যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১১.
গতকাল রাতের বন্দী সেই তিন ছেলের উপর এতক্ষণ পাষবিক অত্যাচার চালিয়েছে পার্থ। তার সম্পূর্ণ শরীর ঘামে জর্জরিত। একটা চেয়ারে বসে সে পানির বোতল থেকে কিছুটা পানি খেয়ে নেয়৷ অত:পর শামীমের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ যেকোনো সরকারি হাসপাতালে নিয়ে এখন ভর্তি করিয়ে দে। আর মুখ যেন জীবনে না খুলে। “
শামীম সহ আরো কয়েকজন মিলে ছেলেগুলোকে টেনে তুলে নিয়ে যেতে নিলেই পার্থ সেই ছেলেগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
“ আমার আজাব থেকে তো বেঁচে গেলি। কিন্তু যেই মহিলার নিষ্পাপ ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছিস সেই মহিলার বদদোয়া হবে তোদের সবথেকে বড় শাস্তি। জাহান্নামও নসিব হবে না তোদের। “
ছেলেগুলোকে নিয়ে যেতেই পার্থ চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজে রয়। কালকে থেকে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনার রাগ ঝেড়ে এখন কিছুটা হালকা লাগছে তার। একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো তাকে বেশ পীড়া দিচ্ছিলো। পার্থর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আসিফ বলে,
“ ভাই আপনে এখন বাসাত যান। অনেক ক্লান্ত লাগতাসে আপনারে। দুইদিন ধইরা ঘুমাইতাসেন না। “
পার্থ চোখ বুজে রেখেই মৃদু হাসে৷ অত:পর প্রশ্ন করে,
“ তোর কি আমাকে খারাপ মনে হচ্ছে না আসিফ? জোর করে ডাক্তার সাহেবাকে বিয়ে করলাম নিজের লাভের জন্য। আমার ব্যক্তিগত ঝামেলার বলিদান আমার বোন হলো। সবকিছুর জন্য আমি দায়ী না? “
“ ভাই আপনি যা করসেন একদম ঠিক করসেন। অপরাধীগোরে যদি আইন শাস্তি না দেয় তাইলে নিজেগোই হেই শাস্তি দিয়া দেওন উচিত। কালকা ভাবীরে যদি না আটকাইতেন তাইলে উনি এই সব ফাঁস কইরা দিতো। আর তখন ক্ষমতাশীল দলরা এইডার ফায়দা নিতো। কেউ কখনো জানার চেষ্টা করতো না আসল অপরাধী কে। কেউ জানলেও বিষয়ডা ধামাচাপা দিয়া দিতো। সবার কাছে আপনেরে কালার করতো। “
“ আর এখন যা করছি তা ঠিক করছি আমি? একজনকে জোর করে বিয়ে করলাম। আমিতো এখনো এটাও জানিনা সারাজীবন এই বিয়ে কিভাবে চালাবো আমি। আর আমার বোনেরই বা কি হবে? “
“ বিয়া তো একখান ফরজ কাম। আজকে হোক কালকে হোক এইডা আপনার করতেই হয়তো। হ, একটা ছোট সমস্যা আছে। হেইডা হইলো ভাবী হইসে ধানী মরিচের মতো। কিন্তু আপনেও বা কম কিসে? নায়কের মতো সুন্দর দেখতে। দুইদিন পরেই দেখবেন ভাবী আপনার প্রেমে পইড়া গড়াগড়ি খাইবো৷ তখন আর আপনার সংসার করতে অসুবিধা হইবো না। “
আসিফের কথা শুনে পার্থ হাসে। এর মাঝেই আসিফের ফোন বেজে উঠে। ফোনে শোভনের নাম দেখতেই আসিফ বলে,
“ শোভন ভাই কল দিতাসে। “
“ রিসিভ কর। “
আসিফ ফোনে কথা শেষ করেই আতংকিত সুরে বলে উঠে,
“ ভাই, পৃথা নাকি সিঁড়ি থেইক্যা পইড়া গেসে। আপনার আব্বা, আম্মা সবাই তরী ভাবীগোর বাসায় যাইতাসে। আপনারেও যাইতে কইসে। “
বোনের কথা শুনতেই পার্থ আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। সোজা দৌঁড়ে বেরিয়ে যায় তরীদের বাসার উদ্দেশ্যে।
__________
তূর্যের গালে থাপ্পড়টা পড়তেই সে বিস্ফোরিত গলায় উচ্চারণ করলো,
“ পাপা! “
হুমায়ুন সাহেব বেশ ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। কিন্তু আপাতত উনার সম্পূর্ণ শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছে। হাতের ল্যাগেজটা বাইরে ফেলেই তিনি হনহনিয়ে লিভিং রুমে প্রবেশ করেন। তূর্য সেই ল্যাগেজটা দরজার ভিতরে টেনে এনে দরজা লাগিয়ে দেয়। হুমায়ুন রশীদ ক্রোধান্বিত স্বরে বলে উঠে,
“ খুব লায়েক হয়ে গিয়েছো তুমি? আমাকে না জানিয়ে বিয়ে সেড়ে ফেলছো আর তা আমার জানতে হচ্ছে হয় এলাকার মানুষদের ফোনকল থেকে নাহয় দাঁড়োয়ানের কল থেকে। “
তূর্য কিছু বলে না। চুপচাপ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়। হুমায়ুন রশীদ গর্জন করে উঠে,
“ তরী কোথায়? নিশ্চয়ই ও নিজেও এসবে জড়িত। এজন্যই আজ সারাদিন আমার ফোন রিসিভ করছে না। কল দাও ওকে এক্ষুণি। হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরতে বলো। তোমাদের দুই ভাই বোনের সাথে আজ আমার বোঝাপড়া আছে। “
তূর্য শান্ত স্বরে জবাব দেয়,
“ আপি হসপিটালে নেই। “
“ তাহলে কোথায়? “
“ নিজের শশুড়বাড়ি। “
হুমায়ুন রশীদের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সড়ে গিয়েছে। এসব কি হচ্ছে? উনি কিছু বলবে তার আগেই আবার কলিংবেল বেজে উঠে। তূর্য এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই অবাক হয়। তরী এসেছে! সাথে পিছনে মানুষ গুলো কে হতে পারে তা-ও বুঝতে অসুবিধে হয় না তার। তরী তূর্যর দিকে এক মুহুর্ত তাকিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। তার পিছু পিছু আফজাল সাহেব, সাদিকা বেগম এবং শোভনও প্রবেশ করে। সকলেই তূর্যকে আড়চোখে দেখছিলো। তরী ভিতরে প্রবেশ করতেই অবাক হয়। লিভিং রুমে তার পাপা দাঁড়িয়ে! এতদিন পর নিজের পাপাকে দেখে সে দৌঁড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। আদুরে গলায় বলে উঠে,
“ আই মিসড ইউ সো মাচ পাপা। “
দৃশ্যটা দূর হতে দেখেন আফজাল সাহেব। তার অশান্ত দৃষ্টিও নিজের মেয়েকে খুঁজতে ব্যস্ত। হুমায়ুন সাহেব সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে,
“ সব কিছু আমাকে খুলে বলো। আমার অনুপস্থিতিতে আমার ছেলে মেয়ের জীবনে কি হয়েছে আমি সব জানতে চাই৷ “
তরী হুমায়ুন সাহেবকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ আপনারা বসুন। আমি পৃথাকে ডেকে নিয়ে আসছি। “
কথাটা বলতে বলতেই পৃথাকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে দেখা যায়। সে কলিংবেলের শব্দ শুনে কৌতূহল বসত বেড়িয়েছে রুম থেকে। হুমায়ুন সাহেব সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা নিজের পুত্রবধূকে দেখে বিস্মিত হয়। এটাই কি সেই মেয়ে যাকে তার ছেলে বিয়ে করে এনেছে? শভ্র আলতা মিশ্রিত গায়ের রঙের মেয়েটার চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া কোনো কিশোরী।
পৃথাকে দেখতে পেয়েই সবার আগে সাদিকা বেগম ছুটে যায় মেয়ের দিকে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে উনি কান্না জুড়ে বসে। মায়ের ছোঁয়া পেয়ে পৃথাও ঠোঁট উল্টে গুটিসুটি মেরে মায়ের বুকে পড়ে রয়।
উহু! এভাবে তো সব হবে না। তরী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ আপনারা সবাই বসুন। আমি সব ক্লিয়ার করে জানাচ্ছি। “
হুমায়ুন রশীদ মেয়ের কথায় আশ্বস্ত হয়। আপাতত কি হয়েছে এটা জানা সবথেকে জরুরি। উনি শান্ত হয়ে একটা সোফায় বসে। আফজাল সাহেব এবং শোভনও বসেন। সাদিকা বেগম পৃথাকে টেনে নিজের সাথে বসায়। অবশিষ্ট রয় একটি সোফা। তরী সেটাতে সোজা হয়ে বসে চুপ করে রয়। সবার মধ্যে কেবল তূর্যই দাঁড়িয়ে আছে অপরাধীর ন্যায়।
হুমায়ুন রশীদ তরীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ এখন সব খুলে বলো। “
“ ওয়েট পাপা। আরেকজন আসা বাকি। “
কথাটা বলতে বলতেই আবার কলিংবেল বেজে উঠে। তূর্য এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই পার্থ হন্তদন্ত পায়ে প্রবেশ করতে করতে বলে উঠে,
“ পৃথা কোথায়? “
তরী ভিতর থেকে বলে উঠে,
“ পৃথা ইজ অলরাইট। আমিই আপনার ভাইকে বলেছিলাম আপনাকে কল দিয়ে এই ফেক এক্সকিউজ জানাতে। যাতে সুরসুর করে আপনি এসে পড়েন। “
পার্থ লিভিং রুমে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
“ এখানে কি চলছে? “
তরী শান্ত ভঙ্গিতে ওই তিন ছেলের ঘটনা বাদে বাকি সব কিছু খুলে বলে। সব শুনে আফজাল সাহেব আর শান্ত থাকতে পারে না। উঠে গিয়ে পার্থর গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলে,
“ এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোমাকে? তুমি আমার গর্ব ছিলে, অথচ আজ তোমার কারণেই আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে করা কোথাকার কোন ভদ্রতা? তোমার যদি ওকে এতোই পছন্দ হয়ে থাকে আমাকে বলে দেখতে। ভদ্র সমাজের মানুষের ন্যায় আমি সমন্ধ পাঠাতাম। “
পার্থ জবাব দেয় না। তূর্যর পাশে চুপচাপ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়। হুমায়ুন রশীদ আফজাল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
“ আপনি ঠান্ডা হয়ে বসুন। এর একটা বিহিত করতে হবে। “
আফজাল সাহেব গরম মস্তিষ্ক নিয়েই সোফায় বসে। হুমায়ুন রশীদ শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“ এই ঘটনাতে দোষী হলো পার্থ আর তূর্য। মাঝখান দিয়ে তরী আর পৃথার জীবনটাকে ওরা এলোমেলো করে দিলো। “
আফজাল সাহেব গরম চোখে একবার নিজের ছেলেকে দেখে নিয়ে হুমায়ুন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ ওরা সম্মান যতটুকু ডুবানোর ডুবিয়েছে। বাকি বিষয়টা এখন আমাদেরই সামলে নিতে হবে। “
সাদিকা বেগম পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলে,
“ কি করতে চাইছো তুমি? “
আফজাল সাহেব স্ত্রীর দিকে ফিরে নিচু স্বরে বলে,
“ যা আমার শশুড় আব্বা করেছিলো। “
অত:পর হুমায়ুন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ আপনি রাজি থাকলে আমি পার্থ এবং তরীর বিয়ে দিতে চাই। সাথে তূর্য এবং পৃথারও। “
পার্থ জোর গলায় বলে উঠে,
“ বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে। নতুন করে আবার কিসের বিয়ে? “
আফজাল সাহেব গর্জে উঠে,
“ চুপ করো তুমি নালায়েক। আইনগত ভাবে তোমাদের কেবল বিয়ে হয়েছে, কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তোমাদের বিয়ে জায়েজ হয়নি। “
হুমায়ুন রশীদ শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“ এইখানে আমার মর্জির কিছু নেই। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তরী এবং পৃথার। ওদের আপত্তি না থাকলে আমার কোনো সমস্যা নেই। “
পৃথা যে তূর্যকে ভালোবাসে তে ইতিমধ্যে কারো অজানা নয়। তাই তার এই সিদ্ধান্তেও কোনো অসুবিধা থাকার কথা না। তাই আফজাল সাহেব সরাসরি তরীকে প্রশ্ন করে,
“ তোমার কোনো আপত্তি নেই তো মা? “
তরী নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দেয়,
“ আপনার ছেলে অলরেডি আমার লাইফ অনেক মেসড আপ করে দিয়েছে। ডিভোর্সির ট্যাগ লাগিয়ে আমি আমার লাইফের প্রব্লেমস আর বাড়াতে চাই না। তাই আমার কোনো সমস্যা নেই। “
আফজাল সাহেব হুমায়ুন রশীদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ সামনের মাসে আমি আমার ছোট ছেলের বিয়ে ঠিক করে এসেছি। তাই তরী এবং পার্থর বিয়েটা সামনের সপ্তাহে পড়ালে কেমন হয়? “
হুমায়ুন রশীদ বলে,
“ তা না হয় হলো কিন্তু তূর্য এবং পৃথার কি হবে? “
“ ওদের না হয় এখন হুজুর ডেকে বিয়ে পড়িয়ে রাখি? আর এক দুই বছর পর অনুষ্ঠান করে মেয়েকে তুলে দিবো আমি। “
তূর্য এতে বাঁধ সেধে বলে,
“ বিয়ে পড়ানোর হলে পড়ান কিন্তু পৃথা এই বাসায়ই থাকবে। “
ছেলের এমন নির্লজ্জের ন্যায় কথায় হুমায়ুন রশীদ বিরক্ত হয়। এতো বড় অপরাধের পরও যে এই দুই ব্যাটাকে জেল হাজতে না পাঠিয়ে বিয়ের মালা পড়ানো হচ্ছে তা যেন এদের হজম হচ্ছে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সাদিকা বেগমও তূর্যের পক্ষ নিয়ে বলে উঠে,
“ হ্যাঁ। যেহেতু ওদের মধ্যে এখন স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক আছে তাই ওদের আলাদা থাকার কোনো মানে হয় না। ভাইজানের যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে পৃথা আপাতত এখানে থেকেই নিজের পড়াশোনাটা চালাক। একটু দায়িত্বজ্ঞান আসুক ওর মাঝে তারপর নাহয় ওদের ধুমধাম করে রিসিপশন করা হবে। “
হুমায়ুন রশীদ বলে,
“ কি বলেন আপা! পড়াশোনা নিয়ে আমার তরফ থেকে কখনো কোনো বাঁধা ফেস করবে না পৃথা কথা দিচ্ছি। উল্টো আমার বাসায় ও মেয়ের মতোই আদরে থাকবে। “
__________
রাত ৮ টা নাগাদ কাজী ডেকে সবার উপস্থিতিতে তূর্য এবং পৃথার বিয়ে পড়ানো হয়। যদিও তূর্য এবং পার্থর প্রতি আফজাল সাহেবের রাগ এখনো কমে নি কিন্তু তরী এবং হুমায়ুন সাহেবকে উনার পছন্দ হয়েছে। উনি হুমায়ুন সাহেবের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“ বেয়াইন নিজের এক মেয়েকে আজ আপনার আমানতে দিয়ে দিলাম। আর আরেক মেয়েকে আপাতত আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ এক সপ্তাহ পর তরীকে নিজের বড় ছেলের পুত্রবধূ হিসেবে নিতে আসবো। “
“ অপেক্ষায় থাকবো আমি। “
আফজাল সাহেবরা বেরিয়ে যাওয়ার সময় পার্থ আড়চোখে একবার তরীর দিকে তাকায়। তরী পার্থর দৃষ্টি দেখতে পেয়েই অগ্নিমুখ করে অন্যদিকে ফিরে যায়। মনে মনে বলে,
“ একবার খালি এই অসভ্যকে বাগে পাই, তরী কি জিনিস চিনিয়ে দিবো। “
__________
পার্থ বাসায় ফিরেই আর কারো সাথে কোনো কথা না বলে নিজের রুমে গিয়ে গোছল সেরে নেয়। গোছল সেরে বের হতেই দেখে শোভন তার রুমে বসে আছে। নিজের পুলিশের সন্দেহজনক দৃষ্টি তাক করে পার্থকে আগাগোড়া পরখ করছে। পার্থ বিরক্তির সুরে প্রশ্ন করে,
“ কি? “
“ আমাকে বুদ্ধি দিয়ে নিজেই মেয়ে তুলে বিয়ে করে ফেললি? তোর পার্সোনালিটির সাথে এটা যায় না দাদা। “
“ তুইও তো বেয়াদবের মতো বড় ভাইয়ের আগে নিজে ঢেইঢেই করে বিয়ে করার প্ল্যান করছিলি। সেজন্য তাড়াহুড়ো করে আমি আগে শুভ কাজ সেড়ে নিলাম। “
“ তুই যেটাকে শুভ কাজ বলছিস সেটা একটা ক্রাইম ছিলো। ভাগ্যিস ভাবী কোনো মামলা ঠুকে নি তোর বিরুদ্ধে। নাহলে আমি তোকে গ্রেফতার করার জন্য একপায়ে রাজী ছিলাম। “
“ বিরক্ত করিস না তো। যা। ঘুমাবো আমি। “
শোভন এবার মুখ সামান্য কালো করে বলে,
“ পৃথাকে মিস করছি। “
পার্থ ভাইয়ের দিকে তাকায়। সে নিজেও বোনকে মিস করছে খুব। শোভন নিজ থেকেই বলে,
“ আংকেল কে তো ভালোই মনে হলো। আর পৃথা নিজেও ওই ছেলেকে পছন্দ করে। তবুও যদি ওই ছেলে আমার বোনের সাথে উল্টাপাল্টা কোনো বিহেভ করে তাহলে ডিরেক্ট কেস করে দিবো। “
“ তোর মাথায় কি সারাদিন শুধু কেস ঠুকার প্ল্যানই ঘুরে? কখনো আমাকে জেলে নিতে চাস, কখনো নিজের বোন জামাইকে। “
“ আমি তো শুধু কেস ঠুকার কথা বলছি। একবার ভাব যদি নানাজান এসব ঘটনা জানতে পারে তাহলে কি হবে! “
পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“ আব্বার রফাদফা করে দিবে। “
__________
গতকাল থেকে এক থ্রি পিস পড়ে থাকায় বেশ অশান্তি লাগছিলো পৃথার। ভাগ্যিস তরী নিজ থেকে তাকে একটা জামা এনে দিয়েছে পড়ার জন্য। জামাটা একদম নতুন। কিন্তু সমস্যা হলো ড্রেসের ফিটিং নিয়ে। তরী বেশ লম্বা আর চিকন। দেখে মনে হয় গায়ে কঙ্কাল কোনো। সেই তুলনায় পৃথা বেশ ছোটখাটো দেখতে। আবার গায়ে গড়নের দিক দিয়েও তার স্বাস্থ্য সুন্দর। তাই জামাটা তার গায়ে বেশ বেমানান লাগছে। কিন্তু আপাতত একদিনের জন্য তার এটা পড়েই কাটাতে হবে। তূর্য তখন জানিয়ে গেলো যে সে কাল অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। সকালে নাস্তা করেই সে পৃথাকে নিয়ে শপিংয়ে বের হবে।
নতুন পরিবেশ নতুন ঘরে বেশ অদ্ভুত লাগছে পৃথার। কে জানতো একদিনেই তার জীবনে এতো পরিবর্তন এসে পড়বে? কিন্তু মনে মনে সে কিছুটা খুশিও। ভাগ্যিস আম্মা তাকে এই বাসায় রেখে গিয়েছে। নাহয় এখন ওই বাসায় ফিরে গেলে তার আরও অস্বস্তি হতো।
পৃথার ভাবনার মাঝেই তূর্য রুমে প্রবেশ করে। তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ। পৃথা চুপচাপ নিজের ফোন হাতে নিয়ে বসে রয়। তূর্য তার দিকে শপিং ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ ভাগ্য ভালো একটা শো রুম খোলা পেয়েছি। আপির ড্রেসে আনকোমফর্টেবল ফিল করছো। তাই এটা পড়ে নাও। “
পৃথা অবাক হয়। তূর্য কিভাবে বুঝলো সে আনকমফোর্টেবল ফিল করছে? পৃথা সেই প্রশ্ন আর করে না। চুপচাপ তূর্যর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। তূর্যও নিজের শার্ট বদলে নিয়ে বিছানায় বসে ফোন চালাতে থাকে। কিছুক্ষণ পরই পৃথা তার আনা লাল রঙের থ্রি পিস পড়ে বের হয়। তূর্য এক পলক পৃথাকে দেখে নিয়ে হেসে বলে উঠে,
“ বাহ! বউ বউ লাগছে। “
তূর্যর কথা শুনে পৃথা লজ্জায় পড়ে যায়। এই লোক বেশ শেয়ানা। ইচ্ছে করে এই রঙের জামা নিয়ে এসেছে যেন এই কথাটা বলে পৃথাকে লজ্জা দিতে পারে। তূর্য ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠে,
“ কেবিনেটের উপর রাখা বক্স এবং খামটা তোমার। খুলে দেখো। “
পৃথা আগ্রহ নিয়ে গিয়ে আগে খাম খুলে দেখে। সেটার ভিতর একটা চেক পেপার ও ক্রেডিট কার্ড ছিলো। চেক পেপারের উপর একটা নির্ধারিত এমাউন্টও লেখা আছে। পৃথা অবাক সুরে প্রশ্ন করে,
“ এগুলো কি? “
“ চেক পেপারটা তোমার দেনমোহরের জন্য। আর সাথে ক্রেডিট কার্ডটাও তোমার। এখন থেকে এটা ইউজ করবে। “
“ আমার কাছে তো আমার ক্রেডিট কার্ড আছে। “
“ সেটা তোমার আব্বার দেওয়া। এতদিন উনার দায়িত্বে ছিলে তুমি। কিন্তু এখন থেকে যেহেতু তুমি আমার দায়িত্ব সো তোমার সব কিছুই আমার রেস্পন্সিবিলিটি। “
পৃথা আর কোনো কথা বলে না। সে পাশের চতুর্ভুজাকৃতির বক্সটা হাতে নিয়ে খুলে। সাথে সাথে দেখতে পায় বক্সের ভিতর একটা ডায়মন্ডের নাকফুল। তূর্য এবার নিজ থেকেই বলে উঠে,
“ এটা তোমার বিয়ের গিফট। “
পৃথা গতবছরই তার আম্মার জোরাজুরিতে নাক ফুটিয়েছিলো। কিন্তু তার খুব একটা পছন্দ না দেখে তেমন একটা জিনিস পড়তো না। অথচ তূর্য ঘুরেফিরে তাকে এটাই গিফট করলো। পৃথা নিজের মনের কথা চাপা দিয়ে মুখ কালো করে বলে,
“ ওহ। কিন্তু আমি তো আপনার জন্য কোনো গিফট কেনার সুযোগ পায় নি। “
তূর্যর এই মুহুর্তে বেশ হাসি পাচ্ছে পৃথার এমন বোকা কথা শুনে। সে কোনোমতে নিজের হাসি চাপিয়ে রেখে বলে,
“ এটা চুপচাপ পড়ে নাও। সেটাই আমার গিফট হবে। “
পৃথা কোনো কথা না বলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাকফুলটা পড়ে নেয়। অদ্ভুতভাবে তার নাকে এটা বেশ সুন্দর মানিয়েছে। এখন তার মনে হচ্ছে আম্মা ঠিকই বলতো, যে তার নাকে নাকফুল সুন্দর লাগবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে ব্যস্ত পৃথা খেয়াল করে নি তূর্য কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। যখন লক্ষ্য করে তখন আর পালানোর সাহস কিংবা জায়গা কোনটাই খুঁজে পায় না সে। তূর্য নিঃশব্দে পিছনে দাঁড়িয়ে থেকেই পৃথার ওড়না টেনে মাথায় দিয়ে দেয়। অত:পর মুখ কিছুটা নিচে নামিয়ে পৃথার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“ এখন আমার বউ লাগছে। “
লালে রাঙা অষ্টাদশী লজ্জায় নিজের দৃষ্টি নত করে ফেলে। সেই দৃশ্যটা একধ্যানে দেখে তূর্য। সে একই ভঙ্গিতে আবার বলে উঠে,
“ ভালোবাসতে পারবো কবে তা জানি না। কিন্তু এই মুহুর্তে প্রেমে পড়ে গেলাম তা অস্বীকার করবো না। “
পৃথা চোখ তুলে আয়নার মধ্য দিয়ে তূর্যর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“ দুটো কি আলাদা জিনিস? “
“ হ্যাঁ। খুব আলাদা। “
চলবে…
যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১২.
শা শা শব্দ তুলে গাড়ি এসে থামে পুরান ঢাকার বেশ বড় এক বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে আসে আফজাল সাহেব, সাদিকা বেগম, পার্থ ও শোভন। বাড়ির সামনে খেলতে থাকা দুটি ছোট বাচ্চা তাদের দেখেই দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। আফজাল সাহেব সবার অগোচরে নিজের বুকে সামান্য ফু দেয়। এই বাড়িতে আসলেই উনার মনে হয় এই বুঝি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। সবার উপর কর্তৃত্ব চালানো আফজাল সাহেব নিজের শশুড় উজ্জ্বল মোল্লাকে বেশ ভয় পান। এই একজনের সামনেই উনি বাঘ থেকে বিড়াল হয়ে যায়।
আফজাল সাহেবরা দরজা পেরিয়ে ঘরের আঙিনায় প্রবেশ করতেই দুজন হাস্যজ্বল মহিলা উনাদের দিকে এগিয়ে আসে। সম্পর্কে তারা পার্থর দুই মামার স্ত্রী হন। সাদিকা বেগম নিজের ভাবিদের সাথে কুশল বিনিময় করে প্রশ্ন করে,
“ আব্বা কোথায়? ভাইজানদেরও দেখছি না যে। “
পার্থর বড় মামী বলে উঠে,
“ আব্বা তো ঘরের ভিতরে। আর তোমার দুই ভাইজান এবং ভাইপো কাজে গেসে। তোমরা দাঁড়ায় আছো কেন? ভিতরে আইসা বসো। “
আফজাল সাহেবরা বসার ঘরে বসতেই দুই মামী নাস্তা পানির ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাদিকা বেগমের ভাজতি শর্মী এবং ভাইপোর স্ত্রী রাহেলা শরবত পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শর্মী পার্থকে শরবত এগিয়ে দেওয়ার সময় ইচ্ছে করেই পার্থর আঙুল ছুঁয়ে দেয়। পার্থ গরম চোখে তাকাতেই সে লজ্জায় দূরে সড়ে দাঁড়ায়।
এরই মাঝে পান চিবুতে চিবুতে বসার ঘরে প্রবেশ করেন উজ্জ্বল মোল্লা। উনাকে দেখতেই সবাই উঠে দাঁড়ায়। আফজাল সাহেব এগিয়ে গিয়ে সালাম জানায় উনাকে। উজ্জ্বল মোল্লা সেই সালামের জবাব নেয় না। বরং কিছুটা তিরষ্কার করে বলেন,
“ আহারে! আমার মাইয়াডা কি সুন্দর চাঁদের লাহান আসিলো। এখন তো শরীরে একটা মাংসও নাই। তুমি কি আমার মাইয়ার যত্ন নাও না গো পার্থর আব্বা? “
আফজাল সাহেব মাথা নত করে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে,
“ ছি, ছি কি বলেন আব্বা! “
উজ্জ্বল সাহেব চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে বলে,
“ আমার নাতনিডা কই? পৃথারে লগে কইরা আনো নাই ক্যালা? “
সাদিকা বেগম বলে উঠে,
“ পরের বার ওকে সাথে করে নিয়ে আসবো আব্বা। “
উজ্জ্বল সাহেব সতর্ক দৃষ্টি তাক করেন মেয়ে এবং মেয়ের জামাইর দিকে। তার বিচক্ষণ দৃষ্টি সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে যায় এখানে কোনো ঘাপলা আছে। উনি প্রশ্ন করে,
“ কি হইসে? চেহারার এমন বারোডা বাইজ্জা আছে ক্যালা? “
সাদিকা বেগম বলে,
“ সবাই আসুক আব্বা। তারপর বলছি। “
পার্থর দুই মামা এবং মামাতো ভাই আধঘন্টার ভেতরেই এসে পৌঁছায়। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে তারা বসতেই আফজাল সাহেব বলেন,
“ আসলে আব্বা একটা গুরুত্বপূর্ণ খুশির খবর জানাতে আজকে এসেছি। “
উজ্জ্বল মোল্লা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি বলে উঠে,
“ সামনের সপ্তাহে পার্থর বিয়ের ডেট ঠিক করেছি আমরা। “
উপস্থিত সবাই বেশ অবাক হলো। তাদের মধ্যে শর্মী সবথেকে বেশি অবাক হলো মনে হচ্ছে। উজ্জ্বল সাহেব বলে,
“ কিছু জানলাম না, হুনলাম না ডাইরেক্ট বিয়ার দাওয়াত দিতে আইয়্যা পড়সো। “
“ আসলে আব্বা মেয়ে পার্থর পছন্দ করা। গতকালই কথা পাকা করে এলাম। “
“ পোলা দেখি এক্কেরে বাপের মতন হইসে। নিজের পছন্দে বিয়া করবো। “
আফজাল সাহেব মনে মনে বিরক্ত হয়। তাকে খোঁটা না দিলে যেনো তার শশুড়ের ভাত হজম হয় না। এটাই শেষ বার। এর পরের জনমে জীবনেও আর কারো মেয়ে নিয়ে ভাগবেন না তিনি। এই জনমেই ঢের শিক্ষে হয়েছে। আফজাল সাহেব ভয়ে ভয়ে বলে,
“ আরেকটাও কথা বলার ছিলো আব্বা। “
“ কি কথা? “
“ পার্থ যেই মেয়েকে পছন্দ করেছে ওই মেয়ের একটা ছোট ভাই আছে। শিক্ষিত, ভালো চাকরি করে। ছেলেটাকে আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। তাই কাল আমরা পৃথার আকদ পড়িয়ে দিয়েছি। এক দুই বছর পর অনুষ্ঠান করা হবে। “
উজ্জ্বল সাহেবের মাথায় হাত,
“ খাইসেরে! কি গো পার্থর বাপ? তুমি নিজেও লুকায়া বিয়া করসিলা এখন পোলাপাইনগোর বিয়াডাও দেখি লুকাইয়াই সাইরা ফালাইতাসো। “
সাদিকা বেগম কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলে,
“ যেই যুগ আসছে আব্বা! ভালো ছেলে মেয়ে পাওয়া মুশকিল। তাই এতো ভালো একটা ছেলে পেয়ে আমরা আর অপেক্ষা করি নি। “
উজ্জ্বল সাহেব সেই কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,
“ হেইসব বাদ দে তুই। আগে ক আমার নাতনিরে জোর কইরা বিয়া দেস নাই তো? ওয় রাজি আছিলো? “
“ হ্যাঁ আব্বা। পৃথার মতেই বিয়ে হয়েছে। “
উজ্জ্বল সাহেবের উপস্থিতিতে উনার ছেলেরা এবং ছেলের বউরা এই বিষয়ে আর কোনো কথা বলে না। কিন্তু তারা কেউই যে এই পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট না তা তাদের চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠছে। বিশেষ করে পার্থর ছোট মামী এই বিষয়ে বেশ অসন্তুষ্ট। উনি নিজের মেয়ে শর্মীর জন্য পার্থকে পাত্র হিসেবে চাইতেন সবসময়। নিজের ননদ সাদিকা বেগমকে আকারে ইঙ্গিতে বেশ কয়েকবার এটা বলেছেনও উনি। কিন্তু সাদিকা বেগম সবসময় বুঝেও না বুঝে থাকার ভান করতো। উনার চাঁদের মতন মেয়েকে রেখে এখন কোন মেয়েকে পার্থর বউ করে আনবে তা উনিও দেখতে চায়।
__________
ফোন আসায় উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো পার্থ। কথা বলা শেষ হতেই পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে শর্মী তার দিকে টলমলে চোখে তাকিয়ে আছে। পার্থ বিরক্ত হয়। এই মেয়েকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সে এই বাসায় আসতেও চায় না। শর্মী কাদো কাদো স্বরে বলে,
“ আপনি বিয়ে করে ফেলবেন পার্থ ভাই? ওই মেয়ে কি আমার থেকেও বেশি সুন্দর? “
পার্থ কঠিন স্বরে জবাব দেয়,
“ অন্তত তোমার মতো বারবার প্রত্যাখ্যান পেয়েও নিজের আত্মসম্মান বিকিয়ে সে আমার পিছনে পড়েছিলো না কখনো। এরকম ব্যক্তিত্ববান মেয়েই একমাত্র আমার স্ত্রী হওয়ার যোগ্য। “
কথাটা বলেই পার্থ সেখান থেকে সড়ে যায়। এরকম একটা অপমানের পরও শর্মীর মাঝে ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে এখনো জানতে আগ্রহী পার্থ কোন মেয়েটাকে বিয়ে করছে।
__________
সকালে নাস্তা সেরেই শপিংয়ে বেড়িয়েছিলো তূর্য এবং পৃথা। কিছুক্ষণ আগেই মাত্র বাসায় ফিরেছে। পৃথা নিজের জন্য বেশ কিছু রেডি মেড থ্রি পিসের পাশাপাশি কয়েকটা শাড়িও কিনে নিয়েছে। আম্মাকে সে সবসময় শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে বড় হয়েছে। সেই থেকে তার মাথায় একটা জিনিস সেট হয়ে গিয়েছে। যে বিয়ের পর একটা মেয়ের শাড়িই পড়া উচিত। এতে তাকে বেশ সংসারী দেখায়। কিন্তু তূর্যর গতরাতে তাকে দেওয়া লজ্জার কথা মনে পড়তেই সে শাড়িগুলো তুলে ক্লসেটে রেখে দেয়। এই লোকের সামনে আর লজ্জায় পড়তে রাজি না সে।
বাসায় এই মুহুর্তে কেউ নেই। তরী এবং হুমায়ুন সাহেব দুজনেই সকাল সকাল হসপিটাল চলে গিয়েছেন। বাকি রইলো তূর্য। সে-ও বাসায় ফেরার পর থেকে লাপাত্তা। হয়তো বাহিরে গিয়েছে। পৃথা করার মতো কিছু না পেয়ে বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে ফোনে গেমস খেলতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই পিছন থেকে তূর্য বলে উঠে,
“ এই বয়সে কেউ সাবওয়ে সারফারস খেলে নাকি? “
পৃথা সাথে সাথে সোজা হয়ে উঠে বসে। তার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে। সে বেশিক্ষণ কোনো এক বিষয় মনে রেখে তা নিয়ে জীবন পাড় করতে পারে না। যেমন গতকাল সারাদিন তূর্যর প্রতি তার একধরনের অভিমান কাজ করছিলো। কিন্তু হুট করেই সব অভিমান গায়েব হয়ে গিয়েছে তার। পৃথা অত:পর সরু চোখে তূর্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ বয়সের সাথে গেমসের কি সম্পর্ক? “
“ এডমিশনের পড়াশোনা বাদ দিয়ে বসে বসে গেমস খেললে ইউনিভার্সিটি তে চান্স পাবে না। “
পৃথা আনমনে বলে উঠে,
“ বিয়ে করেছি কি পড়াশোনা করার জন্য নাকি? “
তূর্য কেবিনেটের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হ্যান্ড ওয়াচ খুলছিলো। পৃথার কথা শুনে সে ভ্রু কুচকে পিছনে তাকায়। নিজের বলা কথায় পৃথা নিজেও হতভম্ব হয়ে পড়েছে। সে সাথে সাথে নিজের দৃষ্টি লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তূর্য পৃথার সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
“ এইযে মিস এ বি সি। মতলব কি বলো তো? “
পৃথা ঘাড় ঘুরিয়ে পিটপিটিয়ে তূর্যর দিকে তাকায়। অত:পর একটা বোকা হাসি দিয়ে বলে উঠে,
“ একচুয়্যালি আমার ছোট বেলা থেকেই এইম ইন লাইফ হচ্ছে বিয়ে করা আর পড়াশোনা থেকে মুক্তি লাভ করা। “
তূর্য মাথায় হাত দিয়ে বলে,
“ ওহ মাই গড! মারাত্মক অবস্থা! এই এইম নিয়ে তুমি এইচ এস সি তে এ প্লাস কিভাবে পেলে? “
পৃথা সরু চোখ করে বলে,
“ ইট ইজ এ সিক্রেট। একচুয়্যালি আমার আম্মা আব্বা এক্সেপশনাল পিস। মানুষরা তাদের মেয়ে এক্সামে খারাপ করলে বিয়ে দিয়ে দেয়। আর আমার কেসে আমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে আম্মা আব্বার বিয়ে দেওয়ার প্ল্যান ছিলো না। তাই তাড়াতাড়ি পড়াশোনা শেষ করার জন্য আমি মন দিয়ে সারাদিন পড়তাম। কারণ পড়া শেষ হলেই বিয়ে করতে পারবো। কিন্তু আল্লাহর কি মেহেরবানি দেখেন! পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই আমার বিয়ে হয়ে গেলো। “
পৃথার এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া কথা শুনে তূর্য হতাশ হয়ে বসে পড়ে। এই মেয়েকে সে বোকা ভাবছিলো? এখন তো তার নিজেকেই বলদ মনে হচ্ছে। তূর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,
“ উহু! এভাবে চলবে না। তোমার যত বইখাতা আছে সব কালকের মধ্যে ওই বাসা থেকে আনার ব্যবস্থা করো। এরকম ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট নিয়ে পড়াশোনা বাদ দেওয়ার চিন্তা করলে তোমাকে কিন্তু আমি ছেড়ে দিবো না। “
পৃথা গাল ফুলিয়ে বলে,
“ অদ্ভুত তো! আপনি জামাই না ছাই? মাস্টার মশাই সাজার ভূত চড়েছে কেনো আপনার মাথায়? “
“ বউ এরকম পড়া চোর হলে জামাইদের আর কি-ই বা করার থাকে বলো? আর তাছাড়াও এটা করতে আমি বেশ মজা পাচ্ছি। আগে পাপা আর আপি সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে আমার উপর চিল্লাতো। এখন আমি তোমার উপর চিল্লাবো। শোধবোধ। “
“ আপনার এতো চিল্লানোর শখ থাকলে নিজের বাচ্চাদের উপর চিল্লিয়েন। আমাকে মাফ করেন। “
কথাটা বলেই পৃথা নিজেই হতভম্ব হয়ে যায়। তার এই এক বাজে স্বভাব! একবার কারো সাথে ফ্রি হয়ে গেলে তার সামনে না বুঝে শুনেই পকপক করতে শুরু করে দেয়। তূর্য ভ্রু কুচকে পৃথার দিকে তাকিয়ে আছে। পৃথা সাথে সাথে সরি বলে সেখান থেকে ছুটে পালায়।
__________
হসপিটাল থেকে বের হতেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পার্থর মুখটা দেখতে পেয়েই তরী বিরক্ত হলো। অত:পর পার্থর দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলে উঠে,
“ দেখতে তো সম্পূর্ণ সুস্থই লাগছে। তাহলে এখানে কি কাজ আপনার? আবার কাকে তুলে নিতে এসেছেন? “
“ আপনাকে। “
“ মানে? “
“ আম্মা বলেছে আপনাকে নিয়ে গিয়ে দুটো রিং পছন্দ করে নিতে। “
“ আমি এই মুহুর্তে খুব টায়ার্ড। বাসায় গিয়ে ঘুমোবো। “
পার্থ তরীর হাত ধরে বলে,
“ তা তো হচ্ছে না। আপনি এখন আগে আমার সাথে রিং কিনতে যাবেন। তারপর আমরা ডিনারে যাবো। “
তরী চোখ গরম করে বলে,
“ আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না। “
“ অবশ্যই পারি। অধিকার আছে। “
“ আপনার সাথে ডিনার করার থেকে বিষ খেয়ে মরে যাওয়া ভালো। “
পার্থ হেসে বলে,
“ আপনাকে কে বললো আমি আপনাকে নিয়ে স্পেশাল ডিনারে যাচ্ছি? এই ডিনার তো শোভন প্ল্যান করেছে। ও এবং ওর ফিয়ন্সেও আমাদের সাথে যোগ দিবে। ওরা আপনার সাথে পরিচিত হতে আগ্রহী। “
তরী ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। তার ঝামেলা হচ্ছে কেবল পার্থর সাথে। কিন্তু যেহেতু দু’দিন পর আসলেই তাদের বিয়ে হবে তাই এধরণের সোশ্যালাইজিং সে চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারবে না। তাই অগ্যতা সে যাওয়ার জন্য রাজি হয়।
__________
“ শোভন তো সবসময় বলতো আপনি অনেক স্ট্রিক্ট দাদা। কিন্তু আপনাকে দেখে তো একদমই মনে হচ্ছে না। “
মধুমিতার কথা শুনে পার্থ কেবল মৃদু হাসে। শোভন তাদের কথার মাঝে বাগড়া দিয়ে বলে,
“ ভাবি যদিও আমি সবসময় আইন মেনে চলি, কিন্তু ভাইয়ার আপনাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করার ব্যাপারে কিন্তু আমি আপনাকে কোনো হেল্প করতে পারবো না। কারণ দু’দিন আগে আমি নিজেও এরকম কিছুই প্ল্যান করছিলাম। “
তরী খেতে খেতে বলে উঠে,
“ এটা তো কোরাপশনের আওতায় পড়ে। আমি ভেবেছিলাম তুমি একজন দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার। “
“ ভালোবাসার কেসে টুকটাক কোরাপশন মেনে নেওয়া যায় ভাবি। আফটার অল এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ। “
তরী আচমকা তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে একটা টেবিলের দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়। সাথে সাথেই সে পাথরের ন্যায় জমে যায়। চোখ মুখ শক্ত করে সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অত:পর আবার তাকায় সেদিকে। সেই টেবিল হতে এক জোড়া চোখও তার দিকে তাকায়। তরী আচমকা হেসে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ আমাদের এখন যাওয়া উচিত। বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে আজকে। “
আচমকা তরীর এরকম হাসিমুখ দেখে পার্থ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়। তরী সেদিকে পাত্তা না দিয়ে শোভন এবং মধুমিতার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ তোমরা ইঞ্জয় করো। পার্থ আমাকে ড্রপ করে দিয়ে আসবে। “
শোভন আর মধুমিতা সামান্য অবাক হলেও তারা হাসিমুখে বিদায় জানায়। পার্থ টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তরী তার দিকে এগিয়ে এসে তার একহাত ধরে দাঁড়ায়। পার্থ অবাক হয়। এই ডাক্তার সাহেবার হঠাৎ করে কি হলো? একটু আগেও তো পার্থর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলো। আর এখন একদম নাইন্টি ডিগ্রি এংগেলে ঘুরে গেলো! আসিফের কথামতো কি এই ধানী মরিচ তার চার্মনেসে ডুব দিলো নাকি? কথাটা ভাবতেই পার্থ আপনমনে হেসে দেয়।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]