যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৯.
পার্থ দুঃসাহসিক কাজটা করে তরীর থেকে দুটো কঠিন কথা শোনার অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু যখন দেখে তার মাঝে তেমন কোনো হেলদোল নেই তখন বুঝতে পারে তরী ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। পার্থ হতাশ হয়। ডাক্তারকে তার আর লজ্জা দেওয়া হলো না। সে চুপচাপ আরো কিছুক্ষণ তরীর মাথায় পানি ঢেলে তারপর তাকে রুমে নিয়ে আসে।
__________
ভাগ্য ভালো থাকায় সেদিন রাতেই তরীর শরীরের তাপমাত্রা নেমে যায়। পরের দিনই তরী হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। যদিও আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগম তাকে ড্রাইভার নিয়ে বের হতে বলছিলো বারবার। কিন্তু পার্থ তাদের বলে দেয় তরীকে নিশ্চিন্তে একাই যেতে দিতে।
রাস্তায় জ্যাম প্রচুর। গতরাতের আকাশে জমে থাকা মেঘগুলো সড়ে এখন আকাশ পরিষ্কার দেখাচ্ছে। মাথার উপর তপ্ত সূর্যের তাপ চারিদিকে বিকিরিত হচ্ছে। তরী গাড়িতে বসে থেকেই এসি কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। অপেক্ষা করছে জ্যাম ছোটার।
স্টিয়ারিংয়ে নিজের চঞ্চল দু’হাত রেখে তরী বাহিরে দৃষ্টি বোলাচ্ছে। আচমকা তার পাশের গাড়িতে একটা পরিচিত মুখ দেখতে পায় সে। সাথে সাথে তরীর চঞ্চল হাত স্থির হয়ে যায়। সে সাথে সাথে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। জ্যাম ছুটতেই সাথে সাথে সে সেখান থেকে প্রস্থান করে হসপিটালে এসে পৌঁছায়।
কারো সাথে কথা না বলে সে সোজা চলে যায় নিজের কেবিনে। প্রচুর অস্থির অনুভব করছে সে। এক গ্লাস পানি খেয়ে নিজেকে ঠান্ডা করতেই তার কেবিনের টেলিফোনে কল আসে। তরী টেলিফোন তুলে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে বলে উঠে,
“ ডক্টর তরী, দেয়ার ইজ এ ইমারজেন্সি কেস। প্লিজ কাম টু দ্যা ইমারজেন্সি ইউনিট। “
তরী ফোন রেখে উঠে নিজের এপ্রোন গায়ে জড়িয়ে নেয়। টেবিল থেকে নিজের স্টেথোস্কোপ এবং ফোন তুলে নিয়ে ইমারজেন্সি ইউনিটের দিকে দৌড় দেয় সে।
ইমারজেন্সি ইউনিটে পৌঁছাতেই একজন নার্স তার দিকে তড়িঘড়ি করে দৌড়ে এসে বলে,
“ ম্যাম, পেশেন্টের নাম আইয়াদ জহির। বয়স ছয়। মেডিক্যাল সিম্পটমস… “
নার্সের কথা শুনতে শুনতে তরী ইমারজেন্সি ইউনিটের শেষ বেডটার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। কিন্তু বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার দু পা থমকে যায়। একটু আগে রাস্তায় যেই মানুষটাকে দেখে সে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এসেছিলো সেই মানুষটাই এখন তার সামনে দাঁড়ানো। বেডে শুয়ে থাকা ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটির একহাত ধরে ব্যস্ত সুরে বলছে,
“ সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। আরেকটু ওয়েট করো। “
তরী নিজেকে ধাতস্থ করে বেডের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠে,
“ বাচ্চার একমাস ধরে ব্রিথিংয়ে প্রবলেম হচ্ছে, আর আপনারা আজ হসপিটালে নিয়ে আসলেন? “
বেডের অপরপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো নর নারী হতবাক দৃষ্টিতে তরীর দিকে তাকায়। তরী সেদিকে তোয়াক্কা করে না। সে তার স্টেথোস্কোপটা পেশেন্টের বুকের বাম পাশে ধরে বেশ শান্ত গলায় বলে উঠে,
“ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নাও তো বাবু। “
বাচ্চাটা তার কথা অনুযায়ী কাজ করতেই তরী পাশে বোর্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলে। নার্স তরীর কথা শুনতে শুনতে ব্যস্ত হাতে কাগজে কিছু লিখতে থাকে। তরী এবার সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ কিছু টেস্টস করাতে হবে। আজকের মধ্যে টেস্টস করিয়ে নিন আপনারা। কাল যদিও আমার ওপিডি নেই। কিন্তু আপনারা কাল দুপুর দুটোর দিকে একবার রিপোর্টস কালেক্ট করে আমার সাথে দেখা করবেন। “
বেডের অপরপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটা বলে উঠে,
“ আপাতত কোনো মেডিসিন সাজেস্ট করবেন না? “
“ বাচ্চা মানুষ। প্রবলেম সম্পর্কে শিওর না হয়ে কোনো মেডিসিন দেওয়াটা ঠিক হবে না। “
কথাটুকু বলে তরী বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলে উঠে,
“ আইয়াদ বাবু। একমাস কষ্ট করেছো, আরেকটা দিন সহ্য করে নাও প্লিজ? আন্টি কালকে তোমার ব্যথা দূর করার মেডিসিন দিয়ে দিবো। ওকে? “
বাচ্চাটা ব্যাথাতুর মুখ নিয়েও মৃদু মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বলে। তরী হেসে আইয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। পিছনে রয়ে যায় বিস্মিত দুটো মুখ।
__________
দূরদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে পার্থ। তার পকেটে থাকা ফোন লাগাতার বেজে যাচ্ছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আসিফ বলে উঠে,
“ ভাই আপনার এই সিদ্ধান্তে দলের কেউ খুশি না। পার্টির উপর থেকে প্রেশার আসতাসে প্রচুর। এখন তো ভাবী ঠিক আছে। আপনার গুপ্তচরও চব্বিশ ঘণ্টা ভাবীর উপর নজর রাখতাসে। এখন নির্বাচন করলে কি সমস্যা? দল থেকে অন্য কোনো প্রার্থীরে নমিনি দেওয়ার আগেই আপনি আবার ইলেকশনে যোগ দেন। “
পার্থ শান্ত স্বরে বলে,
“ আমি কিছুক্ষণ কোলাহল মুক্ত পরিবেশে থাকতে চাই দেখে এতো দূর ড্রাইভ করে এলাম। তাই আমার কানের কাছে এখন চিল্লাচিল্লি করিস না প্লিজ। “
আসিফ চুপ হয়ে যায় সাথে সাথে। পার্থ বেশ ক্ষাণিকক্ষণ দূরে থাকা সারি সারি সবুজ জমির দিকে চেয়ে রয়। অত:পর হঠাৎ সামান্য হেসে বলে,
“ রুবেল এখন নিশ্চয়ই নিজের জয় উল্লাসে ব্যস্ত? “
আসিফ মুখ কালো করে বলে,
“ এইডা ছাড়া আর কি করবো হালায়। হালার একমাত্র শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিলেন আপনি। বাকি যেই কয়জন প্রার্থী আছে, হেরা ইলেকশন করলেও যা না করলেও তা। “
পার্থ পূণরায় হাসে। মুখে হাসি বজায় রেখেই সে বলে উঠে,
“ তাহলে ওকে আপাতত উল্লাস করতে দে। এই ক্ষণস্থায়ী সুখটা আপাতত ওকে উপভোগ করতে দেওয়াই শ্রেয়। কারণ এরপর ও আর জীবনে সুখের মুখ দেখতে পারবে না। “
আসিফের চোখ মুখ মুহুর্তেই জ্বলজ্বল করে উঠে। সে খুশিতে গদগদ হয়ে প্রশ্ন করে,
“ আপনি কি ওই রুবেলের মাথায় কদবেল ভাঙবেন নি ভাই? “
পার্থ আসিফের দিকে ফিরে মৃদু হাসে। অত:পর মুহুর্তেই তার চেহারার ভাবমূর্তি পরিবর্তন হয়। সে চোখ মুখ শক্ত করে বলে উঠে,
“ ও নিজেও জানে না যে ও কত বড় ভুল করেছে। ব্যাপারটা রাজনীতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে আমি হয়তো তবুও ওকে ছাড় দিতাম। কিন্তু বিষয়টা এখন পার্সেনাল হয়ে গিয়েছে। ওদিন রাতের তরীর চেহারা যতবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, ততবার আমার শরীরের রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ লোডেড রিভলবার দিয়ে যদি ওর সারা শরীর ছিন্নভিন্ন করতে পারতাম, তাহলে আমার এই রক্ত ঠান্ডা হতো। ও ভুল জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছে। “
আসিফ পার্থর কথা শুনতে শুনতে মাথা নাড়ে। হঠাৎ সে মুখ ফসকে বলে ফেলে,
“ আপনি আজকাল ভাবীর খুব চিন্তা করতেসেন ভাই। “
পার্থ আসিফের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ অন্যের বউয়ের চিন্তা করাটা আমার স্বভাবের সাথে যায় না। তাই নিজের বউয়ের চিন্তাই করছি। “
__________
তূর্য আজ কিছুটা তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরেছে। পৃথা সারাদিন বাসায় একা থাকে। আজ তূর্য প্ল্যান করেছে ওকে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে গেলে মন্দ হয়না। কলিংবেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিছুক্ষণের মাঝেই পৃথা উঠে এসে দরজা খুলে দেয়। তার দৃষ্টি হাতের ফোনের দিকে নিবদ্ধ। দরজা খুলে দিয়ে আবার ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখেই সে হাঁটতে হাঁটতে লিভিং রুম এরিয়ার দিকে চলে যায়। তূর্য অবাক হয়। এই মেয়ে ফোনের মাঝে এতটা বিভোর হয়ে গিয়েছে যে চোখ তুলে একবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তূর্যকে দেখলোও না।
তূর্য জুতা খুলে বাসায় প্রবেশ করতে করতে বলে উঠে,
“ মহারাণীর ফোন কি স্বামীর থেকে বেশি ইম্পোরট্যান্ট হয়ে গেলো? “
লিভিং রুমের সামনে আসতেই তূর্যর কথা থেমে যায়। সোফায় পৃথার সাথে হুমায়ুন রশীদও বসে আছেন। তূর্য মনে মনে ভাবলো পাপা আজ এতো তাড়াতাড়ি বাসায় কি করছে? হুমায়ুন রশীদ নিজের ফোনের স্ক্রিন থেকে ছেলের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে,
“ আমাদের এখন বিরক্ত করবে না। “
তূর্য ভ্রু কুচকে তাকায়। বিরক্ত করবে না মানে? কি এমন মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে তারা যে বিরক্ত করা যাবে না? তূর্য এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,
“ কি করছো তোমরা? “
পৃথা ফোন থেকে দৃষ্টি না তুলে বলে উঠে,
“ আমি আর পাপা গেমস খেলছি। সাবওয়ে সারফারস। মোটেও বিরক্ত করবেন না। গেম ওভার হলে আপনি রাতের খাবার পাবেন না। “
তূর্য তাজ্জব বনে যায়। এক সামান্য গেমসের জন্য তার বাপ আর বউ তাকে ইগ্নোর করছে? তূর্য কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,
“ পরে খেলো। আমরা এখন বাহিরে যাবো। “
পৃথা নাছোড়বান্দার ন্যায় বলে,
“ আমি এখন কোথাও যাবো না। “
হুমায়ুন রশীদের সামনে তূর্য চাইলেও বেশি কিছু বলতে পারছে না। সে রাগ নিয়ে উপরে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হুমায়ুন রশীদ ইচ্ছে করেই গেম ওভার করে বলে উঠে,
“ আজকের জন্য এতটুকুই থাকুক আম্মু। তোমরা এখন বাহির থেকে ঘুরে আসো। “
পৃথা বলে উঠে,
“ বাহিরে গেলে তিনজন একসাথেই যাই চলুন। “
“ উহু। আজকে তোমরা যাও। বিয়ের পর থেকে এভাবেও তোমরা একসাথে বাহিরে যাওয়ার সুযোগ পাও নি তেমন একটা। তূর্য যেহেতু আজকে ফ্রি আছে তাই এই চান্স মিস দিও না। “
পৃথা আর কথা বাড়ায় না। সে চুপচাপ উপরে চলে যায়। তূর্য সবেমাত্র গায়ের শার্ট খুলেছে। পৃথা তা দেখে বলে উঠে,
“ শার্ট খুলছেন কেন? বাহিরে না যাবেন? “
“ কেন? তোমার গেমস খেলা শেষ? “
“ হ্যাঁ। “
কথাটুকু বলেই পৃথা আবার বলে উঠে,
“ আচ্ছা, পাপাও আমাদের সাথে চলুক? “
তূর্য হেসে বলে,
‘’ হ্যাঁ, শিওর। শুধু পাপা কেন? তোমার আব্বা, আম্মা, বড় দা, ছোট দা আর তোমার বড় ভাবী ওরফে আমার আপিকেও সাথে নিয়ে যাই ডেটে? “
তূর্য যে মশকরা করে কথাটা বলেছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়না পৃথার। সে মুখ ফুলিয়ে ক্লসেট থেকে নিজের একটা শাড়ি বের করতে এগিয়ে আসে। হঠাৎ সে বিস্ময় নিয়ে তূর্যর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“ ওয়েট, ডেট মানে? “
তূর্য এগিয়ে এসে পৃথার সামনে দাঁড়ায়। পৃথার পিঠ তখন ক্লসেটের সাথে ঠেকে রয়েছে। তূর্য মাথা সামান্য ঝুকিয়ে বলে উঠে,
“ বিয়ের পর স্ত্রীর পাশাপাশি প্রেমিকা হতে কি আপনার আপত্তি আছে ম্যাডাম? “
পৃথা মৃদু মাথা নেড়ে না বলে। তূর্য একইভাবে বলে উঠে,
“ সো মিস পৃথা মুমতাহিনা চৌধুরী, আ’ম টেকিং ইউ অন এ ডেট টুনাইট। গেট রেডি নাও। “
কথাটা বলে তূর্য চলে যাচ্ছিলো। পৃথা পিছন থেকে বলে উঠে,
“ আমি আপনার বাইকে করে যাবো। “
তূর্য পিছনে না ফিরেই জবাব দেয়,
“ এজ ইউর উইশ। “
__________
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে তরীর মুখোমুখি বসে আছে আয়রা এবং সাদ। তরীর হাতে তাদের ছেলে আইয়াদের রিপোর্ট। ইকো কার্ডিওগ্রামের রিপোর্টটা বিচক্ষণ নজরে দেখছে তরী। রিপোর্ট দেখা শেষ হতেই তরী আইয়াদের মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ দেয়ার ইজ এ হোল ইন আইয়াদ’স হার্ট। “
আয়রা সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সাদ চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করে,
“ এটার কোনো ট্রিটমেন্ট আছে? “
“ দেখুন, একোর্ডিং টু দ্যা রিপোর্ট এই হোলের সাইজ মোটামুটি বড় আকারের। আপনারা মানসিক ভাবে শক্ত থাকুন। প্রয়োজন পড়লে সার্জারি করতে হতে পারে। “
আয়রা কান্না জর্জরিত গলায় বলে উঠে,
“ আমার বাচ্চার শরীরে আমি কোনো কাটাছেঁড়া সহ্য করতে পারবো না সাদ। প্লিজ অন্য কোনো উপায় বের করো। মেডিসিন দিয়ে ওকে সুস্থ করা যাবে না? “
আয়রার কান্না দেখে তরীর মায়া হয়। অতীতে যতো তিক্ত স্মৃতিই থাকুক না কেন, এই মুহুর্তে তার সামনে এই মানুষ দুটো কেবলমাত্র তার পেশেন্টের গার্ডিয়ান। সেই হিসেবে মানবতা থেকেই তার মাঝে খারাপ লাগা কাজ করছে। তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ শুধুমাত্র মেডিসিন দ্বারা ট্রিট করার স্টেজে নেই কেসটা। অপারেশন ইজ মাস্ট রাইট নাও। কিন্তু তার আগে আই নিড টু ডিসকাস দ্যা কেস উইথ মাই সিনিয়র কার্ডিওলজিস্টস। উনাদের অপিনিয়নের প্রয়োজন পড়বে আমার। আপনারা আগামী সোমবার আমার সাথে দেখা করতে আসুন। আর প্লিজ আইয়াদকে জোর করে হলেও আনার, বিটরুট, আপেল আর খেজুরটা বেশি করে খাওয়ান এর মাঝে। ওর সিবিসি রিপোর্টে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম। হিমোগ্লোবিন লো থাকলে সার্জারি করা পসিবল হবে না। “
সাদ এবং আয়রা চলে যেতেই তরী আইয়াদের কেস নিয়ে হুমায়ুন রশীদ এবং আনিকা রহমানের সাথে ডিসকাস করে। সব রিপোর্টস দেখে তারাও সাজেস্ট করে সার্জারি করার জন্য। হুমায়ুন রশীদ তরীকে একা পেয়ে প্রশ্ন করে,
“ পেশেন্টের গার্ডিয়ানের নাম আমি লক্ষ্য করেছি। তুমি আমাকে আগে বলো নি কেন? “
“ তারা সাদ এবং আয়রা হিসেবে আমার কাছে আসে নি পাপা। আইয়াদের পেরেন্টস হিসেবে এসেছে। এজ এ ডক্টর আমি শুধু নিজের কাজটুকু করছি। ব্যক্তিগত ব্যাপারে তাদের সাথে আমি কোনো কথাই বলি নি। “
হুমায়ুন রশীদ চোখ ছোট করে প্রশ্ন করে,
“ তোমার খারাপ লাগছে না প্রিন্সেস? “
“ মোটেও না পাপা। ওরা আমার পাস্টের এমন একটা চ্যাপ্টার যেটা আমি অনেক আগেই ছিড়ে ফেলে দিয়েছি। আমি এখন বিবাহিত। আরেকজনের স্ত্রী হয়ে নিজের এক্সকে মনে করে কষ্ট পাওয়ার শিক্ষা আমাকে দাও নি তুমি। “
হুমায়ুন রশীদ কিছু না বলে নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। এটাই শুনতে চাচ্ছিলো সে। তরী নিজের পাপার বুকে মুখ গুজে বলে উঠে,
“ ওরা আমার সাথে যাই করে থাকুক না কেন পাপা, আমি তবুও ওদের ছেলের সার্জারিটা করবো। এসবে তো ওদের ছেলের কোনো দোষ নেই। তাই না? আই’ল ট্রিট হিম রাইট। “
“ আই নো মা। “
__________
রাত বেড়েছে। তরী ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চলছে ওয়ান ডিরেকশনের বিখ্যাত বেস্ট সং এভার গানটি। স্যান সিরো স্টেডিয়ামে এই গানের লাইভ পারফরম্যান্সটা তরীর খুব প্রিয়। ছোট বেলা থেকেই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে সময় পেলে ওয়ান ডিরেকশনের গান শুনে সময় পাড় করতো। কালের বিবর্তনে ওয়ান ডিরেকশনের মেম্বারদের মধ্যে ভাটা পড়লেও তরীর এই অভ্যাসে কোনো পরিবর্তন আসে নি।
পার্থ সবেমাত্র রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকেছে। ভিতরের বেডরুম হতে গানের আওয়াজ পেতেই সে ভ্রু কুচকে তাকায়। ধীর পায়ে হেঁটে বেডরুমে পা রাখতেই দেখে তরী ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চলমান গানের লিরিক্সের সাথে হালকা ঠোঁটও নাড়াচ্ছে।
পার্থ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতঘড়ি খুলতে খুলতে বলে উঠে,
“ কি দেখছেন? “
তরী স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই জবাব দেয়,
“ হ্যারিকে। “
পার্থ ভ্রু কুচকে পিছনে ফিরে তাকায়। হ্যারি মানে? কিসের হ্যারি? কোথাকার হ্যারি? হ্যারি পটার? পার্থ তরীর পাশে বেডসাইড কেবিনেটের উপর নিজের ফোন রাখার বাহানায় এসে স্ক্রিনের দিকে সামান্য উঁকি মারে। এই ব্যান্ডের গান তার কখনো শোনা হয় নি। ইংরেজি গান কখনোই তার তেমন একটা পছন্দ ছিলো না। পার্থ কপালে ভাজ নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ এখানে তো স্টেজে পাঁচটা হাটুর বয়সী ছেলে বাদরের মতো লাফালাফি করছে। এদের মধ্যে হ্যারি কে? “
পার্থর কথা শুনতেই তরীর হাস্যজ্বল মুখ বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। সে বিরক্তিকর সুরে বলে,
“ আপনার তা দিয়ে কি আসে যায়? নিজের বালিশ নিয়ে এই রুম থেকে বিদায় হোন। আর কখনো ওয়ান ডি নিয়ে আমার সামনে আজেবাজে বকবেন না। “
পার্থ নিজের গায়ের পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে বলে উঠে,
“ আপনার সং টেস্ট খুব বাজে। “
পার্থর কথায় যেনো তরীর গায়ে আগুন ধরে যায়। সে ল্যাপটপ রেখে এক লাফে বিছানা ছেড়ে নেমে বলে,
“ এই! সমস্যা কি আপনার? আমার সং টেস্ট বাজে? আর নিজে সেদিন রাতে আমাকে ওয়াশরুমে কিসব গান শোনাচ্ছিলেন হ্যাঁ? আপনি নিজেও দেখতে যেমন আপনার গানের টেস্টও তেমন। “
কথাটা শুনে পার্থ এগিয়ে আসে তরীর দিকে। শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“ কেমন দেখতে আমি? “
“ একদম গরুর মতো। ষাড় গরু। “
তরী কথাটুকু বলতেই তার ফোন বেজে উঠে। সে আর কোনো কথা না বলে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। পার্থ ঘাড় ঘুরিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে একবার নিজেকে দেখে নেয়। তার মেদহীন উন্মুক্ত সুঠাম দেহ দেখেও এই মহিলা তাকে গরু বলতে পারলো? যেখানে তার দলের সবাই বলে বেড়ায় যে তাকে নাকি সাউথ ইন্ডিয়ান হিরোদের মতো লাগে সেখানে তার বউ রাত বিরাতে তাকে গরু বলে অপমান করবে, এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। পার্থ বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
“ ছোট বেলায় মনে হয় শশুর আব্বা ডাক্তার সাহেবাকে ছোট মাছ খাওয়ায় নি। এজন্যই তো নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষকে গরু বলার দুঃসাহস দেখিয়েছে এই নারী। “
তরী বারান্দায় এসে কল রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসে,
“ আমার কর্মের শাস্তি কি আমার বাচ্চা পাচ্ছে তরী? “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]
যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২০.
হঠাৎ মধ্যরাতে সাদের এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে তরী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অত:পর নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দেয়,
“ বাচ্চাটা নিষ্পাপ। একটা নিষ্পাপ বাচ্চার অসুস্থতাকে অভিশাপ হিসেবে না ভেবে তার শেফার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করো। “
“ এই বাচ্চার জন্যই তো সাত বছর আগে আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আয়রাকে বিয়ে করি। তোমার কি আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণ হিসেবে ওকে দায়ী মনে হয়না? “
তরীর মেজাজ খারাপ হয়। এতো বছর পর অতীত খুড়ে তার সামনে তুলে ধরে কি প্রমাণ করতে চাইছে সাদ? যে সে অনুতপ্ত? তরী কঠিন গলায় বলে উঠে,
“ তোমার আর আমার সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণ আইয়াদ ছিলো না, বরং তুমি নিজে ছিলে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে মিলে আমার উপর চিট করার সময় একবারও তোমার মনে পড়ে নি যে তুমি কমিটেড কারো সাথে? “
এতটুকু বলে তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেসব পুরনো কথা সে আর মনে করতে চায় না। তাই ঠান্ডা গলায় বলে,
“ তোমার এবং আয়রার সাথে বর্তমানে আমার শুধু একটাই সম্পর্ক আছে। সেটা হলো যে তোমরা আমার পেশেন্টের গার্ডিয়ান। তাই আমার সাথে তোমাদের যোগাযোগটা কেবল হসপিটাল পর্যন্তই যেন সীমাবদ্ধ থাকে। ফার্দার এরকম আউট অফ নো হোয়ার আমাকে আর কল করবে না। মাঝ রাত্রে অন্য কারো স্ত্রীকে কল করা মোটেও কোনো ভদ্রলোকের কাজ না। “
কথাটুকু বলেই তরী ফোন কেটে দেয়। তার এতক্ষণের ফুরফুরে মেজাজটা ইতিমধ্যে এই ফোন কলের মাধ্যমে সাদ নষ্ট করে দিয়েছে। বিরক্তি নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই দেখে পার্থ রুমে নেই। বিছানার এক কোণে একটা বালিশও উধাও। তরী ফোন রেখে দরজা ভিতর থেকে লক করার জন্য এগিয়ে যায়। দরজার রূপালী রঙের নবটা ধরেও হঠাৎ তার হাত থেমে যায়। কৌতূহল বসত সামান্য উঁকি দিয়ে বাহিরে তাকায়। পার্থ অলরেডি পাঞ্জাবি বদলে একটা টি শার্ট গায়ে জড়িয়েছে। সিটিং এরিয়ার একপাশের ল্যাম্পের আবছা আলোতেও তার ঘুমন্ত মুখশ্রী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সোফায় সোজা হয়ে শুয়ে একহাত দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে রয়েছে সে।
তরী পা টিপে টিপে সোফার দিকে এগিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে যখন নিশ্চিত হয় যে পার্থ ঘুমোচ্ছে তখন দুই হাঁটু গেড়ে সোফার সামনে বসে সে। তার পিঠ ঠেক খেয়ে আছে ছোট টি টেবিলের সাথে। এক পলকে সে পার্থর দিকে তাকিয়ে রয়। মনে মনে তার হাজার হাজার ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। ভালো তো সে একবার বেসেই ছিলো। কিন্তু সেই ভালোবাসা তার সাথে প্রতারণা করে। সেই প্রতারণার ধাক্কা সামলে উঠে তরী সিদ্ধান্ত নেয় নিজের মনের দ্বার চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিবে। সময়মতো পাপার পছন্দের কোনো ভালো ছেলেকে বিয়ে করে নিবে। তখনই তার জীবনে ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় আগমন হয় পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর। কিছু বুঝে উঠার আগেই তার জীবন বাঁধা পড়ে এই ভদ্র মুখোশধারী প্রতারকের সাথে।
এরকম কেন হচ্ছে তার সাথে? আজীবন মেডিক্যাল টেস্টের জন্য প্রিপারেশন নিতে ব্যস্ত তরী যদি আগে জানতো তার লাইফ এতটা মেসড আপ হয়ে যাবে, তাহলে বায়োলজির বদলে সারাদিন লাইফ লেসনের বই নিয়ে বসে থাকতো সে। এই মুখোশধারী প্রতারকের সাথে সারাটা জীবন কিভাবে পাড় করবে সে? কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই তার। নিজের নামের পাশে ডিভোর্সী ট্যাগ লাগিয়ে তার পাপাকে সে আরও কটু কথা শোনার সুযোগ করে দিতে চায় না। ইতিমধ্যে তার সেই এনগেজমেন্ট ভাঙার পর থেকে তার আত্মীয় স্বজন সবাই ঘুরে ফিরে তরীর মধ্যেই দোষ খুঁজে বেড়ায়। সুযোগ পেলেই তার পাপাকে এই টপিক তুলে পিঞ্চ করতেও ভুলতো না তারা। এই একই পরিস্থিতিতে তরী আর পড়তে চায় না। তার কাছে তার পাপার সম্মান সবার আগে। তার বদলে এরকম একটা স্ক্রাউন্ডেলকে তার সারাজীবন সহ্য করতে হলে সে সেটাও করতে রাজি।
ভাবনার দেশ থেকে ফিরে আসতেই তরী সাথে সাথে উঠে ভিতরে বেডরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। এতক্ষণ ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকা পার্থ এবার চোখের উপর থেকে নিজের ডান হাত সরিয়ে বেডরুমের দরজার দিকে তাকায়। অত:পর বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
“ আমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হলে নিজেকে বেঁধে রাখবেন না তরী। এতে আমাদের জীবনই সহজ হয়ে যাবে। বিশ্বাস রাখুন আপনার ভালোবাসার প্রতিদান দিতে মোটেও কার্পণ্য করবে না এই পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। “
__________
শোভন সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে হাতের মোটা ফাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাইলটা মূলত রিসেন্ট ঘটে যাওয়া একটা রহস্যময় ডেথ কেসের ব্যাপারে। সপ্তাহ তিনেক আগেই বনানীর একটা ম্যানহোল হতে একটা লাশ উদ্ধার করে তারা। পোস্ট মার্টাম রিপোর্ট অনুযায়ী এটা একটা মার্ডার কেস। কিন্তু হাজার তল্লাশী চালিয়েও এই মার্ডার কেস রিলেটেড কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছে না তারা। সামনে ইলেকশন। এখন এরকম একটা কাজ কোনো পার্টি ইচ্ছে করে ঘটায় নি তো?
শোভনের গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সে এতটুকু জানে যে এই ইলেকশন হলো ক্রাইমের একটা পিক মোমেন্ট। এই সময়টায় দেশের ভেতর অনেক বড় বড় অপরাধ ঘটে যায়। আর সেই অপরাধ গুলো ধামাচাপা দেওয়ার জন্য অপরাধীরা এই ধরনের কাজ করে থাকে। পুলিশ, সাংবাদিক, মিডিয়া সবাই যখন ব্যস্ত থাকে এরকম রহস্যময় কেস সলভ করার জন্য, তখন মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতার দাপটে বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়ায়।
কিন্তু এই কেসটা এতো সহজে ছেড়ে দিবে না শোভন। প্রত্যেক ক্রিমিনালই নিজের কোনো না কোনো ক্লু রেখেই যায়। একবার সেই ক্লু ধরে এই কেস সলভ করতে গেলেই অনেক কিছুর খোলাসা হয়ে যাবে। শোভন কেবল একটাই দোয়া করছে। সেই মিসিং ক্লু যেন সামনের মাসের ইলেকশন এবং তার বিয়ের আগেই সে পেয়ে যায়।
শোভনের গভীর মনযোগের বিঘ্ন ঘটে ফোনের রিংটোনের শব্দে। সে ফাইলটা বিছানার একপাশে রেখে ফোন রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে হাস্যজ্বল রিনঝিন স্বর বলে উঠে,
“ ডিউটি টাইম শেষ হলে আমাকেও একটু সময় দিন জনাব। “
“ ডিউটি টাইম শেষ হতে হয়? আপনি একবার বলে দেখুন ডিউটির মাঝেও আপনার জন্য সময় বের করে ফেলতে পারি আমি। “
মধুমিতা শব্দ করে হেসে উঠে। অত:পর খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“ আমি খুব জরুরি একটা কথা বলার জন্য কল করেছি। এই মাঝরাতে খুব বড় এক ডিসিশন নিয়েছি আমি। “
শোভন ভ্রু কুচকে বলে উঠে,
“ দেখো মধু, লাস্ট মোমেন্টে এসে যদি তুমি বলো আমার মতো সাধারণ ডিউটিওয়ালাকে তুমি বিয়ে টিয়ে করবে না তাহলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে। সোজা তুলে নিয়ে হাজতে আটকে দিবো। তখন তোমার জামিনের জন্য কেবল একটাই উপায় খোলা থাকবে। সেটা হলো তিন বার কবুল বলা। “
শোভনের কথায় ফুল স্টপ বসিয়ে মধু বলে উঠে,
“ এই! থামো, থামো। চেন্নাই এক্সপ্রেসের মতো চলা শুরু করেছো, কোনো থামার নাম নেই। পুরো কথা না শুনেই তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছো। দাদার ধারা বজায় রাখার ইচ্ছে আছে নাকি? “
“ প্রয়োজন হলে তা-ই করবো। ইভেন আমার ছেলে, ভাতিজা, ভাগিনাকেও শিখিয়ে দিবো কিভাবে সাহসিকতার সাথে পছন্দের নারীকে তুলে বিবাহ করিতে হয়। “
“ আর ধরো উল্টো হলো। তোমার মেয়ে, ভাতিজি এবং ভাগ্নীকে কেউ তুলে নিয়ে বিয়ে করলো? “
শোভন কিছুটা গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়,
“ ডিরেক্ট ক্রস ফায়ার করে দিবো শালাকে। “
“ এই যাহ! নিজেদের বেলায় ষোল আনা আর অন্যের বেলায় ক্রস ফায়ার। তুমি তো পুরাই একটা থাঙ্গাবালী। “
শোভন ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
“ থাঙ্গাবালী কে? “
“ আরেএ! চেন্নাই এক্সপ্রেসের ভিলেন। “
শোভন চেন্নাই এক্সপ্রেসকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বলে উঠে,
“ তুমি কি জরুরি কথা বলতে চাইছিলে? “
“ ধ্যাৎ! এখন আর বলার মুড নেই। কাল বলবো। “
__________
নিজের কেবিনে বসে ফোনে কারো সাথে কথা বলতে ব্যস্ত তরী। টেবিলের উপর রাখা ফাইলটার দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। কেবিনের দরজায় নকের শব্দ হতেই তরী চোখ তুলে তাকায়। একজন ওয়ার্ড বয় একটা কফির মগ ট্রে-তে করে নিয়ে প্রবেশ করে। তরী ফোন রেখে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“ সুগার ফ্রি তো? “
“ হ্যাঁ ম্যাডাম। “
কথাটুকু বলতে বলতে সে ট্রে হতে কফির ওয়ান টাইম কাপটা নামিয়ে তরীর সামনে রাখে। অত:পর ভদ্রতার সুরে প্রশ্ন করে,
“ আর কিছু লাগবে ম্যাডাম? “
তরী কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে বলে উঠে,
“ আমার কেবিনের কফি মেকারটা সরিয়ে ফেলো। নষ্ট হয়ে গিয়েছে। গতকাল থেকে কাজ করছে না। “
“ আচ্ছা ম্যাডাম। আমি কাউকে পাঠিয়ে দিবো পরে এটা নিয়ে যাওয়ার জন্য। “
“ যেতে পারো এখন। “
তরী ঘড়ির কাঁটার দিকে সময় দেখতে দেখতে তাড়াতাড়ি কফি শেষ করে। সকাল ৮ টা বাজে আইয়াদকে ওটিতে নেওয়া হবে। এখন বাজে ৭ টা ১৫। লম্বা সময়ের কোনো সার্জারিতে যাওয়ার আগে তরী সবসময় কফি খেয়ে নেয়। এতে ওটিতে থাকা অবস্থায় কখনোই ঘুম ঘুম ভাব অনুভব করে না সে।
__________
আইয়াদের মতো এরকম সেম কেসের সার্জারি করার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে তরীর। তাই এই সার্জারির মূল দায়িত্বে সে নিজেই আছে। সঙ্গে রয়েছে আরো কয়েকজন ডক্টর তাকে এসিস্ট করার জন্য। ইতিমধ্যে এনেস্থিসিয়ার সাহায্যে আইয়াদকে সেন্সলেস করা হয়েছে। সার্জারি শুরু হওয়ার পর প্রথম আধা ঘণ্টা সব স্মুথলি যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই তরীর মাথা ঝিমঝিম করে উঠে। চোখের সামনে সব এক মুহুর্তের জন্য ঝাপসা হয়ে আসে তার। সাথে সাথে আইয়াদের উন্মুক্ত বুকে তার হাতে থাকা স্ক্যালপেলের গতি স্থির হয়ে যায়। তরীর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ডক্টর ফাবিহা বলে উঠেন,
“ ডক্টর? এভ্রিথিং অলরাইট? “
তরী নিজের স্তম্ভিত ফিরে পায়। সে মাথা নেড়ে বুঝায় যে সব ঠিক আছে। আবার সার্জারিতে মন দেয় সে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে তরী অনুভব করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওটিতেও তার অত্যাধিক গরম লাগছে। কান ঘাড় দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। গলাও শুকিয়ে প্রচুর তেষ্টা পাচ্ছে। তরী কিছু বলবে তার আগেই আবার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে তার। ঠিক সেই মুহুর্তেই তার দ্বারা তার ক্যারিয়ারের সবথেকে বড় ভুলটা হয়। তার হাতে থাকা স্ক্যালপেল দ্বারা ভুল করে হার্টের রক্ত সঞ্চালনের ভেইন কেঁটে ফেলে সে। মুহুর্তেই ফিনকি দিয়ে রক্তপাত শুরু হয়। এই দৃশ্য দেখে অন্য ডাক্তাররা আতংকিত হয়ে আর্তনাদ করে উঠে। কিন্তু সেই আর্তনাদের আওয়াজ তরীর কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। তার আগেই সে চেতনা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
__________
তরীর পাশে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে পার্থ। ঘন্টা খানিক আগে হসপিটাল থেকে তার কাছে কল আসে যে তরী হসপিটালে সার্জারী চলাকালীন অবস্থায় সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। সাথে সাথে পার্থ নিজের হাতের সব কাজ ফেলে হসপিটালে আসে। হুমায়ুন রশীদ এখনো হসপিটালে পৌঁছায় নি। কিন্তু উনার কাছেও ইতিমধ্যে খবর পৌঁছে গেছে।
চেতনা ফিরে পেতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় তরী। চোখের সামনে এখনো সব ঝাপসা দেখছে সে। ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে সব পরিষ্কার হয়ে উঠে তার। মস্তিষ্ক এবং চেতনাবোধ সজাগ হয়। সাথে সাথে সম্পূর্ণ শরীরে এক বিভৎসকর ব্যাথা অনুভব করে সে। তরী ব্যথায় কুকড়ে উঠে আর্তনাদ শুরু করে। পার্থ সাথে সাথে এগিয়ে এসে তার পাশে বসে তার এক হাত ধরে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন শুরু করে,
“ কি হয়েছে তরী? কষ্ট হচ্ছে? আমাকে বলুন। “
তরী জবাব দিতে পারে না। শরীরে হাজারটা সূঁচ বিধার যন্ত্রণা টের পাচ্ছে সে। একপাশে ফিরে সে আরেকটু কুকড়ে চিৎকার করা শুরু করে। পার্থ আচমকা পরিস্থিতিতে বিস্মিত হয়ে পড়ে। সে সাথে সাথে ইমার্জেন্সি নার্সকে কল করে তরীকে পিছন থেকে জাপ্টে ধরে। মুহুর্তেই কক্ষে একজন ডক্টর এবং নার্স প্রবেশ করে। এই অবস্থা দেখে তারাও ভয় পেয়ে যায়। ডক্টর রাগী সুরে বলে উঠে,
“ উনার রিপোর্টস কোথায়? এখনো পৌঁছায় নি কেন? “
“ আমি এখনই পাঠাতে বলছি ডক্টর। “
বলে নার্স দৌড়ে বেরিয়ে যায়। তরী চিৎকার করতে করতে পার্থর একহাত শক্ত করে জাপ্টে ধরে। তার নখের আঁচড়ে পার্থর হাতের উপরের পিঠের সামান্য অংশ কেঁটে যায়। পার্থ সেদিকে তোয়াক্কা না করে রাগী স্বরে ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
“ কিছু করছেন না কেন? যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। পেইনকিলার ওর সামথিং কোনো মেডিসিন দেন। “
সেই মুহুর্তে রুমে প্রবেশ করে হুমায়ুন রশীদ। মেয়ের খবর পেতেই তিনি ছুটে হসপিটাল এসেছেন। স্ব চক্ষে নিজের মেয়ের এই অবস্থা দেখে উনি বাকরুদ্ধ। এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“ প্রিন্সেস? কি হচ্ছে মা? পাপাকে বলো। পাপা এসে পড়েছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। “
হুমায়ুন রশীদের কথা থামে নার্সের আগমনে। নার্স এগিয়ে এসে ডক্টরের হাতে ব্লাড রিপোর্টস দিতেই তিনি বিচক্ষণ চোখে একবার সেটাতে নজর বুলিয়ে বিস্মিত গলায় বলে উঠে,
“ দেয়ার ইজ ড্রাগস ইন হার ব্লাড। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]