যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৩১+৩২

0
728

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩১.

নিজের বড় ছেলে এবং একমাত্র মেয়ের হুট করে হয়ে যাওয়া বিয়েতে মনের অনেক শখ আহ্লাদই পূরণ করতে পারে নি আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগম। কিন্তু সেইসব শখ ছোট ছেলের বিয়ের উছিলায় পূরণ করে নেওয়ার একটা সুযোগ পেতেই তারা তা লুফে নেন।

আজ শোভন এবং মধুমিতার হলুদ সন্ধ্যার অনুষ্ঠান। শোভনের ইচ্ছে অনুযায়ী দুজনের একসাথেই হলুদ হবে। হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য চৌধুরী নিবাসের বাড়ির বাগান এবং ছাদ বেশ আকর্ষণীয় ভাবে সাজানো হয়েছে। ছাদে মূলত বর ও কনেকে হলুদ দেওয়া হবে। আর বাড়ির বাগানে গেস্টদের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।

বাড়ির বড় বউ হিসেবে তরী আজ সারাদিন শাশুড়ির সাথে বিভিন্ন কাজে হাত মেলাচ্ছে। সবশেষে শাশুড়ির কথা মতন মধুমিতা ঠিকঠাক তৈরি হচ্ছে কিনা কিংবা কিছু প্রয়োজন কিনা সেদিকটা দেখতে ব্যস্ত সে।

পার্থও আজ সারাদিন একমাত্র ভাইয়ের হলুদের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়ে বেশ দৌড়াদৌড়ি করছে। এক মুহুর্তের জন্যও তরীর দেখা পায়নি সে। সকল গেস্টরা ইতিমধ্যে এসে পড়েছে। সকলেই পালাক্রমে বাড়ির বড় বউয়ের খোঁজ করছে। পার্থ তাই আর অপেক্ষা না করে নিচে চলে আসে তরী তৈরি হয়েছে কিনা দেখতে।

__________

নিজের বেডরুমের কাঠের দরজাটা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই আয়নার সামনে একটা অপ্সরা দেখতে পায় পার্থ। কমলা এবং গোলাপি রঙের মিশেলে জামদানি শাড়ি পরিহিত তরী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হলুদের বাটির থালাটা ফুল দিয়ে সাজাতে ব্যস্ত। দরজা খোলার শব্দ পেয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে পার্থকে দেখে বলে উঠে,

“ দেখুন না কেমন হয়েছে? আমি আগে কখনো সাজাই নি। “

তরী মূলত হলুদের স্বচ্ছ কাচের বাটিকে বুঝিয়ে এই কথাটা বলে। কিন্তু পার্থ তা শুনে না। সে এগিয়ে গিয়ে তরীর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,

“ অপূর্ব লাগছে। “

তরী সরু চোখে পার্থর দিকে মুখ তুলে তাকায়। মুহুর্তেই সে পার্থর দৃষ্টি দেখে তার বুকে মৃদু আঘাত করে রুম থেকে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ আপনার এই দৃষ্টি আমি ভালো করে চিনি। একশো হাত দূরে থাকবেন আজকে আমার থেকে। বহু কষ্টে এই মেকাপ করেছি আর চুল খোপা করেছি। “

কথাটুকু বলে বেশিদূর যেতে পারে না তরী তার আগেই হাতে টান লেগে পিছিয়ে আসে সে। ব্যালেন্স বিগড়ে একহাতে থাকা হলুদের বাটিটা পড়ে যেতে নিলেই পার্থ নিজের ডানহাতে তা ধরে ফেলে। তরী সাথে সাথে ফুসে উঠে,

“ পার্থ! আম্মা আমাকে তাড়াতাড়ি উপরে যেতে বলেছে। শোভন আর মধুমিতাও অলরেডি উপরে চলে গিয়েছে। হলুদের অনুষ্ঠানে বর কনে সহ সকলে উপস্থিত কেবল হলুদই নেই। “

পার্থ ভ্রু কুচকে বলে,

“ যেতে মানা করেছে কে আপনাকে? “

“ হাত ছাড়ুন তাহলে। “

“ আমি কখন বললাম ছাড়বো না? “

“ উফ পার্থ! “

তরীর তাড়াকে তোয়াক্কা করে না পার্থ। সে একহাতে স্বচ্ছ কাঁচের বাটি হতে সামান্য হলুদ বাটা তুলে নিয়ে তরীর ঘাড়ের পিছনে লাগিয়ে দেয়। তরী চোখ বড় বড় করে বলে,

“ পাগল হয়ে গিয়েছেন? কার হলুদ কাকে দিচ্ছেন? “

“ আমাদের বিয়ের সময় আমি ব্যতীত সবাই আপনাকে হলুদ লাগিয়েছিলো। সেই হিসাবের খাতাটা তোলা ছিলো। আজ পূরণ করে নিলাম। “

তরীর বিরক্ত মাখা মুখে মুহুর্তেই সলজ্জ হাসি ফুটে উঠে। সেই হাসি দেখে পার্থ কপোকাত হয়। সকল তাড়া নিমিষেই মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায়। কাচের বাটিটা একপাশে রেখে হাত বাড়িয়ে তরীর খোপায় গোজা বেলী ফুলের মালাটা একটানে খুলে ফেলে। মুহুর্তেই ঝরঝর করে পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে কালো চুলের গোছা। পার্থ আবার খানিকটা হলুদ বাটা হাতে নিয়ে শাড়ির আঁচল ভেদ করে তরীর নির্মেদ পেটের একপাশে তা মেখে দেয়। অত:পর ফিসফিসিয়ে বলে,

“ হিসাব বুঝে নিয়েছি তরী রশীদ। চাইলে যেতে পারেন এখন। বাঁধা দিবো না। “

এইটুকু বাক্য শুনতেই তরী সাথে সাথে একহাতে বাটি এবং অন্য হাতে শাড়ির কুচি সামলে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নেয়। দরজার কাছাকাছি যেতেই পার্থ পিছন থেকে বলে উঠে,

“ কেউ দেখে ফেলার ভয় মনে রাখবেন না। পার্থ মুন্তাসিরের স্ত্রী বাকি সকলের জন্য নিষিদ্ধ। যে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করবে সে নিজের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলবে। “

__________

সকলের দৃষ্টি বর কনের দিকে থাকলেও বর ও কনে ব্যস্ত একে অপরকে দেখতে। কখনো নজর লুকিয়ে তো কখনো প্রকাশ্যে। অবশ্য এটা নিয়ে এই পর্যন্ত তাদের বন্ধুমহল কম লেগ পুল করে নি। তবুও তারা সেটার তোয়াক্কা করলো না। যেই প্রেমিক যুগল প্রেম করার সময়ই কখনো কারো তোয়াক্কা করে নি তারা বিয়ের একদিন আগেই বা কার পরোয়া করবে?

হলুদের একফাঁকে শোভন মধুমিতার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থেকে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ অবশেষে তোমাকে আমার পাওয়া হলো মধু। “

মধুমিতা জবাব দেয় না। তাদের আজকের এই পরিণতির পিছনে সবটাই অবদান শোভনের। নিলখেত রোড হতে শুরু করে টিএসসি রোড পর্যন্ত সম্পূর্ণ সড়ক সাক্ষী শোভনের সেই অবদানের। উড়নচণ্ডী এক রমণীর মনে প্রথমে প্রেমের বীজ বুনন করে। অত:পর রোজ নিয়ম করে সেই ছোট্ট প্রেম চারায় পানি দিয়ে তাকে বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে। সেই ছোট্ট চারা আজ বড় বৃক্ষে রূপ ধারণ করেছে। শাখা-প্রশাখা, ডাল-পালা ছড়িয়ে ছায়া দিতে শিখেছে। সেইজন্য মধুমিতা শোভনের কাছে চির কৃতজ্ঞ।

__________

নিজের ছোট দা’র বিয়ে নিয়ে সবথেকে এক্সাইটেড থাকা পৃথা ছাদের এককোণে বসে আছে নীরব ভঙ্গিতে। বেশ অস্থির লাগছে তার। এতো লাউড মিউজিক ও মানুষের সমাগম আচমকাই তার কাছে বেশ অস্বস্তিকর ঠেকছে। তূর্যটাও উধাও হয়ে গিয়েছে যেনো এই বাসায় আসার পর থেকে। তার আম্মা বিয়ের এতো ব্যস্ততার মাঝেও একমাত্র মেয়ে জামাইর খাতির যত্নে কোনো কমতি রাখছে না। বরং ঢের বেশিই করছেন। তূর্য যদিও অনেকবার বলেছে তাকে নিয়ে এতো ব্যস্ত না হতে কিন্তু সাদিকা বেগম তা শুনলে তো!

পৃথার আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু চাইলেও এখান থেকে যেতে পারছে না। তাই দম খিচে বসে বসে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার প্রহর গুনছে। আচমকা তরী তার পাশে এসে বসে প্রশ্ন করে,

“ খারাপ লাগছে পৃথা? “

পৃথা শুকনো গলাটা এক ঢোক গিলে ভিজিয়ে সামান্য হেসে বলে,

“ না বড় ভাবী। এভাবেই বসে আছি। “

তরী শান্ত গলায় বলে,

“ ঠিক থাকলে তুমি এখানে চুপচাপ বসে থাকতে না। শরীর খারাপ লাগছে নাকি মন খারাপ? “

“ আসলে একটু মাথা ধরেছে ভাবী। “

তরী চিন্তিত গলায় বলে,

“ তাহলে এখানে বসে আছো কেন? নিচে রুমে যাও। রেস্ট করো। “

“ না ভাবী। আমি এখন ভাইয়ের বিয়ে রেখে গিয়ে নিচে বসে থাকলে কেমন দেখায় না বিষয়টা? “

“ বোকা মেয়ে। কেউ কিছু বলবে না। তুমি তোমার রুমে গিয়ে রেস্ট করো। আমি ছোটকে খুঁজে পাঠাচ্ছি। বলদটা এই বাসায় আসার পর থেকে বউ কিংবা বোন কাউকেই চিনছে না। “

পৃথা হেসে উঠে নিচে চলে যায়। তরী ব্যস্ত হয়ে সম্পূর্ণ ছাদ ঘুরে তূর্যকে খুঁজে বের করে। তারপর তাকে পৃথার কাছে পাঠিয়ে দেয়।

__________

তূর্য নিচে নেমে পৃথার রুমে প্রবেশ করতেই দেখে পৃথা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বিছানার এককোণে বসে আছে। তূর্য ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে বসে প্রশ্ন করে,

“ বেশি খারাপ লাগছে? মাথা টিপে দিবো? “

পৃথা কথা বলে না। কেবল মাথাটা সামনের দিকে ঝুকিয়ে তূর্যের হাতের বাহুতে ঠেক দেয়। তূর্য অপর হাতে আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আচমকা পৃথা তার একহাত জাপ্টে ধরে বলে,

“ তূর্য মাথা ঘুরাচ্ছে প্রচুর। “

কথাটা বলতে বলতেই তার শরীর ঢলে পড়ে। তূর্য চিন্তিত ভঙ্গিতে পৃথাকে আগলে ধরে। সাথে সাথে তার মনে পড়ে যায় পৃথার ডায়াবেটিস আছে। আবারও কি ব্লাডে সুগার লেভেল কম হয়ে গিয়েছে নাকি? সে সাথে সাথে তরীকে কল করে। কিন্তু কিছুক্ষণ কল করার পরও তরী ফোন রিসিভ করে না। তূর্য পৃথাকে ডাকতে ডাকতে নিজের পাপার নাম্বার ডায়াল করতে নেয় কিন্তু তখনই তার রুমে সাদিকা বেগম প্রবেশ করে। তূর্য উনাকে দেখে সাথে সাথে বলে,

“ আম্মা আপিকে একটু ডেকে আনেন প্লিজ। পৃথা সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। “

__________

রুমের মধ্যে পৃথা, তরী এবং সাদিকা বেগম উপস্থিত কেবল। বাকি সকলে দরজার অপরপাশে দাঁড়ানো। হলুদের অনুষ্ঠান ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। গেস্টরা সকলেই ফিরে গিয়েছে।

তরী পৃথার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

“ তোমার সুগার লেভেল তো নরমাল আছে। “

পৃথা ক্লান্ত গলায় বলে,

“ জানিনা ভাবী, প্রচুর মাথা ঘুরাচ্ছে হঠাৎ করে। “

সাদিকা বেগম তরীকে রুমের একপাশে ডেকে নিয়ে নিচু স্বরে কিছু কথা বলে। সাথে সাথে তরীর মস্তিষ্ক সচল হয়। এতক্ষণ সে-ও এই সন্দেহ করে নি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তার একটু বের হতে হবে। তাই সাদিকা বেগমকে বলে,

“ আম্মা আপনি পৃথার সাথে থাকুন। আমি পাঁচ মিনিটেই ফিরছি। “

বলেই সে বেরিয়ে যায়। রুম থেকে বের হতেই সকলে তাকে ঘিরে ধরে। তরী আপাতত কিছু একটা বুঝ দিয়ে পার্থকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আমার সাথে একটু সামনের ফার্মেসি চলুন। “

পার্থ চিন্তিত গলায় বলে,

“ কি লাগবে আমাকে বলো। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। “

“ না। আমার সাথে যেতে হবে। “

পার্থ আর বাড়াবাড়ি করে না। তরীকে নিয়ে এলাকার ফার্মেসিতে চলে যায়। ভাগ্যিস ফার্মেসি তখনো খোলা ছিলো। তরী একাই ভিতরে প্রবেশ করে কিছু একটা কিনে বেরিয়ে আসে। বাসায় ফিরে সাথে সাথে আবার পৃথার রুমের ভেতর চলে যায় সে। প্রায় পনেরো মিনিট পর সাদিকা বেগম ও তরী দুজনই বেরিয়ে আসে রুম থেকে। তরী শান্ত গলায় তূর্যকে বলে,

“ তুই ভিতরে যা। “

স্ত্রীর কাছে যাওয়ার অনুমতি পেতেই আর এক মুহুর্ত দেরি করে না তূর্য। দরজাটা লক করে রুমের ভেতর প্রবেশ করতেই বিছানার এককোণে বসে থাকা পৃথা তার দিকে মুখ তুলে তাকায়। তূর্য তার সামনে গিয়ে চিন্তিত গলায় বলে,

“ কি হয়েছে পৃথা? “

পৃথা কোনো জবাব না দিয়ে হাতে থাকা প্রেগন্যান্সি কিটটা তূর্যর দিকে তুলে ধরে। কিছুটা ডিজিটাল থার্মোমিটারের ন্যায় দেখতে বস্তুটির দিকে তূর্য ভ্রু কুচকে দুই সেকেন্ড তাকায়। অত:পর সেটাতে নীল রঙের দুটো দাগ দেখতে পেয়েই বিস্মিত নয়নে পৃথার দিকে তাকায়। পৃথা মনে সামান্য ভয় নিয়ে কাঁপা গলায় বলে,

“ আই এম প্রেগন্যান্ট তূর্য। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩২.

অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদে সম্পূর্ণ চৌধুরী নিবাস যেন স্তব্ধ বনে গিয়েছে। লিভিং রুমে উপস্থিত আফজাল সাহেব বেশ চিন্তিত মুখে বসে আছে। সরাসরি কিছু না বললেও উনার মুখে সেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। এমন নয় যে উনি খুশি নয়। নানা হতে যাচ্ছেন এই খুশিতে যেমন উনি ভিতরে ভিতরে গদগদ অনুভব করছেন, একইভাবে নিজের একমাত্র মেয়ের চিন্তাও উনাকে ক্লান্ত করে তুলছেন।

মেয়েটা এখনো ছোট, নাজুক। সবেমাত্র তার জীবন শুরু হলো। কিভাবে কি সামলাবে তার মেয়ে? সাদিকা বেগম অবশ্য তেমন একটা চিন্তা করছেন না। উনি খুশি মনে মিষ্টির প্লেট হাতে নিয়ে উপস্থিত হন লিভিং রুমে। সবার আগে নিজের বেয়াই হুমায়ুন রশীদের উদ্দেশ্যে বলেন,

“ ভাইসাব! দাদা হচ্ছেন। মিষ্টি মুখ করেন। “

হুমায়ুন রশীদ হাসিমুখে প্লেট হতে একটি কালো মিষ্টি তুলে নেয়। মনে মনে উনিও বেশ চিন্তিত। তার বুঝদার ছেলেটা এতো হতচ্ছাড়া কবে হলো? এক দুটো বছর কি অপেক্ষা করা যেতো না? মেয়েটা সবে মেডিক্যালে টিকেছে। হুমায়ুন রশীদ আরো কতো স্বপ্ন দেখছিলো। উনার একমাত্র পুত্রবধূও ডাক্তার হবে। উনার মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু এখন এই বাচ্চা মেয়েটা কিভাবে কি সামলাবে? সংসার সামলাবে, পড়াশোনা সামলাবে নাকি বাচ্চা সামলাবে?

তরী নিচু স্বরে শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আম্মা, আগামীকাল তো রাতে বিয়ে। সকালের দিকে আমি পৃথাকে নিয়ে হসপিটাল যাই? একবার চেকাপ করিয়ে শিওর হয়ে নেওয়াটা ভালো না? “

সাদিকা বেগম মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। উনি জানে চেকাপেও একই রিপোর্ট আসবে। তিন তিন সন্তানের জননী তিনি। উনার বিচক্ষণ দৃষ্টি এক দেখাতেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে যে উনি নানি হতে চলেছেন। এই সম্পূর্ণ ঘটনায় নীরব ভূমিকা পালন করছে পার্থ এবং শোভন। নিজেদের খুশি প্রকাশে অপরিপক্ক দুই ভাই নীরব থাকাটাই শ্রেয় মনে করছে আপাতত।

__________

পৃথার শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে আছে। তূর্যকে গুড নিউজটা দেওয়ার পর থেকেই তূর্য একদম স্রোতহীন নদীর ন্যায় শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব কঠিন কিছু হিসেব মিলাচ্ছে। পৃথা কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে ডাকে,

“ তূর্য? “

“ তুমি কি সেদিন মেডিসিনটা খাও নি পৃথা? “

সহজ একটা প্রশ্ন। এই সহজ প্রশ্নের উত্তরও একদম ছোট এবং সহজ। কিন্তু আপাতত ভয়ের চোটে এই উত্তর দেওয়াটা বেশ কঠিন মনে হচ্ছে পৃথার। তূর্য কি খুব রেগে যাবে উত্তরটা শুনলে? কোনো মতে মাথা দুলিয়ে না বলে পৃথা।

তূর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে নিজেকে হতচ্ছাড়া বলে দু চারটে গালি দিতেও ভুলে না। পৃথা এখন যেই বয়সটাতে আছে সেখানে তার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সেই স্বপ্নের জগতে এই ছোট অতিথিকেও তার কাছে খুশির বার্তা মনে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তূর্যের আগেই উচিত ছিলো পৃথাকে খুলে সব বুঝিয়ে বলা।

তূর্যের ভাবনার মাঝেই পৃথা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে,

“ আপনি কি খুশি না? “

পৃথার প্রশ্নটা শুনতেই তূর্যের ধ্যান ফিরে। দ্বিতীয় দফায় নিজের বোকামির উপর বিরক্ত হয় সে। তার নিশ্চুপতায় নিশ্চয়ই মেয়েটা ভয় পেয়েছে? হয়তো এটাও ভাবছিলো যে তূর্য খুশি নয়?

তূর্য স্ত্রীর ছোট্ট দেহটা টেনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। হৃদয় শীতল করা স্বরে শুধায়,

“ অনেক খুশি আমি। “

পৃথার অস্থির মন শান্ত হয়। ঠিক এইটুকু আলিঙ্গনের আশায় সে মুখিয়ে ছিলো এতক্ষণ। তা পেতেই সে প্রশান্তি নিয়ে চোখ বুজে ফেলে। তূর্য ফের বলে,

“ আঠারো যেমন তোমার লাকি সংখ্যা, একইভাবে পঁচিশ আমার লাকি সংখ্যা আজ থেকে। আর কোনো অপ্রাপ্তি নেই। “

তূর্যের কাধে দায়িত্বের পরিমাণ বেড়েছে। এই দায়িত্ব নিয়ে সে মোটেও ভয় পাচ্ছে না। বরং সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত অনুভূতি টের পাচ্ছে সে। ছেলে, ভাই, স্বামী হওয়ার থেকে বড্ড অন্যরকমের অনুভূতি এটা। প্রতিরাতে ঘুমানোর সময় পৃথা তার বুকে লেপ্টে ঘুমিয়ে থাকে। সেই প্রশস্ত বুকে জায়গা হবে এখন আরেকটা ছোট্ট দেহের। দৃশ্যটা কল্পনা করতেই তূর্যের ঠোঁটের কোণের হাসি দীর্ঘ হয়। পৃথাকে আরেকটু বুকে টেনে নিয়ে বলে,

“ এখন থেকে আমার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। আমার কথার বাহিরে কিচ্ছু করবে না। আমাদের বেবির জন্য যা বেস্ট হবে সব করবো আমি। “

__________

পৃথাদের বাসার ছাদে রেলিং ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে তূর্য। আগামী দু’দিন তারা এই বাসায়ই থাকবে। পৃথাটা বেশ কিছুক্ষণ আগেই খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে। নতুন জায়গায় তূর্যের সহজে ঘুম আসে না। বেশ কিছুক্ষণ রুম জুড়ে পায়চারি করে তাই ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে সে। এখানে অবশ্য কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছে সে। মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে অসংখ্য চিন্তা ও ভাবনা। সকল চিন্তাই তার পৃথা আর বেবিকে ঘিরে। কিভাবে কি করবে। কিভাবে সব ম্যানেজ করবে। কিভাবে পৃথার জন্য সব সহজ করা যাবে। এই প্রেগন্যান্সি জার্নির সবটা শারীরিক কষ্ট পৃথা একা সহ্য করবে। সেই কষ্টটুকুর ভাগ তূর্য না নিতে পারলেও অন্তত সেই কষ্ট কিভাবে কিছুটা কমিয়ে আনা যায় সেই চিন্তা করাটা তার সাধ্যের মধ্যে আছে।

তূর্যের ভাবনার মাঝেই তার পাশে এসে দাঁড়ায় একজন। তূর্য ঘাড় ঘুরিয়ে মানুষটাকে দেখতেই অবাক হয়। এই বাসায় একমাত্র এই মানুষটার সাথেই তার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় নি এখনো। কোথাও একটা অস্বস্তি কাজ করে তার মধ্যে। তার বোন এই লোকটাকে মেনে নিতে পারলেও সে পারে না।

পার্থ বিনা জড়তায় বলে উঠে,

“ কংগ্রেচুলেশনস। “

তূর্য যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ ধন্যবাদ। “

পার্থ জানে এই ছেলেটার মনে তার প্রতি রাগ জমে আছে। কিন্তু যেহেতু তাদের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে সেহেতু নিজেদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরী করার চেষ্টা করতে হবে। আর সেই চেষ্টার শুরুটা নাহয় পার্থই করলো। সে শান্ত স্বরে বলে,

“ পৃথাকে ভালো রাখার জন্য ধন্যবাদ। “

“ আমার স্ত্রীকে ভালো রাখা আমার দায়িত্ব। সেটার জন্য ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। “

“ আমি তোমার স্ত্রীকে ভালো রাখার জন্য ধন্যবাদ বলছি না। আমার বোনকে ভালো রাখার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। “

তূর্য সরু চোখে তাকিয়ে বলে,

“ আপনি আমার বোনের উপর কি জাদু করেছেন? আপি আপনাকে মেনে নিলো কি করে? “

পার্থ হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,

“ আমার বোন তোমার উপর যেই জাদু করেছে একই জাদু দ্বারা তোমার বোনকে কাবু করেছি আমি। তোমার চোখে তাকালেই এখন যেমন পৃথার জন্য ভালোবাসা দেখা যায় একইভাবে তোমার বোনও এখন আমাকে চোখে হারায়। “

তূর্য কিছু বলে না। পার্থ এই মুহুর্তে হাসি থামিয়ে বলে,

“ তরীকে আমি আগে থেকেই ভালোবাসতাম তূর্য। তোমাকে দেওয়া আমার থ্রেটগুলো সব মিথ্যে ছিলো। শুধুমাত্র তোমাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যেই সেসব বলেছিলাম। “

তূর্য কিছুটা অবাক হয়। কিন্তু সেটা নিজের মনে চেপে রেখে শান্ত গলায় বলে,

“ কিভাবে কি হয়েছে এসব কিছুই আমি জানতে চাই না। যেহেতু দাবি করছেন যে আমার আপিকে ভালোবাসেন সেহেতু তাকে ভালোও রাখার চেষ্টা করুন। ভাই হিসেবে এইটুকুই চাওয়া রইলো আপনার কাছে। “

পার্থ মৃদু হেসে তূর্যর কাধে হাত রাখে। অত:পর দুষ্টুমি করে বলে উঠে,

“ বাই দ্যা ওয়ে, হানিমুনে গেলাম আমি আর তরী। মামা হওয়ার কথা ছিলো তোমার। অথচ এখানে আমিই মামা হয়ে গেলাম। “

পার্থর ঠাট্টা শুনে এবার তূর্যও মৃদু হাসে।

__________

সকাল সকাল তূর্য এবং বড় ভাবীর সাথে হসপিটালে গিয়ে বেশ কিছু টেস্ট করিয়ে এসেছে পৃথা। এই সামান্য দৌড়াদৌড়ির ধকলেই তার ছোট্ট নাজুক শরীর বেশ নেতিয়ে পড়েছে। বাড়িতে ফিরেই মুখ ভরে বমি করে এখন ক্লান্ত চিত্ত নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে সে। বিয়ে বাড়ির এতো ঝামেলা। সেসব ফেলে সাদিকা বেগম চাইলেও মেয়ের কাছে দু দন্ড এসে বসতে পারছে না। কিন্তু তরীর কারণে তার চিন্তা কিছুটা কম হচ্ছে। মেয়েটা আঠার মতো পৃথার সাথে সাথে থাকছে।

পৃথার পাশে বসে একটা বাটিতে দুটো আনার খুলে আলাদা করতে ব্যস্ত। ফুপ্পি হওয়ার খুশির পাশাপাশি একমাত্র ননদের সব খেয়াল রাখার দায়িত্বও যেন সে তুলে নিয়েছে। রুমের একপাশে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে তূর্য। তার শক্ত মন হঠাৎই ভীষণ নরম হয়ে গিয়েছে। একদিনের সামান্য ধকলেই পৃথার এই অবস্থা, এই কয়েকটা মাস মেয়েটা কিভাবে পার করবে?

তরী আনার খুলে পৃথার দিকে বাটিটা এগিয়ে দিতেই পৃথা ক্লান্ত গলায় বলে,

“ আমার এটা পছন্দ না ভাবী। “

তূর্য সামান্য ধমকে উঠে বলে,

“ পছন্দ না মানে কি হ্যাঁ? শরীরে রক্ত নেই আবার এতো কথা বলো। চুপচাপ খাও। “

তরী পাল্টা ভাইকে ধমকে উঠে বলে,

“ কমনসেন্স কোথায় গিয়েছে তোর ছোট? ওর উপর চিল্লাচ্ছিস কেন? পার্সোনাল চয়েস থাকতেই পারে ওর। “

তূর্য সাথে সাথে দমে যায়। তরী আদুরে গলায় পৃথাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ তোমার পছন্দ না জানি। কিন্তু বাবুর হয়তো এটা পছন্দ। আর তুমি জাস্ট চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। খাবারটা বাবুর পেটে যাবে। সো আর চিন্তা কিসের? “

পৃথা বাধ্য হয়ে নাক মুখ ছিটকে চামচ দিয়ে অল্প অল্প আনার দানা তুলে মুখে দেওয়া শুরু করে। তরী হেসে বলে উঠে,

“ প্রথম কয়েক মাসই এসব প্রবলেমস বেশি হবে। এরপর দেখবে বমি আর অস্থিরতা অনেকটাই কমে আসবে। “

তরীর কথায় পৃথা কিছুটা আশ্বস্ত হলেও তূর্য হয়না। পৃথা যে খাবার দাবার নিয়ে কি পরিমাণে পিকি তা তার ইতিমধ্যে জানা হয়ে গিয়েছে। এই মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু খাওয়াতে রাজি করানো আর একটা যুদ্ধ জয় করা এক সমান। তূর্য মনে মনে বলে,

“ বেবি তুমি অন্তত তোমার মা’য়ের মতো হয়ো না। এক পিকিকে সামলাতেই আমার হিমশিম অবস্থা, তুমিও যদি এরকম হও পরে বাবা কিভাবে সামলাবো বলো? “

__________

সাধারণত বিয়ের দিন বিদায়ের বেলায় সবসময়ই একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করে। কনে নিজের পরিবার থেকে দূরে যাওয়ার দুঃখে অশ্রুও বিসর্জন দেয়। এটাই বহুকাল ধরে চলে আসা রীতি। কিন্তু সেই রীতি যেন মধুমিতার বেলায় খাটলো না। সারা বিয়ের অনুষ্ঠান জুড়ে তার মুখে লেপ্টে থাকা হাসিটা বিদায় বেলায়ও মলিন হলো না। শোভন মজার ছলে তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ অন্তত ফরমালিটির জন্য হলেও দু ফোটা অশ্রু বিসর্জন দেও। “

মধুমিতা বেশ হাসি মুখে নিয়েই জবাব দেয়,

“ কাদবে আমার শত্রুরা। তোমাকে পেয়েছি এখন আবার কিসের কান্নাকাটি হ্যাঁ? “

মধুমিতার কথা শুনে শোভন হাসে। এই সন্ধ্যাটা তার কাছে স্বপ্নের ন্যায়। জীবনের নতুন আর প্রিয় অধ্যায় শুরু হতে চলেছে তাদের। সেই অধ্যায় তো হাসিমুখেই শুরু হওয়া উচিত। শোভন অস্ফুটে বলে,

“ তোমার এই হাসির স্থায়িত্ব অমর হোক মধু। “

__________

চশমার গ্লাস ভেদ করে নিজের হাতের স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন আফজাল সাহেব। সাদিকা বেগম সবেমাত্র শোভনকে নিজের রুমে পাঠিয়ে এসেছেন। রুমে ঢুকতেই আফজাল সাহেবের মুখে লেপ্টে থাকা মৃদু হাসি দেখে প্রশ্ন করে,

“ কি দেখে হাসছেন? “

আফজাল সাহেব আগ্রহভরা গলায় স্ত্রীকে ডেকে বলে,

“ এদিকে আসো পার্থর আম্মা। “

সাদিকা বেগম পাশে এসে বসতেই নিজের ফোনটা স্ত্রীর দিকে ধরে আফজাল সাহেব। ফোনের স্ক্রিনে নিজেদের কম্পলিট ফ্যামিলি ফোটোটা দেখে সাদিকা বেগমেরও মুখে হাসি ফুটে উঠে। এই ছবিটা আজকের তোলা। ছবিতে সোফার মাঝে বসে আছে শোভন এবং মধুমিতা। তাদের দুইপাশে বসে আছে আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগম। সোফার পিছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের পরিবারের আরো দুটি যুগল। তরী, পার্থ, তূর্য এবং পৃথা। সকলের মুখে লেপ্টে আছে খুশির ছাপ। আফজাল সাহেব উৎফুল্ল গলায় বলে উঠে,

“ ছবিটা অনেক সুন্দর আসছে না পার্থর আম্মা? “

“ হ্যাঁ। “

“ ভাবতেসি ছবিটা ফ্রেমে বাধাই করে আমাদের রুমে টানাবো। “

“ হ্যাঁ। ভালো হবে। আমাদের প্রথম ফ্যামিলি পিকচার এটা। “

আফজাল সাহেব শব্দ করে হেসে বলে উঠে,

“ নাতি নাতনিরা আসলে তখন আরেকটা ফ্যামিলি ফোটো তুলে টানাবো আমি। “

স্বামীর কথা শুনে সাদিকা বেগমও হাসেন। ছেলেমেয়েদের সামনে আফজাল সাহেব যতটা গম্ভীর হয়ে থাকে তাদের আড়ালে ততটাই নরম এবং কোমল মনের মানুষ তিনি। এই কোমল হৃদয়ের আফজাল সাহেবকে ভালোবেসেই তো নিজের পিতার অবাধ্য হয়েছিলো সাদিকা বেগম। অবশ্য তা নিয়ে কোনো আফসোসও নেই উনার মধ্যে। কারণ সেই পিতা নিজেই আফজাল সাহেবকে জামাই বলে মেনে নিয়েছেন।

__________

রাত একটা বাজে হঠাৎ শোভনের জরুরি তলবে ছাদে এসে উপস্থিত হয় পার্থ, তরী, পৃথা ও তূর্য। এতো রাতে তাদের এভাবে ছাদে ডাকার কারণ কেউই জানে না। ছাদে আসতেই তারা দেখে শোভন আর মধুমিতা আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত।

পৃথা লাগামহীন প্রশ্ন করে বসে,

“ এই ছোট দা! নিজের বাসর রেখে ছাদে কি করিস? “

তূর্য সাথে সাথে পৃথার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়। বড় ভাইয়ের সাথে এমন কথা কেউ বলে বুঝি? অন্য সময় হলে শোভন জোরে সোরে একটা ধমক দিতো পৃথাকে। কিন্তু আজ তার মন বেশ ফুরফুরে আর পৃথাও এখন প্রেগন্যান্ট তাই আর সে ধমক দেয় না। উল্টো হাসি হাসি মুখে বলে,

“ মধুর অনেক ইচ্ছা ছিলো আমরা ছয়জন মিলে ট্রিয়ো কাপল ডেটে যাবো। কিন্তু কখন কে ফ্রি থাকি তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তাই আজ যেহেতু সবাই একসাথে আছি ভাবছি আজ রাত সবাই একসাথে আড্ডা দেই। “

শোভন আর মধুর এই আবদার কেউই নাকোচ করে না। পৃথা আর তূর্য ছাদের একপাশে ইট সিমেন্টের তৈরী বসার জায়গাটায় পাশাপাশি বসে। তাদের মুখোমুখিই বসে মধু আর শোভন। পার্থ আর তরী অবশ্য বসলো না। তারা রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। সকলের গায়েই এখনো অনুষ্ঠানের পোশাক। মুহুর্তেই নিস্তব্ধ রাত মুখোরিত হয় তিন জোড়া কপোত-কপোতীর মিষ্টি আলাপে। এদের মধ্যে পৃথা, মধু আর শোভন মিলেই আড্ডা আরো বেশি জমিয়ে তুলেছে।

তরী আজ সোনালী রঙের মসলিন শাড়ি পড়েছে। শাড়ির গায়ে ডার্ক মেরুন রঙের পাথরের কারচুপি কাজ করা। আড্ডায় মশগুল পার্থের চোখ ঘুরে ফিরে বারবার তরীর দিকে গিয়ে ঠেকছে। আচমকা তার ধ্যান ভাঙে পৃথার ডাকে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় সে। পৃথা প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলে উঠে,

“ অনেকদিন তোর আর ছোট’দার সাথে গলা মিলিয়ে গান গাওয়া হয় না আমার। চল না এখন গান গাই। “

তূর্য এবং তরী অবাক হয়। এই তিন ভাই বোনই যে এতো গান পাগল তা তাদের জানা ছিলো না। তরী মনে মনে ভয় পায়। তার স্বামীর যেই বেহায়া প্লেলিস্ট তা যদি এখানে বেজে উঠে তাহলে সে লজ্জায় ছাদ থেকে লাফ দিবে। শোভন বলে উঠে,

“ কোনটা গাবি ডিসাইড কর। “

পৃথা দাঁত বের করে হেসে বলে,

“ আমাদের প্রিয় জ্যামিং সং। “

শোভন আর পার্থও একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। পৃথা মধুমিতা, তরী ও তূর্যের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ আমরা স্টার্ট করছি তোমরাও সাথে জয়েন করো। “

মুহুর্তেই তিন ভাই বোন পালাক্রমে গেয়ে উঠে,

“ দো লাফজ কি হে
বাত এক হি হে
কিউ দারমিয়া ফির
রুকি রুকি,
কেহ ভি না পায়ে
রেহ ভি না পায়ে
কিউ বেওয়াজা হে
ইয়ে বেবাসি। “

তিন ভাইবোন এতদূর গেয়ে বাকিদের দিকে তাকাতেই বাকিরাও হেসে তাদের সাথে গলা মিলায়,

“ তুম মে হাম হে,
হাম মে তুম হো,
তুমসে হাম হো,
হামসে তুম হো,
কিসমাতো সে মিলতে হে
দো দিল ইয়াহা।
হার কিসিকো নেহি মিলতা
ইয়াহা পেয়ার জিন্দেগী মে,
খুশ নাসিব হে হাম
জিনকো হে মিলি
ইয়ে বাহার জিন্দেগী মে। “

গলা ছেড়ে গান গাওয়া তিন যুগলের চোখে মুখেই অকৃত্রিম হাসি লেপ্টে আছে। গানের লাইনের অর্থ বুঝার সময় নেই কারো। সবাই ব্যস্ত মুক্ত তারার মেলার নিচে নিজেদের এই মুহুর্তটুকু উপভোগ করতে। সকলের কণ্ঠেই রাজ্যের উচ্ছ্বাস।

পৃথা গান গাইতে গাইতে তূর্যের একহাত জড়িয়ে ধরে তার কাধে মাথা রাখে। তূর্য আশেপাশে তাকিয়ে টুপ করে পৃথার কপালে নীরবে চুমু আকে। শোভন আর মধুমিতা ইতিমধ্যে গান গাইতে গাইতে একে অপরের চোখে হারিয়ে গিয়েছে। পার্থ সবার আড়ালে নিজের একহাত তরীর পিঠের পিছন দিয়ে নিয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথে তরী তার দিকে ফিরে তাকায়। পার্থ সেই চোখে চেয়ে থেকেই নিষ্প্রভ গলায় শুধায়,

“ আপনি হতে তুমিতে নেমে আসা উচিত আমাদের। তাই না তরী? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে