#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
#শেষ পর্ব
জাহানারা ছেলে-মেয়েদের খেতে ডাকলেন।খাবার টেবিল পূর্ণ হলো বড় ভাইয়া, ভাবি। ছোট চাচ্চু, চাচ্চি আর তার দুই ছেলে-মেয়ে আর মহুয়া।পরিবারের সকলের সামনে মহুয়ার বাবা জানিয়ে দিলেন,,
” রওনকের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি!”
মহুয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। বাবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। কিছুটা ক্ষুদ্ধ হয়েই বললো,,
” আমি তাকে বিয়ে করতে পাড়বো না বাবা!”
বাবা মহুয়ার দিকে কড়া চোখে তাকালেন। শক্ত কন্ঠে বললেন,,
” শেষ বয়সে এসে আমাদের মানুষের সামনে লাঞ্ছনা অপমানিত করতে চাইছো? এ জন্যই কি তোমাদের বড় করেছি?”
মহুয়া অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ জোড়া থেকে টপটপ পানি পড়তে শুরু করেছে। মহুয়া কম্পিত কণ্ঠে বললো,
“বাবা আমার বিয়ে হয়ে গেছে যেনেও কিভাবে বিয়ে দিতে চাইছো? ”
মহুয়ার বাবা ক্ষেপে গেলেন। খাবার ভর্তি টেবিল উল্টে ফেলে দিলেন। ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো বাচ্চা দুটো। তাদের দাদাজানকে এমন রাগতে কখনো দেখেনি। কান্না কান্না চোখে মায়ের দিক তাকাতেই ছোট চাচি তাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। বাবা তখন দিগুণ চেঁচিয়ে বললেন,
“কিসের বিয়ে? এসব বিয়ে, ফিয়ে মানি না আমি! আমার এখানে থাকতে হলে আমার কথাই মানতে হবে!”
মহুয়া ছলছল চোখে তাকালো বাবার দিকে। কম্পিত কন্ঠে বলল,,
“বাবা তুমি মানো বা না মানো বিয়ে আমাদের হয়েছে। শরিয়ত মোতাবেক হয়েছে। কালেমা পড়ে, কবুল বলে হয়েছে। এ বিয়ে তুমি নাকচ করলেও এ বিয়ে….”
কথার মাঝেই বাবা গালে থাপার মারলেন কসে।দূরে ছিটকে সোকের কোনায় বাড়ি খায়। বাবার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি চিৎকার করে বললেন,,
“কই তোর নাগর? ডাক আজই বিদেয় করবো তোকে এই বাড়ি থেকে। তোর মতো অবাধ্য সন্তান আমার চাই না। হয়তো তোর নাগরকে ডাক বের হবি! নয় সন্ধ্যার মাঝে তৈরি হবি। আজ তোকে বিয়ে দিয়ে আপদ ঘার থেকে নামাবো!”
মহুয়া বাবার দিক অসহায় ভাবে তাকালো।আশে-পাশে সবাই দাঁড়িয়ে কেউ এগিয়ে এলোনা। মহুয়া একা, একা ছিল, আছে, থাকবে। ডুকরে উঠল
মহুয়া।
——–
দাদাজানের সামনে বসে আছে ইয়ামিন। শরীর আধো ভেজা, চুল বৃষ্টির পানিতে ভিজে লেপ্টে আছে কঁপালে। দাদাজান চুরুট খাচ্ছিলেন। নাক, মুখ দিয়ে ধোয়া ছাড়ছেন। কালো ধোঁয়া। ইয়ামিন অবাক হয়ে দাদাজানকে দেখে যাচ্ছে হাতে তার 9MM পিস্তল। মাথায় ঘুরছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। সার্ভিস সেন্টার থেকে গাড়ি আসার পর ইয়ামিন বার চারেক তল্লাশি করেছে চিঠি পায়নি। ইয়ামিন হতাশ হয়ে স্টাডি রুমে বসলো। সেখানেই ময়লার ঝুড়িতে পড়ে থাকতে দেখলো আধো পুড়ে যাওয়া চিঠি। ইয়ামিনের চোখ খুশিতে উদ্যপিত হলো৷ চিঠি বুকে জড়িয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো। বিগত কটা দিন নীজের অস্তিত্বই যেন খুঁজে পাচ্ছিলো না। ইয়ামিন হাসলো। পরমুহূর্তেই চিঠি হাতে বেড়িয়ে গেলো মায়ের রুমে। ইয়ামিনকে এভাবে দেখে চমকে উঠলেন ইয়ামিনের মা। শুকনো ঢুক গিলে চাপা হাসার চেষ্টা করে বললেন,
“কিছু বলবে বাবা?”
ইয়ামিন স্থীর দৃষ্টিকে তার মায়ের দিকে তাকালো। শীতল কন্ঠে বলল,,
“কেন মিথ্যা বললে মা? ”
ইয়ামিনের মা থম মেরে গেলেন। মাথার মাঝে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠলো। ছেলের দিকে তাকিয়ে থমথমে কন্ঠে বলল,
“আমার ছেলের প্রাণ আমার কাছে সব থেকে দামি। তার জন্য সারাজীবন মিথ্যা বলতে হলে তাই বলবো।”
ইয়ামিন আহত দৃষ্টিতে তাকালো।দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“কে করেছে এমন?”
মা চুপ করে রইলেন। মুখে কুলূপ এটে বসে রইলেন৷ ইয়ামিন এক পলক তাকিয়ে মায়ের দিকে। বের হয়ে সোজা দাদাজানের কাছে। ইয়ামিন এবার ঠোঁট নাড়লো,,
“কেন করলেন দাদা জান?”
দাদাজান বললেন,
“আমি কিছুই করি নি দাদু ভাই! মেয়েটি তোমার জন্য ঠিক ছিলো না!সে টাকা নিয়ে বিদায় হয়েছে। ইয়ামিন কিছুই বিশ্বাস করলো না। মহুয়া কখনোই টাকা নেয়নি তা সে জানে। ইয়ামিন তপ্ত কন্ঠে বলল,
” আমি সব জেনে গেছি দাদাজান? সেদিন মহুয়ার বাবার চাকরি আপনি খেয়ে ছিলেন। তাই না? এমন কি সেই মেয়েকেও আপনি পাঠিয়ে ছিলেন?”
দাদাজান ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন,
“হে সব আমি করিয়েছি। কত সাহস এক কর্মচারী হয়ে আমার নাতির সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়ার ধান্দা করে!”
ইয়ামিন বন্দুক তাক করলো দাদাজানের দিক। চিৎকার করে বলল,
“তার মানে? জেবিন কে আপনি মারিয়ে ছিলেন?ওর এক্সিডেন্ট হয়নি!”
দাদাজানের সহজ স্বীকারোক্তি,
“হে!”
ইয়ামিন উঠে দাঁড়ালো। পুলিশের ভিতরে আসতে বলল। খবর আগেই দিয়ে এসেছিলো সে। দাদাজান সহজ ভাবেই চলে গেলেন পুলিশদের সাথে। যাওয়ার আগে বলে গেলেন,
“দাদু ভাই আমার সব সম্পত্তি তোমার নামে সুখে থাকে। ”
ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো দাদাজানের যাওয়ার পথে। ইয়ামিন আজ পর্যন্ত তার দাদাজানকে বুঝতে পারেনি লোকটি রহস্য ময়ে ঘেরা।
———-
মহুয়া বউ সেজে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে কাঠ হয়ে। মহুয়ার ভাবী বললো,
“জামাই চলে এসেছে। চলো!”
মহুয়া রবোর্টের মতো উঠে দাঁড়ালো। ভাবী তাকে এনে বসিয়ে দিলো একটি ছেলের পাশে। মহুয়া মাথাও তুললো না। ছেলেটির দিকে তাকালোও না। যখন কবুল বলতে বলা হলো। রোবটের মতো বলল,
“কবুল, কবুল কবুল!”
ছেলেটিও কবুল বললো। ঠিক সেই মুহুতেই মহুয়া হাতের মাঝে গুঁজে রাখা বিষের শিশি টুপ করে খেয়ে নিলো। সকলেই হতবাক। হুট করেই মহুয়ার মুখ থেকে রক্ত বের হতে আর্তনাদ করে উঠলো পরিচিত এক মুখ। ইয়ামিনকে পাশে বসে থাকতে দেখেই মহুয়া চোখ বুঝে ফেললো। ইয়ামিন বুকে চেপে কোলে তুলে দ্রুত বের হলো। পিছন থেকে কান্নার রোল পরে গেলো। মেয়ের সুখের জন্য এত কিছু করলো? মেয়েকে মৃত্যুর দাড়ে পৌছানোর জন্য নয়। মহুয়া বাবা ঠায় বসে রইলেন। ইয়ামিনের মা বোন পিছু ছুটেছে তাদের। তখনি ভাবি ঘর থেকে বের হলো। চিঠি হাতে। আঁচলে মুখ চেঁপে বলল,
“বাবা একটা বার ওর কথা শুনলে কি হতো?”
বাবা চুপ করেই রইলেন। নিথর দেহ তার। চোখের কোনে জল টলমল করছে। তিনি চিঠি মেলে ধরলেন,
“বাবা,
ছোট বেলায় মাকে হারিয়ে জাহানারা মাকে মা জেনেছি তার কারণ তুমি বলেছো। আমার জীবনের প্রতিটা ডিসিশন তুমি নিয়েছো আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু মন? তা কিভাবে আমার পত্র প্রেমিকের হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি। আমি পাড়তাম না তোমায় অপানিত করতে, আর না আমার পত্র প্রেমিককে ছাড়তে। ছাড়াতো তখন যেত পরিস্থিতি যদি আমাদের বিপক্ষে না হতো। ওভাবে আমাদের বিয়ে না হলেও আমি তোমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে নিতাম। কিন্তু আমি বিবাহিত। যেভাবেই হোক বিয়ে আমার হয়েছিলো। তাহলে কেন তুমি মানতে চাইছো না? এবার হয়তো মানবে, আমার মৃত্যুতে। যতক্ষণে এ চিঠি তুমি পাবে? ততক্ষণে আমি পারি জমাবো ভিন্ন দেশে। ক্ষমা করো আমায়। ভালো থেকো।
ইতি,
তোমার ঘার থেকে নেমে যাওয়া আপদ”
মহুয়ার বাবা স্থীর হয়ে বসে রইলো। অপরাধ বোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সে তো ভেবে ছিলো মেয়েকে পার করে দিবেন সমাজের তুচ্ছ কথা বন্ধ করতে। একটি মেয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আবার ফিরে এলে কতরকম কথা শুনতে হয়? ইশশ! উনি যদি সমাজের কথা না শুনতো?? তাহলে তার মেয়ের এই অবস্থা হতো না!”
———-
মহুয়ার অবস্থা বেশি ভালো না। ডাক্তার তাদের যথাযথ চেষ্টা করছে। গলার মাঝে নল ঢুকিয়ে বিস বের করা হচ্ছে। ইয়ামিন শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহুয়ার দিকে। মেয়েটি বার বার কুঁকড়ে যাচ্ছে।ইয়ামিনের বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে বার বার। এই ভয়ানক দৃশ্য সে দেখতে পারছে না। ইয়ামি দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। তখনি কাছে এলো আয়দা। ইয়ামিনের কাছে একটি চিঠি দিয়ে বলল,
“মহুয়া আপুর ভাইয়া দিয়েছে!”
ইয়ামিন চিঠি হাতে নিলো। আয়দা চলে যেতেই চিঠি খুললো সে,
“আমার নিশ্চুপ পাগলাটে প্রেমিক,
জানি না আমার শেষ চিঠি তোমার কাছে পৌঁছাবে কিনা। তবে আমি চাই পৌঁছাক। তুমি বলেছিলে, আমি মিথ্যা বলছি। আমার কাছে কোনো প্রুভ নেই নিজেকে যাচাই করার মতো। আছে শুধু এই চিঠি। যদি কখনো পৌঁছায় হয়তো বুঝে যাবে আমি তোমার মরীচিকা। মনে আছে বলে ছিলাম? আমি মরুভূমির দেখা জল ভ্রমের ন্যায়। এবার যত ছুঁতে চাইবে? তত হারোবো দূরে।
ইতি,
মরিচীকা”
ইয়ামিন হুহু করে কেঁদে উঠলো। সেখানেই বসে হাত পা ছড়িয়ে ডাকতে লাগলো,
“মহুয়া প্লীজ কাম ব্যাক। প্লীজ, প্লীজ! ”
“ইয়ামিন?”
পিছন থেকে মহুয়ার কন্ঠে ভেসে আসতেই ইয়ামিন দৌড়ে যায় তার কাছে। ডাক্তার জানায় সে ভালো এখন। ইয়ামিন ধমকে উঠে,
“কেন করলে এমন পাগলামি! ”
মহুয়ার চোখেও পানি। ইয়ামিনের গালে স্পর্শ করে বলল,
“তোমার জন্য মরতে পারি!”
ইয়ামিন হেসে বলল,
“আমি যে তোমার সাথে বাঁচতে চাই।”
মহুয়ার ওষ্ঠে হাসি ফুঁটে উঠলো। এই প্রথম দুজন যুগলবন্দীর দৃষ্টি মিলন হলো। ঠোঁটে ঠোঁটে কথা হলো। আলিঙ্গন করে নিলো একে ওপরকে।
———-
চার বছর পর,,
আজ বাবা-মায়ের হাত ধরে হেটে চলছে মেহুল। ছোট ছোট হাতে আকড়ে আছে বাবা-মায়ের আঙ্গুলের ভাজে। কবর খানার সামনে এসে থামলো তারা। ইয়ামিনের দাদাজানের কবরে। চারিদিকে ঢেকে আছে গাছপালা। ইয়ামিন শ্রদ্ধার সাথে মোনাজাত করলেন কবর খানার বাহিরে দাঁড়িয়ে দু হাত তুললো, মহুয়া আর তার মেয়ে মেহুল। ইয়ামিনের চোখে পানি। তার দাদাজানের জন্য আজ মহুয়া তার স্ত্রী। সব অবদানই তার। সেদিন মহুয়ার ঠিকানা দাদাজান দিয়েছিলেন। শুধু তাই না তাকে চমকে দিয়ে মহুয়ার সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। সেদিন সময় মতো না গেরে মহুয়ার মরা মুখ তাকে দেখতে হতো। এই জন্যই বার বার দাদাজানের কাছে কৃতজ্ঞতা জানায় সে।কবর খানা থেকে আসার পথে তাদের ছোট মেয়ে কবুতর দেখে আবদার করে বসে। তাদের ভালবাস প্রতীক এই পায়রা যুগলদের কিনে নিলো তারা। নিজেদের ঘরের বেলকনিতে সাজিয়ে দিলো তাদের ছোট্র সংসার। তাদের কাজ গ্রিলের উপর বসে প্রেম করে তারা। ঠিক ইয়ামিন আর মহুয়ার মতো যুগলবন্দী পায়রা 🕊️ তারা।
সমাপ্ত
খুব ভালো লাগলো গল্পটা, খুব সুন্দর করে সাজিয়ে লেখা হয়েছে। ধন্যবাদ, এতো সুন্দর করে একটা গল্প দেয়ার জন্য।