ ছাপিয়ে নামবে ভারী বর্ষণ। সন্ধ্যা লগ্ন পেরিয়ে নিশ্চুপ রাতের আগমন হয়েছে। নিশ্চুপ হয়ে আছে সকল প্রার্থীও। আর কিছু মুহুর্তের ব্যবধান। যেকোনো মুহুর্তেই বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হবে।
টিভির সামনে বসে আছে উৎসুক দেশবাসী। বসে আছে পার্থর পরিবারও। শোভন খুব একটা ইন্টারেস্ট না দেখালেও, সে-ও ঠিকই আড়ালে নিজের রুমে বসে ফোনে নিউজের লাইভ টেলিকাস্ট দেখছে।
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ঘোষণা করা হলো বিজয়ীর নাম। পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। নামটা ঘোষণা করা হতেই উল্লাসে ফেটে পড়লো সকলে। আফজাল সাহেবের চোখ ভিজে আসে ছেলের কাঙ্ক্ষিত বিজয় দেখে। সাদিকা বেগম সাথে সাথে চলে যায় দু রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে। শোভন নিজের খুশিটা চেপে যায়। পৃথা খুশিতে ইয়েস বলে লাফিয়ে উঠে। তার উল্লাস দেখে তূর্যও নীরবে হাসে। লোকটা স্বামী হিসেবে এখন পর্যন্ত তার আপিকে কোনো অভিযোগের সুযোগ দেয় নি। এখন একজন নেতা হিসেবেও যেনো নিজের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে তা-ই তূর্যর কাম্য।
জনগণের সিংহভাগই পার্থের পক্ষে ভোট দিয়ে তার ব্যালেট ভারী করেছে। কথাটা যেনো পার্থর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। সবটা তার স্বপ্ন মনে হচ্ছে। নিজের প্রতিপালকের প্রতি সে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে। তার উপর আল্লাহর মেহেরবানি আছে বলেই আজ সে এই অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছে। প্রথমে তরীর ভালোবাসা এখন জনগণের ভালোবাসা। এই সবটা তার ভাগ্যে ছিলো ভাবতেই পার্থর শরীরে শীতল হাওয়া বয়ে যায়।
চারিদিক থেকে পার্থকে ঘিরে ধরেছে সাংবাদিকেরা। পার্থকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তার সাথে রয়েছে তার দলের লোকেরা এবং পুলিশ। উৎসুক ও উদগ্রীব জনতার উদ্দেশ্যে পার্থ ক্যামেরায় নিজের দৃষ্টি স্থির করে দৃঢ় গলায় বলে উঠে,
“ এই জয় আমার নয়। এই জয় আপনাদের সকলের। সেই প্রতিটা মানুষের যারা ভোট কেন্দ্রে এসে এই নগন্য মানুষের উপর আস্থা রেখে তাকে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছেন। “
কথাটুকু বলেই পার্থ মৃদু হাসে। অত:পর বলিষ্ঠ গলায় ফের বলে উঠে,
“ একজন বাচ্চা ছোট বেলা থেকেই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন স্বপ্ন সাজায়। আমার সকল স্বপ্ন ছিলো নিজের দেশ ও দেশের মানুষদের ঘিরে। সেই স্বপ্ন মনে লালন করেই আমি বেড়ে উঠেছি। আমার এই চলার পথে বহু বিপদ এসেছে। কিন্তু মহান আল্লাহর রহমত এবং আমার আব্বা আম্মার দোয়ায় আমি সেই সকল বিপদ কাটিয়ে আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আরেকজন মানুষের কথাও না বললে নয়। আমার আব্বা আম্মার দোয়া যেমন আমার ঢাল হয়েছিলো তেমনই সেই মানুষটা আমার শক্তির উৎস হয়ে সাথে ছিলো। সেই মানুষটা আমার স্ত্রী, আমার প্রেরণা। “
কথাটুকু বলে পার্থ এবার কিছুটা সিরিয়াস মুখে বলে,
“ আমিও আপনাদের মতো এই দেশের একজন অতি সাধারণ মানুষ। কিন্তু আপনাদের সেবার মাধ্যমে নিজেকে অসাধারণ করে তোলার প্রচেষ্টা আমার আমরণ থাকবে। তাই আপনারা আপনাদের সকল সমস্যা আমার কাছে তুলে ধরতে দ্বিধা বোধ করবেন না। সকলে ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন। এই প্রত্যাশা রেখে আজকের জন্য আল্লাহ হাফেজ। “
দেশের প্রতিটা টিভি চ্যানেলে টেলিকাস্ট হচ্ছে পার্থর এই লাইভ বক্তব্য। বক্তব্যের পাট চুকিয়ে বেরিয়ে আসতেই পার্থর দলের সকলে তাকে ঘিরে ধরলো। দেশের বিভিন্ন মন্ত্রী এমপির ফোন কলে তার ফোন ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ফুলের অভ্যর্থনায় সকলেই পার্থকে ঘিরে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এতো মানুষের সমারোহেও পার্থর মস্তিষ্কে বাজছে একটাক কথা। তরী তার জন্য অপেক্ষা করছে।
__________
ভারী বর্ষণ নেমেছে ধরায়। নীল রঙা গাড়ির উইন্ডশেল্ড ওয়াইপার ক্রমাগত গাড়ির সামনের কাঁচে বেয়ে পড়া বৃষ্টির পানি সরিয়ে দিতে ব্যস্ত। তরী ফোনের স্ক্রিনের দিকে গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে তাকাচ্ছে। মুখে তার মুচকি হাসি লেপ্টে। এতক্ষণ পার্থর লাইভ ইন্টারভিউ সম্পূর্ণটা সে দেখেছে।
গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে নিজের হাত রেখেই তরী আবার ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের সিটে থাকা ফাইলটার দিকে তাকায়। সাথে সাথে তার হাসির রেখা দীর্ঘ হয়। খুশির পরিমাণ অত্যাধিক বেশি হলে মানুষ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তরীও তার ব্যতিক্রম নয়। তার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। মনে মনে ভাবছে পার্থকে কিভাবে খুশির খবরটা জানাবে। বাবা হতে চলেছে জানার পর পার্থর সেই হাসিমাখা মুখটা তরীর চোখের সামনে ভেসে উঠে। সাথে সাথে তরী ফিক করে হেসে দেয়।
ড্রাইভ করতে করতে একটা হাত নিজের পেটের উপর সন্তর্পণে রেখে সে বলে উঠে,
“ তোমার বাবা তোমার কথা জানলে খুশিতে পাগল হয়ে যাবে। “
কথাটুকু বলেই তরী নীরবে হাসে। অত:পর বেশ আগ্রহী গলায় বলে,
“ তোমার বাবার গান শুনবে? খুব ভালো গান গায়। আমার মতো ফাটা বাঁশ নয় একদম। “
কথাটুকু বলেই তরী একহাত বাড়িয়ে ফোনে একটা রেকর্ডিং প্লে করে দেয়। কোনো এক একান্ত রাতে পার্থ তাকে বুকে জড়িয়ে এই গান শোনানোর সময় তরী এটা রেকর্ড করে রেখেছিলো। হসপিটালে নিজের কর্মব্যস্ততায় যখন সে খুব ক্লান্ত অনুভব করে তখন এই রেকর্ডিংটা শুনে সে। ফোনের ভলিউম সম্পূর্ণ বাড়িয়ে দেয় তরী। বর্ষণের সাথে তাল মিলিয়ে পার্থর গান শুনতে বেশ শ্রুতিমধুর লাগছে। সবসময়ের মতোই পার্থ নিজের নির্লজ্জ মার্কা গানই গাইছে,
“ ভিগে ভিগে তেরে লাব
মুঝকো কুছ কেহতে হে
দিল হে খুশ মেরা
কে খেয়াল এক জেয়সে হে
রোকো না আব খুদকো ইউ
সুন লো দিল কি বাত কো
ঢাল জানে দো শাম
ওর আজা নে দো রাত কো। “
গানটুকু শুনতে শুনতেই তরী হেসে বলে উঠে,
“ তোমার বাবার প্লে লিস্ট এমনই। কিন্তু চিন্তা করো না, তুমি আসার আগেই মা বাবাকে ভালো গান শিখিয়ে দিবো। তোমাকে সেগুলোই শুনাবে। এইসব গান শুধু মায়ের জন্যই সীমাবদ্ধ। “
কথাটুকু বলতে বলতেই তরী একটা চার রাস্তার মোড় পেরিয়ে সোজা যাচ্ছিলো। ঠিক সেই সময় হঠাৎ ডানপাশ হতে একটা বড় ট্রাক এসে নীল রঙা গাড়িটা সজোরে ধাক্কা দিয়ে চুরমার করে দিয়ে শা শা শব্দ তুলে সেখান থেকে প্রস্থান করে। পুরো ঘটনাটা ঘটে চোখের পলকে।
চার রাস্তার মিলন মোড়ের মাঝে নীল রঙা গাড়িটা তিন চারটে ডিগবাজি খেয়ে উলটে পড়ে রয়। গাড়ির সব কাঁচ গুড়ো গুড়ো হয়ে রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গাড়ির একপাশের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আছে একটা নারী হাত। মৃদু কাপছে সেই হাতটি। সম্পূর্ণ হাত রক্তাক্ত। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সম্পূর্ণ রাস্তাও। সেই রক্ত ধুয়ে মুছে নেওয়ার দায়িত্ব যেনো কাধে তুলে নিয়েছে এই নির্মম বর্ষণ। গাড়ির ভেতর হতে একটা ভাঙা ফোন হতে ভেসে আসছে একটা পুরুষের গাওয়া কিছু বেহায়া চরণ,
“ কিতনা হাসিন ইয়ে লামহা হে,
কিসমাত সে মেনে চুরায়া হে। “
এতদূর আসতেই রেকর্ডিংটা বন্ধ হয়ে যায়। সেই নারী হাতের মৃদু কম্পনও থেমে যায়। নিস্তেজ হাতটা অসাড় হয়ে পড়ে।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]